দুর্নীতির বিরুদ্ধে চাই সামাজিক প্রতিরোধ by নুরুল আমিন
অতি
সম্প্রতি টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে
বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। গত বছরের (১৬তম) অবস্থান থেকে আমাদের অবনমন হয়েছে
এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে। এমনকি
পাকিস্তানের অবস্থানও আমাদের ওপরে যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণকে
পীড়িত করছে। বর্তমান সময়ে দুর্নীতির তেজ বা ব্যাপকতা বুঝতে টিআইবির
রিপোর্টের প্রয়োজন নেই, ঘরের বাইরে ভাঙা রাস্তায় পা রাখলেই তা আঁচ করা যায়।
দুর্নীতির কালো থাবায় সমাজের প্রতি স্তরে বিরাজ করছে অস্থিরতা এবং ধসে
পড়েছে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক, অফিস-আদালতের শৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ।
এখন সবাই শুধু টাকার পেছনে ছুটছে এবং যেনতেন তা পকেটে ভরে ভোগবিলাসে ডুবে
যাচ্ছে। কোথায় আইন, কোথায় মূল্যবোধ ও লাজলজ্জা, তার তোয়াক্কা কেউ করছে না।
যুগ যুগ ধরে ক্ষমতাবান ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের টাকার সাগরে আকণ্ঠ ডুবে যেতে
দেখেও দুদকের চৈতন্যের শক্তি নেই। এমন অবাধ দুর্নীতি চলতে থাকলে এটাই
নিয়মে পরিণত হবে এবং হচ্ছে। এখন সরকারি যেকোনো অফিস আদালতে ঘোষণা দিয়ে লাখ
লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়, যা এ সরকারের বিগত আমলেও এত খোলামেলা ছিল না।
অর্থমন্ত্রীর স্পিড মানি তত্ত্বও দুর্নীতিকে এ কয়েক মাসে ত্বরান্বিত করেছে
বহু গুণে। এ রকম দুর্নীতিগ্রস্ত ও দ্রুত ক্ষয়িঞ্চু মূল্যবোধ নিয়ে কিভাবে
একটি দেশ মধ্যম আয় ও উন্নত দেশে উন্নীত হবে? আর হলেও বা আমজনতার অর্জন হবে
কতটুকু? গবেষকেরা বলছেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা গেলে দেশে ১০ শতাংশ
প্রবৃদ্ধি সম্ভব। আবার বিশ্বব্যাংক বলছে, দুর্নীতি জিডিপির ২ শতাংশ
প্রবৃদ্ধি খেয়ে ফেলছে। দুর্নীতি থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ আবার দেশের
বাইরে পাচার হচ্ছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল
ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে (২০০৩-২০১২) বাংলাদেশ থেকে
এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা, যমুনা সেতু হতো এবং
ঢাকা শহরকে ফাইওভার দিয়ে ঢেকে দেয়া যেত। দুর্নীতি আমাদের শ্রমিক, কৃষক ও
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয়ের বড় অংশ গিলে খাচ্ছে এবং বাড়িয়ে তুলছে দেশে আয়
বৈষম্য, বিদেশী পণ্যের বাজার ও বেকারত্ব। অর্থাৎ দুর্নীতি সম্মিলিতভাবে
নষ্ট করছে উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা, দেশীয় পণ্যের বাজার এবং
মানুষের মনের শান্তি। দুর্নীতিকে অনেকটা সামুদ্রিক ঝড় সিডর বা আইলার সাথে
তুলনা করা যায়, যা সব কিছুকে তছনছ করে দিয়ে যায়। পার্থক্য হচ্ছে প্রকৃতি
আপনা-আপনি উঠে দাঁড়ালেও দেশ বা জাতির জন্য দরকার হয় উপযুক্ত থেরাপি।
দুর্নীতির মূল কারণকে চিহ্নিত করে দিতে হবে প্রয়োজনীয় থেরাপি ও চিকিৎসা।
দুর্নীতির প্রধান কারণই হলো দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় রাজনীতি ও তার থেকে সৃষ্ট
সরকার। চার দশক ধরে জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলো দিয়ে নাকাল হয়ে বারবার
সরকার পরিবর্তন করেও সুফল পায়নি। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। জনগণ বারবার
প্রতারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। গড়ে উঠছে না বিকল্প দল বা জোট। তাই একমাত্র
সামাজিক প্রতিরোধই দুর্নীতির রাহু গ্রাস থেকে আমাদের কিছুটা আগলে রাখতে
পারে। ছোটবেলায় অল্প শিক্ষিত বাবা-দাদাদের দেখেছি ঘুষ ও সুদখোরদের বাসায়
কৌশলে দাওয়াত বর্জন করতে।
আবার অনেককে দেখেছি দুর্নীতিগ্রস্তদের সাথে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে এবং কথায় ও কর্মে তাদের ঘৃণা করতে। এখন সেদিন বিগত হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার ও স্থানে স্থানে গণজমায়েত করে শিক্ষার্থী ও জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। গণিত উৎসব ও বন্ধু সভার মতো দেশের আনাচে-কানাচে দুর্নীতিবিরোধী সভা-সমাবেশের আয়োজন জরুরি। সুশীলসমাজ ও দেশের থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে এবং দুর্নীতি আধিক্য সরকারি অফিসের সামনে দুর্নীতিবিরোধী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুজন, বাপা, সিপিডি, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিরোধে একসাথে কাজ করতে পারে। প্রয়োজনে বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠনে সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে। কয়েক দিন আগে নাগরিক ঐক্যের দুর্নীতিবিরোধী একটি সমাবেশে স্বল্প লোকের উপস্থিতি আমাদের কষ্ট দেয়। আয়োজকদের সামনের নেতৃত্বের সারিতে আরো ভারিক্কি নেতানেত্রীর প্রয়োজন। ঐক্যের নেতৃত্বে নিজেদের বড় নেতা মনে করলে এ প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হবে। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, দুর্নীতি সব সময় আত্মঘাতী। দেশে দেশে এর অসংখ্য প্রমাণ আমরা পাই। যেমন- ফিলিপাইনে মার্কোস, ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো, আমাদের এরশাদ সরকারের পতন ও এক-এগারোর ধাক্কা এবং সম্প্রতি ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি এর ভালো উদাহরণ। তাই সবাইকে বুঝতে ও বুঝাতে হবে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করে ধনী হলেও সে যেমন দুর্নীতির কুফল থেকে মুক্ত নয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার নিজের পতন নিজেই ডেকে আনে।
লেখক : খণ্ডকালীন শিক্ষক, রয়েল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
আবার অনেককে দেখেছি দুর্নীতিগ্রস্তদের সাথে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে এবং কথায় ও কর্মে তাদের ঘৃণা করতে। এখন সেদিন বিগত হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার ও স্থানে স্থানে গণজমায়েত করে শিক্ষার্থী ও জনগণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। গণিত উৎসব ও বন্ধু সভার মতো দেশের আনাচে-কানাচে দুর্নীতিবিরোধী সভা-সমাবেশের আয়োজন জরুরি। সুশীলসমাজ ও দেশের থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে এবং দুর্নীতি আধিক্য সরকারি অফিসের সামনে দুর্নীতিবিরোধী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুজন, বাপা, সিপিডি, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিরোধে একসাথে কাজ করতে পারে। প্রয়োজনে বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠনে সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে। কয়েক দিন আগে নাগরিক ঐক্যের দুর্নীতিবিরোধী একটি সমাবেশে স্বল্প লোকের উপস্থিতি আমাদের কষ্ট দেয়। আয়োজকদের সামনের নেতৃত্বের সারিতে আরো ভারিক্কি নেতানেত্রীর প্রয়োজন। ঐক্যের নেতৃত্বে নিজেদের বড় নেতা মনে করলে এ প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হবে। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, দুর্নীতি সব সময় আত্মঘাতী। দেশে দেশে এর অসংখ্য প্রমাণ আমরা পাই। যেমন- ফিলিপাইনে মার্কোস, ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো, আমাদের এরশাদ সরকারের পতন ও এক-এগারোর ধাক্কা এবং সম্প্রতি ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি এর ভালো উদাহরণ। তাই সবাইকে বুঝতে ও বুঝাতে হবে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করে ধনী হলেও সে যেমন দুর্নীতির কুফল থেকে মুক্ত নয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার নিজের পতন নিজেই ডেকে আনে।
লেখক : খণ্ডকালীন শিক্ষক, রয়েল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
No comments