লা-জবাব by তালহা বিন নজরুল

বাঘে সিংহে নয়, এ যেন বাঘ-মুষিকের লড়াই। কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি বিশ্বের অন্যতম সেরা দলটি। প্রথমে বলে, পরে ব্যাটকে চাবুক বানিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বাংলাদেশ এখন অদম্য-অপ্রতিরোধ্য। বোলারদের গড়া ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে সৌম্য-তামিম সহজ এক জয় উপহার দেন দেশবাসিকে। ৯ উইকেটের এ জয় যেন জাতিকে ক্রিকেটারদের ঈদ-উপহার। টসে জিতে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকার ৪০ ওভারে করা ১৬৯ রানের জবাবে ২৬.১ ওভারেই দেয় বাংলাদেশ মাত্র এক উইকেট হারিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের অক্ষত এক উইকেট যেন হারায় বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে জয়ের পর তিন ম্যাচের সিরিজ খুব কমই হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। না, স্বপ্ন নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও সিরিজ জয়। পাকিস্তান ও ভারতের পর দক্ষিণ আফ্রিকাও কাবু। বিশ্বকাপ থেকে নতুন বাংলাদেশ দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব। এ বছর টানা তিন সিরিজে তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তারও আগে গত বছর হারায় জিম্বাবুয়েকে। বাংলাদেশ দল টানা চারটি সিরিজ জয় দেখেছিল এর আগে ২০০৯-১০ মওসুমে। ওই চার সিরিজ ছিল ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এবার চারটি ভিন্ন দলের বিপক্ষে টানা সিরিজ জিতলো তারা। ওপেনিংয়ে ১৫৪ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে প্রোটিয়াদের নতুন করে জাত চেনালো টাইগাররা। টি-২০ সিরিজ জয়ের পর প্রথম ওয়ানডেতে হেরে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। এরপর বোর্ড সভাপতির উদ্দীপনায় বদলে গেল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই ঘুরে দাঁড়ালো টাইগাররা, শুইয়ে দিল আফ্রিকান লায়নদের। সিরিজে সমতা ফেরানোর পর অপেক্ষা ছিল সিরিজ জয়ের। সংশয় ছিল সমর্থকদের। কিন্তু আরও দুর্দান্তভাবে জয় ছিনিয়ে আনলো বাংলাদেশ। সিরিজ জিতলো ২-১এ। প্রথমটিতে ৮ উইকেটে হারের পর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ জিতেছিল ৭ উইকেটে। যাদের বিরুদ্ধে ২০০৭ এর পর কোন জয় ছিল না তাদের পর পর দুই খেলায় হারিয়ে অস্ট্রেলিয়াকেও ছুঁয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। গত বছরের নভেম্বর থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ১৫টি ওয়ানডে। গতকালের জয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাটাও দাঁড়ালো ১৫তে। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে ১৬ ম্যাচে বাংলাদেশের এটি দশম জয়।
তামিম ইকবাল আর সৌম্য সরকার যখন নামেন তখন কেউ ভাবেনি এত সহজেই তারা দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আগের ওপেনিং জুটির রেকর্ড ছিল ৫০এর নিচে (৪৫)। এবার তা তিন গুণের বেশি হলো। তবে আর ১৬টি রান হলে তারা ছুঁতে পারতেন মেহরাব-শাহরিয়ারের রেকর্ড যা ১৬ বছর ধরে অক্ষত রয়েছে। সৌম্যের মারের সামনে সংযমী হয়ে খেলতে থাকেন মারমুখী স্বভাবের তামিম। সৌম্য যেখানে ৪১ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেন সেখানে তামিম ৫০ করেন ৭০ বলে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম খেলায় ৬০ রান করার পর তামিমের চার ইনিংস ছিল ১৩, ৫,০,৫। এবার ঘরে মাঠে অপরাজিত থাকলেন ৬১ রানে। খেলেন ৭৭ বল, হাঁকান ৭টি চার। তার আগে শতরানের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে আউট হয়ে যান সৌম্য সরকার। ৯০ রান করে ইমরান তাহিরের বলে হাশিম আমলার হাতে ধরা পড়েন তিনি। তবে আগের খেলায় ৮৮ রান করা সৌম্যের ম্যাচসেরা হওয়া আটকে যায়নি। সিরিজসেরাও হয়েছেন তিনি। ৭৫ বলে ৯০ রান করার পথে ১৩টি চারের পাশাপাশি ছক্কাও হাঁকান একটি। তামিম-সৌম্যের ১৫৪ রানের জুটি যে কোন উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেরা আর সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অষ্টম সেরা জুটি। ১৭৮ নিয়ে সবার ওপরে আছে তামিম-মুশফিক জুটি। এ বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় উইকেটে তারা ওই জুটি গড়েন।
তামিম এই ফিফটি দিয়ে দেশর হয়ে সবচেয়ে বেশি ৩৭টি (৬টি সেঞ্চুরি) ফিফটিপ্লাস ইনিংসের মালিক হলেন। সাকিবের রয়েছে ৩৬টি। আর গতকালের ইনিংস দিয়ে সৌম্য এখন ওয়ানডেতে বাংরাদেশের সবচেয়ে বেশি গড়ের অধিকারী। তার গড় এখন ৪৯.৪২। ১৬ ম্যাচে সংগ্রহ ৬৯২ , সর্বোচ্চ ১২৭, ফিফটি চার।
এর আগে প্রোটিয়াদের স্পিন ভেলকি ও পেস ধামাকায় আটকে রাখে টাইগাররা। ফলে প্রবল লড়াইয়ের পুঁজিই পায়নি তারা। দলীয় ৫০ রানেই চার উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে প্রোটিয়া শিবিরে স্বস্তি ফেরে বৃষ্টিতে। ইনিংসের  ২৩তম ওভারে বৃষ্টির কারণে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। এসময় দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ৭৮/৪। দর্শকদের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় রেখে খেলা ফের মাঠে গড়ায় তিন ঘন্টা পর। তবে কমে যায় ম্যাচের পরিসর। সীমিত করা হয় ৪০ ওভারে। তবে টাইগার বোলাররা দম ফেলতে দেয়নি প্রোটিয়াদের। ৪০ ওভারে ১৬৮/৯ নিয়ে থামে সফরকারীদের ইনিংস। দলীয় মাত্র ৮ রানে উইকেট খোয়ান প্রোটিয়া ওপেনার কুইন্টন ডি কক। হন্তারক মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের ১৯ বছরের এ পেসারের কোনাকুনি ফুলার ডেলিভারি স্টাম্প উপড়ে নেয় ডি ককের। এতে ২০১৫ সালে ওয়ানডেতে ডি ককের রানের গড় ১৭.৫। আগের দুই বছর তার রানের গড় ছিল ৪০ ছাড়িয়ে। দলীয় ১৯ রানে ফাফ ডু প্লেসির উইকেট তুলে নেন সাকিব আল হাসান। সিরিজে তৃতীয় ম্যাচে এসে উইকেটের দেখা পেলেন বাংলাদেশের এ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। সাকিবের বলে ব্যক্তিগত ১১ রানে জীবন পান আমলা। তবে ১৫ রানে তিনি কাটা পড়েন সাকিব আল হাসানের স্পিনেই। এতে ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০০ উইকেট পূর্ণ হয় সাকিবের। ৪৫ বছরের ওয়ানডে  ইতিহাসে ব্যাটে বলে ৪০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ‘ডবল’ কৃতিত্ব দেখানো মাত্র সপ্তম ক্রিকেটার তিনি। বোলিং পরিবর্তনে এদিনও ম্যাজিক দেখান বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান রাইলি রুসোকে সাজঘরে পাঠান নিজের প্রথম ওভারেই। বৃষ্টি শেষে খেলায় ফিরে ব্যাট হাতে ইনিংস গোছাতে মনোযোগী হন ডেভিড মিলার ও জেপি ডুমিনি। কিন্তু প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের ওপর বাংলাদেশী পেস-স্পিনের সাঁড়াশি আক্রমণ অব্যাহত থাকে ইনিংসের শেষ পর্যন্ত। ব্যাট হাতে বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন ডেভিড মিলার। তবে ‘কিলার মিলার‘ খ্যাত এ প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানকে সাজঘরের পথ দেখান বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফির ডেলিভারিতে পয়েন্টে দারুণ ক্যাচ নেন সাব্বির রহমান। এতে গর্বের রেকর্ডে ওঠেন মাশরাফি মুর্তজাও। ১৫৭ ম্যাচে এটি মাশরাফির ২০০তম উইকেট। সাকিব আল হাসানের বলে ইনিংসের শুরুতে হাশিম আমলার ক্যাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন সাব্বির রহমান। তবে পরে দারুণ নৈপুণ্যে সাকিবকে তার প্রাপ্য ফেরত দেন সাব্বির। সাকিবের বলে তিনি বাউন্ডারি দড়ির কাছে দারুণ ক্যাচ লুফে নিয়ে সাজঘরে ফেরত পাঠান প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান ফারহান বেহারদিনকে। কাগিসো রাবাদাকে বোল্ড আউট করেন মুস্তাফিজ। আর শেষ ওভারে জোড়া আঘাত হানেন পেস তারকা রুবেল হোসেন। নিজের বিশেষ দিনে ব্যাট হাতে ১ রানে অপরাজিত থাকে প্রোটিয়া পেস তারকা মরনে মরকেল। এটি ছিল ক্যারিয়ারে মরনে মরকেলের ১০০তম ওয়ানডে।

No comments

Powered by Blogger.