শ্রমিকদের সদাচার, শিষ্টাচার by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
জীবিকার তাগিদে প্রবাসী বাংলাদেশী |
মানবসম্পদ
আধুনিক অর্থনীতির শক্তিশালী নিয়ামক। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ
কিংবা বৈদেশিক সাহায্য সীমিত হয়ে গেলেও জনশক্তি হ্রাস পাবে না। শিক্ষিত
জনশক্তি দেশের সম্পদ, কিন্তু অশিক্ষিত জনশক্তি জাতির বোঝা, জিডিপিতে নেই
তাদের ভূমিকা। অশিক্ষা জনগোষ্ঠীর আচরণ ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে। শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণ না থাকায় সস্তা শ্রমে নিযুক্ত প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে
অনৈতিক কাজে জড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছেন। কুয়েত, বাহরাইন,
কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের হানাহানি, কলহ, জালিয়াতি ও
অনৈতিক কার্যক্রম দেশের পতাকাকে কলঙ্কিত করেছে।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে জালিয়াতি সৌদি প্রশাসনের জন্য বাড়তি উপদ্রব। মাথা হেঁট হয়ে যায়, যখন বিদেশে আমাদের ‘জালিয়াত’ বা ‘প্রতারক’ বিশেষণটি জুড়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বা কর্মক্ষমতার অনুষঙ্গে যুক্ত এখন শিক্ষা, আচরণ, মূল্যবোধ। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া শিক্ষার আলোয় জাতিকে প্রশিক্ষিত জনসম্পদে রূপান্তর করেছে। সুতরাং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির গুরুত্ব এখন সময়ের দাবি।
জ্বালানি শক্তি মানেই বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বের ২৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল-সম্পদের মালিক সৌদি আরব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটা ধ্রুব সত্য। সাত বছর পর (২০০৮ সালের নিষেধাজ্ঞার পর) বাংলাদেশ থেকে জনশক্তির দ্বার উন্মোচন করেছে সৌদি সরকার। জানুয়ারিতে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। নতুন বাদশাহ খুব অল্প সময়েই জনগণকে বহুমুখী সেবা ও সুবিধা বাড়ানোর নীতি অবলম্বন করছেন। ইতিমধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বোনাস, পেনশনভোগীদের সুবিধা ও অন্যান্য খাতে।
অবস্থা অনুকূল থাকলে সৌদি আরবে কয়েক লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। সৌদি শ্রমবাজারের এ সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য বিশাল ইতিবাচক অর্জন। এটি হবে বৃহৎ শ্রমবাজার। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার অচলায়তন ভাঙার জন্য সৌদি সরকারকে অশেষ অভিনন্দন। এখন সে দেশে ১৩ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। ২০১৪ সালে সৌদি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ডলার। দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে শ্রমিক রপ্তানিতে সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে বিশাল বাধার প্রাচীর অপসারিত হয়েছে। এখন অনেক কম খরচে শ্রমিকেরা সৌদি আরব যেতে পারবেন। সর্বোচ্চ ব্যয় হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, যা ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এ সুখবর যেন আবার কাল হয়ে না দাঁড়ায়। সৌদিতে আইনের শাসন খুব কঠোর। এখানে শরিয়াহ আইন ও সামাজিক সংস্কৃতি কঠোর অনুশাসনের শৃঙ্খলে বাঁধা।
একশ্রেণির বাংলাদেশির অপরাধপ্রবণতার অবধারিত পরিণতিতে সৌদি প্রশাসন রুষ্ট হয়ে ২০০৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনা না ঘটলে আরও কত বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সে সমৃদ্ধ হতো বাংলাদেশ! এগিয়ে যেতাম আমরা বহু যোজন। রাস্তাঘাটে সুশৃঙ্খল চলাফেরা, দোকানপাটে নিষ্কলুষ ব্যবসা, চাকরিতে শৃঙ্খলা, আর্থিক লেনদেনে সততা, কর্তৃপক্ষের আনুগত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সৌদিতে কঠোর আইনের শাসনে অনভ্যস্ত বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে জাল পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ সৌদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সুবাদে শ্রমবাজার দখলে এগিয়ে আসে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম।
সুতরাং এ যাত্রায় নতুন শ্রমিকেরা যেন অপরাধ, অপকর্মে জড়িয়ে না পড়েন, সে লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনন্য। এ প্রেক্ষাপটে সৌদি রেমিট্যান্সের অবদান শীর্ষে। যেসব নেতিবাচক ঘটনায় সৌদি আরবে শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। তবে এবার দুই সরকারের মধ্যে সরাসরি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় খর্ব হবে প্রতারক ও দালাল চক্রের আধিপত্য। নতুন শ্রমিকদের সৌদি সরকারের আইনকানুন, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন দিতে হবে। জীবিকা অর্জনের জন্য শুধু শ্রমিক হিসেবে নন, দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তাঁরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, দূত। যাঁরা কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত তাঁরা প্রশিক্ষণের অনুপযুক্ত, এমন মনোভাব ভ্রান্ত। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও প্রেষণা। বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষের জন্য প্রয়োজন জীবনব্যাপী শিক্ষা। শ্রমিকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সনদের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মানসিক প্রশিক্ষণ, আইন মান্যতার অনুশীলন। আচরণে উগ্রতা ও অভদ্রতা পরিহার এবং চাকরিতে শৃঙ্খলা ও সততার জন্য তাঁদের প্রয়োজন ওরিয়েন্টেশন। নৈতিকতা ও শিষ্টাচার ছাড়া শুধু খেয়ে-পের বেঁচে থাকার জন্য শ্রম বিক্রি করা জীবনের সার্থকতা নয়, এ ধ্রুব সত্য তাঁদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে। প্রবাসজীবনে দেশি-বিদেশিদের সঙ্গে শান্তিময় সহাবস্থান ও সম্প্রতির বন্ধন রাখতে হবে।
বিমানে আরোহণের আগেই সততা, শিষ্টাচার, নিরাপত্তা, শালীনতা, স্বাস্থ্যরক্ষা, খাবার গ্রহণ ও টয়লেট ব্যবহারবিধি এবং ন্যূনতম ইংরেজি কথোপকথন চর্চা করাতে হবে। শ্রমিকদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ এবং ন্যায়-অন্যায় বোধ সম্পর্কে সচেতন না করলে জনশক্তি রপ্তানির সাফল্য ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। পল্লি অঞ্চলে প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও শিক্ষার অভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুপ্ত প্রতিভা, মেধা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না। বিদেশযাত্রায় বিমানে আরোহণ, অবস্থান ও বিমান থেকে নেমে শ্রমিক-কর্মীদের উগ্র ও তির্যক-মন্তব্য, আঞ্চলিক ভাষার অশালীন উচ্চারণ, আনস্মার্ট চলাফেরা, শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ পরিহার করে শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের স্মরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
তপ্ত আবহাওয়ার মরুর দেশ সৌদি আরব এখন শিল্পায়নের পথে অগ্রসরমাণ। ২০২২ সালের মধ্যে সড়ক, রেল ও আকাশপথের উন্নয়নে বিনিয়োগ হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এমনকি অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, আইটি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাসন খাতে। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। শ্রমিক রপ্তানির সমান্তরালে আমাদের প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, আইটি প্রফেশনালদেরও এখানে নতুন জগৎ তৈরি করতে হবে।
স্থানীয় দূতাবাস, বায়রাসহ সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে উঠুক সৌদি আরবসহ সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারসমৃদ্ধ বিদেশের মাটিতে, যেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান থাকবে। এভাবেই অর্থনৈতিক শক্তি কেন্দ্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। জনশক্তি রপ্তানির নতুন অভিযাত্রায় সৌদি অভিমুখী ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তিদের উগ্র আচরণ বা অনৈতিক কীর্তিকলাপ প্রতিরোধে সচেতন ও সংবেদনশীল করতে হবে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে। বিদেশের জমিতে নোংরা জামা পরে, পান চিবোনো লাল দাঁত দেখিয়ে এবং থুতু ও বর্জ্য ফেলে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করা যাবে না। নতুবা সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পের মতো পরিণাম বয়ে আসবে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
mmunirc@gmail.com
বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে জালিয়াতি সৌদি প্রশাসনের জন্য বাড়তি উপদ্রব। মাথা হেঁট হয়ে যায়, যখন বিদেশে আমাদের ‘জালিয়াত’ বা ‘প্রতারক’ বিশেষণটি জুড়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বা কর্মক্ষমতার অনুষঙ্গে যুক্ত এখন শিক্ষা, আচরণ, মূল্যবোধ। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া শিক্ষার আলোয় জাতিকে প্রশিক্ষিত জনসম্পদে রূপান্তর করেছে। সুতরাং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির গুরুত্ব এখন সময়ের দাবি।
জ্বালানি শক্তি মানেই বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বের ২৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল-সম্পদের মালিক সৌদি আরব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটা ধ্রুব সত্য। সাত বছর পর (২০০৮ সালের নিষেধাজ্ঞার পর) বাংলাদেশ থেকে জনশক্তির দ্বার উন্মোচন করেছে সৌদি সরকার। জানুয়ারিতে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। নতুন বাদশাহ খুব অল্প সময়েই জনগণকে বহুমুখী সেবা ও সুবিধা বাড়ানোর নীতি অবলম্বন করছেন। ইতিমধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বোনাস, পেনশনভোগীদের সুবিধা ও অন্যান্য খাতে।
অবস্থা অনুকূল থাকলে সৌদি আরবে কয়েক লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। সৌদি শ্রমবাজারের এ সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য বিশাল ইতিবাচক অর্জন। এটি হবে বৃহৎ শ্রমবাজার। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার অচলায়তন ভাঙার জন্য সৌদি সরকারকে অশেষ অভিনন্দন। এখন সে দেশে ১৩ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। ২০১৪ সালে সৌদি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ডলার। দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে শ্রমিক রপ্তানিতে সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে বিশাল বাধার প্রাচীর অপসারিত হয়েছে। এখন অনেক কম খরচে শ্রমিকেরা সৌদি আরব যেতে পারবেন। সর্বোচ্চ ব্যয় হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, যা ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এ সুখবর যেন আবার কাল হয়ে না দাঁড়ায়। সৌদিতে আইনের শাসন খুব কঠোর। এখানে শরিয়াহ আইন ও সামাজিক সংস্কৃতি কঠোর অনুশাসনের শৃঙ্খলে বাঁধা।
একশ্রেণির বাংলাদেশির অপরাধপ্রবণতার অবধারিত পরিণতিতে সৌদি প্রশাসন রুষ্ট হয়ে ২০০৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনা না ঘটলে আরও কত বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সে সমৃদ্ধ হতো বাংলাদেশ! এগিয়ে যেতাম আমরা বহু যোজন। রাস্তাঘাটে সুশৃঙ্খল চলাফেরা, দোকানপাটে নিষ্কলুষ ব্যবসা, চাকরিতে শৃঙ্খলা, আর্থিক লেনদেনে সততা, কর্তৃপক্ষের আনুগত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সৌদিতে কঠোর আইনের শাসনে অনভ্যস্ত বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে জাল পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ সৌদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সুবাদে শ্রমবাজার দখলে এগিয়ে আসে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম।
সুতরাং এ যাত্রায় নতুন শ্রমিকেরা যেন অপরাধ, অপকর্মে জড়িয়ে না পড়েন, সে লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনন্য। এ প্রেক্ষাপটে সৌদি রেমিট্যান্সের অবদান শীর্ষে। যেসব নেতিবাচক ঘটনায় সৌদি আরবে শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। তবে এবার দুই সরকারের মধ্যে সরাসরি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় খর্ব হবে প্রতারক ও দালাল চক্রের আধিপত্য। নতুন শ্রমিকদের সৌদি সরকারের আইনকানুন, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন দিতে হবে। জীবিকা অর্জনের জন্য শুধু শ্রমিক হিসেবে নন, দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তাঁরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, দূত। যাঁরা কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত তাঁরা প্রশিক্ষণের অনুপযুক্ত, এমন মনোভাব ভ্রান্ত। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও প্রেষণা। বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষের জন্য প্রয়োজন জীবনব্যাপী শিক্ষা। শ্রমিকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সনদের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মানসিক প্রশিক্ষণ, আইন মান্যতার অনুশীলন। আচরণে উগ্রতা ও অভদ্রতা পরিহার এবং চাকরিতে শৃঙ্খলা ও সততার জন্য তাঁদের প্রয়োজন ওরিয়েন্টেশন। নৈতিকতা ও শিষ্টাচার ছাড়া শুধু খেয়ে-পের বেঁচে থাকার জন্য শ্রম বিক্রি করা জীবনের সার্থকতা নয়, এ ধ্রুব সত্য তাঁদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে। প্রবাসজীবনে দেশি-বিদেশিদের সঙ্গে শান্তিময় সহাবস্থান ও সম্প্রতির বন্ধন রাখতে হবে।
বিমানে আরোহণের আগেই সততা, শিষ্টাচার, নিরাপত্তা, শালীনতা, স্বাস্থ্যরক্ষা, খাবার গ্রহণ ও টয়লেট ব্যবহারবিধি এবং ন্যূনতম ইংরেজি কথোপকথন চর্চা করাতে হবে। শ্রমিকদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ এবং ন্যায়-অন্যায় বোধ সম্পর্কে সচেতন না করলে জনশক্তি রপ্তানির সাফল্য ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। পল্লি অঞ্চলে প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও শিক্ষার অভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুপ্ত প্রতিভা, মেধা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হয় না। বিদেশযাত্রায় বিমানে আরোহণ, অবস্থান ও বিমান থেকে নেমে শ্রমিক-কর্মীদের উগ্র ও তির্যক-মন্তব্য, আঞ্চলিক ভাষার অশালীন উচ্চারণ, আনস্মার্ট চলাফেরা, শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ পরিহার করে শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের স্মরণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
তপ্ত আবহাওয়ার মরুর দেশ সৌদি আরব এখন শিল্পায়নের পথে অগ্রসরমাণ। ২০২২ সালের মধ্যে সড়ক, রেল ও আকাশপথের উন্নয়নে বিনিয়োগ হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এমনকি অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, আইটি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাসন খাতে। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। শ্রমিক রপ্তানির সমান্তরালে আমাদের প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, আইটি প্রফেশনালদেরও এখানে নতুন জগৎ তৈরি করতে হবে।
স্থানীয় দূতাবাস, বায়রাসহ সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে উঠুক সৌদি আরবসহ সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারসমৃদ্ধ বিদেশের মাটিতে, যেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান থাকবে। এভাবেই অর্থনৈতিক শক্তি কেন্দ্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। জনশক্তি রপ্তানির নতুন অভিযাত্রায় সৌদি অভিমুখী ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তিদের উগ্র আচরণ বা অনৈতিক কীর্তিকলাপ প্রতিরোধে সচেতন ও সংবেদনশীল করতে হবে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে। বিদেশের জমিতে নোংরা জামা পরে, পান চিবোনো লাল দাঁত দেখিয়ে এবং থুতু ও বর্জ্য ফেলে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করা যাবে না। নতুবা সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পের মতো পরিণাম বয়ে আসবে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
mmunirc@gmail.com
No comments