দশ শর্তে বন্দি দুদকের দুর্নীতির অনুসন্ধান by তাসকিনা ইয়াসমিন

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বয়স প্রায় একযুগ হলেও নানা কারণে প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধান কার্যক্রম ১০ শর্তে বন্দি হয়ে আছে। সময়ের ব্যবধানে দুর্নীতির ধরন পাল্টালেও পুরনো আইনের কারণে নতুন ধরনের দুর্নীতি অনুসন্ধানে ভূমিকা রাখতে পারছে না দুদক। ফলে, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য দুদকের কাছে গিয়ে হোঁচট খেয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে।
এদিকে, গত এপ্রিল মাসে দুদকে আসা অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য নিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে জনগণের মধ্যে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি কাটাতে দুদক ডাটা তৈরি করে তাদের কাছে আসা অভিযোগ কেন গ্রহণ করা হলো না তা জনগণের কাছে প্রকাশ করতে পারে।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর আলোকে দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়। বর্তমানে দুদক দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭-এর আলোকে দুদকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
দুদকের কাজের সুবিধার জন্য দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ১০টি শর্ত বেছে নিয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে  অর্থ ও মুদ্রা পাচার, ভূমি, ভূমি রাজস্ব ও ইজারা, ঘুষ (অর্থ, সম্পদ ও সেবা), অবৈধ উপায়ে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ অর্জন, নির্মাণ কাজ ও যোগাযোগ খাতে দুর্নীতি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ও বেসরকারি সংস্থাগুলোতে দুর্নীতি, শুল্ক ও কর, রাজস্ব, ব্যবসায়ী/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, লাইসেন্স ইস্যু করা, অঙ্গীকারের শপথ ভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুদক আইন ২০০৪-এর তফসিলে উল্লিখিত অপরাধগুলোসহ অন্যান্য। দুদক শুধু এই ১০টি শর্তের অধীনে থাকা অনুসন্ধানগুলোই করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে, দুদকে আসা অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দশটি দিক বিবেচনায় নেয় দুদকের যাচাই-বাছাই শাখা। সেগুলো হচ্ছে অভিযোগটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ কি-না, কাকে সম্বোধন করে অভিযোগটি পাঠানো হয়েছে, অভিযোগকারীর পরিচয়, নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর যথার্থ কি-না, প্রাপ্ত অভিযোগটি সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ কি-না, পক্ষ-বিপক্ষ কর্তৃক (শত্রুতাবশত) অযথা হয়রানির উদ্দেশ্যেই অভিযোগটি দেয়া হয়েছে কি-না, অভিযুক্ত ব্যক্তির দফতর, তার দাফতরিক পদ মর্যাদা, বর্ণিত অপরাধ করার ক্ষমতা ও সুযোগ আছে কি-না ইত্যাদি, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়-কাল, অভিযোগের দরখাস্তে বর্ণিত অপরাধের ব্যক্তি ও অর্থ-সঙ্গতির পরিমাণ, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার স্থান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সম্বলিত জেলা কার্যালয় কর্তৃক অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত করা হতে পারে, প্রাপ্ত অভিযোগটি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ ও দুর্নীতি দমন বিধিমালা-২০০৭ মোতাবেক কার্য সম্পাদন শেষে কোর্টে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে কি-না, প্রমাণে কি পরিমাণ অর্থ, শ্রম, মেধা, সময় এবং উপকরণ প্রয়োজন হবে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ গ্রহণ করে।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে দুদকে অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ জমা হয় ১২ হাজার ৫শ’টি। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই কমিটির বাছাইয়ে বাতিল হয় ১০ হাজার ৫৭৪টি। আর অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় ১৬৮৯টি, ২৩৭টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে কমিশন আগের বছরের শেষ না হওয়া অনুসন্ধানসহ মোট ৭ হাজার ৭৭৫টি অনুসন্ধান শুরু করে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৭৫টি নিষ্পত্তি করেছে। যার মধ্যে ৩৩৩টি মামলা দায়ের করেছে। অন্যদিকে, গত এপ্রিল মাসে দুদকের প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা ৬১৭টি। যাচাই-বাছাই করে কমিশন অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে ৪৯টি। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগে পাঠিয়েছে ১২টি। কমিশনের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় বা সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায়  ৫৫৬টি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্নীতি সংক্রান্ত বিবেচ্য প্রতিবেদন সংখ্যা ৭টি এবং যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের জন্য নেয়া প্রতিবেদনের সংখ্যা ১টি। জানুয়ারি-এপ্রিল মাসে প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা ২ হাজার ৭৯৮টি। কমিশন মামলা নিয়েছে ২৩২টি, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরিত ৬৯টি, তফসিলভুক্ত না হওয়ায় বাতিল ২৪৯৭টি, বিভিন্ন পত্রিকা থেকে নেয়া অভিযোগের সংখ্যা ৪১টি এবং যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত অভিযোগের সংখ্যা ১২টি।
দুদক সূত্র জানায়, দেশের মানুষের দুদকের কাছে প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু দুদকের জনবল কম হওয়ায় সংস্থাটির পক্ষে তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে দুদকের কাজের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছ হলে তা দুদকের জন্য ভালো এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, দুদকে যে অভিযোগগুলো আসে তার বেশির ভাগই বাদ পড়ে। তবে এটা সত্যি দুদকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। যে অভিযোগগুলো সরাসরি দুর্নীতি সম্পর্কিত, সেগুলো হয়ত দুদকের তফসিল বহির্ভূত হতে পারে। দুদকের শিডিউল অনুযায়ী অভিযোগটি পড়ছে কিনা সেটা দুদক যাচাই-বাছাই করে থাকে। দুদকের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে যথার্থতা, স্বচ্ছতা, বিশেষ কোন অভিযোগকে ছাড় দেয়ার প্রবণতা না থাকলে সেটাকে সুনির্দিষ্টভাবে বাছাই সঠিক হচ্ছে না বলা কঠিন। যদি এমন হয় দুদকে যে ৯৫ শতাংশ অভিযোগ বাছাই থেকে বাদ পড়ছে সেগুলো দুদকের সিডিউলের আওতাভুক্ত না হওয়ায় বাদ পড়েছে সেক্ষেত্রে দুদক ডাটাবেজ তৈরি করে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং সেগুলো কেন নেয়া সম্ভব হয়নি তার কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল তা প্রকাশ করে দুদক জনগণকে জানাতে পারে। এটা করা সম্ভব। আর এটা হলে কিসের ভিত্তিতে কেন দুদকের যাচাই-বাছাইয়ে এটি বাদ পড়ল তা জানা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.