মহাত্মা লোকমান এবং তার হিকমত by কাজী সাঈদ
হজরত
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যখন জিহাদলব্ধ
সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করা হবে, যখন গচ্ছিত বস্তুকে লুটের মাল
গণ্য করা হবে, যাকাতকে জরিমানার মতো কঠিন মনে করা হবে, যখন পার্থিব সম্পদ
লাভের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করা হবে, যখন মানুষ স্ত্রীর আনুগত্য ও
মায়ের অবাধ্যতা শুরু করবে, যখন বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে ও বাবাকে দূরে
সরিয়ে রাখবে, যখন মসজিদগুলোয় হট্টগোল হবে, যখন পাপাচারী ও কুকর্মী ব্যক্তি
গোত্রের নেতা হবে, যখন নীচতম ব্যক্তি তার সম্প্রদায়ের প্রধান হবে, যখন
দুষ্ট লোকেদের সম্মান করা হবে তাদের অনিষ্টের ভয়ে, যখন গায়িকা নারী ও
বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন হবে, যখন মদ্যপান শুরু হবে, যখন মুসলিম
সম্প্রদায়ের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তীদেরকে অভিসম্পাত করবে, তখন তোমরা
প্রতীক্ষা কর একটি লাল বর্ণযুক্ত বায়ুর, ভূমিকম্পের, ভূমি ধসের, আকার-আকৃতি
বিকৃত হয়ে যাওয়ার এবং কিয়ামতের এমন নিদর্শনগুলোর, যেগুলো একের পর এক
প্রকাশমান হতে থকাবেÑ যেমন কোনো মালার সুতা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো একের পর এক
খসে পড়তে থাকে (তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন/সপ্তম খণ্ড/ সূরা লোকমান অধ্যায়)।
মক্কার ব্যবসায়ী নজর ইবনে হারেস ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে সফর করত। এই মুশরিক একবার পারস্য দেশ থেকে কিসরা প্রমুখ আজমি সম্রাটের ঐতিহাসিক কাহিনীর বই কিনে এনে মক্কার মুশকিরদের বলল, মুহাম্মাদ তোমাদের আদ, সামুদ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কিসসা-কাহিনী শোনায়। আমি তোমাদের রুস্তম, ইসফেন্দিয়ার প্রমুখ পারস্য সম্রাটের সেরা কাহিনী শোনাই। মক্কার মুশরিকেরা আগ্রহভরে তার আনীত কাহিনী শুনতে থাকে। এগুলোতে শিক্ষা বলতে কিছুই ছিল না, বরং এগুলো ছিল চটকদার গল্পগুচ্ছ। এর ফলে অনেক মুশরিক, যারা এর আগে কুরআনের অলৌকিকতা ও অদ্বিতীয়তার কারণে একে শোনার আগ্রহ রাখত এবং গোপনে শুনত এবং তারাও কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ছুতা পেয়ে গেল।
দুররে মনসুরে ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছেÑ উল্লিখিত ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী ক্রয় করে এনে তাকে কুরআন শ্রবণ থেকে মানুষকে ফিরানোর কাজে নিয়োজিত করল। কেউ কুরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে বাঁদীকে আদেশ করত এবং বলত, মুহাম্মাদ তোমাদেরকে কুরআন শুনিয়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়ার কথা বলে। এতে কষ্ট আর কষ্ট। এসো, এ গানটি শোনো এবং উল্লাস করো।
মহাত্মা লোকমান এবং তার হিকমত : পবিত্র কুরআনের ৩১ নম্বর সূরা ‘সূরা লোকমান’। বর্ণিত লোকমান সম্পর্কে ইবনে কাসির বলেন, প্রাচীন ইসলামি মনীষীরা এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি নবী ছিলেন না। কেবল হজরত ইকরামা রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এর বর্ণনা সূত্র (সনদ) দুর্বল। ইমাম বাগাবির দাবিÑ এ কথা সর্বসম্মত যে, তিনি বিশিষ্ট ফকিহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন, নবী ছিলেন না। (মাজহারী)।
হজরত কাতাদাহ রা: থেকে বর্ণিতÑ মনীষী লোকমানকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি হিকমতকে (প্রজ্ঞা) নবুয়ত থেকে সমধিক গ্রহণযোগ্য কেন মনে করলেন, যখন আপনাকে যেকোনো একটা গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল? তিনি বললেন, নবুয়ত বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদ। কোনো কোনো রেয়ায়েতে আছে, তাঁকে নবুয়ত গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তিনি আরজ করলেন, ‘যদি আমার প্রতি এটা গ্রহণ করার নির্দেশ হয়ে থাকে তবে তা শিরোধার্য। অন্যথায় আমাকে ক্ষমা করুন।’ হজরত লোকমানের বহু জ্ঞানগর্ভ বাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ওয়াহাব বিন মুনাব্বেহ্ বলেন, আমি হজরত লোকমানের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দশ হাজারের চেয়েও বেশি অধ্যায় অধ্যয়ন করেছি (কুরতুবি)।
একদিন হজরত লোকমান এক বিরাট সমাবেশে উপস্থিত জনতাকে জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি বলল, আপনি এ মর্যাদা কিভাবে লাভ করলেন যে আল্লাহর গোটা সৃষ্টিকুল আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং আপনার বাণী শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোক এসে জমায়েত হয়? লোকমান বলেছিলেন, এমন কতকগুলো কাজ আছে যা আমাকে এ স্তরে উন্নীত করেছে। যদি তুমি তা গ্রহণ করো তবে তুমিও এ মর্যাদা ও স্থান লাভ করতে পারবে। সে কাজগুলো হলোÑ নিজের দৃষ্টি নি¤œমুখী রাখা এবং মুখ বন্ধ করা, হালাল জীবিকায় তুষ্ট থাকা, নিজের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করা, সত্য কথায় অটল থাকা, অঙ্গীকার পূর্ণ করা, মেহমানের আদর-আপ্যায়ন ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, প্রতিবেশীর প্রতি সর্বদা লক্ষ রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা পরিহার করা (ইবনে কাসির)। ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহের বর্ণনা অনুযায়ী, মহাত্মা লোকমান হজরত আইয়ুব আ:-এর ভাগ্নে ছিলেন। মুকাতেল তাঁর খালাতো ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। এক কৃষ্ণকায় হাবশি হজরত সাঈদ বিন মুসাইয়েবের খিদমতে কোনো মাসআলা জিজ্ঞেস করতে হাজির হন। হজরত সাঈদ তাকে সান্ত্বÍনা দিয়ে বললেন, তুমি কৃষ্ণকায় বলে দুঃখ কোরো না। কারণ কালো বর্ণধারীদের মধ্যে এমন তিনজন মহান ব্যক্তি আছেন, যারা মানবকুলে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিতÑ হজরত বেলাল, হজরত ওমর বিন খাত্তাব কর্তৃক মুক্ত গোলাম হজরত ‘মাহজা’ ও হজরত লোকমান আ:।
আবু ‘হাইয়্যান’ বলেছেন, হিকমত বলতে সেসব বাক্য সমষ্টিকে বোঝায়, যার দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে, তাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে এবং যা মানুষ সংরক্ষণ করে অপরের কাছে পৌঁছায়। ইবনে আব্বাস রা: বলেন, হিকমত হলো বিবেক, প্রজ্ঞা ও মেধা। হজরত লোকমানকে প্রদত্ত ‘হিকমত’ শব্দটি পবিত্র কুরআন করিমে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেÑ বিদ্যা, বিবেক, গাম্ভীর্য, নবুয়ত, মতের বিশুদ্ধতা।
সূরা লোকমানের ৮টি আয়াত : (১২) আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয় সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্য কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসতি। (১৩) যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল : হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শরিক করা মহা অন্যায়। (১৪) আর আমি মানুষকে তার বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।
(১৫) বাবা-মা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করব। (১৬) হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তরগর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূগর্ভে, তবে আল্লাহ তা-ও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন। (১৭) হে বৎস! নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজে আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। (১৮) অহঙ্কার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। (১৯) পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।
লোকমান আ: তাঁর ছেলেকে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, সেসব উপদেশ সন্তানদের দান করা পৃথিবীর সব মুসলমান বাবা-মায়ের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সন্তানদেরও এসব উপদেশ শিরোধার্য হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বিভিন্ন আঙ্গিকে ওপরের আয়াতগুলো বারবার বিধৃত করেছেন। যেমনÑ সূরা আর রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালার দৃপ্ত ঘোষণাÑ ‘হে জিন ও মানবকুল! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পারো তবে করো; কিন্তু ছাড়পত্র ছাড়া তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’
বর্তমান যুগে বেশির ভাগ যুবক-যুবতী অশ্লীল উপন্যাস, পেশাদার অপরাধীদের কাহিনী অথবা অশ্লীল কবিতা পাঠে অভ্যস্ত। অনুরূপভাবে পথভ্রষ্ট বাতিলপন্থীদের চিন্তাধারা অধ্যয়ন করা ও সর্বসাধারণের জন্য পথভ্রষ্টতার সম্ভাবনার কারণ বিধায় নাজায়েজ। তবে গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ জওয়াবদানের উদ্দেশ্যে এগুলো পাঠ করলে তাতে আপত্তি নেই বলে আলেমসমাজ একমত।
পবিত্র কুরআনের সূরা আর রুমের ৪১ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ওদের কোনো কর্মের শাস্তি ওদের আস্বাদন করানো হয়, যাতে ওরা সৎ পথে ফিরে আসে।’
তাফসিরে রুহুল মা’আনিতে বলা হয়েছে : ‘বিপর্যয় বলতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্যÑ সব কিছুতে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কমে যাওয়া এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়ার ইত্যাদি আপদ-বিপদ বোঝানো হয়েছে।’ পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদেরকে যেসব বিপদ-আপদ স্পর্শ করে সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে।’ কোনো কোনো আলেম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো গোনাহ করে, সে সারা বিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশুপক্ষীদের প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গোনাহর কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্য যেসব বিপদাপদ দুনিয়ায় আসে, তাতে সব প্রাণীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কিয়ামতের দিন এরা সবাই গোনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।
নব্বই ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষই আজ ভয়াবহ আতঙ্কে আক্রান্ত। ইসলামি দলগুলো এবং তাদের মেধাবী কর্মীদের ইতোমধ্যেই কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে- জেল-জুলুম ও গুম-হত্যা তাদের যেন নিয়তি। ‘জঙ্গিবাদী’, ‘মৌলবাদী’, ‘যুদ্ধাপরাধীর দল’ নানা তকমা ইতোমধ্যে এদের শরীরে এঁটে দেয়া হয়েছে। হাদিস, কুরআন, বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থকে ‘জেহাদি বই’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আলেম-ওলামা যারা ইসলামি পণ্ডিত, ইসলামের সত্যিকার দীক্ষা যাদের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করেÑ তারা যেন অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। দেশের এ চলমান অস্থিরতায় তাদের ভূমিকা রহস্যময় বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। লোকমান আ:-এর হিকমতের কার্যকরি অনুশীলন ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনার সহায়ক হতে পারে, আমার বিশ্বাস। আমাদের কৃতকর্মের ফলে সৃষ্ট এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে মহান রাব্বুল আলামিনের গায়েবি মদদ প্রার্থনা করছি। কৃতকর্মের জন্য তাঁর দরবারে মার্জনা ভিক্ষা করছি। আমিন! ছুম্মা আমিন।
মক্কার ব্যবসায়ী নজর ইবনে হারেস ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে সফর করত। এই মুশরিক একবার পারস্য দেশ থেকে কিসরা প্রমুখ আজমি সম্রাটের ঐতিহাসিক কাহিনীর বই কিনে এনে মক্কার মুশকিরদের বলল, মুহাম্মাদ তোমাদের আদ, সামুদ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কিসসা-কাহিনী শোনায়। আমি তোমাদের রুস্তম, ইসফেন্দিয়ার প্রমুখ পারস্য সম্রাটের সেরা কাহিনী শোনাই। মক্কার মুশরিকেরা আগ্রহভরে তার আনীত কাহিনী শুনতে থাকে। এগুলোতে শিক্ষা বলতে কিছুই ছিল না, বরং এগুলো ছিল চটকদার গল্পগুচ্ছ। এর ফলে অনেক মুশরিক, যারা এর আগে কুরআনের অলৌকিকতা ও অদ্বিতীয়তার কারণে একে শোনার আগ্রহ রাখত এবং গোপনে শুনত এবং তারাও কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ছুতা পেয়ে গেল।
দুররে মনসুরে ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছেÑ উল্লিখিত ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী ক্রয় করে এনে তাকে কুরআন শ্রবণ থেকে মানুষকে ফিরানোর কাজে নিয়োজিত করল। কেউ কুরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে বাঁদীকে আদেশ করত এবং বলত, মুহাম্মাদ তোমাদেরকে কুরআন শুনিয়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়ার কথা বলে। এতে কষ্ট আর কষ্ট। এসো, এ গানটি শোনো এবং উল্লাস করো।
মহাত্মা লোকমান এবং তার হিকমত : পবিত্র কুরআনের ৩১ নম্বর সূরা ‘সূরা লোকমান’। বর্ণিত লোকমান সম্পর্কে ইবনে কাসির বলেন, প্রাচীন ইসলামি মনীষীরা এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি নবী ছিলেন না। কেবল হজরত ইকরামা রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এর বর্ণনা সূত্র (সনদ) দুর্বল। ইমাম বাগাবির দাবিÑ এ কথা সর্বসম্মত যে, তিনি বিশিষ্ট ফকিহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন, নবী ছিলেন না। (মাজহারী)।
হজরত কাতাদাহ রা: থেকে বর্ণিতÑ মনীষী লোকমানকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি হিকমতকে (প্রজ্ঞা) নবুয়ত থেকে সমধিক গ্রহণযোগ্য কেন মনে করলেন, যখন আপনাকে যেকোনো একটা গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল? তিনি বললেন, নবুয়ত বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদ। কোনো কোনো রেয়ায়েতে আছে, তাঁকে নবুয়ত গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তিনি আরজ করলেন, ‘যদি আমার প্রতি এটা গ্রহণ করার নির্দেশ হয়ে থাকে তবে তা শিরোধার্য। অন্যথায় আমাকে ক্ষমা করুন।’ হজরত লোকমানের বহু জ্ঞানগর্ভ বাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ওয়াহাব বিন মুনাব্বেহ্ বলেন, আমি হজরত লোকমানের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দশ হাজারের চেয়েও বেশি অধ্যায় অধ্যয়ন করেছি (কুরতুবি)।
একদিন হজরত লোকমান এক বিরাট সমাবেশে উপস্থিত জনতাকে জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি বলল, আপনি এ মর্যাদা কিভাবে লাভ করলেন যে আল্লাহর গোটা সৃষ্টিকুল আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং আপনার বাণী শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোক এসে জমায়েত হয়? লোকমান বলেছিলেন, এমন কতকগুলো কাজ আছে যা আমাকে এ স্তরে উন্নীত করেছে। যদি তুমি তা গ্রহণ করো তবে তুমিও এ মর্যাদা ও স্থান লাভ করতে পারবে। সে কাজগুলো হলোÑ নিজের দৃষ্টি নি¤œমুখী রাখা এবং মুখ বন্ধ করা, হালাল জীবিকায় তুষ্ট থাকা, নিজের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করা, সত্য কথায় অটল থাকা, অঙ্গীকার পূর্ণ করা, মেহমানের আদর-আপ্যায়ন ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, প্রতিবেশীর প্রতি সর্বদা লক্ষ রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা পরিহার করা (ইবনে কাসির)। ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহের বর্ণনা অনুযায়ী, মহাত্মা লোকমান হজরত আইয়ুব আ:-এর ভাগ্নে ছিলেন। মুকাতেল তাঁর খালাতো ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। এক কৃষ্ণকায় হাবশি হজরত সাঈদ বিন মুসাইয়েবের খিদমতে কোনো মাসআলা জিজ্ঞেস করতে হাজির হন। হজরত সাঈদ তাকে সান্ত্বÍনা দিয়ে বললেন, তুমি কৃষ্ণকায় বলে দুঃখ কোরো না। কারণ কালো বর্ণধারীদের মধ্যে এমন তিনজন মহান ব্যক্তি আছেন, যারা মানবকুলে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিতÑ হজরত বেলাল, হজরত ওমর বিন খাত্তাব কর্তৃক মুক্ত গোলাম হজরত ‘মাহজা’ ও হজরত লোকমান আ:।
আবু ‘হাইয়্যান’ বলেছেন, হিকমত বলতে সেসব বাক্য সমষ্টিকে বোঝায়, যার দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে, তাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে এবং যা মানুষ সংরক্ষণ করে অপরের কাছে পৌঁছায়। ইবনে আব্বাস রা: বলেন, হিকমত হলো বিবেক, প্রজ্ঞা ও মেধা। হজরত লোকমানকে প্রদত্ত ‘হিকমত’ শব্দটি পবিত্র কুরআন করিমে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেÑ বিদ্যা, বিবেক, গাম্ভীর্য, নবুয়ত, মতের বিশুদ্ধতা।
সূরা লোকমানের ৮টি আয়াত : (১২) আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয় সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্য কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসতি। (১৩) যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল : হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শরিক করা মহা অন্যায়। (১৪) আর আমি মানুষকে তার বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।
(১৫) বাবা-মা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করব। (১৬) হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তরগর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূগর্ভে, তবে আল্লাহ তা-ও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন। (১৭) হে বৎস! নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজে আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। (১৮) অহঙ্কার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। (১৯) পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।
লোকমান আ: তাঁর ছেলেকে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, সেসব উপদেশ সন্তানদের দান করা পৃথিবীর সব মুসলমান বাবা-মায়ের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সন্তানদেরও এসব উপদেশ শিরোধার্য হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বিভিন্ন আঙ্গিকে ওপরের আয়াতগুলো বারবার বিধৃত করেছেন। যেমনÑ সূরা আর রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালার দৃপ্ত ঘোষণাÑ ‘হে জিন ও মানবকুল! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পারো তবে করো; কিন্তু ছাড়পত্র ছাড়া তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’
বর্তমান যুগে বেশির ভাগ যুবক-যুবতী অশ্লীল উপন্যাস, পেশাদার অপরাধীদের কাহিনী অথবা অশ্লীল কবিতা পাঠে অভ্যস্ত। অনুরূপভাবে পথভ্রষ্ট বাতিলপন্থীদের চিন্তাধারা অধ্যয়ন করা ও সর্বসাধারণের জন্য পথভ্রষ্টতার সম্ভাবনার কারণ বিধায় নাজায়েজ। তবে গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ জওয়াবদানের উদ্দেশ্যে এগুলো পাঠ করলে তাতে আপত্তি নেই বলে আলেমসমাজ একমত।
পবিত্র কুরআনের সূরা আর রুমের ৪১ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ওদের কোনো কর্মের শাস্তি ওদের আস্বাদন করানো হয়, যাতে ওরা সৎ পথে ফিরে আসে।’
তাফসিরে রুহুল মা’আনিতে বলা হয়েছে : ‘বিপর্যয় বলতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্যÑ সব কিছুতে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কমে যাওয়া এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়ার ইত্যাদি আপদ-বিপদ বোঝানো হয়েছে।’ পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদেরকে যেসব বিপদ-আপদ স্পর্শ করে সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে।’ কোনো কোনো আলেম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো গোনাহ করে, সে সারা বিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশুপক্ষীদের প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গোনাহর কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্য যেসব বিপদাপদ দুনিয়ায় আসে, তাতে সব প্রাণীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কিয়ামতের দিন এরা সবাই গোনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।
নব্বই ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষই আজ ভয়াবহ আতঙ্কে আক্রান্ত। ইসলামি দলগুলো এবং তাদের মেধাবী কর্মীদের ইতোমধ্যেই কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে- জেল-জুলুম ও গুম-হত্যা তাদের যেন নিয়তি। ‘জঙ্গিবাদী’, ‘মৌলবাদী’, ‘যুদ্ধাপরাধীর দল’ নানা তকমা ইতোমধ্যে এদের শরীরে এঁটে দেয়া হয়েছে। হাদিস, কুরআন, বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থকে ‘জেহাদি বই’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আলেম-ওলামা যারা ইসলামি পণ্ডিত, ইসলামের সত্যিকার দীক্ষা যাদের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করেÑ তারা যেন অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। দেশের এ চলমান অস্থিরতায় তাদের ভূমিকা রহস্যময় বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। লোকমান আ:-এর হিকমতের কার্যকরি অনুশীলন ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনার সহায়ক হতে পারে, আমার বিশ্বাস। আমাদের কৃতকর্মের ফলে সৃষ্ট এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে মহান রাব্বুল আলামিনের গায়েবি মদদ প্রার্থনা করছি। কৃতকর্মের জন্য তাঁর দরবারে মার্জনা ভিক্ষা করছি। আমিন! ছুম্মা আমিন।
No comments