শিক্ষার্থীদের চোখে আমাদের দুই ভাষাকন্যা by ড. সুফিয়া আহমেদ ও ড. হাবিবা খাতুন
(১৯৪৮-৫২ ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী। মাতৃভাষার জন্য লড়াই করেছেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। তৈরি করেছেন শিক্ষায়-দীক্ষায় অসংখ্য সফল মানুষ। জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ এবং প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে নিয়ে লিখেছেন তেমনি দুজন সফল শিক্ষার্থী ড. হাবিবা খাতুন ও ডা. জুলিয়া আহমেদ আলোকচিত্রী মাহমুদুল হাসান) সদ্য
বিলেত ফেরত নারী শিক্ষক সুফিয়া আহমেদ যেদিন কলাভবনের তিনতলার শ্রেণীকক্ষে
প্রবেশ করলেন তখনই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। সেদিন আমার মতো ছাত্রছাত্রীরা
তার মাঝে আধুনিক জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করেছিল। তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কৃতী ছাত্রী ছিলেন।
বিলেতে SOAS থেকে পিএইচডি শেষ করে সরাসরি একই বিভাগে শিক্ষক হয়েছিলেন তারই
শিক্ষকদের সঙ্গে। তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম নারী
শিক্ষকও বটে।
নির্ভীক বাস্তববাদী ইতিহাসবিদ জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের প্রিয় শিক্ষক। মানুষ হিসেবেও তিনি অমায়িক। পাঠকালীন সময়েই জানতে পারি, তিনি একজন ভাষাকন্যা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় নির্ভীক এ শিক্ষককে আমরা প্রতি পদক্ষেপে অনুসরণ করেছি। যদিও জীবনের শুরু থেকে তিনি তার আইনজ্ঞ বাবাকে চিন্তায় ও চেতনায় অনুকরণ করতেন। জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের চিন্তালগ্নের শুরুতেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার কথা হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে ভাবতেন। সাহসী বাবার মতো যৌক্তিক কারণনির্ভর সুফিয়া আহমেদ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ছাত্র আন্দোলনে জড়িত হন। তিনি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের অংশীদার হন। এ আন্দোলনে তিনি নিজে, বোরখা পরা পর্দানশীন সহপাঠী শামসুন নাহার সক্রিয়ভাবে এবং বিভিন্ন বাড়ির গৃহিণীরা মানসিকভাবে যে সম্পৃক্ত ছিলেন একথা তার বিভিন্ন বক্তৃতায় অকপটে ব্যক্ত করেছেন। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। জয়তু সুফিয়া আহমেদ। তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে ধন্য আমরা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করে ইংরেজিতে পারদর্শী ড. সুফিয়া আহমেদ বাংলা ভাষায় সর্বসাধারণের মাঝে ইতিহাস চর্চা হোক এটা চাইতেন। তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সুদক্ষ কর্মী। আর্থিক যোগান দিয়ে, চিন্তা দিয়ে বিভিন্ন গুণীজনদের সুচিন্তিত ঐতিহাসিক বক্তৃতার আয়োজন করে তিনি বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চাকে অব্যাহত রেখেছেন, গতিময় রেখেছেন। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের মুখপাত্র ‘ইতিহাস’ প্রচার তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উজ্জ্বলতর ভূমিকা রাখছে। তিনি আমাদের ধ্রুবশক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের পীঠস্থান। এর চত্বরে কিংবা শ্রেণীকক্ষে আমাদের প্রিয় শিক্ষক ড. সুফিয়া আহমেদ এক স্মরণীয়, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি কীভাবে ক্লাসে পড়াতেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী রাখতেন সে এক আশ্চর্য বিষয়। তিনি দৃঢ়পদে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে পাঠদান করতেন। পাঠ্য বিষয়ের পরিমাণ এত বেশি ও আকর্ষণীয় থাকত যে, অমনোযোগী হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আজ জাতীয় অধ্যাপক। জাতীয় গৌরবের ধারক। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কথ্য ইতিহাস কার্যক্রমের আওতায় বরেণ্য ব্যক্তিদের মাঝে বরণীয় হয়েছেন। বরেণ্যদের জীবনের ওপর প্রামাণ্য চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জীবনকর্মের বিভিন্ন অর্জনের ওপর প্রদর্শনী হয়েছে এবং স্মৃতিচারণ করেছেন তারা। ভাষাকন্যা জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কৃতী ছাত্রী ও শিক্ষক হিসেবে এসব বরেণ্যদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার সব গুণগ্রাহীদের মুগ্ধ করেছেন। বরণীয় হয়েছেন সবার কাছে। তিনি অনেক দরিদ্র ছাত্রছাত্রীকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। তারই আর্থিক সহযোগিতায় এসব শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে।
ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের জাতির গৌরব। আধুনিক বিশ্বের নারী জাতির তিনি পথপ্রদর্শক। সুশিক্ষার আলোকদানকারী এ মহীয়সী নারীর দীর্ঘায়ু কামনা করি, যারা আলোকিত হয়েছি তারই আদর্শ নিয়ে।
প্রিয় অধ্যক্ষ ভাষাকন্যা মিস্ মুৎসুদ্দি
ডা. জুলিয়া আহমেদ
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের গভীর প্রভাব হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকে। জীবনে চলার পথে সেসব স্মৃতি আলোকবর্তিকা হয়ে ক্ষণে ক্ষণেই উজ্জীবিত করে তোলে আমার মনন। আমি আজ যার কথা বলছি, তিনি এমনই একজন মানুষ; যার মহান ছোঁয়ায় আমার আর আমার বোন ডালিয়া আহমেদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সুশিক্ষা। শিক্ষা পরবর্তী জীবনে যার সুপ্রভাবে আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে ও পারিবারিক জীবনে পেয়েছি নান্দনিক পরিপূর্ণতা। তিনি আমাদের সবার প্রিয় ভারতেশ্বরী হোমসের সাবেক অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি। আমরা তাকে মিস্ মুৎসুদ্দি নামেই সম্বোধন করতাম।
খুব অল্প বয়সেই আমি জীবন শুরু করেছিলাম। তখন বইপত্র থেকে আমি কি শিখেছি তা মনে করা কঠিন; কিন্তু আমি অনায়াসে যা মনে করতে পারি তা হল কঠিন নিয়মানুবর্তিতা। শ্রেণী শিক্ষক, হোস্টেল শিক্ষক যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা আমাদের দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা সময়ানুযায়ী সব কাজ নিয়মমতো করতে বাধ্য করেছিলেন। যদিও সেসব কঠিন নিয়মানুবর্তিতা মেনে নিতে বা মেনে চলতে তখন খুব কষ্ট হতো। কিন্তু পরে অনুধাবন করতে পেরেছি, সেই কঠিন অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যবসায়ই ছিল আসলে সুপরিশীলিত জীবন গড়া ও চলার দক্ষতা অর্জনের জন্য মহান শিক্ষা। যা আমরা খুব অল্প বয়সেই বই পড়ার পাশাপাশি বাস্তব কাজ যেমন- থাকার ঘর, বাথরুম, খাবার ঘর, সিঁড়ি, রাস্তা, ড্রেন, মাঠ ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমেই শিখেছিলাম।
আমরা আরও শিখেছিলাম মানবিকতা, মূল্যবোধ, সততা। এগুলো শুধু পড়া বা বলার জন্যই নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনে সব কাজে সৎ থাকা, সময় মেনে চলা, বঞ্চিতদের সহায়তা করা, সামাজিক ন্যায্যতা চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে জীবন পরিচালিত করার সুদৃঢ় প্রত্যয়ী শিক্ষা। যা আমরা বহন করে চলেছি আজও নিরলস নিরন্তর।
আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে যে অত্যুজ্জ্বল মানুষটির কথা বলতে চাই তিনি সেই মিস্ মুৎসুদ্দি। যিনি তার সুদৃঢ় সুশৃংখল চালিকাশক্তির দ্বারা ভারতেশ্বরী হোমসকে নিয়ে গিয়েছেন বা রূপান্তরিত করেছেন অনেক উঁচুমাত্রার সুযোগ্য শিক্ষালয়ে। তার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছিলাম এক চমৎকার সংস্কৃতিময় পরিবেশ। ধর্ম বর্ণ মত নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেছি আমরা তারই সুনিবিড় ছায়াতলে। ভারতেশ্বরী হোমসে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের ছাত্রীরাই ছিল একসঙ্গে। নামাজ শিক্ষা, ঈদ, সরস্বতী পূজা অর্চনা, বড়দিন বা বৌদ্ধপূর্ণিমা সব উৎসবে আমরা সবাই মিলে সমানভাবে উপভোগ করেছি- তা থেকে আমরা প্রায়োগিকভাবে বিশ্বাস করতে শিখেছি মানব কল্যাণই হল বড় ধর্ম। ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে কোনো বিভেদ নয়- কবির ভাষায় ‘সকলেই আমরা সকলের তরে’।
ভারতেশ্বরী হোমসের সাবেক একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সেই সুশিক্ষাকে আজ অনায়াসে অনুধাবন করতে পারি এবং সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারি আমাদের মূল সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ- ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে।
ভারতেশ্বরী হোমস আজ যে গৌরবময় অবস্থানে এসে পৌঁছেছে তার পেছনে প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধাস্পদ জেঠামণি ও রণদা প্রসাদ সাহার অবদান ইতিহাস হয়ে আছে। আজ যে আমরা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বা সময় অতিবাহিত করছি সেখানে ভারতেশ্বরী হোমসের অবদান প্রণিধানযোগ্য।
মিস্ মুৎসুদ্দি ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮-৫২) একজন সক্রিয় সৈনিক, ভাষা কন্যা। এ অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। আজ যখন আমি আমার স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের সঙ্গে মনে করি, তার মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের দিকনির্দেশনা। আমার ছোট্ট কৈশোর চেতনায় তিনি তা আমার মনের গভীরে প্রোথিত করেছেন। জীবনের প্রথম ধাপেই তার কাছে শিখেছিলাম, ‘বিয়েই একজন মেয়ের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না।’ তার কাছ থেকে শেখার অদম্য আকাক্সক্ষা আজও সমান অম্লান। তাই ধবধবে সাদা শাড়ি পরা সাদা মনের প্রিয় মিস্ মুৎসুদ্দিকে নিশ্চিত প্রেরণায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছি জীবনের সম্মুখ পানে।
এ সাহসী মানুষটির কাছ থেকে এখনও আমার শেখার আছে অনেক কিছু।
নির্ভীক বাস্তববাদী ইতিহাসবিদ জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের প্রিয় শিক্ষক। মানুষ হিসেবেও তিনি অমায়িক। পাঠকালীন সময়েই জানতে পারি, তিনি একজন ভাষাকন্যা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় নির্ভীক এ শিক্ষককে আমরা প্রতি পদক্ষেপে অনুসরণ করেছি। যদিও জীবনের শুরু থেকে তিনি তার আইনজ্ঞ বাবাকে চিন্তায় ও চেতনায় অনুকরণ করতেন। জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের চিন্তালগ্নের শুরুতেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার কথা হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে ভাবতেন। সাহসী বাবার মতো যৌক্তিক কারণনির্ভর সুফিয়া আহমেদ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ছাত্র আন্দোলনে জড়িত হন। তিনি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের অংশীদার হন। এ আন্দোলনে তিনি নিজে, বোরখা পরা পর্দানশীন সহপাঠী শামসুন নাহার সক্রিয়ভাবে এবং বিভিন্ন বাড়ির গৃহিণীরা মানসিকভাবে যে সম্পৃক্ত ছিলেন একথা তার বিভিন্ন বক্তৃতায় অকপটে ব্যক্ত করেছেন। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। জয়তু সুফিয়া আহমেদ। তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে ধন্য আমরা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করে ইংরেজিতে পারদর্শী ড. সুফিয়া আহমেদ বাংলা ভাষায় সর্বসাধারণের মাঝে ইতিহাস চর্চা হোক এটা চাইতেন। তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সুদক্ষ কর্মী। আর্থিক যোগান দিয়ে, চিন্তা দিয়ে বিভিন্ন গুণীজনদের সুচিন্তিত ঐতিহাসিক বক্তৃতার আয়োজন করে তিনি বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চাকে অব্যাহত রেখেছেন, গতিময় রেখেছেন। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের মুখপাত্র ‘ইতিহাস’ প্রচার তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উজ্জ্বলতর ভূমিকা রাখছে। তিনি আমাদের ধ্রুবশক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের পীঠস্থান। এর চত্বরে কিংবা শ্রেণীকক্ষে আমাদের প্রিয় শিক্ষক ড. সুফিয়া আহমেদ এক স্মরণীয়, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি কীভাবে ক্লাসে পড়াতেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী রাখতেন সে এক আশ্চর্য বিষয়। তিনি দৃঢ়পদে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে পাঠদান করতেন। পাঠ্য বিষয়ের পরিমাণ এত বেশি ও আকর্ষণীয় থাকত যে, অমনোযোগী হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আজ জাতীয় অধ্যাপক। জাতীয় গৌরবের ধারক। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কথ্য ইতিহাস কার্যক্রমের আওতায় বরেণ্য ব্যক্তিদের মাঝে বরণীয় হয়েছেন। বরেণ্যদের জীবনের ওপর প্রামাণ্য চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জীবনকর্মের বিভিন্ন অর্জনের ওপর প্রদর্শনী হয়েছে এবং স্মৃতিচারণ করেছেন তারা। ভাষাকন্যা জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কৃতী ছাত্রী ও শিক্ষক হিসেবে এসব বরেণ্যদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার সব গুণগ্রাহীদের মুগ্ধ করেছেন। বরণীয় হয়েছেন সবার কাছে। তিনি অনেক দরিদ্র ছাত্রছাত্রীকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। তারই আর্থিক সহযোগিতায় এসব শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে।
ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের জাতির গৌরব। আধুনিক বিশ্বের নারী জাতির তিনি পথপ্রদর্শক। সুশিক্ষার আলোকদানকারী এ মহীয়সী নারীর দীর্ঘায়ু কামনা করি, যারা আলোকিত হয়েছি তারই আদর্শ নিয়ে।
প্রিয় অধ্যক্ষ ভাষাকন্যা মিস্ মুৎসুদ্দি
ডা. জুলিয়া আহমেদ
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের গভীর প্রভাব হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকে। জীবনে চলার পথে সেসব স্মৃতি আলোকবর্তিকা হয়ে ক্ষণে ক্ষণেই উজ্জীবিত করে তোলে আমার মনন। আমি আজ যার কথা বলছি, তিনি এমনই একজন মানুষ; যার মহান ছোঁয়ায় আমার আর আমার বোন ডালিয়া আহমেদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সুশিক্ষা। শিক্ষা পরবর্তী জীবনে যার সুপ্রভাবে আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে ও পারিবারিক জীবনে পেয়েছি নান্দনিক পরিপূর্ণতা। তিনি আমাদের সবার প্রিয় ভারতেশ্বরী হোমসের সাবেক অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি। আমরা তাকে মিস্ মুৎসুদ্দি নামেই সম্বোধন করতাম।
খুব অল্প বয়সেই আমি জীবন শুরু করেছিলাম। তখন বইপত্র থেকে আমি কি শিখেছি তা মনে করা কঠিন; কিন্তু আমি অনায়াসে যা মনে করতে পারি তা হল কঠিন নিয়মানুবর্তিতা। শ্রেণী শিক্ষক, হোস্টেল শিক্ষক যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা আমাদের দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা সময়ানুযায়ী সব কাজ নিয়মমতো করতে বাধ্য করেছিলেন। যদিও সেসব কঠিন নিয়মানুবর্তিতা মেনে নিতে বা মেনে চলতে তখন খুব কষ্ট হতো। কিন্তু পরে অনুধাবন করতে পেরেছি, সেই কঠিন অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যবসায়ই ছিল আসলে সুপরিশীলিত জীবন গড়া ও চলার দক্ষতা অর্জনের জন্য মহান শিক্ষা। যা আমরা খুব অল্প বয়সেই বই পড়ার পাশাপাশি বাস্তব কাজ যেমন- থাকার ঘর, বাথরুম, খাবার ঘর, সিঁড়ি, রাস্তা, ড্রেন, মাঠ ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমেই শিখেছিলাম।
আমরা আরও শিখেছিলাম মানবিকতা, মূল্যবোধ, সততা। এগুলো শুধু পড়া বা বলার জন্যই নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনে সব কাজে সৎ থাকা, সময় মেনে চলা, বঞ্চিতদের সহায়তা করা, সামাজিক ন্যায্যতা চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে জীবন পরিচালিত করার সুদৃঢ় প্রত্যয়ী শিক্ষা। যা আমরা বহন করে চলেছি আজও নিরলস নিরন্তর।
আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে যে অত্যুজ্জ্বল মানুষটির কথা বলতে চাই তিনি সেই মিস্ মুৎসুদ্দি। যিনি তার সুদৃঢ় সুশৃংখল চালিকাশক্তির দ্বারা ভারতেশ্বরী হোমসকে নিয়ে গিয়েছেন বা রূপান্তরিত করেছেন অনেক উঁচুমাত্রার সুযোগ্য শিক্ষালয়ে। তার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছিলাম এক চমৎকার সংস্কৃতিময় পরিবেশ। ধর্ম বর্ণ মত নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেছি আমরা তারই সুনিবিড় ছায়াতলে। ভারতেশ্বরী হোমসে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের ছাত্রীরাই ছিল একসঙ্গে। নামাজ শিক্ষা, ঈদ, সরস্বতী পূজা অর্চনা, বড়দিন বা বৌদ্ধপূর্ণিমা সব উৎসবে আমরা সবাই মিলে সমানভাবে উপভোগ করেছি- তা থেকে আমরা প্রায়োগিকভাবে বিশ্বাস করতে শিখেছি মানব কল্যাণই হল বড় ধর্ম। ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে কোনো বিভেদ নয়- কবির ভাষায় ‘সকলেই আমরা সকলের তরে’।
ভারতেশ্বরী হোমসের সাবেক একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সেই সুশিক্ষাকে আজ অনায়াসে অনুধাবন করতে পারি এবং সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারি আমাদের মূল সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ- ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে।
ভারতেশ্বরী হোমস আজ যে গৌরবময় অবস্থানে এসে পৌঁছেছে তার পেছনে প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধাস্পদ জেঠামণি ও রণদা প্রসাদ সাহার অবদান ইতিহাস হয়ে আছে। আজ যে আমরা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বা সময় অতিবাহিত করছি সেখানে ভারতেশ্বরী হোমসের অবদান প্রণিধানযোগ্য।
মিস্ মুৎসুদ্দি ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮-৫২) একজন সক্রিয় সৈনিক, ভাষা কন্যা। এ অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। আজ যখন আমি আমার স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের সঙ্গে মনে করি, তার মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের দিকনির্দেশনা। আমার ছোট্ট কৈশোর চেতনায় তিনি তা আমার মনের গভীরে প্রোথিত করেছেন। জীবনের প্রথম ধাপেই তার কাছে শিখেছিলাম, ‘বিয়েই একজন মেয়ের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না।’ তার কাছ থেকে শেখার অদম্য আকাক্সক্ষা আজও সমান অম্লান। তাই ধবধবে সাদা শাড়ি পরা সাদা মনের প্রিয় মিস্ মুৎসুদ্দিকে নিশ্চিত প্রেরণায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছি জীবনের সম্মুখ পানে।
এ সাহসী মানুষটির কাছ থেকে এখনও আমার শেখার আছে অনেক কিছু।
No comments