শূন্যের নিচে সুদের হার
জানুয়ারির শুরুর দিকে লিখেছিলাম, ২০১৬ সালের অর্থনৈতিক অবস্থা ২০১৫
সালের মতোই দুর্বল হবে, যেটা ছিল ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর সবচেয়ে খারাপ
বছর। আর গত এক দশকে যা হয়েছে এবারও তা-ই হচ্ছে, বছরের প্রথম কয়েক মাসের
মধ্যে আশাবাদী পূর্বাভাসগুলো উল্টে গেছে। এর অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে,
বৈশ্বিক সম্মিলিত চাহিদার পরিমাণ কমে গেছে, যার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি
পীড়িত হয়েছে। এখন এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক
(ইসিবি) ব্যাংক অব জাপানসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে
প্রণোদনার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, ‘জিরো লোয়ার বাউন্ড’
(সুদের হারের নেতিবাচক হওয়ার অক্ষমতা) ব্যাপারটা স্রেফ প্রথাগত
অর্থনীতিবিদদের চিন্তাতেই থাকে। আর যেসব দেশ এই অপ্রচলিত নেতিবাচক সুদের
হার প্রবর্তন করেছে, তাদের দেশে কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার বাড়েনি, এমনকি
সেখানে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানও হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফলাফল খুবই
অপ্রত্যাশিত হয়েছে: ঋণের সুদের হার বেড়েছে। এটা সবার কাছে পরিষ্কার হওয়া
উচিত যে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকটপূর্ব মডেল খুবই বাজেভাবে ভুল ছিল,
আনুষ্ঠানিক ও মানসিক মডেল দুটোই। কেউই সংকট সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে
পারেনি, আর খুব কম দেশই পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানের কাছাকাছি যেতে পেরেছিল।
ইসিবি যে ২০১১ সালে দুবার সুদের হার বাড়িয়েছিল, সেই ঘটনা তো বিখ্যাত হয়ে
আছে, ঠিক যখন ইউরো সংকট তীব্রতর হচ্ছিল, আর বেকারত্বের হার দুই অঙ্কের ঘরে
উঠে যাচ্ছিল, তখন তারা এ কাজ করেছে। ফলে মূল্যহ্রাস হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
তাঁরা সেই পুরোনো আস্থাহীন মডেলই ব্যবহার করছিলেন, সম্ভবত কিছুটা বদলে
নিয়ে। এসব মডেলে সুদের হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যেখানে তা
বাড়ানো-কমানো হলে অর্থনীতির ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা যায়। যদি সুদের হার
শূন্যের ওপরে রাখলেও কাজ না হয়, তাহলে তা শূন্যের নিচে নামিয়ে আনলে কেল্লা
ফতে হবে। সেটা হয়নি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত সুদের হার
(মূল্যস্ফীতি-সমন্বিত) শূন্যের নিচে, কোথাও কোথাও মাইনাস ২ শতাংশ। আর
প্রকৃত সুদের হার কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের হারও কমে গেছে।
ওইসিডি (অর্গানাইজেশন অব ইেকানমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)–এর
হিসেবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কিছু
ক্ষেত্রে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার কমে গেছে (যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালে
এর পরিমাণ ছিল জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, আর ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬
দশমিক ৮ শতাংশ)। অন্যান্য তথ্য থেকেও একই চিত্র পাওয়া যায়। এ কথা হলফ করেই
বলা যায়, বড় করপোরেশনগুলো সুদের হার হিসাব করে বিনিয়োগ করে—এমন চিন্তার
ভিত্তি নেই। মানে সুদের হার আরও একটু কমানো হলেই তারা বড় বড় প্রকল্পে
বিনিয়োগ করবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব করপোরেশনের হাতে
বিপুল অঙ্কের টাকা আছে, উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে তার পরিমাণ হবে ট্রিলিয়ন
ট্রিলিয়ন ডলার। তবে যে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো (এসএমই) ঋণ নিতে চায়,
ইসিবি সুদের হার শূন্যের নিচে নামিয়ে আনার আগে তারা সেটা নিতে পারছে না।
কিন্তু ইসিবি এখন তা করতে পারবে না। সহজ কথায় বললে, এসএমইসহ অধিকাংশ
প্রতিষ্ঠান সহজেই ট্রেজারি (টি) বিলের সুদের হারে ঋণ নিতে পারে না। তারা
পুঁজিবাজার থেকে ধার করে না। তারা ঋণ নেয় ব্যাংক থেকে। আর টি-বিলের হার ও
ব্যাংক সুদের হারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তা ছাড়া, ব্যাংক তো কিছু
প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে অনাগ্রহী হতে পারে। অন্য ক্ষেত্রে তারা তো জামানত
দাবি করে (কখনো জমি)। যাঁরা অর্থনীতিবিদ নন, তাঁরা এটা শুনে ধাক্কা খেতে
পারেন যে গত কয়েক দশকে অর্থনীতিবিদেরা যে অর্থনৈতিক মডেল ব্যবহার করছেন,
সেখানে ব্যাংকের ভূমিকা নেই। এ কথা অবশ্যই বলা যায়, যদি ব্যাংক না থাকে
তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও থাকবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের এসব মডেলে
যে আস্থা রয়েছে, এই তুলনা তাতে তেমন একটা চিড় ধরাতে পারেনি।
সত্য হচ্ছে, ইউরোজোনের কাঠামো ও ইসিবির নীতির কারণে এটা নিশ্চিত হয়েছে, যেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, তাদের দেশের ব্যাংক খুবই দুর্বল, বিশেষ করে সংকটপূর্ণ দেশগুলোর। এর ফলে মানুষ আমানত উঠিয়ে নিয়েছে। আর জার্মানি যে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অনুসরণ করছে, তাতে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে এবং বেকারত্বের উচ্চ হার বজায় থাকছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আর ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ইচ্ছা ও সামর্থ্য কোনোটাই থাকে না, বিশেষ করে এসএমই প্রতিষ্ঠানকে (যারা সর্বাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে)।
সরকারি বন্ডের প্রকৃত সুদের হার কমে মাইনাস ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামলে তেমন কিছু হবে না, পরিবর্তন হলেও তার মাত্রা হবে খুব কম। সুদের হার শূন্যের নিচে নামলে ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে তার প্রভাব পড়ে। ফলে নীতিপ্রণেতারা সতর্ক না হলে ঋণের সুদের হার বাড়লেও তার প্রাপ্যতা কমতে পারে।
আরও তিনটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, সুদের হার কম থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিঘন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারে, এতে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিকের চাহিদা পড়ে যেতে পারে। এমনকি বেকারত্বের পরিস্থিতি স্বল্প মেয়াদে আরও খারাপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে বুড়ো মানুষেরা সুদের ওপর নির্ভর করেন, তাঁরা আরও আক্রান্ত হবেন। পরিণামে তাঁরা নিজেদের ভোগ আরও কমিয়ে দিতে পারেন, যেখানে ইক্যুইটির মালিকেরা নিজেদের ভোগ বাড়িয়ে দিতে পারেন, ফলে সামগ্রিক চাহিদা পড়ে যায়। তৃতীয়ত, ব্যাপারটা অযৌক্তিক হলেও বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে নিজেদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে পারেন, ফলে অর্থনীতি গুরুতর আর্থিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যা করা উচিত তা হলো ঋণের প্রবাহের ওপর নজর রাখা, অর্থাৎ স্থানীয় ব্যাংকগুলোর এসএমইতে ঋণ দেওয়ার ইচ্ছা ও সক্ষমতা বাড়ানো। তা না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা পৃথিবীতেই বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই মনোযোগী, যাদের বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণ ও অপব্যাংকিংয়ের কারণে ২০০৮ সালে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ছোট ছোট ব্যাংক সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি কেউ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়।
এসব থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা এই পরিচিত প্রবচনের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়: ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ভুল মডেল ব্যবহার করেই যায়, তাহলে তারা ভুল কাজটা করেই যাবে। অবশ্যই এটা ঠিক যে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও মুদ্রানীতি দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির দেশে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহজ নয়। মুদ্রানীতির এ সুযোগ সীমিত। কিন্তু ভুল মডেলের ওপর নির্ভর করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ করার সুযোগ কমে যায়, এমনকি এতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
সত্য হচ্ছে, ইউরোজোনের কাঠামো ও ইসিবির নীতির কারণে এটা নিশ্চিত হয়েছে, যেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, তাদের দেশের ব্যাংক খুবই দুর্বল, বিশেষ করে সংকটপূর্ণ দেশগুলোর। এর ফলে মানুষ আমানত উঠিয়ে নিয়েছে। আর জার্মানি যে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অনুসরণ করছে, তাতে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে এবং বেকারত্বের উচ্চ হার বজায় থাকছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আর ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ইচ্ছা ও সামর্থ্য কোনোটাই থাকে না, বিশেষ করে এসএমই প্রতিষ্ঠানকে (যারা সর্বাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে)।
সরকারি বন্ডের প্রকৃত সুদের হার কমে মাইনাস ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামলে তেমন কিছু হবে না, পরিবর্তন হলেও তার মাত্রা হবে খুব কম। সুদের হার শূন্যের নিচে নামলে ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে তার প্রভাব পড়ে। ফলে নীতিপ্রণেতারা সতর্ক না হলে ঋণের সুদের হার বাড়লেও তার প্রাপ্যতা কমতে পারে।
আরও তিনটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, সুদের হার কম থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিঘন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারে, এতে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিকের চাহিদা পড়ে যেতে পারে। এমনকি বেকারত্বের পরিস্থিতি স্বল্প মেয়াদে আরও খারাপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে বুড়ো মানুষেরা সুদের ওপর নির্ভর করেন, তাঁরা আরও আক্রান্ত হবেন। পরিণামে তাঁরা নিজেদের ভোগ আরও কমিয়ে দিতে পারেন, যেখানে ইক্যুইটির মালিকেরা নিজেদের ভোগ বাড়িয়ে দিতে পারেন, ফলে সামগ্রিক চাহিদা পড়ে যায়। তৃতীয়ত, ব্যাপারটা অযৌক্তিক হলেও বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে নিজেদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে পারেন, ফলে অর্থনীতি গুরুতর আর্থিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যা করা উচিত তা হলো ঋণের প্রবাহের ওপর নজর রাখা, অর্থাৎ স্থানীয় ব্যাংকগুলোর এসএমইতে ঋণ দেওয়ার ইচ্ছা ও সক্ষমতা বাড়ানো। তা না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা পৃথিবীতেই বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই মনোযোগী, যাদের বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণ ও অপব্যাংকিংয়ের কারণে ২০০৮ সালে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ছোট ছোট ব্যাংক সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি কেউ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়।
এসব থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা এই পরিচিত প্রবচনের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়: ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ভুল মডেল ব্যবহার করেই যায়, তাহলে তারা ভুল কাজটা করেই যাবে। অবশ্যই এটা ঠিক যে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও মুদ্রানীতি দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির দেশে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহজ নয়। মুদ্রানীতির এ সুযোগ সীমিত। কিন্তু ভুল মডেলের ওপর নির্ভর করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ করার সুযোগ কমে যায়, এমনকি এতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
No comments