সুশাসন ও শুদ্ধাচার কেন জরুরি? by মো: মতিউর রহমান
শুদ্ধাচারের ধারণাটি সুশাসনের (Good
governance) ধারণা থেকে উদ্গত। শুদ্ধাচার সুশাসনের পূর্বশর্ত। এরা একে
অপরের পরিপূরকও বটে। বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনাচারের ব্যাপক বিস্তৃতির
কারণে দাতা সংস্থা তথা উন্নয়ন সহযোগীরা সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার
বিষয়টিকে সাহায্য প্রদানের পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়। দাতা সংস্থা বা
দেশগুলো তিনটি বিষয়কে সুশাসনের জন্য অপরিহার্য মনে করে। এগুলো হলোÑ
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশিদারত্ব। এগুলোর অভাব সুশাসন এবং শুদ্ধাচার
প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়।
২. বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি ও দলীয়করণ পরিষেবা প্রাপ্তির পথে এক বিরাট অন্তরায়। এর সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার একটা মেলবন্ধন রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে শুদ্ধাচার উৎকটভাবে অনুপস্থিত। ফলে পরিষেবা প্রত্যাশীরা বিভিন্ন রকমের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আর সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাবে অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি এবং নির্মম শাসন-শোষণের শিকার হচ্ছেন জনগণ আর রাজনীতিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন বিরোধী দল বা জোট।
৩. তথ্য অধিকার আইন থাকা সত্ত্বেও তথ্য প্রকাশ কিংবা শেয়ার করার মানসিকতা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় একদম নেই। কেননা এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং দুরাচার উন্মোচিত হওয়ার আশঙ্কা অতি প্রবল। এক কথায় বলতে গেলে দুর্নীতি ও দুরাচার স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে এক বিরাট বাধা। শুধু উন্মুক্ত অর্থনীতি হলেই হবে না, সর্বক্ষেত্রে উন্মুক্ত নীতিরও চর্চা থাকতে হবে। এ জন্য দুর্নীতি নির্মূলকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আগ্রাসী ভূমিকা কাম্য।
৪. আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার চর্চা তো দূরের কথা, চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও হয়রানি। আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে কিংবা ইচ্ছামাফিক এগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংশোধন করে ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করাই আচার হয়ে গেছে। কোথাও কোনো সিস্টেম কাজ করছে না। অথচ সুশাসনের জন্য প্রয়োজন উত্তম আইনের শাসন এবং সিস্টেমের কঠোর অনুশীলন। অ্যারিস্টটল বলেছেনÑ Rule by the best law is preferable to the rule by the best men. দুর্নীতির ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্ফন ঘটায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। অতএব ঊর্ধ্বতন সোপানে অধিষ্ঠিতদের সততা ও জবাবদিতিহার নজির সৃষ্টি করতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে থেকে। কেননা রাজনৈতিক নেতৃত্বেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে।
৫. গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশিদারিত্ব সুশাসন তথা শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য শর্ত। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় তদবিরের ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর ফলে সম্পদের অপচয় হয়। অথচ এসব প্রকল্প বাদ দিলে বা ছাঁটাই করলে সম্পদের সাশ্রয় হয় যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নে ব্যয় করে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো যায়। আমাদের সংবিধানে ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক প্রত্যেক একাংশে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলা পরিষদগুলোয় প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আর প্রশাসকেরা সরকারি দলের লোক বিধায় প্রকল্প গ্রহণ, যত্রতত্র অনুদান প্রদান এবং গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করছেন। তাদের জবাবদিহিতার অভাবে জেলা পরিষদের সীমিত সম্পদের অপচয় ও অপব্যয় ঘটছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটো চলছে বছরের পর বছর ধরে আমলাদের মাধ্যমে, যাদেরও জবাবদিহিতার বালাই নেই। ফলে পৌরবাসী কাক্সিত নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদগুলোয় নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলেও এমপি ও সরকারি দলের লোকদের অযাচিত হস্তক্ষেপে এগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
৬. সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা ও সততার চর্চা। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছায় কাজ করার প্রবৃত্তি নেই। সুপারভিশন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ঘুষের মহোৎসব চলছে। ঘুষ ছাড়া জনসাধারণের পক্ষে সেবাপ্রাপ্তি অসম্ভব। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করার প্রয়াস নিলে কিছুটা ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে দলীয় আনুগত্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ কাজ করতে পারছে না বা করছে না। বিরোধী দল বা জোটের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যত তৎপর, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগে মোটেও নয়। ফলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে এবং তারা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে জ্ঞান করে। এহেন অবস্থা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
৭. জনসেবার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন একশ্রেণীর রাজনীতিক। তাদের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। তাদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচকতা, লোভ ও আত্মস্বার্থসর্বস্বতা কাজ করছে। তারা 'Winner takes all' অর্থাৎ বাজিমাত নীতি দ্বারা পরিচালিত। এসব কারণে সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত। আর সুশাসন ও শুদ্ধাচারের অভাবের বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ। সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় অংশীদারিত্বমূলক ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। আর শাসন-প্রশাসনে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার বিভাজন ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
৮. অতএব, রাজনীতিবিদরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে আশু প্রাপ্তির কথা না ভেবে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাষ্ট্রনায়কসুলভ আচরণ করবেন এবং কল্যাণবোধে উদ্বুদ্ধ হবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা। এতে ব্যক্তিবিশেষের সাময়িক ক্ষতি হলেও দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে রাজনীতিবিদেরা ডিভিডেন্ড পাবেন এবং সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হবে। আর শুধু মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশে পরিণত হওয়াই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া কাম্য নয়, এর সুফল সমভাবে বণ্টন ও ভোগ করতেও সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। এ জন্য রাজনীতিবিদদের (সরকার ও বিরোধী দলগুলো) মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নীতি সংলাপ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য ক্ষমতাসীনদেরই উদ্যোগ নিতে হবে এবং এ লক্ষ্যে তাদের ওপর সুশীলসমাজ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ অংশীজনদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব
২. বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি ও দলীয়করণ পরিষেবা প্রাপ্তির পথে এক বিরাট অন্তরায়। এর সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার একটা মেলবন্ধন রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে শুদ্ধাচার উৎকটভাবে অনুপস্থিত। ফলে পরিষেবা প্রত্যাশীরা বিভিন্ন রকমের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আর সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাবে অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি এবং নির্মম শাসন-শোষণের শিকার হচ্ছেন জনগণ আর রাজনীতিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন বিরোধী দল বা জোট।
৩. তথ্য অধিকার আইন থাকা সত্ত্বেও তথ্য প্রকাশ কিংবা শেয়ার করার মানসিকতা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় একদম নেই। কেননা এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং দুরাচার উন্মোচিত হওয়ার আশঙ্কা অতি প্রবল। এক কথায় বলতে গেলে দুর্নীতি ও দুরাচার স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে এক বিরাট বাধা। শুধু উন্মুক্ত অর্থনীতি হলেই হবে না, সর্বক্ষেত্রে উন্মুক্ত নীতিরও চর্চা থাকতে হবে। এ জন্য দুর্নীতি নির্মূলকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আগ্রাসী ভূমিকা কাম্য।
৪. আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার চর্চা তো দূরের কথা, চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও হয়রানি। আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে কিংবা ইচ্ছামাফিক এগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংশোধন করে ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করাই আচার হয়ে গেছে। কোথাও কোনো সিস্টেম কাজ করছে না। অথচ সুশাসনের জন্য প্রয়োজন উত্তম আইনের শাসন এবং সিস্টেমের কঠোর অনুশীলন। অ্যারিস্টটল বলেছেনÑ Rule by the best law is preferable to the rule by the best men. দুর্নীতির ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্ফন ঘটায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। অতএব ঊর্ধ্বতন সোপানে অধিষ্ঠিতদের সততা ও জবাবদিতিহার নজির সৃষ্টি করতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে থেকে। কেননা রাজনৈতিক নেতৃত্বেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে।
৫. গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশিদারিত্ব সুশাসন তথা শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য শর্ত। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় তদবিরের ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর ফলে সম্পদের অপচয় হয়। অথচ এসব প্রকল্প বাদ দিলে বা ছাঁটাই করলে সম্পদের সাশ্রয় হয় যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নে ব্যয় করে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো যায়। আমাদের সংবিধানে ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক প্রত্যেক একাংশে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলা পরিষদগুলোয় প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আর প্রশাসকেরা সরকারি দলের লোক বিধায় প্রকল্প গ্রহণ, যত্রতত্র অনুদান প্রদান এবং গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করছেন। তাদের জবাবদিহিতার অভাবে জেলা পরিষদের সীমিত সম্পদের অপচয় ও অপব্যয় ঘটছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটো চলছে বছরের পর বছর ধরে আমলাদের মাধ্যমে, যাদেরও জবাবদিহিতার বালাই নেই। ফলে পৌরবাসী কাক্সিত নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদগুলোয় নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলেও এমপি ও সরকারি দলের লোকদের অযাচিত হস্তক্ষেপে এগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
৬. সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা ও সততার চর্চা। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছায় কাজ করার প্রবৃত্তি নেই। সুপারভিশন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ঘুষের মহোৎসব চলছে। ঘুষ ছাড়া জনসাধারণের পক্ষে সেবাপ্রাপ্তি অসম্ভব। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করার প্রয়াস নিলে কিছুটা ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে দলীয় আনুগত্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ কাজ করতে পারছে না বা করছে না। বিরোধী দল বা জোটের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যত তৎপর, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগে মোটেও নয়। ফলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে এবং তারা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে জ্ঞান করে। এহেন অবস্থা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
৭. জনসেবার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন একশ্রেণীর রাজনীতিক। তাদের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। তাদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচকতা, লোভ ও আত্মস্বার্থসর্বস্বতা কাজ করছে। তারা 'Winner takes all' অর্থাৎ বাজিমাত নীতি দ্বারা পরিচালিত। এসব কারণে সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত। আর সুশাসন ও শুদ্ধাচারের অভাবের বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ। সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় অংশীদারিত্বমূলক ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। আর শাসন-প্রশাসনে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার বিভাজন ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
৮. অতএব, রাজনীতিবিদরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে আশু প্রাপ্তির কথা না ভেবে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাষ্ট্রনায়কসুলভ আচরণ করবেন এবং কল্যাণবোধে উদ্বুদ্ধ হবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা। এতে ব্যক্তিবিশেষের সাময়িক ক্ষতি হলেও দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে রাজনীতিবিদেরা ডিভিডেন্ড পাবেন এবং সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হবে। আর শুধু মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশে পরিণত হওয়াই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া কাম্য নয়, এর সুফল সমভাবে বণ্টন ও ভোগ করতেও সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। এ জন্য রাজনীতিবিদদের (সরকার ও বিরোধী দলগুলো) মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নীতি সংলাপ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য ক্ষমতাসীনদেরই উদ্যোগ নিতে হবে এবং এ লক্ষ্যে তাদের ওপর সুশীলসমাজ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ অংশীজনদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব
No comments