নাগাল্যান্ডের ফরিদ খান : টার্গেটকিলিংয়ের নির্মম শিকার by জি. মুনীর
নাগাল্যান্ডে বাংলাভাষী ইস্যুতে গাত্রদাহ |
ডিমাপুর
শহর। এটি ভারতীয়দের কাছে নাগাল্যান্ডের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত।
নাগাল্যান্ড হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। শহরটি তেমন কোনো বড় শহর
নয়। তবে গত ৫ মার্চ ২০১৫ এই শহরে যে এক ভয়াবহ অমানবিক ঘটনা ঘটে গেল, তা
গোটা বিশ্বের বিবেকি মানুষকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে। সেই সাথে প্রতিটি
বিবেকবান মানুষের প্রশ্ন জেগেছেÑ আধুনিক যুগের এই ভারতে কী করে দিনে দুপুরে
সবার চোখের সামনে এ ধরনের একটি অমানবিক ঘটনা ঘটতে পারল, যেখানে সরকারের সব
মহলকে পালন করতে দেখা গেছে নীরব দর্শকের ভূমিকা, কিংবা বলা যায় এ ধরনের
ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন মহলের ছিল মৌন সম্মতি। এ ঘটনার শিকার সৈয়দ ফরিদ খান
ওরফে শরিফ খান নামে এক ভারতীয় যুবক। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ধর্ষণের
সাজানো অভিযোগ। সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হাজার দশেক উচ্ছৃঙ্খল মানুষ
বিক্ষোভ মিছিল করে কারাগারে গিয়ে ফটক ভেঙে তাকে বের করে এনে উলঙ্গ করে
রাস্তায় ঘুরিয়ে এরপর প্রথমে পিটিয়ে ও পরে মোটরসাইকেলের পেছনে দড়ি দিয়ে
বেঁধে রাস্তার ওপর দিয়ে ছেঁছড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরও পর তার
প্রাণহীন দেহ শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি কক টাওয়ারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। একমাত্র
তখন পুলিশ এসে তাদের এ কাজে বাধা দেয়। বলা যায়, একমাত্র এটাই হচ্ছে এ
ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের একমাত্র সাফল্য।
ভারতের ‘সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি’ এই মর্মান্তিক পরিকল্পিত হত্যা ঘটনায় তাদের মর্মাহত হওয়ার কথা প্রকাশ করেছে। তাদের অভিমত, এ ধরনের অমানবিক ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা তাদের নেই। মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণার মাত্রা যে কী মাত্রায় পশুত্বের পর্যায়ে নামাতে পারে, এ ঘটনা এরই এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ ও উদাহরণ। হয়তো অনেকেই বলতে পারেন, সমাজে যেভাবে ধর্ষণের ছড়াছড়ি, তাতে করে অভিযুক্ত ফরিদ খান তার উপযুক্ত সাজাই পেয়েছে। প্রতিটি ধর্ষকের বেলায় এমনটিই হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলে আইন আদালত থাকার দরকারটা কী? এ ছাড়া ফরিদ খানের ঘটনাটি তলিয়ে দেখলে এ ঘটনার এত সহজ সমীকরণ সম্ভব নয়।
সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি এ ব্যাপারে স্পষ্টতই বলতে চায়, এটি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত খুন। পরিকল্পিত এক গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। আর এর পেছনে রয়েছে একটি মুসলিমবিরোধী প্রাইভেট গ্যাং। একই সাথে এতে সমর্থন রয়েছে রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদেরও। গোটা ঘটনাপর্বটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলে বহুল আলোচিত-সমালোচিত গুজরাট জেনোসাইডের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের সহজ শিকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল গুজরাটের মুসলমানেরা। দেখা যাবে, ডিমাপুরের ঘটনায় জড়িত রয়েছে একই ধরনের মুসলিমবিরোধী শক্তি, আর এতে সমর্থন জুগিয়েছে নাগাল্যান্ড রাজ্য সরকার। তা না হলে কী করে ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো একটি সুরক্ষিত কারাগার থেকে বিচারাধীন একজন অভিযুক্তকে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা বের করে নিয়ে এসে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা নানা নির্যাতনের ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে এভাবে নির্মমভাবে প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করতে পারে? এ ঘটনা প্রমাণ করে ভারতীয় মুসলমানেরা সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও নিরাপদ নয়।
ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ডিমাপুরের এই ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি চলছে এ ঘটনার নানামুখী বিশ্লেষণ। ঘটনার বিবরণে প্রকাশÑ ৩০ বছরের মতো বয়েসী বাংলা ভাষাভাষী সৈয়দ ফরিদ খান ওরফে সৈয়দ শরিফ খান ভারতের আসাম রাজ্যের করিমপুর জেলার মূল অধিবাসী। কিন্তু বর্তমানে তিনি বসবাস করছিলেন নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর শহরে। সেখানে তিনি পুরনো ভাঙাগাড়ির ব্যবসায় করতেন। ব্যবসায় ভালোই চলছিল। চার বছর আগে তিনি বিয়ে করেন এক নাগা মহিলাকে। সেখানে এরা সুখেই সংসার করছিলেন। তাদের রয়েছে তিন বছরের একটি কন্যাসন্তান। ফরিদ খানের ছোট ভাই নাসিরুদ্দিন তার সাথেই বসবাস করতেন। বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার কারণে ফরিদ খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্ট বলে অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা এ দাবির অসারতাই প্রমাণ করে। তার বাবা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে চাকরি করেছেন ২০ বছর। তার দুই ভাই এখনো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত। তার এক ভাই ১৯৯৯ সালে নিহত হন কারগিল যুদ্ধে, ভারতের বাহিনীর হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ফরিদ খান তার স্ত্রীর এক জ্ঞাতিবোন ও এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে স্থানীয় একটি হোটেলে যান একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। পরদিন পুলিশ তার বাসায় এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। বলা হয়, তার স্ত্রীর ওই জ্ঞাতিবোন তার বিরুদ্ধে থানায় একটি ধর্ষণ মামলার এফআইআর দাখিল করেছে। জানা গেল, পরদিন এই মহিলা ফরিদ খানের স্ত্রীর কাছে গিয়ে তার কাছে দুই লাখ রুপি দাবি করে। এ পরিমাণ অর্থ তাকে দেয়া হলে তিনি এই ধর্ষণ মামলা তুলে নেবেন বলে জানান। ফরিদ খানের স্ত্রী এ অর্থ তাকে দিতে অস্বীকার করেন। অপর দিকে ফরিদ খানকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তাকে পাঠানো হয় ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি এই কারাগারের হেফাজতেই ছিলেন। তাকে গ্রেফতার ও কারাগারে আটক রাখার খবর স্থানীয় একটি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় ঘটনার এক সপ্তাহ পর। এ ছাড়া এ ব্যাপারে উসকানিমূলক খবর ছড়িয়ে দেয়া হয় ফেসবুকে।
গত ৪ মার্চে নাগাল্যান্ডের একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে অভিযুক্ত ফরিদ খানকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানায়। ৫ জানুয়ারি এক হিসাবে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার, অন্য হিসাবে ১০ হাজার উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিক্ষোভ মিছিল করে ডিমাপুর কারাগারে যায়। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে প্রচুর নারী ও শিশুও ছিল। এরা কড়া নিরাপত্তায় থাকা কারাগারের ফটক ভেঙে ফরিদ খানকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে রাস্তায়। এর পর তার জামা-কাপড় টেনে খুলে উলঙ্গ করে মারধর শুরু করে। এ সময় তার ওপর পাথরও ছোড়া হয়। এরপর তার দেহ নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তাকে দড়ি দিয়ে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে ডিমাপুর শহরের কেন্দ্রস্থলের রাস্তায় ছেঁছড়িয়ে মারা হয়। এরও পর তার লাশ প্রদর্শনের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি কক টাওয়ারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উল্লেখ্য, ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারটি সিআরপিএফ সিকিউরিটির আওতাধীন একটি কারাগার। এ ধরনের নিরাপত্তাধীন কারাগার থেকে একজন বন্দীকে জেল থেকে জনতা বের করে নিয়ে গেল, অথচ কারারক্ষীরা ন্যূনতম ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিলো নাÑ বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর ও রহস্যজনক।
ডিমাপুরের এসপি বলেছেন, ধর্ষণের এ অভিযোগটি ছিল মিথ্যা। আসলে মেয়েটি এর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করার প্রয়াস চালিয়েছিল। অবশ্য এই এসপিকে পরে বরখাস্ত করা হয়। মেডিক্যাল রিপোর্টেও ধর্ষণের কোনো প্রমাণ মেলেনি। তা ছাড়া হোটেলের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্যেও ওই মেয়েটির সাথে ফরিদ খানের কোনো অস্বাভাবিক আচরণের কোনো দৃশ্যও ধরা পড়েনি। সব মিলিয়ে গোটা ধর্ষণের অভিযোগটি যে ছিল সাজানো, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ফরিদ খানের জীবনে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। তার পরিবারের জন্য যে ক্ষতি হওয়ার তা-ও হয়ে গেছে।
উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে কারাগারে গেল। সেখানে এরা পূর্বপরিকল্পনামতে শুধু ওই ফরিদ খানকেই টার্গেটে পরিণত করল। এর কারণ দুটো। প্রথম কারণ তিনি ছিলেন মুসলমান। দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। যার ফলে তাকে বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর সহজ সুযোগ এরা হাতের কাছে পেয়ে যায়। তাই উদ্দেশ্যমূলক তাকে পরিচিত করে তোলা হয় অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে। বিষয়টি পরিকল্পিত ছিল বলেই এই উচ্ছৃঙ্খল জনতা সেখানে থাকা অন্য এক অভিযুক্ত ধর্ষণকারীকে স্পর্শমাত্র করেনি। কারণ, তিনি মুসলমান কিংবা বাঙালি এর কোনোটিই ছিলেন না। আসলে ওই অভিযুক্ত ধর্ষক ছিলেন একজন নাগা। এ ঘটনা প্রমাণ করে, ফরিদ খানের এই অমানবিক নির্যাতন মৃত্যুর পেছনে শুধু ওই মহিলারই হাত ছিল না, বরং এটি ছিল একজন মুসলিম যুবকের জীবনে নেমে আসা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত পূর্বপরিকল্পিত এক টার্গেটকিলিং।
উল্লেখ্য, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই নাগাল্যান্ড রাজ্যটি প্রধানত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা হলেও ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মাঝে মুসলমানবিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আগে যেখানে আসামে মুসলমানদের ওপর মাঝে মাঝে নানা অজুহাতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে মুসলমানদের হত্যা করা হতো, এখন সেই একই কাজটি নাগারাও শুরু করেছে নাগাল্যান্ডে। ফরিদ খানের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় : প্রথমত সেখানকার মুসলমানেরা এখন সরকার ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সহজ টার্গেট; এমনকি সেখানকার মুসলমানেরা জুডিশিয়াল কাস্টোডিতেও নিরাপদ নয়; জুডিশিয়ারি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পুরোপুরি দায়ী। উল্লিখিত ‘সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি’ও মনে করে, এর জন্য দায়ী জুডিশিয়ারি। কারণ, ফরিদ খান সরকারের কারাগারের হেফাজতে ছিল। আর প্রশাসনিকভাবে নাগাল্যান্ড সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে দণ্ডণীয় অপরাধে অপরাধী। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত মানবতাবিরোধী এক ঘৃণ্য অপরাধ। এ জন্য এই কমিটি এ ব্যাপারে ভারতের প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনা করে এ ঘটনার বিচার দাবি করেছে। তাদের প্রশ্ন, কেন জুডিশিয়ারি কাস্টোডিতে থাকা অবস্থায় একজন নাগরিককে এ ধরনের নির্মমতার শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে? এখানে সরকারের দায় কোথায়? এ কমিটি মনে করে প্রধান বিচারপতির উচিত এ ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমটো অ্যাকশন) কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এসব প্রশ্নের জবাব সে দেশের মানুষকে জানানো এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। একই সাথে এই কমিটি নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করে। কারণ এরা উভয়ই নাগাল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত। এই কমিটি অবশ্য এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নাগা স্টুডেন্ট ফেডারেশনের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করেনি। কিন্তু যেহেতু কারাগারে নিয়ে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিক্ষোভ মিছিলটির নেতৃত্বে ছিল এই স্টুডেন্ট ফেডারেশন, অতএব এই ফেডারেশন এ ঘটনার দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না। এ ফেডারেশনের নেতাদের নেতৃত্বেই জনতা জোর করে কারাগারে ঢুকে ফরিদ খানকে বের করে নিয়ে এসে এ ঘটনা ঘটায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, যখন এমন খবর ছড়িয়ে দেয়া হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নাগাল্যান্ডের লোক নন, তিনি করিমগঞ্জের লোক। তখন স্থানীয় জনতা আরো বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কারণ এরা ভাবে বাইরে থেকে একজন লোক এসে নাগাল্যান্ডের লোকের বিরুদ্ধে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে যাবে, তা হতে দেয়া যায় না। এর ফলে আসাম থেকে নাগাল্যান্ডে এসে যারা ব্যবসায় বাণিজ্য করছেন কিংবা অন্যান্য ধরনের রোজিরোজগারে নিয়োজিত, তারাও আজ হুমকির মুখে। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে প্রচুর লোক নাগাল্যান্ডে এসে ব্যবসায় বাণিজ্য ও নানা ধরনের কাজকর্ম করে জীবন নির্বাহ করছে। সে জন্য স্থানীয় লোকদের ব্যবসায় বাণিজ্য ও কাজকর্মের সুযোগ ক্রমেই সঙ্কোচিত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের অসন্তুষ্টিও কাজ করছে। তবে সেখানে এমন একটি ধারণাও কাজ করছে, বাইরে থেকে নাগাল্যান্ডে আসা এসব লোক প্রধানত বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী। এসব কারণে, নাগাল্যান্ডে তথাকথিত ‘বহিরাগতদের’ ব্যাপারে এক ধরনের বিদ্বেষ নাগাদের মধ্যে কাজ করে। এই বিদ্বেষ ফরিদ খানের ঘটনার ক্ষেত্রে অংশত কাজ করেছে। একজন ধর্ষণকারী হিসেবে ফরিদ খানের ওপর এদের যতটা না ক্ষোভ ছিল, তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল একজন ‘বহিরাগত’ হিসেবে। নাগাল্যান্ডে ‘ইনসাইডার-আউটসাইডার’ নামে একটি পলিটিক্যাল ডিকোটমি তথা রাজনৈতিক দ্বিবিভাজন কাজ করে। ফরিদ খান সেই পলিটিক্যাল ডিকোটমিরই শিকার। ফরিদ খানের ভাই দাবি করেছেন, তার ভাইকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। ঘটনাটি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এরা এক ধরনের জেনোফোবিয়া তথা বহিরাগতভীতিতে ভোগে। এরা মনে করে, বহিরাগতরা নাগাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে বা করবে। সে উপলব্ধি থেকে এদের মধ্যে এক ধরনের বহিরাগতবিদ্বেষ সব সময় কাজ করে। ফরিদ খানের বেলায়ও হয়তো সে বিদ্বেষও কাজ করেছে।
ভারতের ‘সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি’ এই মর্মান্তিক পরিকল্পিত হত্যা ঘটনায় তাদের মর্মাহত হওয়ার কথা প্রকাশ করেছে। তাদের অভিমত, এ ধরনের অমানবিক ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা তাদের নেই। মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণার মাত্রা যে কী মাত্রায় পশুত্বের পর্যায়ে নামাতে পারে, এ ঘটনা এরই এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ ও উদাহরণ। হয়তো অনেকেই বলতে পারেন, সমাজে যেভাবে ধর্ষণের ছড়াছড়ি, তাতে করে অভিযুক্ত ফরিদ খান তার উপযুক্ত সাজাই পেয়েছে। প্রতিটি ধর্ষকের বেলায় এমনটিই হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলে আইন আদালত থাকার দরকারটা কী? এ ছাড়া ফরিদ খানের ঘটনাটি তলিয়ে দেখলে এ ঘটনার এত সহজ সমীকরণ সম্ভব নয়।
সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি এ ব্যাপারে স্পষ্টতই বলতে চায়, এটি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত খুন। পরিকল্পিত এক গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। আর এর পেছনে রয়েছে একটি মুসলিমবিরোধী প্রাইভেট গ্যাং। একই সাথে এতে সমর্থন রয়েছে রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদেরও। গোটা ঘটনাপর্বটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলে বহুল আলোচিত-সমালোচিত গুজরাট জেনোসাইডের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের সহজ শিকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল গুজরাটের মুসলমানেরা। দেখা যাবে, ডিমাপুরের ঘটনায় জড়িত রয়েছে একই ধরনের মুসলিমবিরোধী শক্তি, আর এতে সমর্থন জুগিয়েছে নাগাল্যান্ড রাজ্য সরকার। তা না হলে কী করে ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো একটি সুরক্ষিত কারাগার থেকে বিচারাধীন একজন অভিযুক্তকে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা বের করে নিয়ে এসে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা নানা নির্যাতনের ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে এভাবে নির্মমভাবে প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করতে পারে? এ ঘটনা প্রমাণ করে ভারতীয় মুসলমানেরা সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও নিরাপদ নয়।
ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ডিমাপুরের এই ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি চলছে এ ঘটনার নানামুখী বিশ্লেষণ। ঘটনার বিবরণে প্রকাশÑ ৩০ বছরের মতো বয়েসী বাংলা ভাষাভাষী সৈয়দ ফরিদ খান ওরফে সৈয়দ শরিফ খান ভারতের আসাম রাজ্যের করিমপুর জেলার মূল অধিবাসী। কিন্তু বর্তমানে তিনি বসবাস করছিলেন নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর শহরে। সেখানে তিনি পুরনো ভাঙাগাড়ির ব্যবসায় করতেন। ব্যবসায় ভালোই চলছিল। চার বছর আগে তিনি বিয়ে করেন এক নাগা মহিলাকে। সেখানে এরা সুখেই সংসার করছিলেন। তাদের রয়েছে তিন বছরের একটি কন্যাসন্তান। ফরিদ খানের ছোট ভাই নাসিরুদ্দিন তার সাথেই বসবাস করতেন। বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার কারণে ফরিদ খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্ট বলে অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা এ দাবির অসারতাই প্রমাণ করে। তার বাবা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে চাকরি করেছেন ২০ বছর। তার দুই ভাই এখনো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত। তার এক ভাই ১৯৯৯ সালে নিহত হন কারগিল যুদ্ধে, ভারতের বাহিনীর হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ফরিদ খান তার স্ত্রীর এক জ্ঞাতিবোন ও এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে স্থানীয় একটি হোটেলে যান একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। পরদিন পুলিশ তার বাসায় এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। বলা হয়, তার স্ত্রীর ওই জ্ঞাতিবোন তার বিরুদ্ধে থানায় একটি ধর্ষণ মামলার এফআইআর দাখিল করেছে। জানা গেল, পরদিন এই মহিলা ফরিদ খানের স্ত্রীর কাছে গিয়ে তার কাছে দুই লাখ রুপি দাবি করে। এ পরিমাণ অর্থ তাকে দেয়া হলে তিনি এই ধর্ষণ মামলা তুলে নেবেন বলে জানান। ফরিদ খানের স্ত্রী এ অর্থ তাকে দিতে অস্বীকার করেন। অপর দিকে ফরিদ খানকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তাকে পাঠানো হয় ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি এই কারাগারের হেফাজতেই ছিলেন। তাকে গ্রেফতার ও কারাগারে আটক রাখার খবর স্থানীয় একটি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় ঘটনার এক সপ্তাহ পর। এ ছাড়া এ ব্যাপারে উসকানিমূলক খবর ছড়িয়ে দেয়া হয় ফেসবুকে।
গত ৪ মার্চে নাগাল্যান্ডের একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে অভিযুক্ত ফরিদ খানকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানায়। ৫ জানুয়ারি এক হিসাবে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার, অন্য হিসাবে ১০ হাজার উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিক্ষোভ মিছিল করে ডিমাপুর কারাগারে যায়। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে প্রচুর নারী ও শিশুও ছিল। এরা কড়া নিরাপত্তায় থাকা কারাগারের ফটক ভেঙে ফরিদ খানকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে রাস্তায়। এর পর তার জামা-কাপড় টেনে খুলে উলঙ্গ করে মারধর শুরু করে। এ সময় তার ওপর পাথরও ছোড়া হয়। এরপর তার দেহ নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তাকে দড়ি দিয়ে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে ডিমাপুর শহরের কেন্দ্রস্থলের রাস্তায় ছেঁছড়িয়ে মারা হয়। এরও পর তার লাশ প্রদর্শনের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি কক টাওয়ারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। উল্লেখ্য, ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারটি সিআরপিএফ সিকিউরিটির আওতাধীন একটি কারাগার। এ ধরনের নিরাপত্তাধীন কারাগার থেকে একজন বন্দীকে জেল থেকে জনতা বের করে নিয়ে গেল, অথচ কারারক্ষীরা ন্যূনতম ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিলো নাÑ বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর ও রহস্যজনক।
ডিমাপুরের এসপি বলেছেন, ধর্ষণের এ অভিযোগটি ছিল মিথ্যা। আসলে মেয়েটি এর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করার প্রয়াস চালিয়েছিল। অবশ্য এই এসপিকে পরে বরখাস্ত করা হয়। মেডিক্যাল রিপোর্টেও ধর্ষণের কোনো প্রমাণ মেলেনি। তা ছাড়া হোটেলের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্যেও ওই মেয়েটির সাথে ফরিদ খানের কোনো অস্বাভাবিক আচরণের কোনো দৃশ্যও ধরা পড়েনি। সব মিলিয়ে গোটা ধর্ষণের অভিযোগটি যে ছিল সাজানো, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ফরিদ খানের জীবনে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। তার পরিবারের জন্য যে ক্ষতি হওয়ার তা-ও হয়ে গেছে।
উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে কারাগারে গেল। সেখানে এরা পূর্বপরিকল্পনামতে শুধু ওই ফরিদ খানকেই টার্গেটে পরিণত করল। এর কারণ দুটো। প্রথম কারণ তিনি ছিলেন মুসলমান। দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। যার ফলে তাকে বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর সহজ সুযোগ এরা হাতের কাছে পেয়ে যায়। তাই উদ্দেশ্যমূলক তাকে পরিচিত করে তোলা হয় অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে। বিষয়টি পরিকল্পিত ছিল বলেই এই উচ্ছৃঙ্খল জনতা সেখানে থাকা অন্য এক অভিযুক্ত ধর্ষণকারীকে স্পর্শমাত্র করেনি। কারণ, তিনি মুসলমান কিংবা বাঙালি এর কোনোটিই ছিলেন না। আসলে ওই অভিযুক্ত ধর্ষক ছিলেন একজন নাগা। এ ঘটনা প্রমাণ করে, ফরিদ খানের এই অমানবিক নির্যাতন মৃত্যুর পেছনে শুধু ওই মহিলারই হাত ছিল না, বরং এটি ছিল একজন মুসলিম যুবকের জীবনে নেমে আসা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত পূর্বপরিকল্পিত এক টার্গেটকিলিং।
উল্লেখ্য, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই নাগাল্যান্ড রাজ্যটি প্রধানত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা হলেও ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মাঝে মুসলমানবিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আগে যেখানে আসামে মুসলমানদের ওপর মাঝে মাঝে নানা অজুহাতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে মুসলমানদের হত্যা করা হতো, এখন সেই একই কাজটি নাগারাও শুরু করেছে নাগাল্যান্ডে। ফরিদ খানের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় : প্রথমত সেখানকার মুসলমানেরা এখন সরকার ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সহজ টার্গেট; এমনকি সেখানকার মুসলমানেরা জুডিশিয়াল কাস্টোডিতেও নিরাপদ নয়; জুডিশিয়ারি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পুরোপুরি দায়ী। উল্লিখিত ‘সিভিল লিভার্টিজ মনিটরিং কমিটি’ও মনে করে, এর জন্য দায়ী জুডিশিয়ারি। কারণ, ফরিদ খান সরকারের কারাগারের হেফাজতে ছিল। আর প্রশাসনিকভাবে নাগাল্যান্ড সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে দণ্ডণীয় অপরাধে অপরাধী। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত মানবতাবিরোধী এক ঘৃণ্য অপরাধ। এ জন্য এই কমিটি এ ব্যাপারে ভারতের প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনা করে এ ঘটনার বিচার দাবি করেছে। তাদের প্রশ্ন, কেন জুডিশিয়ারি কাস্টোডিতে থাকা অবস্থায় একজন নাগরিককে এ ধরনের নির্মমতার শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে? এখানে সরকারের দায় কোথায়? এ কমিটি মনে করে প্রধান বিচারপতির উচিত এ ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমটো অ্যাকশন) কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এসব প্রশ্নের জবাব সে দেশের মানুষকে জানানো এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। একই সাথে এই কমিটি নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করে। কারণ এরা উভয়ই নাগাল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত। এই কমিটি অবশ্য এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নাগা স্টুডেন্ট ফেডারেশনের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করেনি। কিন্তু যেহেতু কারাগারে নিয়ে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিক্ষোভ মিছিলটির নেতৃত্বে ছিল এই স্টুডেন্ট ফেডারেশন, অতএব এই ফেডারেশন এ ঘটনার দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না। এ ফেডারেশনের নেতাদের নেতৃত্বেই জনতা জোর করে কারাগারে ঢুকে ফরিদ খানকে বের করে নিয়ে এসে এ ঘটনা ঘটায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, যখন এমন খবর ছড়িয়ে দেয়া হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নাগাল্যান্ডের লোক নন, তিনি করিমগঞ্জের লোক। তখন স্থানীয় জনতা আরো বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কারণ এরা ভাবে বাইরে থেকে একজন লোক এসে নাগাল্যান্ডের লোকের বিরুদ্ধে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে যাবে, তা হতে দেয়া যায় না। এর ফলে আসাম থেকে নাগাল্যান্ডে এসে যারা ব্যবসায় বাণিজ্য করছেন কিংবা অন্যান্য ধরনের রোজিরোজগারে নিয়োজিত, তারাও আজ হুমকির মুখে। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে প্রচুর লোক নাগাল্যান্ডে এসে ব্যবসায় বাণিজ্য ও নানা ধরনের কাজকর্ম করে জীবন নির্বাহ করছে। সে জন্য স্থানীয় লোকদের ব্যবসায় বাণিজ্য ও কাজকর্মের সুযোগ ক্রমেই সঙ্কোচিত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের অসন্তুষ্টিও কাজ করছে। তবে সেখানে এমন একটি ধারণাও কাজ করছে, বাইরে থেকে নাগাল্যান্ডে আসা এসব লোক প্রধানত বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসী। এসব কারণে, নাগাল্যান্ডে তথাকথিত ‘বহিরাগতদের’ ব্যাপারে এক ধরনের বিদ্বেষ নাগাদের মধ্যে কাজ করে। এই বিদ্বেষ ফরিদ খানের ঘটনার ক্ষেত্রে অংশত কাজ করেছে। একজন ধর্ষণকারী হিসেবে ফরিদ খানের ওপর এদের যতটা না ক্ষোভ ছিল, তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল একজন ‘বহিরাগত’ হিসেবে। নাগাল্যান্ডে ‘ইনসাইডার-আউটসাইডার’ নামে একটি পলিটিক্যাল ডিকোটমি তথা রাজনৈতিক দ্বিবিভাজন কাজ করে। ফরিদ খান সেই পলিটিক্যাল ডিকোটমিরই শিকার। ফরিদ খানের ভাই দাবি করেছেন, তার ভাইকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। ঘটনাটি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এরা এক ধরনের জেনোফোবিয়া তথা বহিরাগতভীতিতে ভোগে। এরা মনে করে, বহিরাগতরা নাগাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে বা করবে। সে উপলব্ধি থেকে এদের মধ্যে এক ধরনের বহিরাগতবিদ্বেষ সব সময় কাজ করে। ফরিদ খানের বেলায়ও হয়তো সে বিদ্বেষও কাজ করেছে।
No comments