সিটি নির্বাচন হবে, ভোট দিতে পারব তো? by সোহরাব হাসান

তফসিল ঘোষণার আগেই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে, লাইটপোস্টে, ফুটওভারব্রিজে পোস্টার লাগানোর মহড়া চলছে। এমনকি রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ব্যানার-সাইনবোর্ড টাঙিয়েও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের চেহারা মোবারক প্রদর্শন করে চলেছেন। সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরাও মাঠে নেমেছেন, নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তাহলে বিলম্বে হলেও বহুপ্রতীক্ষিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সত্যিই আলোর মুখ দেখছে? সরকারি দলের নেতাদের হাবভাব দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসএসসি পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে রোজা শুরু হবে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমরা প্রস্তুত।’ নির্বাচন কমিশন আভাস দিয়েছে যে এইচএসসি পরীক্ষা ও রোজার মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হতে পারে। সরকার চাইলে তারা রোজার মধ্যেও নির্বাচন করতে পারে।
যে নির্বাচনের জন্য হঠাৎ এত তোড়জোড়, সেই নির্বাচন এত দিন হলো না কেন? কমিশন বলবে, কারণ মামলা। যুক্তি বটে! আইনের প্রতি আস্থাশীল কমিশন আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, সীমানাসংক্রান্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গেজেট নোটিফিকেশন তাদের হাতে আগে পৌঁছেনি। এখন পৌঁছেছে বলেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রকৃত কারণ হলো, সরকার চাইছে বলেই নির্বাচন কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। আবার সরকার না চাইলে তারা নীরব হয়ে যাবে। এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচন করেছিল। দফায় দফায় বৈঠক করে ‘ক্ষুব্ধ’ বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পেরেছিল। সে রকম সদিচ্ছা ও সাহস বর্তমান কমিশনের আছে বলে মনে হয় না। তাই তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত বলা যাবে না, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবেই।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে। সেই হিসাবে প্রায় সাত বছর সিটির বাসিন্দারা নির্বাচিত প্রতিনিধি থেকে বঞ্চিত। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কবে হবে, তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হলো, এত দিন হলো না কেন? তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিয়ে সে রকম কোনো জটিলতা হয়নি। ১৯৯৪ সালের পর থেকে সেখানে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়ে আসছে। তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। একবার মোহাম্মদ মন্জুর আলম। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে দুবার নির্বাচন হয়েছে। প্রথমবার জিতেছেন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ হানিফ, দ্বিতীয়বার বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। হানিফ বিপুল ভোটে হারিয়েছিলেন মির্জা আব্বাসকে। আর ২০০২ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা-ই করেনি। ফলে সাদেক হোসেন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জয়ী হন। এবার কি তার ‘প্রতিদান’ হবে? আওয়ামী লীগের সমর্থক প্রার্থীদ্বয় কি ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জিতে যাবেন?
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রার্থী ঠিক করতে পারলেও চট্টগ্রামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সেখানে প্রার্থিতার জন্য তিনজন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। স্থানীয় ১৪ দল মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। শেষমেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে চট্টগ্রামে কে প্রার্থী হচ্ছেন। কিছু দিন আগ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষে বর্তমান মন্জ্‌ুর আলম ও নগর সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেনের পক্ষে পোস্টার–ব্যানার টানানো হলেও এখন চুপচাপ। অর্থাৎ তারাও হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
এবারে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী হবে? নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু করা যেমন কমিশনের দায়িত্ব, তেমনি অংশগ্রহণমূলকও। নির্বাচন অর্থ বাছাই। সেই বাছাইয়ের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্যই প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকে। এটি কোনো সরকারের অধীন প্রতিষ্ঠান নয়। স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে এ প্রতিষ্ঠান যাকেই বাধা মনে করবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, নিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সেই হিম্মত আছে কি না, সেটি আরও একবার পরীক্ষা হবে। নির্বাচন বা বাছাই-প্রক্রিয়াটিতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হয়ে পড়ে অকার্যকর; যার ভুক্তভোগী দেশের ১৬ কোটি মানুষ। বিগত জাতীয় নির্বাচনে জনগণ প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পাননি। অনেকে বলবেন, বিরোধী দল আসেনি। বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার জন্য যে আস্থা দরকার, নির্বাচন কমিশন কেন সেটি নিশ্চিত করতে পারল না? এটি যতটা না রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, তার চেয়ে বেশি নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা। সামনের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ নেয়, তাহলে কমিশনের দায়িত্ব হবে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। আর যদি বিএনপি অংশ না নেয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং সেটি একতরফা ও একপেশে নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হবে। তখন হয়তো ক্ষমতাসীনেরা বলবেন, ‘চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দুটিই আমরা।’ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত ও শ্রীলঙ্কার চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ যতটা গৌরবের, নির্বাচনী যুদ্ধে একই দল থেকে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হওয়া ততটাই লজ্জাজনক।
স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন রাজনৈতিক ব্যানারে না হলেও প্রার্থীরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। তাঁদের পক্ষে প্রচারণায় গোটা দলের নেতৃত্ব নেমে পড়েন। তাই এটিকে অরাজনৈতিক বলারও সুযোগ নেই। কোনো কোনো স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এর রাজনৈতিক পরিচয়ে আপত্তি তুলেছেন। আবার কেউ বলছেন, এ নির্বাচনও দলীয় পরিচয়ে হওয়া উচিত। নাচতে নেমে ঘোমটা দেওয়া কেন? রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিতর্কে না গিয়েও নাগরিকদের একান্ত চাওয়া হলো একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নগরবাসী যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া। আর সেটি তখনই সম্ভব যখন সব পক্ষ অংশ নেবে। জাতীয় নির্বাচন বর্জনকারী দলও স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করার দুই মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি জোট ভালো ফল করেছিল। নির্বাচনটি একই দিনে হলে বিএনপি হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হতো।
এবারের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হবে? কাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে ঢাকা উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ও দক্ষিণে সাঈদ খোকনের নাম ঘোষণা করেছে। জাতীয় পার্টিও আলাদা প্রার্থী দেবে বলে জানিয়েছে। নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জেলখানা থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি বাম দলও তাদের সমর্থক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দলে দুই ধরনের চিন্তাভাবনা আছে। এক পক্ষ ভাবছে, ক্ষমতাসীনদের ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দল সভা-সমাবেশের সুযোগ পাবে, জনগণের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি জোট যাকেই প্রার্থী করুক না কেন, জেতার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু অন্য অংশ দেখছে এটিকে সরকারের ফাঁদ হিসেবে। তারা মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো নির্বাচনেই বিএনপির যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা, ঢাকায় মেয়র পদে তাদের প্রার্থী জিতলেও গাজীপুর, রাজশাহী ও সিলেটের পরিণতি হবে। তা ছাড়া, তারা যখন সর্বাত্মক অবরোধে আছে, তখন কীভাবে নির্বাচন করে? নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অর্থ হবে নিজেদের কর্মসূচিকে নাকচ করে দেওয়া।
সিটি নির্বাচনে সব দল যদি অংশ নেয় তাহলে নির্বাচনটি যেমন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তেমনি তাদের হালনাগাদ জনপ্রিয়তা যাচাইও হয়ে যাবে। আর বিএনপির মতো একটি বড় দল না এলে সেটি হবে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন। এখন নির্বাচন কমিশনকেই ঠিক করতে হবে তারা কী ধরনের নির্বাচন করবে।
ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন কবে হবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন নয়। বড় প্রশ্ন হলো, সেই নির্বাচনে নগরবাসী ভোট দিতে পারবেন কি না? গত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকার বেশির ভাগ ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। এবারেও যদি নির্বাচন কমিশন সে ধরনের একটি একতরফা ও ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন আয়োজন করে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই সিটি করপোরেশনের ৪৪ লাখ ভোটার। নগরবাসী আরেকটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন চায় না, চায় অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। আশা করি, নির্বাচন কমিশন জনগণের ওপর আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন চাপিয়ে দেবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.