এসওএস: বাংলাদেশের প্রাণ বাঁচাও! by ফারুক ওয়াসিফ
‘আমি
সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছি উত্তাল ঝড়ের মধ্যে, ভয় পাই নাই। এখন আমার মনে
দিনরাত পেট্রলবোমার ভয়। এইখানে আর থাকব না, সব বিক্রি করে বিদেশ চলে যাব।’
মধ্যবয়সী শক্ত গড়নের মানুষ। সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এক যুগেরও বেশি সময় পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে জাহাজ নিয়ে ঘুরেছেন। চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে নৌশিক্ষার উচ্চ ডিগ্রি নেন লন্ডনে। চাকরি নেন বিদেশি জাহাজে। ২০০৫ সালে দেশে ফেরেন। দোকান-বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি করেন। বছরের অর্ধেকটা বিদেশে থাকেন, বাকি সময় দেশেই কাটান। কিন্তু এখন তাঁর ‘মন উঠে গেছে এই দেশ থেকে’।
‘১৫ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ এসেছিল, যাইনি। কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। এই দেশে আমার সন্তান নিরাপদ নয়।’ ভয় আর হতাশায় তিনি এক বিকেলে ছুটে আসেন প্রথম আলোর দপ্তরে। কথা হয় সেখানেই।
মানুষটার মধ্যে তীব্র প্রাণশক্তি আছে। কিন্তু কোনোভাবেই ভরসা পাচ্ছেন না। অরূপ রাহীর একটি গান ইদানীং এফএম রেডিওতে খুব বাজে: মরার দেশে ভালো লাগে না। মরার দেশে কারোরই ভলো লাগছে না। পোড়ার দেশে জীবনও জিয়াচ্ছে না। অকালে, বীভৎস অপঘাতে শিশু ও সাধারণের মৃত্যু মানা যাচ্ছে না। জয়-জিন্দাবাদী ঝগড়াপুরি রাজনীতি যত প্রবল হয়, ততই অকাতরে মানুষ মরে আর দেশত্যাগের ঝোঁক বাড়ে। গরিব মানুষের স্বদেশ একটাই। প্রবাসে কর্ম করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশই তাদের স্থায়ী নিবাস। তবে যাঁরা ওপরের লোক; দ্বিতীয় স্বদেশ খোঁজার ঝোঁক তাঁদেরই বেশি। আরও যাঁরা বড়লোক অথবা অবৈধ পথে সম্পদশালী যাঁরা, তাঁরাও ধনপ্রাণ বাঁচাতে বিদেশমুখী হচ্ছেন। হানাহানির সময়ই সম্পদ পাচারে গতি আসে আর ভরে ওঠে বিদেশি ব্যাংক। পরিচিত এক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। জাতীয় আত্মবিশ্বাস তলানিতে, তাই দেশে বিনিয়োগে ভরসা আসছে না। দুর্নীতি ও সহিংসতার রেকর্ডের মতো ভরসাহীনতার জরিপেও আমরাই সেরা।
যেখানে সম্মান আর নিরাপত্তা নেই, তাকে আর দেশ বলা যায় না। এমন দেশে মানুষ থাকতে চায় না। পুরোনো যুগে দেশ ছিল মা, তাকে কখনো ছাড়া যেত না। কিন্তু এখন এমন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যাদের কাছে দেশের চেয়েও বড় হলো ‘উন্নতি’। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’। আজকের কথা হলো, উন্নতিহীনতায় কে বাঁচিতে চায়! স্বাধীনতার চাইতে সুযোগ ও নিরাপত্তা বোধগম্য কারণেই অনেকের কাছে বড়। নিরাপদ পরিবেশে উন্নতি করার সুযোগ তাঁরা যেখানে পাবেন, যোগ্যতাবলে তাঁরা সেখানেই চলে যাবেন। দেশ তাঁদের আটকে রাখতে পারবে না। এভাবে কেউ পুঁজি, কেউ শ্রম, কেউ শিক্ষা, কেউ মেধা-যোগ্যতা, কেউবা শুধু ডিভি লটারি সম্বল করে দেশ ছাড়ায় মরিয়া।
কিন্তু যাঁরা দেশ ছাড়তে চান না, যাঁরা ‘আমার সোনার বাংলা’কে ভালোবাসেন, যাঁরা মনে করেন ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’; তাঁরা কী করবেন? চেয়ে চেয়ে দেখবেন এবং হত্যা-ধ্বংস-লাঞ্ছনার অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্ত হয়ে অপেক্ষা করবেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দেয়াললিখন চোখে পড়ে: রাজনীতি আপনার জীবনকে বদলায়, আপনি কেন রাজনীতিকে বদলাবেন না? এ ধরনের আরও অনেক কথা প্রবাদপ্রতিম মনীষীরা বলে গেছেন। যেমন: রাজনীতি এতই গুরুতর বিষয় যে তা কেবল রাজনীতিবিদদের মর্জির ওপর ছেড়ে রাখা চলে না। রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ার শাস্তি হলো, আপনি আপনার থেকে অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হবেন। যতই আপনি মনে করবেন রাজনীতিতে আপনার কিছুই করার ক্ষমতা নেই, ততই আপনি আপনার সরকারকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করবেন। আর চতুর স্বৈরাচারীরা জনগণের মধ্যে হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের বিশ্বাস করিয়ে ফেলে যে সাধারণ মানুষ আসলেই অসহায় ও অক্ষম। যখন রাজনীতি মারাত্মক ভুলের পথে চলে, তখন সঠিক কথা বলা বিপজ্জনক।
বিপজ্জনক বলেই নাম না প্রকাশ করার শর্তে রাজনীতি নিয়েও কথা বলেছেন ওই নাবিক। সংলাপ নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘সংলাপ কীভাবে সম্ভব? দুই নেত্রীর কেউ কাউকে কোনো দিন মানবে না। এত ঘৃণা যাঁদের মনে, তাঁরা কীভাবে একসাথে বসবেন? কোনো জাপানি কোনো জাপানির সাথে রাগ করে না, মিথ্যা বলে না। কিন্তু আমাদের সবার মধ্যে এত অবিশ্বাস, এত হানাহানির মেজাজ!’ অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই, কবি জীবনানন্দ দাশও বলে গিয়েছিলেন, ‘এত হিংসা নিয়ে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’
বাংলাদেশিরা গণতন্ত্রের অযোগ্য; কথাটি অনেকেই বললেও ইতিহাসে এর উল্টা উদাহরণও বিস্তর। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান ছিল বাংলাদেশে সেক্যুলার গণভিত্তিক রাজনীতির বিরাট বিজয়। জমিদার-মহাজনের শক্তিকে কাবু করেছিল এই নির্বাচন। ১৯৭০-এর নির্বাচন নিয়ে এসেছিল স্বাধীনতার সুযোগ। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বহুদলীয় গণতন্ত্র আবার ফিরেছিল। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আহমেদ কামাল লিখেছেন, ‘নির্বাচনের সংস্কৃতি খুব ভালো করে জানা ছিল বাঙালি বৌদ্ধদের। বৌদ্ধবিহার ও ধর্মসংঘের প্রধান সংঘের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং রাজা গোপালও ছিলেন বৌদ্ধ।’
আবাসিক ভবন বা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে বণিক সমিতি পর্যন্ত সবখানেই নির্বাচিতরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সমঝোতার অলিখিত বিধানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে রেষারেষি কমেছে। আমিও পাব তুমিও কিছু পাবে, এই অলিখিত বিধানে সমাজ চলছে। কিন্তু রাজনীতি চলছে ‘কেউ পাবে কেউ পাবে না’ নীতিতে। এ জন্যই ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচন নিয়ে ছলচাতুরীতে নামে: কি ২০০৬ সালে, কি ২০১৪ সালে। পুরাকালে গোপাল রাজা নির্বাচিত হওয়ায় রাজা-প্রজা দুই-ই বেঁচেছিল। এখন নির্বাচন নিয়ে সংঘাতে রাজা-প্রজা উভয়েই বিপদে।
যাঁরা এতকাল ভেবে এসেছেন, দেয়াল আর পিঠের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, তাঁদের পিঠও এখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ওই দেয়াললিখন এখন আমাদের কপাললিখন হয়ে উঠেছে। তবু দুই নেত্রী জনগণের আকুতিতে সাড়া দেবেন না! অথচ দুই দলেরই জেলা বা থানা পর্যায়ের নেতারা মারো অথবা মরো নীতিতে বিশ্বাসী নন। কারণ, তাঁদের এলাকায় থাকতে হবে। তাই লুটপাটও তাঁরা সমঝোতা করেই করেন। হিংসার হাওয়া বরং ওপরেই বেশি।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে কলাবাগানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা যথারীতি ডেকোরেটর থেকে চেয়ার ভাড়া করে রাস্তার পাশে বসে হরতাল মোকাবিলায় ব্যস্ত। তাঁদের একজন সালেহা বেগম (ছদ্মনাম) বলছিলেন: ‘আইজ মন ভালো নাই। সকালে মেয়ের লগে অনেক ঝগড়া করসি, মেয়েও আমারে অনেক কথা শুনায়া দিছে। মেয়ে বিএনপি করে। সে চলে তার নেত্রীর কথায়, আমি চলি আমার নেত্রীর কথায়। কিন্তু ঘরে এত ঝগড়া লাগে দুইজনায়। আমার ভালো লাগে না।’
তাঁকে বলি: যদি দ্যাখেন আপনার মেয়ে মিছিল করছে, আপনি কী করবেন, মারতে যাবেন? সরাসরি উত্তর না দিয়ে গৃহিণী বললেন, ‘বিএনপি যুদ্ধ করতে করতে আগাবে, কষ্ট করতে করতে একদিন ঠিকই ক্ষমতায় আইসা পড়বে। ক্ষমতায় আসতে হলে কষ্ট তাদের করতেই হবে।’ কিন্তু সেখানে উপস্থিত তাঁরই নেত্রী সালমা সরকার জানান: আইনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিষিদ্ধ করা হলে ভালো। নরম হয়ে তো কাজ হচ্ছে না।
কর্মী নারীটি সংকটকে দেখছেন মায়ের অবস্থান থেকে, সমাজের সদস্য হিসেবে। আর ওই নেত্রী দেখছেন ক্ষমতার অবস্থান থেকে। দুই দলেরই অবস্থান সমাজের বিপক্ষে। দেশ ডুবলে যে তাঁরাও রেহাই পাবেন না, সেই হুঁশ নেই । জাহাজ ডুবলে প্রথম টের পায় খোলের তলার প্রাণীরা। দেশ ডুবলে প্রথম ‘বাঁচাও’ বলে সাধারণ মানুষ। ডুবন্ত জাহাজের নাবিকেরা বার্তা পাঠান: এসওএস (সেইভ আওয়ার সোউলস), আমাদের বাঁচাও! আজ সমগ্র বাংলাদেশই বলে উঠতে চাইছে, ‘সেইভ আওয়ার সৌলস’!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
মধ্যবয়সী শক্ত গড়নের মানুষ। সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এক যুগেরও বেশি সময় পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে জাহাজ নিয়ে ঘুরেছেন। চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে নৌশিক্ষার উচ্চ ডিগ্রি নেন লন্ডনে। চাকরি নেন বিদেশি জাহাজে। ২০০৫ সালে দেশে ফেরেন। দোকান-বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি করেন। বছরের অর্ধেকটা বিদেশে থাকেন, বাকি সময় দেশেই কাটান। কিন্তু এখন তাঁর ‘মন উঠে গেছে এই দেশ থেকে’।
‘১৫ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ এসেছিল, যাইনি। কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। এই দেশে আমার সন্তান নিরাপদ নয়।’ ভয় আর হতাশায় তিনি এক বিকেলে ছুটে আসেন প্রথম আলোর দপ্তরে। কথা হয় সেখানেই।
মানুষটার মধ্যে তীব্র প্রাণশক্তি আছে। কিন্তু কোনোভাবেই ভরসা পাচ্ছেন না। অরূপ রাহীর একটি গান ইদানীং এফএম রেডিওতে খুব বাজে: মরার দেশে ভালো লাগে না। মরার দেশে কারোরই ভলো লাগছে না। পোড়ার দেশে জীবনও জিয়াচ্ছে না। অকালে, বীভৎস অপঘাতে শিশু ও সাধারণের মৃত্যু মানা যাচ্ছে না। জয়-জিন্দাবাদী ঝগড়াপুরি রাজনীতি যত প্রবল হয়, ততই অকাতরে মানুষ মরে আর দেশত্যাগের ঝোঁক বাড়ে। গরিব মানুষের স্বদেশ একটাই। প্রবাসে কর্ম করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশই তাদের স্থায়ী নিবাস। তবে যাঁরা ওপরের লোক; দ্বিতীয় স্বদেশ খোঁজার ঝোঁক তাঁদেরই বেশি। আরও যাঁরা বড়লোক অথবা অবৈধ পথে সম্পদশালী যাঁরা, তাঁরাও ধনপ্রাণ বাঁচাতে বিদেশমুখী হচ্ছেন। হানাহানির সময়ই সম্পদ পাচারে গতি আসে আর ভরে ওঠে বিদেশি ব্যাংক। পরিচিত এক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। জাতীয় আত্মবিশ্বাস তলানিতে, তাই দেশে বিনিয়োগে ভরসা আসছে না। দুর্নীতি ও সহিংসতার রেকর্ডের মতো ভরসাহীনতার জরিপেও আমরাই সেরা।
যেখানে সম্মান আর নিরাপত্তা নেই, তাকে আর দেশ বলা যায় না। এমন দেশে মানুষ থাকতে চায় না। পুরোনো যুগে দেশ ছিল মা, তাকে কখনো ছাড়া যেত না। কিন্তু এখন এমন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যাদের কাছে দেশের চেয়েও বড় হলো ‘উন্নতি’। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’। আজকের কথা হলো, উন্নতিহীনতায় কে বাঁচিতে চায়! স্বাধীনতার চাইতে সুযোগ ও নিরাপত্তা বোধগম্য কারণেই অনেকের কাছে বড়। নিরাপদ পরিবেশে উন্নতি করার সুযোগ তাঁরা যেখানে পাবেন, যোগ্যতাবলে তাঁরা সেখানেই চলে যাবেন। দেশ তাঁদের আটকে রাখতে পারবে না। এভাবে কেউ পুঁজি, কেউ শ্রম, কেউ শিক্ষা, কেউ মেধা-যোগ্যতা, কেউবা শুধু ডিভি লটারি সম্বল করে দেশ ছাড়ায় মরিয়া।
কিন্তু যাঁরা দেশ ছাড়তে চান না, যাঁরা ‘আমার সোনার বাংলা’কে ভালোবাসেন, যাঁরা মনে করেন ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’; তাঁরা কী করবেন? চেয়ে চেয়ে দেখবেন এবং হত্যা-ধ্বংস-লাঞ্ছনার অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্ত হয়ে অপেক্ষা করবেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দেয়াললিখন চোখে পড়ে: রাজনীতি আপনার জীবনকে বদলায়, আপনি কেন রাজনীতিকে বদলাবেন না? এ ধরনের আরও অনেক কথা প্রবাদপ্রতিম মনীষীরা বলে গেছেন। যেমন: রাজনীতি এতই গুরুতর বিষয় যে তা কেবল রাজনীতিবিদদের মর্জির ওপর ছেড়ে রাখা চলে না। রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ার শাস্তি হলো, আপনি আপনার থেকে অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হবেন। যতই আপনি মনে করবেন রাজনীতিতে আপনার কিছুই করার ক্ষমতা নেই, ততই আপনি আপনার সরকারকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করবেন। আর চতুর স্বৈরাচারীরা জনগণের মধ্যে হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের বিশ্বাস করিয়ে ফেলে যে সাধারণ মানুষ আসলেই অসহায় ও অক্ষম। যখন রাজনীতি মারাত্মক ভুলের পথে চলে, তখন সঠিক কথা বলা বিপজ্জনক।
বিপজ্জনক বলেই নাম না প্রকাশ করার শর্তে রাজনীতি নিয়েও কথা বলেছেন ওই নাবিক। সংলাপ নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘সংলাপ কীভাবে সম্ভব? দুই নেত্রীর কেউ কাউকে কোনো দিন মানবে না। এত ঘৃণা যাঁদের মনে, তাঁরা কীভাবে একসাথে বসবেন? কোনো জাপানি কোনো জাপানির সাথে রাগ করে না, মিথ্যা বলে না। কিন্তু আমাদের সবার মধ্যে এত অবিশ্বাস, এত হানাহানির মেজাজ!’ অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই, কবি জীবনানন্দ দাশও বলে গিয়েছিলেন, ‘এত হিংসা নিয়ে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’
বাংলাদেশিরা গণতন্ত্রের অযোগ্য; কথাটি অনেকেই বললেও ইতিহাসে এর উল্টা উদাহরণও বিস্তর। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান ছিল বাংলাদেশে সেক্যুলার গণভিত্তিক রাজনীতির বিরাট বিজয়। জমিদার-মহাজনের শক্তিকে কাবু করেছিল এই নির্বাচন। ১৯৭০-এর নির্বাচন নিয়ে এসেছিল স্বাধীনতার সুযোগ। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বহুদলীয় গণতন্ত্র আবার ফিরেছিল। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আহমেদ কামাল লিখেছেন, ‘নির্বাচনের সংস্কৃতি খুব ভালো করে জানা ছিল বাঙালি বৌদ্ধদের। বৌদ্ধবিহার ও ধর্মসংঘের প্রধান সংঘের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং রাজা গোপালও ছিলেন বৌদ্ধ।’
আবাসিক ভবন বা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে বণিক সমিতি পর্যন্ত সবখানেই নির্বাচিতরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সমঝোতার অলিখিত বিধানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে রেষারেষি কমেছে। আমিও পাব তুমিও কিছু পাবে, এই অলিখিত বিধানে সমাজ চলছে। কিন্তু রাজনীতি চলছে ‘কেউ পাবে কেউ পাবে না’ নীতিতে। এ জন্যই ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচন নিয়ে ছলচাতুরীতে নামে: কি ২০০৬ সালে, কি ২০১৪ সালে। পুরাকালে গোপাল রাজা নির্বাচিত হওয়ায় রাজা-প্রজা দুই-ই বেঁচেছিল। এখন নির্বাচন নিয়ে সংঘাতে রাজা-প্রজা উভয়েই বিপদে।
যাঁরা এতকাল ভেবে এসেছেন, দেয়াল আর পিঠের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, তাঁদের পিঠও এখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ওই দেয়াললিখন এখন আমাদের কপাললিখন হয়ে উঠেছে। তবু দুই নেত্রী জনগণের আকুতিতে সাড়া দেবেন না! অথচ দুই দলেরই জেলা বা থানা পর্যায়ের নেতারা মারো অথবা মরো নীতিতে বিশ্বাসী নন। কারণ, তাঁদের এলাকায় থাকতে হবে। তাই লুটপাটও তাঁরা সমঝোতা করেই করেন। হিংসার হাওয়া বরং ওপরেই বেশি।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে কলাবাগানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা যথারীতি ডেকোরেটর থেকে চেয়ার ভাড়া করে রাস্তার পাশে বসে হরতাল মোকাবিলায় ব্যস্ত। তাঁদের একজন সালেহা বেগম (ছদ্মনাম) বলছিলেন: ‘আইজ মন ভালো নাই। সকালে মেয়ের লগে অনেক ঝগড়া করসি, মেয়েও আমারে অনেক কথা শুনায়া দিছে। মেয়ে বিএনপি করে। সে চলে তার নেত্রীর কথায়, আমি চলি আমার নেত্রীর কথায়। কিন্তু ঘরে এত ঝগড়া লাগে দুইজনায়। আমার ভালো লাগে না।’
তাঁকে বলি: যদি দ্যাখেন আপনার মেয়ে মিছিল করছে, আপনি কী করবেন, মারতে যাবেন? সরাসরি উত্তর না দিয়ে গৃহিণী বললেন, ‘বিএনপি যুদ্ধ করতে করতে আগাবে, কষ্ট করতে করতে একদিন ঠিকই ক্ষমতায় আইসা পড়বে। ক্ষমতায় আসতে হলে কষ্ট তাদের করতেই হবে।’ কিন্তু সেখানে উপস্থিত তাঁরই নেত্রী সালমা সরকার জানান: আইনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিষিদ্ধ করা হলে ভালো। নরম হয়ে তো কাজ হচ্ছে না।
কর্মী নারীটি সংকটকে দেখছেন মায়ের অবস্থান থেকে, সমাজের সদস্য হিসেবে। আর ওই নেত্রী দেখছেন ক্ষমতার অবস্থান থেকে। দুই দলেরই অবস্থান সমাজের বিপক্ষে। দেশ ডুবলে যে তাঁরাও রেহাই পাবেন না, সেই হুঁশ নেই । জাহাজ ডুবলে প্রথম টের পায় খোলের তলার প্রাণীরা। দেশ ডুবলে প্রথম ‘বাঁচাও’ বলে সাধারণ মানুষ। ডুবন্ত জাহাজের নাবিকেরা বার্তা পাঠান: এসওএস (সেইভ আওয়ার সোউলস), আমাদের বাঁচাও! আজ সমগ্র বাংলাদেশই বলে উঠতে চাইছে, ‘সেইভ আওয়ার সৌলস’!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments