দুর্ভোগ নতুন কিছু নয় by এম আবদুল হাফিজ
এমন
দুর্ভোগের কথা প্রতি ঈদেই শুনে আসছি। শুনে আসছি ঈদ আসার অনেক আগে থেকেই
সরকার ও প্রশাসনের গালভরা প্রতিশ্রুতি যে এবারের রমজান ও ঈদে কৃত্রিম
মূল্যবৃদ্ধি ও অতিরিক্ত মুনাফায় রোজা সংশ্লিষ্ট খাদ্যপণ্যের বিক্রি হতে
দেয়া হবে না। ভেজাল খাদ্যের বিক্রি কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তাছাড়াও ঈদ
ভ্রমণের নিষ্কণ্টক ব্যবস্থা থাকবে। প্রতিশ্রুতির ইত্যাকার ফুলঝুরির সঙ্গে
আমরা প্রতিবারই পরিচিত।
কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ও অভিজ্ঞতার আলোকে ওসব শুধু কথার কথা। বলতে হয় তাই বলা। কর্তা ব্যক্তিরা যারা এসব প্রতিশ্রুতির বিস্তার করেন তারাও জানেন যে তাদের ওইসব প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তবু সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে সম্ভবত তারা ওইসব কথা বলে থাকেন। মন্ত্রী, এমপি বা দলীয় হেভিওয়েট যারা প্রতিশ্রুতি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তাদের অনেকেই জনদুর্ভোগের স্বরূপটাই জানেন না। সাধারণ মানুষকে উৎসবে-পার্বণে কতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের সে অভিজ্ঞতাও নেই। এদের অনেকেই পুরো রামাদানেই ইফতার পার্টি নামক বিশেষ ভোজে আপ্যায়িত হয়ে থাকে না। সেই নির্ভেজাল ভোজের মাজেজা তাদের জানা থাকার কথা নয়।
তবে রামাদান বাজার বা সেখানে বিক্রীত পণ্যের মান ও মূল্য যে একেবারে মনিটরিং করা হয় না তা বলা যাবে না। আমাদের দেশে অন্তত দায়সারা লোক দেখানো একটা মনিটরিং প্রতিটি এমন উৎসবের মৌসুমে করা হয়ে থাকে। আখেরে তার ফলাফল শূন্য। তা নাহলে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা পোকাধরা গম যা অন্য কোনো দেশে হয়তো পশু খাদ্য হিসেবেও বিকাবে না তাকেও রীতিমতো মানব খাদ্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার সাহস হয় সংশ্লিষ্ট আমলাদের। এ দেশেই শুধু তা সম্ভব।
আমরা অত্যন্ত সচেতন জাতি হলেও কিছুটা হার মেনে বা কষ্ট স্বীকার করেও সব কিছুতে কুরুক্ষেত্র বাধাতে চাই না। ঘুষ-ঘাস দিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে কোনো ছ্যাকড়া বাসে আধমরা পরিবার নিয়ে ঈদের নামাজ রাস্তায়ই সেরে জীর্ণশীর্ণ বাস্তুভিটায় পৌঁছতে পারলেই আমাদের মুখের হাসি চওড়া হয়ে আসে। ভুলে যাই দীর্ঘ যাত্রাপথের ঝক্কি-ঝামেলার কথা। মনে করি যে বৌ-বাচ্চা নিয়ে নির্ঝামেলায় ঈদ করতে যাওয়া একটি বিশেষ শ্রেণীর একচেটিয়া। আমাদের এই-ই তো যথেষ্ট যে আমরা সমুদ্র জয় করেছি, স্থল সীমান্তের একটি সুরাহা করে ছিটমহল অদলবদল করার পদক্ষেপ নিয়েছি। উপরন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়েছি।
আমরা সামান্যই উপলব্ধি করি যত যা-ই করি না কেন দেশবাসীর মধ্যকার পারস্পরিক বৈষম্য দুস্তর পারাবার সম। আমাদের এই বৈষম্য ঘোচাতে না পারলে ঈদই হোক বা পূজাপার্বণ এক শ্রেণী চিরকালই দুর্ভোগ নতুন কিছু নয়ভেজালই খাবে। বোকার মতো অধিক মূল্যে খাদ্য সামগ্রী কিনবে, উৎসবে-পার্বণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ করবে। আমরা দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়েই এই বৈষম্য ঘোচাতে চেয়েছিলাম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এজেন্ডায় এক পর্যায়ে সমাজতন্ত্র যুক্ত হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলার চার মূলনীতির অন্যতম সমাজতন্ত্র ছিল অতঃপর কোথায় যেন কি হয়ে গেল। সমাজতান্ত্রিক জীবনের ধ্যান-ধারণাকে ওলটপালট করে দিয়ে কিছু মানুষ কল্পনাতীতভাবে ধনবান হতে থাকল। এরা মূলত ভণ্ড ব্যবসায়ী যারা সরকারি আনুকূল্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলল। তাদের সঙ্গে একই সরকারি আনুকূল্যে ঠিকাদারী, ইজারাদারী, সাপ্লায়ার্সের কাজ বাগিয়ে রাতারাতিই আনুকূল্য প্রাপ্তরা হাজার টাকার মালিক।
সমাজের তলানিতে যাদের স্থান সেই সুবিধা ও সুযোগ বঞ্চিতরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গেল। আমরা যত মধ্যম আয়ের দেশ হই না কেন, মাথাপিছু আয় যতই বৃদ্ধি পাক এবং উন্নয়নের মহাসড়কে সামনে এগোই অর্থনৈতিক ও তার ফলে সামাজিক বিভাজনটা থেকেই যাচ্ছে; বিভাজনের কোন পাশে আপনার অবস্থান তার ওপর নির্ভর করবে যে আপনার ঈদ উদযাপনটা কেমন হবে।
স্বাভাবিক নিয়মেই সব কিছুতেই অগ্রাধিকার থাকবে ক্ষমতাবান ও ধনবানদের জন্য। তাদের প্রয়োজন আকণ্ঠ মিটবার পর যে ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই বণ্টন হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর জন্য। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তবু কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা চিন্তা করেই কিছু সুবচন ছড়ান, আশার আলো জ্বালান। কিন্তু বাস্তবে ওটাই হবে যা অতীতেও হয়েছে।
অবাক হয়ে ভাবি এত অগ্রগতি সত্ত্বেও দেশে এহেন অব্যবস্থা থাকবে কেন, পর্যাপ্ত রেলবগি বা নিরাপদ জলযানেরই অপ্রতুলতা থাকবে কেন। বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগ নেই কেন, দেশেই কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান হয় না কেন? জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা মানব পাচারকারীদের প্ররোচনার শিকার হয় কেন?
প্রতিশ্রুতি, প্রলোভন বা প্ররোচনা কি তাহলে একটি ট্রাডিশন যা সমানে চলছে এবং তারই একটি অংশ ঈদ পার্বণে অন্তহীন জনদুর্ভোগ যা শুরু হয় একটি সাবলীল উৎসব উদযাপন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিয়ে। আর মাত্র দিন দশেক বাকি। এই দিনগুলোও কেটে যাবে। তারপর কে মনে রাখবে কোন অপ্রাপ্তির কথা? দুর্ভোগের দুঃসহ স্মৃতি অন্তরে পুষে রাখা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্যও এই ট্রাডিশন বহাল থাকবে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনাপ্রধান
কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ও অভিজ্ঞতার আলোকে ওসব শুধু কথার কথা। বলতে হয় তাই বলা। কর্তা ব্যক্তিরা যারা এসব প্রতিশ্রুতির বিস্তার করেন তারাও জানেন যে তাদের ওইসব প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তবু সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে সম্ভবত তারা ওইসব কথা বলে থাকেন। মন্ত্রী, এমপি বা দলীয় হেভিওয়েট যারা প্রতিশ্রুতি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তাদের অনেকেই জনদুর্ভোগের স্বরূপটাই জানেন না। সাধারণ মানুষকে উৎসবে-পার্বণে কতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের সে অভিজ্ঞতাও নেই। এদের অনেকেই পুরো রামাদানেই ইফতার পার্টি নামক বিশেষ ভোজে আপ্যায়িত হয়ে থাকে না। সেই নির্ভেজাল ভোজের মাজেজা তাদের জানা থাকার কথা নয়।
তবে রামাদান বাজার বা সেখানে বিক্রীত পণ্যের মান ও মূল্য যে একেবারে মনিটরিং করা হয় না তা বলা যাবে না। আমাদের দেশে অন্তত দায়সারা লোক দেখানো একটা মনিটরিং প্রতিটি এমন উৎসবের মৌসুমে করা হয়ে থাকে। আখেরে তার ফলাফল শূন্য। তা নাহলে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা পোকাধরা গম যা অন্য কোনো দেশে হয়তো পশু খাদ্য হিসেবেও বিকাবে না তাকেও রীতিমতো মানব খাদ্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার সাহস হয় সংশ্লিষ্ট আমলাদের। এ দেশেই শুধু তা সম্ভব।
আমরা অত্যন্ত সচেতন জাতি হলেও কিছুটা হার মেনে বা কষ্ট স্বীকার করেও সব কিছুতে কুরুক্ষেত্র বাধাতে চাই না। ঘুষ-ঘাস দিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে কোনো ছ্যাকড়া বাসে আধমরা পরিবার নিয়ে ঈদের নামাজ রাস্তায়ই সেরে জীর্ণশীর্ণ বাস্তুভিটায় পৌঁছতে পারলেই আমাদের মুখের হাসি চওড়া হয়ে আসে। ভুলে যাই দীর্ঘ যাত্রাপথের ঝক্কি-ঝামেলার কথা। মনে করি যে বৌ-বাচ্চা নিয়ে নির্ঝামেলায় ঈদ করতে যাওয়া একটি বিশেষ শ্রেণীর একচেটিয়া। আমাদের এই-ই তো যথেষ্ট যে আমরা সমুদ্র জয় করেছি, স্থল সীমান্তের একটি সুরাহা করে ছিটমহল অদলবদল করার পদক্ষেপ নিয়েছি। উপরন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়েছি।
আমরা সামান্যই উপলব্ধি করি যত যা-ই করি না কেন দেশবাসীর মধ্যকার পারস্পরিক বৈষম্য দুস্তর পারাবার সম। আমাদের এই বৈষম্য ঘোচাতে না পারলে ঈদই হোক বা পূজাপার্বণ এক শ্রেণী চিরকালই দুর্ভোগ নতুন কিছু নয়ভেজালই খাবে। বোকার মতো অধিক মূল্যে খাদ্য সামগ্রী কিনবে, উৎসবে-পার্বণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ করবে। আমরা দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়েই এই বৈষম্য ঘোচাতে চেয়েছিলাম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এজেন্ডায় এক পর্যায়ে সমাজতন্ত্র যুক্ত হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলার চার মূলনীতির অন্যতম সমাজতন্ত্র ছিল অতঃপর কোথায় যেন কি হয়ে গেল। সমাজতান্ত্রিক জীবনের ধ্যান-ধারণাকে ওলটপালট করে দিয়ে কিছু মানুষ কল্পনাতীতভাবে ধনবান হতে থাকল। এরা মূলত ভণ্ড ব্যবসায়ী যারা সরকারি আনুকূল্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলল। তাদের সঙ্গে একই সরকারি আনুকূল্যে ঠিকাদারী, ইজারাদারী, সাপ্লায়ার্সের কাজ বাগিয়ে রাতারাতিই আনুকূল্য প্রাপ্তরা হাজার টাকার মালিক।
সমাজের তলানিতে যাদের স্থান সেই সুবিধা ও সুযোগ বঞ্চিতরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গেল। আমরা যত মধ্যম আয়ের দেশ হই না কেন, মাথাপিছু আয় যতই বৃদ্ধি পাক এবং উন্নয়নের মহাসড়কে সামনে এগোই অর্থনৈতিক ও তার ফলে সামাজিক বিভাজনটা থেকেই যাচ্ছে; বিভাজনের কোন পাশে আপনার অবস্থান তার ওপর নির্ভর করবে যে আপনার ঈদ উদযাপনটা কেমন হবে।
স্বাভাবিক নিয়মেই সব কিছুতেই অগ্রাধিকার থাকবে ক্ষমতাবান ও ধনবানদের জন্য। তাদের প্রয়োজন আকণ্ঠ মিটবার পর যে ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই বণ্টন হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর জন্য। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তবু কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা চিন্তা করেই কিছু সুবচন ছড়ান, আশার আলো জ্বালান। কিন্তু বাস্তবে ওটাই হবে যা অতীতেও হয়েছে।
অবাক হয়ে ভাবি এত অগ্রগতি সত্ত্বেও দেশে এহেন অব্যবস্থা থাকবে কেন, পর্যাপ্ত রেলবগি বা নিরাপদ জলযানেরই অপ্রতুলতা থাকবে কেন। বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগ নেই কেন, দেশেই কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান হয় না কেন? জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা মানব পাচারকারীদের প্ররোচনার শিকার হয় কেন?
প্রতিশ্রুতি, প্রলোভন বা প্ররোচনা কি তাহলে একটি ট্রাডিশন যা সমানে চলছে এবং তারই একটি অংশ ঈদ পার্বণে অন্তহীন জনদুর্ভোগ যা শুরু হয় একটি সাবলীল উৎসব উদযাপন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিয়ে। আর মাত্র দিন দশেক বাকি। এই দিনগুলোও কেটে যাবে। তারপর কে মনে রাখবে কোন অপ্রাপ্তির কথা? দুর্ভোগের দুঃসহ স্মৃতি অন্তরে পুষে রাখা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্যও এই ট্রাডিশন বহাল থাকবে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনাপ্রধান
No comments