পাত্রদের নিঃস্ব ভাষা লালং by রাজীব নূর
'পাত্রদের
যদি নিঃস্ব জাতি বলা হয়, তাদের ভাষাকে বলতে হবে নিঃস্বতর ভাষা।'সিলেটের
আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের ভাষা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিলেটের লোকগবেষক ও
সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ এমন মন্তব্য করলেন। তারপর মনে করিয়ে দিলেন
পাত্রদের নিয়ে ড. রতন লাল চক্রবর্ত্তীর একটি বই আছে, যার নাম 'সিলেটের
নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র'। বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে।ওই বইয়ে রতন লাল
চক্রবর্ত্তী লিখেছেন, '১৮৭২ সালের প্রথম আদমশুমারি হতে অদ্যাবধি পাত্র
সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে বা আদিবাসী তথা উপজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।'
বইয়ে জানানো হয় রামকৃষ্ণ মিশন বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী পাত্রদের সংখ্যা
নিরূপণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওই প্রয়াসসম্পূর্ণ সফল হয়নি। রতন লাল
চক্রবর্ত্তী নিজেও পুরোপুরি সফল হননি বলে বইয়ে জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
'আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায় সম্পর্কেগবেষণার প্রধান অন্তরায় ছিল তাদের ভাষার
দুর্বোধ্যতা।'কেমন সে ভাষা? গবেষক সুমন কুমার দাশ বলেন, পাত্ররা বিশ্বাস
করে তাদের ভাষা কেউ শিখতে পারবে না। বয়োবৃদ্ধরা ছাড়া পাত্রদের সবাই বাংলা ও
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে। তবে বাইরের লোকজনের কাছে কোনো কিছু
গোপন রাখতে চাইলে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, সিলেটে বসবাসকারী ক্ষুদ্র
জাতিসত্তা পাত্রদের আলাদা সমাজ সংস্কৃতি ও ভাষা থাকলেও সে ভাষার কোনো
বর্ণমালা নেই। জাতিগতভাবে পাত্ররা 'বোড়া' জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে প িতরা
অনুমান করে থাকেন। ১৯০০ সালের শুরুতে ড. জি এ গ্রিয়ারসন তার
'লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া' গবেষণায় মণিপুরী, খাসি প্রভৃতি ভাষা
ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট তথা তৎকালীন আসাম অঞ্চলের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতির ভাষা
সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন, সেখানেও পাত্রদের ভাষার উল্লেখ নেই। পাত্রদের
ভাষার যেমন লিপি নেই, তেমনি নেই লিখিত কোনো নিদর্শনও। নিজেদের তারা লালং
জাতি এবং ভাষাকে লালং ভাষা বলে দাবি করেন। পাত্র সমাজে সর্বমোট ১২টি গোত্র
রয়েছে। এরা কখনও পাত্র, কখনও পাত্তর, আবার কখনও পাথর ইত্যাদি নামে অভিহিত
হয়েছে। কাঠ পুড়িয়ে অঙ্গারিক কয়লা বিক্রির মাধ্যমে জীবনযাপন করত বলেই তাদের
বলা হতো পাথর। কালের বিবর্তনের ধারায় ও ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনে এ পাথরই
হয়েছে পাত্র (পাথর>পাতর>পাত্র)।১৯১৭ সালে প্রকাশিত অচ্যুৎচরণ চৌধুরী
তত্ত্বনিধির লেখা 'শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত' থেকে উদৃব্দত করে সৌরভ সিকদার
জানান, এই পাত্রদের সম্পর্কে অচ্যুৎচরণ লিখেছিলেন, 'ইহারা খাসিয়া ও
জৈয়ন্তিয়া পাহাড় হইতে শ্রীহট্টের সমতল ক্ষেত্রে আসিয়া বসতি করিতেছে। কথিত
আছে প্রাচীনকালে ইহারা ভীমাপুরের (কাছাড়ের) নিকট বাস করিত।'সিলেটের আদিবাসী
পাত্র সম্প্রদায়ের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রাচীন ইতিহাস জানতে পারা যায় না বলে
জানালেন এনামুল হক সরদার। পাত্রদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ভারতের আসাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস তপোধীর ভট্টাচার্য্যের তত্ত্বাবধানে
পিএইচডি করছেন তিনি। এনামুল হক সরদার বলেন, পাত্ররা নিজেদেরকে সিলেটের রাজা
গৌড়গোবিন্দের প্রধান সেনাপতি মনারায়ের বংশধর বলে ভাবতে পছন্দ করেন।
পাত্রদের লোকমুখে প্রচলিত এই বিশ্বাসের দালিলিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, পাত্র সম্প্রদায় নিয়ে গবেষণার বাসনা ছাত্রজীবন থেকেই আমার মধ্যে
সুপ্ত ছিল। পরে তাদের প্রাচীন ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আগ্রহ বেড়ে যায়। পাত্ররা
নিজেদের সনাতন ধর্মাবলম্বী বললেও সনাতন বাঙালি হিন্দু সম্প্র্রদায় থেকে
অনেক আলাদা। পাত্রদের জন্ম, বিয়ে এবং এমন কী মৃত্যুর পর সম্পাদিত যাবতীয়
অনুষ্ঠান বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীদের মতোই নিজস্ব রীতিনীতিতে
সম্পন্ন হয়। তারা মূলত প্রকৃতি পূজারি, পাথর পূজা করেন। পাত্রদের দেহের
গঠন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। বাসস্থানের ক্ষেত্রেও
দেখা যায় পাত্ররা জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বা পাহাড়ের কাছাকাছি বসবাস করেন।
আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ও নিরবচ্ছিন্ন জীবনের ওপর প্রথম আঘাত
আসে উনিশ শতকের মধ্যভাগে, যখন সিলেটে চা চাষ শুরু হয়। খাদিমনগর টিলার উভয়
দিকের গ্রামগুলোতে দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় পাত্রদের যে বসতি গড়ে উঠেছিল,
সেখান থেকে তারা উচ্ছেদ হয়।পাত্র সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদের সভাপতি গৌরাঙ্গ
পাত্র বলেন, পাত্ররা দীর্ঘদিন ধরে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। পাত্র
সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদের নিজস্ব জরিপে সিলেট জেলার জৈন্তা, গোয়াইনঘাট ও
সিলেট সদর মিলিয়ে বর্তমানে পাত্রদের ৬০৭টি পরিবার রয়েছে। তাদের মোট
জনসংখ্যা তিন হাজার ৬৩৩ জন। তাদের প্রায় সবাই এখনও পাত্রদের লালং ভাষায় কথা
বলেন। তবে তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে, এখন লালং
ভাষায় ৫০ শতাংশের মতো বাংলা শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে। পাত্রদের এক থেকে দুই
শতাংশ মানুষ নিজেদের মধ্যেও এখন আর লালং ভাষায় কথাবার্তা বলেন না। তিনি তার
নিজের পরিবারের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমার পরিবারে এখনও লালং ভাষা প্রচলিত
রয়েছে। তবে চলি্লশোর্ধ্ব এই আমি কথা বলার সময় ভাষাটা যেভাবে ব্যবহার করি,
আমার পরের প্রজন্মই সেভাবে ব্যবহার করে না। ঘর থেকে বেরুলেই বাচ্চাদের
বাংলা ভাষার মুখোমুখি হতে হয়। তাই নতুন প্রজন্মের এই শিশুদের ভাষা বদলে
যাচ্ছে। তার ধারণা ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা
না হলে একদিন লালং ভাষা শুধু ইতিহাসের অংশ হবে।
No comments