ভাষা শহীদানের মাসে একজন মুক্তি সংগ্রামীর মৃত্যু এবং তা নিয়েও মিথ্যার বেসাতি by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ফেব্রুয়ারি
ভাষা শহীদের মাস। এই স্মরণীয় মাসেই লন্ডনে মৃত্যু হল আমার অনুজপ্রতিম
বন্ধু, বঙ্গবন্ধুর একজন অকৃত্রিম অনুসারী আমিনুল হক বাদশার। দীর্ঘকাল তিনি
আমার জীবনের সুখে-দুঃখে ছায়াসঙ্গীর মতো ছিলেন। তার বিয়োগ-ব্যথা সহ্য করা
সত্যই কঠিন। লন্ডনে গত শুক্রবার তার নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল।
ওইদিন সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের মন্টিকিয়োরি সেন্টারে লন্ডন বাংলা প্রেস
ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত শোকসভাতেও তার অগুনতি শুভাকাক্সক্ষীর ভিড় জমেছিল।
বাদশার মৃত্যুর পরই মাত্র বুঝতে পেরেছি, দেশে এবং বিদেশেও তিনি কতটা
জনপ্রিয় ছিলেন।
বাদশা শুধু বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন না, তার পরিবারেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার শেষ জীবনে যে কোনো কারণেই হোক এই ঘনিষ্ঠতা কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছিল। তবু আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতা দেখে অভিভূত হয়েছি। বাদশার মৃত্যুতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে শোকবাণী দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতিও দিয়েছেন। তখনই আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হবে।
তবু বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি ঢাকায় বন্ধুবর মোনায়েম সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব জানার জন্য অনুরোধ করি। মোনায়েম সরকার আমাকে জানান যে, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হবে। এমনকি মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাকে সমাহিত করারও ব্যবস্থা হতে পারে।
আমি লন্ডনে তার পরিবারকে সে কথা জানাই। পরিবারের সদস্যদের কারও কারও ইচ্ছা ছিল, সরকারি তত্ত্বাবধানে বাদশার মরদেহ ঢাকায় নেয়া হোক এবং সমাহিত করা হোক। সেটা সম্ভব না হলে মরদেহ বাদশার ইচ্ছানুযায়ী কুষ্টিয়ায় তার মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে। তাদের আরও ইচ্ছা ছিল আমি মৃতদেহের সঙ্গে ঢাকায় যাই এবং আমারও সে ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সৌদি আরবে বাঙালিদের একুশের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ আগেই গ্রহণ করায় আমার ঢাকায় আসা হয়নি। তবে এটুকু জেনেছি, তার পরিবার তাকে কুষ্টিয়াতে পারিবারিক গোরস্থানেই সমাহিত করার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এই নিবন্ধটি লেখার সময় (রোববার সকাল) খবর পেয়েছি, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছেছে এবং তার প্রতি মোটামুটি রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়েছে। এই খবরটি পেয়ে যেমন খুশি হয়েছি, তেমনি ঢাকার তথাকথিত একটি নিরপেক্ষ বাংলা দৈনিকে আমার সম্পর্কে একটি বানানো খবর দেখে বিস্মিত হয়েছি। ভাষা শহীদদের এই স্মৃতিপূত মাসে এবং দেশের সবার ভালোবাসার পাত্র এবং বঙ্গবন্ধুর এক ঘনিষ্ঠ অনুসারীর মৃত্যু সংবাদ নিয়েও যে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যার বেসাতি করা যায়, তার একটা বড় প্রমাণ পেলাম।
আর কোনো দৈনিকে নয় (এমনকি লন্ডনের বাংলা কাগজগুলোতেও নয়), একমাত্র ঢাকার এই স্বঘোষিত নিরপেক্ষ দৈনিকটিতেই খবর ছাপা হয়েছে যে, লন্ডনের মন্টিকিয়োরি সেন্টারে বাদশার শোকসভায় আমি বলেছি, ‘বাদশাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিয়ে সমাহিত করা হোক এটা আমারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার মন নরম করা গেল না।’ বাদশাহর মৃত্যুতে শেখ হাসিনার শোকবাণী পাঠের পরও আমি এই ধরনের মন্তব্য করব তা সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ কি ধারণা করবেন? শোকসভায় আমার বক্তব্য বহু টিভি সাংবাদিক রেকর্ড করেছেন। তারা কেউ মন্তব্যটি জানতে পারলেন না, কেবল ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটিই জানতে পারলেন?
এই মিথ্যার বেসাতির আসল কারণটি বুঝতে পেরেছি- যখন ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির খবরেই দেখেছি, তারা আমার কথিত মন্তব্যটি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবকে জানিয়েছেন এবং তার অভিমত জানতে চেয়েছেন। প্রেস সচিব বলেছেন, তিনি এ সম্পর্কে অবহিত নন। যদি পত্রিকাটির অসাধু মতলব না থাকত, তাহলে উচিত ছিল এমন একটি বিতর্কিত উক্তি আমি করেছি কিনা লন্ডনে একটি মাত্র টেলিফোন কল দ্বারা আমার কাছে জানতে চাওয়া। তারা তা করেননি। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবকে জানিয়েছেন। উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট, প্রেস সচিব প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি রুষ্ট হবেন।
আমি এই তথাকথিত নিরপেক্ষ দৈনিকটির নিত্য অসাধু সাংবাদিকতার সমালোচক। সুতরাং আমাকে এই সুযোগে এক হাত দেখে নেয়ার লোভ তারা হয়তো সংবরণ করতে পারেননি। আমার কথা হল, আমি কোনো কোনো সময় হাসিনা সরকারের কোনো কোনো কাজের বিরূপ সমালোচনা করে থাকি। তাতে তিনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার সম্পর্কে যে কথা আমি বলিনি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সে কথা বানিয়ে প্রচার করে প্রধানমন্ত্রীর মনে আমার সম্পর্কে যদি তারা মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই আমি প্রতিবাদ জানাব। দেশের মানুষ দেখুক, এই স্বঘোষিত নিরপেক্ষ পত্রিকার নিরপেক্ষতার নমুনা!
ফেব্রুয়ারি মাসে আমিনুল হক বাদশা চলে গেলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আমার কাছে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন ‘হৃদয়ে বিষাদ সিন্ধু’। বইটির ভূমিকা আমি লিখেছিলাম। তার ইচ্ছা তিনি বইটি আবার নতুন করে লিখবেন এবং আমি যেন তাকে নতুন করে একটি ভূমিকা লিখে দিই। এই সময় তিনি আমাকে জানান, বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে একশ্রেণীর তথাকথিত বামপন্থী লেখক নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছেন। তিনি সেগুলো খণ্ডন করার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছেন এবং সেগুলো নিয়ে তিনি একটি বড় প্রবন্ধ লিখতে চান এবং এই ভাষার মাসেই প্রকাশ করতে চান। তবে বই আকারে বের করার আগে ঢাকার কোনো দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে বের করা তার ইচ্ছা। কোন্ কাগজে পাঠাবেন সে সম্পর্কে আমার অভিমত জানতে চান।
আমি তাকে ইত্তেফাক, যুগান্তর অথবা জনকণ্ঠে পাঠানোর কথা বলি। তিনি যুগান্তরে পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাকে জানাই, যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের মাহবুব কামাল নিজেও একজন কলামিস্ট। আমি তার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। যুগান্তর অবশ্যই তোমার লেখা ছাপাবে। বাদশাহ বলেছিলেন, লেখাটা আগে শেষ করি, তারপর আপনাকে জানাব। এরপর যতদূর জানি, ‘ভাষা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় তার কাছে ছিল। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত আর শেষ করা হয়নি।
ষাটের দশকের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের একজন সামনের কাতারের নেতা ছিলেন আমিনুল হক বাদশা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তার ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের নিযুুক্তি পেয়ে আমি আর বাদশা একসঙ্গে বহু মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ‘মোটিভেটর’ হিসেবে ঘুরেছি। এক শিবিরে এক আহত মুক্তিযোদ্ধার হাঁটু থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে না দেখে বাদশা নিজের গায়ের শার্টের হাতা ছিঁড়ে তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়বাংলা’র আমি ছিলাম নির্বাহী সম্পাদক। বাদশা রণাঙ্গনের খবর এই পত্রিকায় নিয়মিত জোগান দিতেন।
সাংবাদিক হিসেবেও বাদশার জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ষাটের দশকে দৈনিক আজাদে রিপোর্টার থাকাকালে চিফ রিপোর্টার ফয়েজ আহমদের নির্দেশে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অনেক নেপথ্য কাহিনী আজাদে প্রকাশ করে তিনি সবার প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
সত্তরের নির্বাচনী সফরে বঙ্গবন্ধু তিনজন সাংবাদিককে তার সফরসঙ্গী করেছিলেন, একজন আজাদ থেকে আমিনুল হক বাদশা, অন্য দু’জন হচ্ছেন ইত্তেফাক থেকে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং অবজারভার থেকে শহীদুল হক। তাদের মধ্যে বাদশাই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। বাদশা সেতার বাজাতে জানতেন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচন সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বাদশাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বাদশা, তুই সেতার বাজা, আমি শুনি।’ বাদশা সেতার বাজাতেন।
বাদশা আজ নেই। তাকে নিয়ে আমার অজস্র স্মৃতি। লিখলে একটি বই হবে। ইচ্ছে আছে, ‘বাদশানামা’ নামে একটি বই লিখব।
লন্ডন ১৫ ফেব্রুয়ারি, রোববার, ২০১৫
বাদশা শুধু বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন না, তার পরিবারেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার শেষ জীবনে যে কোনো কারণেই হোক এই ঘনিষ্ঠতা কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছিল। তবু আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতা দেখে অভিভূত হয়েছি। বাদশার মৃত্যুতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে শোকবাণী দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতিও দিয়েছেন। তখনই আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হবে।
তবু বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি ঢাকায় বন্ধুবর মোনায়েম সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব জানার জন্য অনুরোধ করি। মোনায়েম সরকার আমাকে জানান যে, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হবে। এমনকি মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাকে সমাহিত করারও ব্যবস্থা হতে পারে।
আমি লন্ডনে তার পরিবারকে সে কথা জানাই। পরিবারের সদস্যদের কারও কারও ইচ্ছা ছিল, সরকারি তত্ত্বাবধানে বাদশার মরদেহ ঢাকায় নেয়া হোক এবং সমাহিত করা হোক। সেটা সম্ভব না হলে মরদেহ বাদশার ইচ্ছানুযায়ী কুষ্টিয়ায় তার মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে। তাদের আরও ইচ্ছা ছিল আমি মৃতদেহের সঙ্গে ঢাকায় যাই এবং আমারও সে ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সৌদি আরবে বাঙালিদের একুশের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ আগেই গ্রহণ করায় আমার ঢাকায় আসা হয়নি। তবে এটুকু জেনেছি, তার পরিবার তাকে কুষ্টিয়াতে পারিবারিক গোরস্থানেই সমাহিত করার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এই নিবন্ধটি লেখার সময় (রোববার সকাল) খবর পেয়েছি, বাদশার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছেছে এবং তার প্রতি মোটামুটি রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়েছে। এই খবরটি পেয়ে যেমন খুশি হয়েছি, তেমনি ঢাকার তথাকথিত একটি নিরপেক্ষ বাংলা দৈনিকে আমার সম্পর্কে একটি বানানো খবর দেখে বিস্মিত হয়েছি। ভাষা শহীদদের এই স্মৃতিপূত মাসে এবং দেশের সবার ভালোবাসার পাত্র এবং বঙ্গবন্ধুর এক ঘনিষ্ঠ অনুসারীর মৃত্যু সংবাদ নিয়েও যে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যার বেসাতি করা যায়, তার একটা বড় প্রমাণ পেলাম।
আর কোনো দৈনিকে নয় (এমনকি লন্ডনের বাংলা কাগজগুলোতেও নয়), একমাত্র ঢাকার এই স্বঘোষিত নিরপেক্ষ দৈনিকটিতেই খবর ছাপা হয়েছে যে, লন্ডনের মন্টিকিয়োরি সেন্টারে বাদশার শোকসভায় আমি বলেছি, ‘বাদশাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিয়ে সমাহিত করা হোক এটা আমারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার মন নরম করা গেল না।’ বাদশাহর মৃত্যুতে শেখ হাসিনার শোকবাণী পাঠের পরও আমি এই ধরনের মন্তব্য করব তা সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ কি ধারণা করবেন? শোকসভায় আমার বক্তব্য বহু টিভি সাংবাদিক রেকর্ড করেছেন। তারা কেউ মন্তব্যটি জানতে পারলেন না, কেবল ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটিই জানতে পারলেন?
এই মিথ্যার বেসাতির আসল কারণটি বুঝতে পেরেছি- যখন ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির খবরেই দেখেছি, তারা আমার কথিত মন্তব্যটি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবকে জানিয়েছেন এবং তার অভিমত জানতে চেয়েছেন। প্রেস সচিব বলেছেন, তিনি এ সম্পর্কে অবহিত নন। যদি পত্রিকাটির অসাধু মতলব না থাকত, তাহলে উচিত ছিল এমন একটি বিতর্কিত উক্তি আমি করেছি কিনা লন্ডনে একটি মাত্র টেলিফোন কল দ্বারা আমার কাছে জানতে চাওয়া। তারা তা করেননি। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবকে জানিয়েছেন। উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট, প্রেস সচিব প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি রুষ্ট হবেন।
আমি এই তথাকথিত নিরপেক্ষ দৈনিকটির নিত্য অসাধু সাংবাদিকতার সমালোচক। সুতরাং আমাকে এই সুযোগে এক হাত দেখে নেয়ার লোভ তারা হয়তো সংবরণ করতে পারেননি। আমার কথা হল, আমি কোনো কোনো সময় হাসিনা সরকারের কোনো কোনো কাজের বিরূপ সমালোচনা করে থাকি। তাতে তিনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার সম্পর্কে যে কথা আমি বলিনি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সে কথা বানিয়ে প্রচার করে প্রধানমন্ত্রীর মনে আমার সম্পর্কে যদি তারা মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই আমি প্রতিবাদ জানাব। দেশের মানুষ দেখুক, এই স্বঘোষিত নিরপেক্ষ পত্রিকার নিরপেক্ষতার নমুনা!
ফেব্রুয়ারি মাসে আমিনুল হক বাদশা চলে গেলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আমার কাছে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন ‘হৃদয়ে বিষাদ সিন্ধু’। বইটির ভূমিকা আমি লিখেছিলাম। তার ইচ্ছা তিনি বইটি আবার নতুন করে লিখবেন এবং আমি যেন তাকে নতুন করে একটি ভূমিকা লিখে দিই। এই সময় তিনি আমাকে জানান, বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে একশ্রেণীর তথাকথিত বামপন্থী লেখক নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছেন। তিনি সেগুলো খণ্ডন করার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছেন এবং সেগুলো নিয়ে তিনি একটি বড় প্রবন্ধ লিখতে চান এবং এই ভাষার মাসেই প্রকাশ করতে চান। তবে বই আকারে বের করার আগে ঢাকার কোনো দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে বের করা তার ইচ্ছা। কোন্ কাগজে পাঠাবেন সে সম্পর্কে আমার অভিমত জানতে চান।
আমি তাকে ইত্তেফাক, যুগান্তর অথবা জনকণ্ঠে পাঠানোর কথা বলি। তিনি যুগান্তরে পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাকে জানাই, যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের মাহবুব কামাল নিজেও একজন কলামিস্ট। আমি তার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। যুগান্তর অবশ্যই তোমার লেখা ছাপাবে। বাদশাহ বলেছিলেন, লেখাটা আগে শেষ করি, তারপর আপনাকে জানাব। এরপর যতদূর জানি, ‘ভাষা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় তার কাছে ছিল। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত আর শেষ করা হয়নি।
ষাটের দশকের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের একজন সামনের কাতারের নেতা ছিলেন আমিনুল হক বাদশা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তার ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের নিযুুক্তি পেয়ে আমি আর বাদশা একসঙ্গে বহু মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ‘মোটিভেটর’ হিসেবে ঘুরেছি। এক শিবিরে এক আহত মুক্তিযোদ্ধার হাঁটু থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে না দেখে বাদশা নিজের গায়ের শার্টের হাতা ছিঁড়ে তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়বাংলা’র আমি ছিলাম নির্বাহী সম্পাদক। বাদশা রণাঙ্গনের খবর এই পত্রিকায় নিয়মিত জোগান দিতেন।
সাংবাদিক হিসেবেও বাদশার জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ষাটের দশকে দৈনিক আজাদে রিপোর্টার থাকাকালে চিফ রিপোর্টার ফয়েজ আহমদের নির্দেশে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অনেক নেপথ্য কাহিনী আজাদে প্রকাশ করে তিনি সবার প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
সত্তরের নির্বাচনী সফরে বঙ্গবন্ধু তিনজন সাংবাদিককে তার সফরসঙ্গী করেছিলেন, একজন আজাদ থেকে আমিনুল হক বাদশা, অন্য দু’জন হচ্ছেন ইত্তেফাক থেকে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং অবজারভার থেকে শহীদুল হক। তাদের মধ্যে বাদশাই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। বাদশা সেতার বাজাতে জানতেন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচন সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বাদশাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বাদশা, তুই সেতার বাজা, আমি শুনি।’ বাদশা সেতার বাজাতেন।
বাদশা আজ নেই। তাকে নিয়ে আমার অজস্র স্মৃতি। লিখলে একটি বই হবে। ইচ্ছে আছে, ‘বাদশানামা’ নামে একটি বই লিখব।
লন্ডন ১৫ ফেব্রুয়ারি, রোববার, ২০১৫
No comments