শিক্ষায় সর্বনাশ by সাবি্বর নেওয়াজ ও কামরান সিদ্দিকী
লাগাতার
হরতাল-অবরোধ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে।
প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিঘি্নত হচ্ছে
পাঠদান। একের পর এক পরীক্ষার জট পাকছে। নতুন শিক্ষাবর্ষের দেড় মাস পার হতে
চললেও এখনও পুরোদমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি কোনো শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানই। পরীক্ষার শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে সারাদেশের এসএসসি ও সমমানের ১৫
লাখ পরীক্ষার্থী। চারটি পরীক্ষা দিয়ে এখন বাকি পরীক্ষাগুলো নিয়ে চরম
অনিশ্চয়তায় ভুগছে তারা। জানা নেই, কবে শেষ হবে এসএসসি পরীক্ষা। আগামী ১
এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া ১২ লাখ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীও একই কারণে
মন বসাতে পারছে না পড়ার টেবিলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লাখ শিক্ষার্থীর
সব ধরনের পরীক্ষা আটকে গেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তর মিলিয়ে
সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চলমান রাজনৈতিক
সহিংসতার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যমতে, সব
শিক্ষাস্তর মিলিয়ে একদিনে ক্লাস না হলে ১৬ কোটি শিক্ষাঘণ্টা (ক্লাস আওয়ার)
নষ্ট হয়। সে হিসাবে গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুক্রবার বাদে গত ৩৭ দিনে
বাংলাদেশের সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীর মোট ৫৯২ কোটি শিক্ষাঘণ্টা নষ্ট হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার যা ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে আগামী ৩০ বছর লাগবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, শিক্ষার ক্ষতি বা উন্নতি দুটোই রাতারাতি বোঝা যায় না। এ দুটোরই ফল সুদূরপ্রসারী।
চলমান হরতাল-অবরোধে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতও। রোববার হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। অপর এক রিট আদেশে হরতাল-অবরোধে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন একই আদালত। এ ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিলে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তবে সাধারণ অভিভাবকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় বাস্তবে এ আদেশ কতটুকু প্রতিপালন করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নগণ্য। প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত সব বিদ্যালয়েরই ক্লাস পুরোপুরি বন্ধ। পাড়া-মহল্লার ভেতরে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে অবরোধে ক্লাস হলেও হরতালে তা বন্ধ থাকে। সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই একই চিত্র। এখন আবার এসএসসির পরীক্ষাকেন্দ্র থাকায় বহু বিদ্যালয় এমনিতেই বন্ধ রয়েছে। আগামী জুনে বিদ্যালয়গুলোর ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। শিক্ষাসূচি ভেঙে পড়ায় ওই পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করা নিয়েই শিক্ষকরা এখন উদ্বিগ্ন। ঢাকার মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বদরউদ্দিন হাওলাদার সমকালকে বলেন, 'আমরা হরতাল-অবরোধে ক্লাস নিচ্ছি। তবে এসএসসির দিনগুলোতে ক্লাস বন্ধ থাকে।'
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, এভাবে যদি হরতাল-অবরোধ চলতে থাকে, তাহলে সিলেবাস শেষ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসরিন সুলতানা জানান, নতুন বছরের ক্লাসে দূরের শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। তার পরও যারা আসছে, তাদের নিয়ে চলছে পাঠদান। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে স্কুলে আসবেন না, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকরা অনেক কষ্ট করে এসে অফিস করছেন।
এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'মানুষের তৈরি দুর্যোগে বাচ্চাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়া মোটেই কাম্য নয়। এ ধরনের হরতালের ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে।'
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর হরতাল। ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি ছিল সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটি। ৫ জানুয়ারি ঘিরে ছিল উত্তেজনা, অনেকেই সেদিন স্কুলে যায়নি। আর ৬ জানুয়ারি থেকে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি। রাজনীতির খেলায় পিষ্ট হচ্ছে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি বিদ্যালয়ে চার কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। দশম শ্রেণীতে রয়েছে আরও অন্তত ১৮ লাখ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে দুই ক্লাসে ২০ লাখ ও উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রায় ২৫ লাখ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি। আর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সেশন শুরু হবে আগামী ১ জুলাই।
প্রতিদিন নষ্ট ১৬ কোটি শ্রেণীঘণ্টা: জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে এখন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা চার কোটি ৭৬ লাখ। তারা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এই তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ও নেতৃত্ব দেবে, যাদের বেশির ভাগই এখন শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের গবেষণায় দেখা যায়, একদিনের হরতালে নষ্ট হয় সাড়ে ১৬ কোটি শিক্ষাঘণ্টা। তার গবেষণামতে, দেশে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার কোটির মতো। আর একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে গড়ে একজন শিক্ষার্থী চারটি শ্রেণীঘণ্টার পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়। সে হিসাবে হরতালে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একদিন বন্ধ থাকলে সাড়ে ১৬ কোটি শ্রেণীঘণ্টা পাঠ থেকে শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করা হয়। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে সৌমিত্র শেখর বলেন, শিক্ষার প্রতিযোগিতা এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করা হয়। কোটি কোটি শিক্ষাঘণ্টা নষ্ট করে আমরা একটি স্থবির জাতিতে পরিণত হচ্ছি। তিনি বলেন, 'আমরা একদিনের হরতালে আলু-পটোলের কত টাকার ক্ষতি হলো, সেই হিসাব করি। শিক্ষার ক্ষতির হিসাব কখনও করি না।'
হিসাব করে দেখা গেছে, বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন আর অন্যান্য ছুটি থাকে ৮৫ দিন। সেই হিসাবে ১৩৭ দিন এমনিতেই বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছরেই থাকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা। ফলে বছরের বড় একটি অংশ ক্লাস ছাড়াই চলে শিক্ষার্থীদের। এর ওপর গত দেড় মাস টানা অবরোধ-হরতালে অনির্ধারিতভাবে বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে কোনোভাবেই সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
দুর্ভাবনায় হাবুডুবু খাচ্ছে পরীক্ষার্থীরা: ২ ফেব্রুয়ারির এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ৬ ফেব্রুয়ারি। পরীক্ষার্থীরা এ পর্যন্ত মাত্র চারটি পরীক্ষা দিতে পেরেছে। শুক্র ও শনিবার এসব পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কোনো কর্মদিবসেই হরতালের কারণে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুক্র-শনিবার মিলিয়ে এখন অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর পরীক্ষা আগেভাগে নিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর পর বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা প্রয়োজনে একদিনে দুটি নেওয়া হবে। যদিও দিনে দুটি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের আপত্তি রয়েছে।
এদিকে, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুর্ভাবনায় পড়েছে। এসএসসি সময়মতো শেষ না হলে তাদের পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে। টানা হরতাল-অবরোধের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশের কলেজগুলোয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ ও ডিগ্রি পাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। সারাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও একই চিত্র। কোথাও কোথাও ক্লাস হলেও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে প্রতিটিতেই। ফলে তৈরি হচ্ছে সেশনজট। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, 'হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তৈরি হচ্ছে সেশনজট। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা ও ভীতি ঢুকে গেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় রুটিনের অনিশ্চয়তা পরীক্ষার্থীদের জন্য কষ্টদায়ক ও মানসিক পীড়ার কারণ। এ অনিশ্চয়তায় পরীক্ষার পরের সময়টা তাদের নিজেদের মতো করে ব্যয়ের ইচ্ছাও ঝুলে আছে। ক্লাস-পরীক্ষা না হলে চাকরিজীবী মা-বাবা সাধারণত বাচ্চাদের বাসায় রেখে যান। অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় টিভি দেখা ছাড়া তখন তাদের কোনো কাজ থাকে না। আর টিভি খুললেই জ্বালাও-পোড়াও, অগি্নদগ্ধ মানুষের বীভৎস দৃশ্য শিশুদের ওপর মানসিকভাবে খারাপ প্রভাব ফেলে। জীবনের শুরুতেই শিশুরা খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে- সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরাও: গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইংরেজি মাধ্যমের এডেক্সেল কারিকুলামের 'ও' এবং 'এ' লেভেল পরীক্ষা দিতে পারেনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। ৬ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২৮ জানুয়ারি তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। সারাদেশের প্রায় সাত হাজার পরীক্ষার্থী ওই পরীক্ষা দিতে না পারায় একটি সেশন পিছিয়ে গেছে তারা। আগামী ছয় মাস পর ফের একই পরীক্ষায় তাদের অবতীর্ণ হতে হবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'বর্তমানে যা চলছে এটা জনবিধ্বংসী, সন্ত্রাসী কর্মকা ।
বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বললেও গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ মারা হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের যেসব শিক্ষার্থীর ছয় মাস পিছিয়ে গেল, আগামী পরীক্ষায়ও তাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। অভিভাবকদের ওপরও বাড়তি চাপ পড়ল। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের পরীক্ষা নেপাল বা মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখা পুরোপুরি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এভাবে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় এটাই প্রমাণিত হলো, আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ।'
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিভাবকদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আমিনা রতনা সমকালকে বলেন, 'দেশের এখন যা অবস্থা, তাতে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে বের হলে বাড়িতে ফিরতে পারব কি-না এর নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাকে স্কুলে পড়াতে এসে যদি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করাতে হয়, তাহলে কে স্কুলে যাবে?'
শিক্ষা ব্যবস্থার এই করুণ দশায় নিজের উদ্বেগ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে আরও বলেন, 'আমরা খুবই মর্মাহত যে, একটি বছরের শুরু থেকেই লেখাপড়া লাটে উঠেছে। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না পেট্রোল বোমার ভয়ে। ঠিকমতো পরীক্ষাটাও নিতে পারছি না। খুবই উদ্বেগের মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছি।
অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, অচিন্তনীয় ও অমানবিক পরিবেশের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে দিন কাটাতে হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'অনেক আবেদন-নিবেদন করেছি। আর লাভ নেই। শুধু পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে তা নয়। শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা ও চেতনায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যার খেসারত বহু বছর ধরে দেশকে, প্রজন্মকে দিতে হবে। এগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, প্রজন্মকে ধ্বংস করার কর্মসূচি।'
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার যা ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে আগামী ৩০ বছর লাগবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, শিক্ষার ক্ষতি বা উন্নতি দুটোই রাতারাতি বোঝা যায় না। এ দুটোরই ফল সুদূরপ্রসারী।
চলমান হরতাল-অবরোধে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতও। রোববার হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। অপর এক রিট আদেশে হরতাল-অবরোধে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন একই আদালত। এ ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিলে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তবে সাধারণ অভিভাবকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় বাস্তবে এ আদেশ কতটুকু প্রতিপালন করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নগণ্য। প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত সব বিদ্যালয়েরই ক্লাস পুরোপুরি বন্ধ। পাড়া-মহল্লার ভেতরে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে অবরোধে ক্লাস হলেও হরতালে তা বন্ধ থাকে। সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই একই চিত্র। এখন আবার এসএসসির পরীক্ষাকেন্দ্র থাকায় বহু বিদ্যালয় এমনিতেই বন্ধ রয়েছে। আগামী জুনে বিদ্যালয়গুলোর ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। শিক্ষাসূচি ভেঙে পড়ায় ওই পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করা নিয়েই শিক্ষকরা এখন উদ্বিগ্ন। ঢাকার মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বদরউদ্দিন হাওলাদার সমকালকে বলেন, 'আমরা হরতাল-অবরোধে ক্লাস নিচ্ছি। তবে এসএসসির দিনগুলোতে ক্লাস বন্ধ থাকে।'
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, এভাবে যদি হরতাল-অবরোধ চলতে থাকে, তাহলে সিলেবাস শেষ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসরিন সুলতানা জানান, নতুন বছরের ক্লাসে দূরের শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। তার পরও যারা আসছে, তাদের নিয়ে চলছে পাঠদান। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে স্কুলে আসবেন না, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকরা অনেক কষ্ট করে এসে অফিস করছেন।
এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'মানুষের তৈরি দুর্যোগে বাচ্চাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়া মোটেই কাম্য নয়। এ ধরনের হরতালের ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে।'
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর হরতাল। ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি ছিল সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটি। ৫ জানুয়ারি ঘিরে ছিল উত্তেজনা, অনেকেই সেদিন স্কুলে যায়নি। আর ৬ জানুয়ারি থেকে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি। রাজনীতির খেলায় পিষ্ট হচ্ছে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি বিদ্যালয়ে চার কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। দশম শ্রেণীতে রয়েছে আরও অন্তত ১৮ লাখ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে দুই ক্লাসে ২০ লাখ ও উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রায় ২৫ লাখ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি। আর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সেশন শুরু হবে আগামী ১ জুলাই।
প্রতিদিন নষ্ট ১৬ কোটি শ্রেণীঘণ্টা: জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে এখন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা চার কোটি ৭৬ লাখ। তারা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এই তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ও নেতৃত্ব দেবে, যাদের বেশির ভাগই এখন শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের গবেষণায় দেখা যায়, একদিনের হরতালে নষ্ট হয় সাড়ে ১৬ কোটি শিক্ষাঘণ্টা। তার গবেষণামতে, দেশে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার কোটির মতো। আর একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে গড়ে একজন শিক্ষার্থী চারটি শ্রেণীঘণ্টার পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়। সে হিসাবে হরতালে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একদিন বন্ধ থাকলে সাড়ে ১৬ কোটি শ্রেণীঘণ্টা পাঠ থেকে শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করা হয়। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে সৌমিত্র শেখর বলেন, শিক্ষার প্রতিযোগিতা এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করা হয়। কোটি কোটি শিক্ষাঘণ্টা নষ্ট করে আমরা একটি স্থবির জাতিতে পরিণত হচ্ছি। তিনি বলেন, 'আমরা একদিনের হরতালে আলু-পটোলের কত টাকার ক্ষতি হলো, সেই হিসাব করি। শিক্ষার ক্ষতির হিসাব কখনও করি না।'
হিসাব করে দেখা গেছে, বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন আর অন্যান্য ছুটি থাকে ৮৫ দিন। সেই হিসাবে ১৩৭ দিন এমনিতেই বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছরেই থাকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা। ফলে বছরের বড় একটি অংশ ক্লাস ছাড়াই চলে শিক্ষার্থীদের। এর ওপর গত দেড় মাস টানা অবরোধ-হরতালে অনির্ধারিতভাবে বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে কোনোভাবেই সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
দুর্ভাবনায় হাবুডুবু খাচ্ছে পরীক্ষার্থীরা: ২ ফেব্রুয়ারির এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ৬ ফেব্রুয়ারি। পরীক্ষার্থীরা এ পর্যন্ত মাত্র চারটি পরীক্ষা দিতে পেরেছে। শুক্র ও শনিবার এসব পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কোনো কর্মদিবসেই হরতালের কারণে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুক্র-শনিবার মিলিয়ে এখন অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর পরীক্ষা আগেভাগে নিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর পর বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা প্রয়োজনে একদিনে দুটি নেওয়া হবে। যদিও দিনে দুটি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের আপত্তি রয়েছে।
এদিকে, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুর্ভাবনায় পড়েছে। এসএসসি সময়মতো শেষ না হলে তাদের পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে। টানা হরতাল-অবরোধের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশের কলেজগুলোয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ ও ডিগ্রি পাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। সারাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও একই চিত্র। কোথাও কোথাও ক্লাস হলেও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে প্রতিটিতেই। ফলে তৈরি হচ্ছে সেশনজট। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, 'হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তৈরি হচ্ছে সেশনজট। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা ও ভীতি ঢুকে গেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় রুটিনের অনিশ্চয়তা পরীক্ষার্থীদের জন্য কষ্টদায়ক ও মানসিক পীড়ার কারণ। এ অনিশ্চয়তায় পরীক্ষার পরের সময়টা তাদের নিজেদের মতো করে ব্যয়ের ইচ্ছাও ঝুলে আছে। ক্লাস-পরীক্ষা না হলে চাকরিজীবী মা-বাবা সাধারণত বাচ্চাদের বাসায় রেখে যান। অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় টিভি দেখা ছাড়া তখন তাদের কোনো কাজ থাকে না। আর টিভি খুললেই জ্বালাও-পোড়াও, অগি্নদগ্ধ মানুষের বীভৎস দৃশ্য শিশুদের ওপর মানসিকভাবে খারাপ প্রভাব ফেলে। জীবনের শুরুতেই শিশুরা খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে- সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরাও: গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইংরেজি মাধ্যমের এডেক্সেল কারিকুলামের 'ও' এবং 'এ' লেভেল পরীক্ষা দিতে পারেনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। ৬ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২৮ জানুয়ারি তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। সারাদেশের প্রায় সাত হাজার পরীক্ষার্থী ওই পরীক্ষা দিতে না পারায় একটি সেশন পিছিয়ে গেছে তারা। আগামী ছয় মাস পর ফের একই পরীক্ষায় তাদের অবতীর্ণ হতে হবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'বর্তমানে যা চলছে এটা জনবিধ্বংসী, সন্ত্রাসী কর্মকা ।
বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বললেও গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ মারা হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের যেসব শিক্ষার্থীর ছয় মাস পিছিয়ে গেল, আগামী পরীক্ষায়ও তাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। অভিভাবকদের ওপরও বাড়তি চাপ পড়ল। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের পরীক্ষা নেপাল বা মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখা পুরোপুরি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এভাবে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় এটাই প্রমাণিত হলো, আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ।'
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিভাবকদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আমিনা রতনা সমকালকে বলেন, 'দেশের এখন যা অবস্থা, তাতে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে বের হলে বাড়িতে ফিরতে পারব কি-না এর নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাকে স্কুলে পড়াতে এসে যদি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করাতে হয়, তাহলে কে স্কুলে যাবে?'
শিক্ষা ব্যবস্থার এই করুণ দশায় নিজের উদ্বেগ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে আরও বলেন, 'আমরা খুবই মর্মাহত যে, একটি বছরের শুরু থেকেই লেখাপড়া লাটে উঠেছে। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না পেট্রোল বোমার ভয়ে। ঠিকমতো পরীক্ষাটাও নিতে পারছি না। খুবই উদ্বেগের মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছি।
অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, অচিন্তনীয় ও অমানবিক পরিবেশের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে দিন কাটাতে হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'অনেক আবেদন-নিবেদন করেছি। আর লাভ নেই। শুধু পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে তা নয়। শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা ও চেতনায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যার খেসারত বহু বছর ধরে দেশকে, প্রজন্মকে দিতে হবে। এগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, প্রজন্মকে ধ্বংস করার কর্মসূচি।'
No comments