মন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে রাজনের মা আমার বুকের ধনকে ফিরিয়ে দিন

‘টানা চার ঘণ্টা শিশু রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে কামরুল ও শামীম। ভোর থেকেই তারা রাজনের দেহে একের পর এক আঘাত করতে তাকে। আর এ খবরটি আমার কানে পৌঁছামাত্র লাশ গুমের চেষ্টা চালাই।’ রিমান্ডে দ্বিতীয় দিনে এসব তথ্য দিয়েছে সিলেটের শিশু রাজন খুনের মামলার প্রধান আসামি শেখপাড়া গ্রামের মুহিত আলম। গতকাল এ মামলার তদন্তে থাকা মনিটরিং টিমের সদস্য ওসি আক্তার হোসেন মানবজমিনকে জানিয়েছে, ‘মুখ খুলছে মুহিত। প্রথম দিনই কামরুলের কথা স্বীকার করেছিল। বুধবার বললো শামীমের কথা। ধীরে ধীরে সব কথা বলবে সে।’ তিনি বলেন, ‘আর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আজমতসহ দুজন মঙ্গলবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এতেও উঠে উঠেছে রাজন হত্যার মিশনে অংশ নেয় ৫ জন।’ মুহিত হচ্ছে কামরুল ও শামীমের ভাই। আর মামলার অপর আসামি আলীও হচ্ছে মুহিতের আপন ভাই। চার ভাই-ই রাজনকে খুন, লাশ গুম করার প্রক্রিয়া চালিয়েছিল। মুহিত যখন ঘটনাস্থলে আসে তখন দেখে শিশু রাজন পানি পানি করতে করতে কাতর হয়ে গেছে। নড়াচড়া নেই শরীরে। একটু পর মারা গেলে সেই রাজনের লাশ গুম করার চেষ্টা চালাই। মামলা, জেল থেকে রক্ষা পেতে এমনটি করে বলে গতকাল পুলিশকে জানিয়েছে মুহিত। অন্যদিকে রিমান্ডে থাকা আবলু গতকাল পর্যন্ত মুখ খুলেনি। জালালাবাদ থানা পুলিশ জানিয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে, সে কিছই দাবি করেনি। এদিকে, মঙ্গলবার রাতে টুকের বাজার থেকে গ্রেপ্তার করা পাহারাদার ময়না মিয়াকে গতকাল ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে গেছে পুলিশ। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি রহমতুল্লাহ মানবজমিনকে জানিয়েছে, ময়নাকে আটকের পর সিলেটের কোতোয়ালি থানা হাজতে রেখে তাকে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ময়না পুরো ঘটনা এড়িয়ে যায়। এ কারণে পুলিশ দুপুরে তাকে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাহেদুল করিমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালত এ সময় আলোচিত এ মামলাটির সটিক তদন্তের জন্য ডিবিতে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। এডিসি রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ মতো মামলাটি ডিবি পুলিশে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। পোস্টারিংয়ে ছেয়ে গেছে সিলেট নগর। রাজনের খুনিদের ফাঁসি চেয়ে যে পোস্টার নগরীতে সাঁটানো হয়েছে সেটি নজর কেড়েছে সিলেটবাসীর। আর পোস্টারে ঘাতকের তালিকায় আছে দুলালের ছবি। মামলার এজাহারে না থাকলেও গতকাল টুকের বাজারের জনতা দুলালকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে স্থানীয় শেখপাড়া গ্রামে দুলাল আত্মগোপনে ছিল বলে জানিয়েছেন ওসি আক্তার হোসেন।
রাজনের বাড়িতে প্রতিমন্ত্রী চুমকি: প্রতিদিনই দলে দলে লোকজন যাচ্ছেন ঘাতকদের নির্মম নির্যাতনে খুন হওয়া সামিউল আলম রাজনদের বাদেআলী গ্রামের বাড়ি। এই গ্রামটি সুরমা নদীর তীর ঘেষে অবস্থিত। এই গ্রামে গতকাল ছুটে গেলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি বিমানের ফ্লাইটে সিলেটে আসেন। এরপর সার্কিট হাউসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে ছুটে যান রাজনের গ্রামের বাড়ি। তার আগেই সেখানে পৌঁছেন সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদসহ নেতাকর্মীরা। বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো এমপি কেয়া বসে আছেন রাজনের মায়ের পাশে। মা লুবনা বেগম আহাজারি করছেন রাজনের জন্য। বলছেন ছেলেটা এত ভদ্র ছিল যে মৃত্যুর সময়ও ঘাতকদের ‘আপনে’ বলে সম্বোধন করেছে। মাটির কুটিরে ছোট দুটি রুমে রাজনদের সংসার। এক রুমে মা লুবনা ও অপর রুমে বসে আছেন পিতা আজিজুর রহমান। চলতে ফিরতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে কাটছে তাদের দিন। বেলা দুই টার দিকে রাজনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। সঙ্গে সিলেটের পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান, সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদীন ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। গাড়ি থেকে নেমে মন্ত্রী সোজা চলে যান রাজনের মায়ের ঘরে। এ সময় রাজনের মা লুবনা বেগম প্রতিমন্ত্রীকে জাপটে ধরে কান্না শুরু করেন। বলেন, ‘আমার বুকের ধন কই। আমি আর কিছুই চাই না। টাকা, পয়সা, ধন, ধৌলত সব নিয়ে যান। আমার বুকের ধনকে ফিরিয়ে দিন।’ এ সময় তার আর্তনাদে কেঁদে উঠেন সবাই। প্রতিমন্ত্রী চুমকি মুখ মুছেন। পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেন লুবনা বেগমকে। এ সময় মন্ত্রী রাজনের মাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় বসেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষা নেই। আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেখতে এসেছি। আল্লাহ আপনাকে সান্ত্বনা দেবেন। কষ্ট একটাই-আমরা রাজনকে বাঁচাতে পারলাম না। এ সময় প্রতিমন্ত্রীকে দেখে কান্না ভেঙে পড়েন রাজনের পিতা আজিজুর রহমান। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার বাচ্চাকে যে ধুঁকে ধুঁকে মারছে আপনারার দেশবাসী। সেটি আমি ভুলতে পারছি না। বলেনই কান্না শুরু করলেন তিনি। সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরী এ সময় বললেন, ‘আমি ২৮ মিনিটের পুরো ফুটেজটি দেখতে পারিনি। আমাকেও অনেকেই বলেছেন তারাও ফুটেজটি দেখতে পারিনি।’ প্রতিমন্ত্রী চুমকি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজন খুনের ঘটনায় শোকাহত। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির উঠানে স্থাপিত মঞ্চে ভাষন দেন প্রতিমন্ত্রী চুমকি। তিনি বলেন, রাজন হত্যার বিচার শেষ করতে প্রয়োজনে বিশেষ ট্র্যাইবুনাল গঠন করা হবে। তিনি বলেন, সরকার আন্তরিক রয়েছে। যখন যেখানে যা করা প্রয়োজন তখন সেখানেই তা করবে। কোনভাবেই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা হবে না। তিনি বলেন, আর এই ঘটনায় প্রশাসনের কারও কর্তব্যে অবহেলা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আরও নেয়া হবে বলে জানান তিনি। এ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে চেক প্রদান:  প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সফরকালে রাজনের মা লুবনার হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুদানের এক লাখ টাকার চেক প্রদান করেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজন খুনের বিচারে খুবই আন্তরিক। আমরা পাশে আছি। যখন যা দরকার আমরা দেখবো। এ সময় তিনি বলেন, রাজনের ভাই সাজনের জন্য প্রতি মাসে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। সিলেটের জেলা প্রশাসক সেটি করবেন বলে জানান তিনি।
রাজনের পিতার প্রশ্ন: প্রতিমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে রাজনের পিতা আজিজুর রহমান বলেন, আমি থানায় এজাহার নিয়ে গেলে পুলিশ আমাকে ধমকায়। বলে, মামলা হয়ে গেছে। ছেলে মারা গেছে আমার। আর পুলিশ করলো মামলা। তার কারণ কী। তিনি বলেন, দালালদের নিয়ে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করা কেন হলো? সে বিষয়ে তিনি জানতে চান। কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, ‘ম্যাডাম রাজনের কী বাচার অধিকার ছিল না।’ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক: বিকাল মহিলা ও শিশু শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সিলেটের জেলা প্রশাসনে সম্মেলন কক্ষে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি রাজনের খুনিদের গ্রেপ্তার, মামলার তদন্ত, বিচারে যাতে কোন গাফিলতি না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। এসময় প্রতিমন্ত্রী পুলিশ প্রশাসনের উপর কিছুটা ক্ষোভ ঝাড়েন। বৈঠকের সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদীন ছাড়া আওয়ামী লীগসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।

No comments

Powered by Blogger.