ইরান ও ৬ জাতির আলোচনার ভবিষ্যৎ by মহীউদ্দীন আহমদ
হোয়াইট
হাউজকে উপেক্ষা করে মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার রিপাবলিকান নেতা জন বেহনার
আমন্ত্রণে কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে ইরানের পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ হওয়ার পথ সুগম
করার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করলেন ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী
নেতানিয়াহু। বহুল আলোচিত এ ভাষণে তিনি অভিযোগ করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি
নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনাধীন চুক্তিটি এ পথ বন্ধের বদলে তা বরং সুগম
করবে। নেতানিয়াহু ইরানকে সারা বিশ্বের জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করেন।
তিনি তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন, পাঁচ বছরের মধ্যেই ইরান ১০০টি পারমাণবিক
বোমা তৈরিতে সক্ষম। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বিষোদগার নতুন
কোনো বিষয় নয়। তিনি তো হরহামেশাই এমনটা বলে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা
কংগ্রেসে দেয়া নেতানিয়াহুর ভাষণকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তার ভাষণে নতুন
কিছু নেই। তিনি এমন চুক্তির বিকল্প কোনো টেকসই উপায় বাতলে দিতে পারেননি।
ইরানকে একটা বিকল্প পথ না দিয়ে কেবল অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয় বলে
মন্তব্য করেন ওবামা।
এ দিকে ইরানের পরমাণু সঙ্কট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তি যখন চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নেতানিয়াহুর কংগ্রেসে ভাষণের পর ৪৭ জন রিপাবলিকান সিনেটর এক খোলা চিঠিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নতুন বিতর্কের সূচনা করেছেন। রিপাবলিকান সিনেটরদের চিঠিতে এরা বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেস অনুমোদন না করলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি বেশি দিন টিকবে না। ইরানের নেতাদের উদ্দেশে ওই খোলা চিঠিতে সিনেটর টম কটনসহ অন্য ৪৬ জন সিনেটর বলেছেন, ‘কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে তা হবে কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির মধ্যে একটি সমঝোতা মাত্র। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ধরনের একটি নির্বাহী চুক্তিকে এক কলমের খোঁচায় বাতিল করে দিতে পারেন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কংগ্রেস চুক্তির যেকোনো শর্তকে পরিবর্তন করতে পারবে।’ রিপাবলিকানদের খোলাচিঠিকে ব্যঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই চিঠির বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কংগ্রেসের কিছু সদস্য ইরানের কট্টরপন্থীদের সাথে কাজের সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছেন। এটা দেখতে বেশ হাস্যকর লাগছে। এটা এক অস্বাভাবিক মিত্রতা।’ ওবামা চলমান পারমাণবিক ইস্যুতে কংগ্রেসে সদস্যদের ভূমিকাকে ‘অনধিকার চর্চা’ বলে অভিহিত করছেন।
ইরানের পারমাণবিক ইস্যু চুক্তির বিষয়টি কংগ্রেসের অনুমোদন নেয়ার পক্ষে রিপাবলিকান সিনেটরদের পাশাপাশি বেশ কিছু ডেমোক্র্যাট সদস্যও সক্রিয় রয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউজ বলে আসছে, এ ধরনের চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের অনুমোদনের কোনো আবশ্যকতা নেই। আইন প্রণেতাদের এই উদ্যোগের ফলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছয় জাতি চুক্তি হুমকির মধ্যে পড়বে কি না, এ প্রশ্ন এখন নতুন করে উঠে এলো। নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট এই জট খুলতে সক্ষম হবেন কি প্রেসিডেন্ট ওবামা?
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ এই সফর নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। হোয়াইট হাউজ এবং ডেমোক্র্যাট দলের আইন প্রণেতাদের সাথে পরামর্শ না করেই নেতানিয়াহুকে কংগ্রেসে ভাষণ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার জন বেহনার। এই মুহূর্তে এভাবে কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর ভাষণ দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সম্পর্কের জন্য ‘ধ্বংসাত্মক’ হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল হোয়াইট হাউজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগে থেকেই নেতানিয়াহুর এই সফরের বিরোধিতা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। কারণ হিসেবে বলা হয়, মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচন, যেখানে নেতানিয়াহুও একজন প্রার্থী। এতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ সময় তার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ ইসরাইলি নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে এবং একটা রাজনৈতিক বার্তা দেবে। তা ছাড়া কংগ্রেস সদস্যদের অনেকেই বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কোনো বিদেশী নেতা মূল্যায়ন করবে, এটা তারা দেখতে চান না। ইরান বিষয়ে নেতানিয়াহুর কঠোর মনোভাব তার নিজ নির্বাচনী বৈতরণী পার করার কৌশল বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই নেতার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। বিষয়টি গোপনও নয়, নিকট অতীতেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার মন্তব্য ছিলÑ ‘আমাকে প্রতিদিনই তো তাকে সমালাতে হবে।’ ওবামা প্রশাসনের এ মনোভাব আরো সুস্পষ্ট হয় গত বছরের অক্টোবরে। ওই সময় একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা নেতানিয়াহুকে ‘মুরগির বিষ্ঠা’ বা চিকেন শিট বলে মন্তব্য করেন। নেতানিয়াহুর সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং কংগ্রেসে ভাষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দ্বিদলীয় তিক্ততা সৃষ্টির পাশাপাশি ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে ঠেকেছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ জাতি জি ফাইভ নামে পরাশক্তিদের আন্তর্জাতিক জোটের নমনীয় মনোভাবের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থান বোধগম্য। ইসরাইল চায় কোনো প্রকারে ইরানের সাথে সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতে। ইরানকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করার ইসরাইলি প্রচেষ্টা অতি পুরনো। এরা এভাবে নিজেদের মানবতা বিধ্বংসী ও যুদ্ধাপরাধী কার্যকলাপকে আড়াল করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ইরান নিয়ে নেতানিয়াহুর কঠোর মনোভাব দৃশ্যত ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদ, জোরজবরদস্তি ও জুলুমকে আড়াল করার কৌশল মাত্র। এ দিকে নেতানিয়াহুর সফর নিয়ে ইসরাইলে বিতর্ক রয়েছে। ইউএস টুডে পত্রিকার খবরে বলা হয়, খোদ ইসরাইলের অনেক মানুষই নেতানিয়াহুর এ সফর নিয়ে নাখোশ। অনেক ইসরাইলি মনে করেন, নেতানিয়াহুর সফর বিশ্বে তাদের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান মেইর দাগান অভিযোগ করে বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থানের কারণে ‘ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে।’ তিনি নেতানিয়াহুকে ভোট না দিতে ইসরাইলি জনগণকে আহ্বান জানান।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বশেষ জেনেভা সম্মেলনে সংবেদনশীল পারমাণবিক ইস্যুতে উভয়পক্ষ একটি কৌশল নির্ধারণে সক্ষম হয়েছে, যা বিশ্বশান্তির জন্য আশাব্যঞ্জক। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, উভয়পক্ষ ৩১ মার্চের মধ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তিতে উপনীত হবে। এরপর জুন ২০১৫ সালের মধ্যে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এর আগে জেনেভা আলোচনায় ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিল উভয়পক্ষ। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনার আলোকে তেহরান ১০ বছর পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে পরাশক্তিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধি। আলোচিত চুক্তির আলোকে তেহরান আগামী ১০ বছরে পারমাণবিক বোমা তৈরির উপাদান ইউরেনিয়াম মজুদে সক্ষম হবে না। ওই সময়ের পর দেশটি আবারো ধীরে ধীরে তার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারবে। চূড়ান্ত চুক্তিতে ইরান কত মাত্রা পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তার অর্থ হলো, একটি মাত্র পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাইলেও ইরানকে যথেষ্ট পরিমাণে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করতে বেগ পেতে হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বরাবর ২০ বছরের সময়সীমা নির্ধারণে জোর দিয়ে আসছিল; যদিও ইরান ১০ বছরের বেশি সময়সীমা নির্ধারণে রাজি ছিল না।
এ দিকে, ইরানের ওপর থেকে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ পুরোপুরি তুলে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। পাশাপাশি তিনি নিশ্চিত করেছেন পরমাণু চুক্তি হলে সব বাধ্যবাধকতা মেনে চলবে ইরান। ইরানি নেতা বলেন, পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছানোর মূল ভিত্তি হবে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও পারস্পরিক আস্থা। বাস্তবতা হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানি জনগণ। একমুখী ও একপেশে অর্থনৈতিক অবরোধে শুধু ইরান নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিও। অথচ পশ্চিমারা বিশ্বশান্তির দুশমন এবং ফিলিস্তিন ভূমির অবৈধ দখলদার ইসরাইলের ওপর কোনো ধরনের অবরোধ আরোপ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়ে আসছে এরা। ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল এবং গাজায় বারবার হামলা করে নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় নির্বিকার। এরা শুধু ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যস্ত। প্রকারান্তরে এরা ইসরাইলের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের পথ চিরতরে রুখে দিতে চায়।
ইরানের সাথে ছয় বিশ্বশক্তির আলোচনাকে হুমকির মধ্যে রাখতে চায় ইসরাইলপন্থীরা। কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে যত বিলম্ব হবে ততই সফল হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের কট্টরপন্থী একটি লবি। ওবামা প্রশাসনের একটি পক্ষের জোরালো মতামত হলো, কংগ্রেসে নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি হলে এত দিনের সফলতা হুমকির মধ্যে পড়বে। ফলে ইরান বর্তমান অবস্থান থেকে সরে আসবে। ওবামা প্রশাসন ইসরাইলের সুরে সুর মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘর্ষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে রাজি হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। কূটনৈতিকপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক সঙ্কট নিরসনে গুরুত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্রÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ইরানের বর্তমান নেতৃত্বও পারমাণবিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। তারা আলোচনায় আন্তরিক। পরমাণু চুক্তি হলে ইরান তার বাধ্যবাধকতা মেনে চলার ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং উত্তেজনা সৃষ্টি নয়, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এখন আন্তরিকতার প্রমাণ রাখতে হবে।
এ দিকে ইরানের পরমাণু সঙ্কট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তি যখন চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নেতানিয়াহুর কংগ্রেসে ভাষণের পর ৪৭ জন রিপাবলিকান সিনেটর এক খোলা চিঠিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নতুন বিতর্কের সূচনা করেছেন। রিপাবলিকান সিনেটরদের চিঠিতে এরা বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেস অনুমোদন না করলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি বেশি দিন টিকবে না। ইরানের নেতাদের উদ্দেশে ওই খোলা চিঠিতে সিনেটর টম কটনসহ অন্য ৪৬ জন সিনেটর বলেছেন, ‘কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে তা হবে কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির মধ্যে একটি সমঝোতা মাত্র। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ধরনের একটি নির্বাহী চুক্তিকে এক কলমের খোঁচায় বাতিল করে দিতে পারেন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কংগ্রেস চুক্তির যেকোনো শর্তকে পরিবর্তন করতে পারবে।’ রিপাবলিকানদের খোলাচিঠিকে ব্যঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই চিঠির বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কংগ্রেসের কিছু সদস্য ইরানের কট্টরপন্থীদের সাথে কাজের সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছেন। এটা দেখতে বেশ হাস্যকর লাগছে। এটা এক অস্বাভাবিক মিত্রতা।’ ওবামা চলমান পারমাণবিক ইস্যুতে কংগ্রেসে সদস্যদের ভূমিকাকে ‘অনধিকার চর্চা’ বলে অভিহিত করছেন।
ইরানের পারমাণবিক ইস্যু চুক্তির বিষয়টি কংগ্রেসের অনুমোদন নেয়ার পক্ষে রিপাবলিকান সিনেটরদের পাশাপাশি বেশ কিছু ডেমোক্র্যাট সদস্যও সক্রিয় রয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউজ বলে আসছে, এ ধরনের চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের অনুমোদনের কোনো আবশ্যকতা নেই। আইন প্রণেতাদের এই উদ্যোগের ফলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছয় জাতি চুক্তি হুমকির মধ্যে পড়বে কি না, এ প্রশ্ন এখন নতুন করে উঠে এলো। নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট এই জট খুলতে সক্ষম হবেন কি প্রেসিডেন্ট ওবামা?
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ এই সফর নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। হোয়াইট হাউজ এবং ডেমোক্র্যাট দলের আইন প্রণেতাদের সাথে পরামর্শ না করেই নেতানিয়াহুকে কংগ্রেসে ভাষণ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার জন বেহনার। এই মুহূর্তে এভাবে কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর ভাষণ দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সম্পর্কের জন্য ‘ধ্বংসাত্মক’ হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল হোয়াইট হাউজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগে থেকেই নেতানিয়াহুর এই সফরের বিরোধিতা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। কারণ হিসেবে বলা হয়, মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচন, যেখানে নেতানিয়াহুও একজন প্রার্থী। এতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ সময় তার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ ইসরাইলি নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে এবং একটা রাজনৈতিক বার্তা দেবে। তা ছাড়া কংগ্রেস সদস্যদের অনেকেই বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কোনো বিদেশী নেতা মূল্যায়ন করবে, এটা তারা দেখতে চান না। ইরান বিষয়ে নেতানিয়াহুর কঠোর মনোভাব তার নিজ নির্বাচনী বৈতরণী পার করার কৌশল বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই নেতার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। বিষয়টি গোপনও নয়, নিকট অতীতেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার মন্তব্য ছিলÑ ‘আমাকে প্রতিদিনই তো তাকে সমালাতে হবে।’ ওবামা প্রশাসনের এ মনোভাব আরো সুস্পষ্ট হয় গত বছরের অক্টোবরে। ওই সময় একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা নেতানিয়াহুকে ‘মুরগির বিষ্ঠা’ বা চিকেন শিট বলে মন্তব্য করেন। নেতানিয়াহুর সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং কংগ্রেসে ভাষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দ্বিদলীয় তিক্ততা সৃষ্টির পাশাপাশি ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে ঠেকেছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ জাতি জি ফাইভ নামে পরাশক্তিদের আন্তর্জাতিক জোটের নমনীয় মনোভাবের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থান বোধগম্য। ইসরাইল চায় কোনো প্রকারে ইরানের সাথে সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতে। ইরানকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করার ইসরাইলি প্রচেষ্টা অতি পুরনো। এরা এভাবে নিজেদের মানবতা বিধ্বংসী ও যুদ্ধাপরাধী কার্যকলাপকে আড়াল করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ইরান নিয়ে নেতানিয়াহুর কঠোর মনোভাব দৃশ্যত ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদ, জোরজবরদস্তি ও জুলুমকে আড়াল করার কৌশল মাত্র। এ দিকে নেতানিয়াহুর সফর নিয়ে ইসরাইলে বিতর্ক রয়েছে। ইউএস টুডে পত্রিকার খবরে বলা হয়, খোদ ইসরাইলের অনেক মানুষই নেতানিয়াহুর এ সফর নিয়ে নাখোশ। অনেক ইসরাইলি মনে করেন, নেতানিয়াহুর সফর বিশ্বে তাদের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান মেইর দাগান অভিযোগ করে বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থানের কারণে ‘ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে।’ তিনি নেতানিয়াহুকে ভোট না দিতে ইসরাইলি জনগণকে আহ্বান জানান।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বশেষ জেনেভা সম্মেলনে সংবেদনশীল পারমাণবিক ইস্যুতে উভয়পক্ষ একটি কৌশল নির্ধারণে সক্ষম হয়েছে, যা বিশ্বশান্তির জন্য আশাব্যঞ্জক। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, উভয়পক্ষ ৩১ মার্চের মধ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তিতে উপনীত হবে। এরপর জুন ২০১৫ সালের মধ্যে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এর আগে জেনেভা আলোচনায় ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিল উভয়পক্ষ। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনার আলোকে তেহরান ১০ বছর পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে পরাশক্তিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধি। আলোচিত চুক্তির আলোকে তেহরান আগামী ১০ বছরে পারমাণবিক বোমা তৈরির উপাদান ইউরেনিয়াম মজুদে সক্ষম হবে না। ওই সময়ের পর দেশটি আবারো ধীরে ধীরে তার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারবে। চূড়ান্ত চুক্তিতে ইরান কত মাত্রা পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তার অর্থ হলো, একটি মাত্র পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাইলেও ইরানকে যথেষ্ট পরিমাণে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করতে বেগ পেতে হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বরাবর ২০ বছরের সময়সীমা নির্ধারণে জোর দিয়ে আসছিল; যদিও ইরান ১০ বছরের বেশি সময়সীমা নির্ধারণে রাজি ছিল না।
এ দিকে, ইরানের ওপর থেকে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ পুরোপুরি তুলে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। পাশাপাশি তিনি নিশ্চিত করেছেন পরমাণু চুক্তি হলে সব বাধ্যবাধকতা মেনে চলবে ইরান। ইরানি নেতা বলেন, পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছানোর মূল ভিত্তি হবে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও পারস্পরিক আস্থা। বাস্তবতা হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানি জনগণ। একমুখী ও একপেশে অর্থনৈতিক অবরোধে শুধু ইরান নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিও। অথচ পশ্চিমারা বিশ্বশান্তির দুশমন এবং ফিলিস্তিন ভূমির অবৈধ দখলদার ইসরাইলের ওপর কোনো ধরনের অবরোধ আরোপ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়ে আসছে এরা। ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল এবং গাজায় বারবার হামলা করে নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় নির্বিকার। এরা শুধু ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যস্ত। প্রকারান্তরে এরা ইসরাইলের দখলদারিত্ব মেনে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের পথ চিরতরে রুখে দিতে চায়।
ইরানের সাথে ছয় বিশ্বশক্তির আলোচনাকে হুমকির মধ্যে রাখতে চায় ইসরাইলপন্থীরা। কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে যত বিলম্ব হবে ততই সফল হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের কট্টরপন্থী একটি লবি। ওবামা প্রশাসনের একটি পক্ষের জোরালো মতামত হলো, কংগ্রেসে নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি হলে এত দিনের সফলতা হুমকির মধ্যে পড়বে। ফলে ইরান বর্তমান অবস্থান থেকে সরে আসবে। ওবামা প্রশাসন ইসরাইলের সুরে সুর মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘর্ষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে রাজি হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। কূটনৈতিকপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক সঙ্কট নিরসনে গুরুত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্রÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ইরানের বর্তমান নেতৃত্বও পারমাণবিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। তারা আলোচনায় আন্তরিক। পরমাণু চুক্তি হলে ইরান তার বাধ্যবাধকতা মেনে চলার ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং উত্তেজনা সৃষ্টি নয়, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এখন আন্তরিকতার প্রমাণ রাখতে হবে।
No comments