বসন্তের দিন, প্রণয়ের আভাস by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
শীতের
পরশ মিলিয়ে যায়নি। হঠাৎ উতল হাওয়া। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
কেমন করে যেন গিয়ে হাজির। কাউকে না জানিয়ে বসন্ত তার হলুদ পতাকা উড়িয়ে
সেখানে উপস্থিত, গানে গানে, কবিতায় আর ভালোবাসার মধুর উচ্চারণে। নবীন
যারা, তাদের কাছে না পৌঁছালে বসন্তকে শনাক্ত করতে পারি না। যেখানে তারুণ্য
নেই, বসন্ত নেই। বন্ধু না থাকলে কোকিল ডাকে না, কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে থাকে
না রঙের বিলাস। পেছনের দিনগুলো কথা কয়। আনোয়ারউদ্দিন খান আর আমি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট একটি রুমে সারা দিন গান গাইতাম। কণ্ঠটি মধুর এবং
উচ্চারণ মর্মস্পর্শী। তবলা বাজানোর কেউ নেই, আমিই বাজাতাম। গান ধরলে ও
সুন্দর সুন্দর টোকা দিত। দুজনের গান শুনতাম দুজনে। ওর আশা ছিল, কোঁকড়া
চুলের একটি মেয়ে চুপি চুপি এসে দাঁড়াবে ওর গান শুনতে। এমনটি ঘটল একদিন।
কোঁকড়া চুলের একটি মেয়ে সন্তর্পণে ঘরে প্রবেশ করে বসে পড়ে তবলচির পাশেই।
আনোয়ারউদ্দিনের খোঁজে। ওর গান ভালোবাসত মন থেকে। গানের ভালোবাসা আর
জীবনের ভালোবাসা যে আলাদা। আরও একদিন এসেছিল। হাতে কার্ড নিয়ে। কারও নাম
লেখা নেই। সম্ভবত আনোয়ারউদ্দিনের নামটি লিখতে চেয়েছিল, সময় পায়নি। তার
বিয়ের কার্ড।
যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, কত কিছুই যে ভালো লাগত। মৌসুমি ফুলগুলো ফুটে থাকত প্রেমিকদের জন্য। মনে আছে, একেকটি ফুলের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম; বিশেষ করে কসমস, তার রঙের সীমাহীন বৈচিত্র৵ নিয়ে। ডালিয়ার ফুটে থাকা আরেক বিস্ময়! একেকটি ফুলের আশ্রয়ে শত পাপড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তো মাত্র কয়েকটি মেয়ে, পরনে সাদা শাড়ি। হয়তো একটি ছোট পাড়, সবুজ অথবা লাল। ফাল্গুনে এ শাড়ির রং হতো হলুদ। তাদের মোহনীয় সৌন্দর্য পরিবেশকে করে তুলত বেহেশতি। একটি
মেয়ে আসত তার ভাবির আঁচল ধরে। এতই লজ্জাশীলা যে কখনোই তাকে একা দেখা যায়নি, ফুলের মতোই মিষ্টি ও পবিত্র তাদের সৌন্দর্য। এ কথা সত্যি যে যৌবনের অনুভূতিটুকুই জাগিয়ে দেয় প্রেম। গানে গানে সে প্রেম হয় মুখরিত।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছিলেন কৃষ্ণচূড়ার প্রথম গান: ‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’। সুর দিলেন আবদুল আহাদ। গাইলেন বোন ফেরদৌসী। এক গানেই মাত। প্রথম আধুনিক বাংলা গান। রেডিওতেই বেজেছে হাজারবার। সবার মনে মনে গেঁথে আছে গানটি। আবু হেনাকে বললাম, আমার গান কই? লিখলেন আমার জন্য:
‘মহুয়ার বনে বনে মৌমাছি ওড়ে মনবিলাসে/ ঝিকিমিকি রোদ লাগে পলাশে। ফুলে ফুলে গুঞ্জন/ ভুলে বুঝি যায় মন/ ফাগুনের আলোড়ন দোলা দেয় চঞ্চল বাতাসে’। রেডিওতে গাওয়ার পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন ভালোবাসার বাতাস বয়ে গেল। পরের লাইনটি শুনুন: ‘কেন আর দূরে থাক সহেলি/ আকাশে তো আর নেই পৌষের কুহেলি/ রুনুঝুনু ছন্দে মাধবীর গন্ধে/ ছড়ায়ে আনন্দে এসো তুমি প্রণয়ের আভাসে’।
সুর করল আনোয়ারউদ্দিন খান, আবু হেনার প্রাণের বন্ধু। দেখা গেল সুরটি আমার কণ্ঠেই বেশি মানিয়েছে। সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হলে নানা অনুষ্ঠানে আমিই গানটি গেয়েছি। আনোয়ার রেকর্ড করল না, আমিই করলাম। আনোয়ারের আশা ছিল, গানটির শেষ চরণে তার ‘প্রণয়ের আভাস’ দল মেলবে। মেলেনি। গীতিকার-সুরকার কিছুই পেলেন না। পেলেন, যিনি গানটি কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন।
তখন মোবাইল নেই। চিঠিপত্র দূরাগত। ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন’। দেখাদেখি নেই, কিছুই নেই। যা কিছু শুধু কবিতায় ও গানে। আবু হেনা আরও কয়েকটি গান লিখলেন আমার জন্য। ‘এ গান আমার ফুলের মতো ঝরে যেতে চায়/ পথের ধুলায় এবার সে তো হারিয়ে যাবে হায়’। গানটির প্রতিটি কথা ভালোবাসার মানুষের জন্য নিবেদিত। এখন ভাবি, কীভাবে এত সুন্দর গান তিনি লিখতে পারলেন। তিনি যাঁকে ভালোবাসতেন, তিনি থাকত অনেক দূরে। গ্রামের বালিকা বধূ তিনি। পরের দিন লিখলেন: ‘গানে আমার এ কোন মায়া মেঘের মতো রং ছড়ায়/ স্বপ্ন আমার নদীর মতো অনেক দূরে হারিয়ে যায়...’। আবু হেনা সব কটি গান আমার খাতায় লিখে দেন। যে গানটি আমার কণ্ঠে তার সবচেয়ে ভালো লাগত: ‘মহুয়ার হাসিতে রাখালিয়া বাঁশিতে ভুলেছি আমি/ পলাশের মেলাতে ফাগুনের দোলাতে দুলেছি আমি’।
আবু হেনার গান গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন তুললাম। ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লক্ষ করল। বলল, আব্বাসী, আমিও তোমাকে গান দেব। শর্ত একটাই। গানগুলোতে নিজেই সুরারোপ করবে। সেদিনই প্রথম গান পেলাম: ‘কুসুমে কাঁপে ওই ফাল্গুনী সন্ধ্যা/ ঘনালো কাজলে কালো কী নিবিড় তন্দ্রা’। সুর দিলাম। মনিরুজ্জামান আমাকে জড়িয়ে ধরল। মনিরুজ্জামানের সঙ্গে তখনো রাশিদার বিয়ে হয়নি। জানি, গানটি সে রাশিদার জন্য লিখেছিল। পরের গানটি: ‘মিনতি জড়ানো মধুর কণ্ঠে যে কথা শুনেছিলাম/ আজ মনে হয় সে শুধু ছলনা নেই তার কোনো দাম’। মনিরুজ্জামানের শব্দচয়ন ছন্দঘন, প্রেম উচ্ছ্বাসী ও বেদনার হাসি লুকোনো। সেই গানই মানুষ গাইবে, যাতে লুকোনো বেদনার আভাস। বসন্তের দিন এলে ওই গানগুলো আমার বেদনাকে উসকে দেয়। আবু হেনার লেখা: ‘ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না, ফুলের দেশে’। ওরা যেখানেই থাকুক, ওই গানগুলো বসন্তের প্রণয় আভাস ভোমরের পাখনায় ভর করে দিনগুলোকে কাছে নিয়ে আসে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, কত কিছুই যে ভালো লাগত। মৌসুমি ফুলগুলো ফুটে থাকত প্রেমিকদের জন্য। মনে আছে, একেকটি ফুলের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম; বিশেষ করে কসমস, তার রঙের সীমাহীন বৈচিত্র৵ নিয়ে। ডালিয়ার ফুটে থাকা আরেক বিস্ময়! একেকটি ফুলের আশ্রয়ে শত পাপড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তো মাত্র কয়েকটি মেয়ে, পরনে সাদা শাড়ি। হয়তো একটি ছোট পাড়, সবুজ অথবা লাল। ফাল্গুনে এ শাড়ির রং হতো হলুদ। তাদের মোহনীয় সৌন্দর্য পরিবেশকে করে তুলত বেহেশতি। একটি
মেয়ে আসত তার ভাবির আঁচল ধরে। এতই লজ্জাশীলা যে কখনোই তাকে একা দেখা যায়নি, ফুলের মতোই মিষ্টি ও পবিত্র তাদের সৌন্দর্য। এ কথা সত্যি যে যৌবনের অনুভূতিটুকুই জাগিয়ে দেয় প্রেম। গানে গানে সে প্রেম হয় মুখরিত।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছিলেন কৃষ্ণচূড়ার প্রথম গান: ‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’। সুর দিলেন আবদুল আহাদ। গাইলেন বোন ফেরদৌসী। এক গানেই মাত। প্রথম আধুনিক বাংলা গান। রেডিওতেই বেজেছে হাজারবার। সবার মনে মনে গেঁথে আছে গানটি। আবু হেনাকে বললাম, আমার গান কই? লিখলেন আমার জন্য:
‘মহুয়ার বনে বনে মৌমাছি ওড়ে মনবিলাসে/ ঝিকিমিকি রোদ লাগে পলাশে। ফুলে ফুলে গুঞ্জন/ ভুলে বুঝি যায় মন/ ফাগুনের আলোড়ন দোলা দেয় চঞ্চল বাতাসে’। রেডিওতে গাওয়ার পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন ভালোবাসার বাতাস বয়ে গেল। পরের লাইনটি শুনুন: ‘কেন আর দূরে থাক সহেলি/ আকাশে তো আর নেই পৌষের কুহেলি/ রুনুঝুনু ছন্দে মাধবীর গন্ধে/ ছড়ায়ে আনন্দে এসো তুমি প্রণয়ের আভাসে’।
সুর করল আনোয়ারউদ্দিন খান, আবু হেনার প্রাণের বন্ধু। দেখা গেল সুরটি আমার কণ্ঠেই বেশি মানিয়েছে। সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হলে নানা অনুষ্ঠানে আমিই গানটি গেয়েছি। আনোয়ার রেকর্ড করল না, আমিই করলাম। আনোয়ারের আশা ছিল, গানটির শেষ চরণে তার ‘প্রণয়ের আভাস’ দল মেলবে। মেলেনি। গীতিকার-সুরকার কিছুই পেলেন না। পেলেন, যিনি গানটি কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন।
তখন মোবাইল নেই। চিঠিপত্র দূরাগত। ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন’। দেখাদেখি নেই, কিছুই নেই। যা কিছু শুধু কবিতায় ও গানে। আবু হেনা আরও কয়েকটি গান লিখলেন আমার জন্য। ‘এ গান আমার ফুলের মতো ঝরে যেতে চায়/ পথের ধুলায় এবার সে তো হারিয়ে যাবে হায়’। গানটির প্রতিটি কথা ভালোবাসার মানুষের জন্য নিবেদিত। এখন ভাবি, কীভাবে এত সুন্দর গান তিনি লিখতে পারলেন। তিনি যাঁকে ভালোবাসতেন, তিনি থাকত অনেক দূরে। গ্রামের বালিকা বধূ তিনি। পরের দিন লিখলেন: ‘গানে আমার এ কোন মায়া মেঘের মতো রং ছড়ায়/ স্বপ্ন আমার নদীর মতো অনেক দূরে হারিয়ে যায়...’। আবু হেনা সব কটি গান আমার খাতায় লিখে দেন। যে গানটি আমার কণ্ঠে তার সবচেয়ে ভালো লাগত: ‘মহুয়ার হাসিতে রাখালিয়া বাঁশিতে ভুলেছি আমি/ পলাশের মেলাতে ফাগুনের দোলাতে দুলেছি আমি’।
আবু হেনার গান গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন তুললাম। ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লক্ষ করল। বলল, আব্বাসী, আমিও তোমাকে গান দেব। শর্ত একটাই। গানগুলোতে নিজেই সুরারোপ করবে। সেদিনই প্রথম গান পেলাম: ‘কুসুমে কাঁপে ওই ফাল্গুনী সন্ধ্যা/ ঘনালো কাজলে কালো কী নিবিড় তন্দ্রা’। সুর দিলাম। মনিরুজ্জামান আমাকে জড়িয়ে ধরল। মনিরুজ্জামানের সঙ্গে তখনো রাশিদার বিয়ে হয়নি। জানি, গানটি সে রাশিদার জন্য লিখেছিল। পরের গানটি: ‘মিনতি জড়ানো মধুর কণ্ঠে যে কথা শুনেছিলাম/ আজ মনে হয় সে শুধু ছলনা নেই তার কোনো দাম’। মনিরুজ্জামানের শব্দচয়ন ছন্দঘন, প্রেম উচ্ছ্বাসী ও বেদনার হাসি লুকোনো। সেই গানই মানুষ গাইবে, যাতে লুকোনো বেদনার আভাস। বসন্তের দিন এলে ওই গানগুলো আমার বেদনাকে উসকে দেয়। আবু হেনার লেখা: ‘ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না, ফুলের দেশে’। ওরা যেখানেই থাকুক, ওই গানগুলো বসন্তের প্রণয় আভাস ভোমরের পাখনায় ভর করে দিনগুলোকে কাছে নিয়ে আসে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments