সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই খুঁজতে হবে -বিশেষ সাক্ষাৎকারে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী by এ কে এম জাকারিয়া
ব্যবসায়ী
নেতা ও এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে
দুই দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের
সাবেক এই সভাপতি বর্তমানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি
বোর্ডের সদস্য।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো : দীর্ঘদিনের অবরোধে দেশ প্রায় অচল হয়ে আছে, হরতালও হচ্ছে, এভাবেই কি চলবে? সমাধানের কোনো আশা?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : আমি তো কোনো আশা দেখছি না। সবাই জানে, সবাই বোঝে যে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের মধ্য দিয়েই এই সমস্যা সমাধানের একটি পথ খোঁজা উচিত। কিন্তু যাদের শোনার কথা তারা তো শুনছে না। যেভাবে চলছে, তার পরিণতি কী বা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কে জানে?
প্রথম আলো : সংলাপ করার পরিস্থিতি কি আছে? বা সংলাপ করে আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : সংলাপ ছাড়া পথটাই বা কী? গত ৫ জানুয়ারি থেকে দেশ অচল হয়ে আছে। মানুষের জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার দশা। কিন্তু মানুষ করবে কী? তাকে তো রোজগার করতে হবে। মানুষ এখন এর মধ্যেই বের হচ্ছে। হরতালের মধ্যেও মতিঝিল গিয়ে মিটিং করে এসেছি। ভয় নিয়ে গেছি, কিন্তু উপায় ছিল না। আগে আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক দলের লোকজন নিজেরা নিজেরা মারামারি করত। এখন মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। বুঝতে পারি না, এটা কেমন রাজনীতি? যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা আসলে কাদের জন্য রাজনীতি করছেন? কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে তো চলতে পারে না। তাহলে পথ কী? দুই পক্ষকেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। সাধারণভাবে আমরা তো এটাই বুঝি।
প্রথম আলো : যেভাবে চলছে, মানে এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কি পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এমন একটি পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আর উপায় কী? আমরা যাঁরা ব্যবসা করি, তাঁরা চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি। শুধু বড় ব্যবসায়ীরাই নয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানমালিকদেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। সব ব্যবসায়ী সংগঠন তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার কাছে আবেদন-অনুরোধ—সবই করা হয়েছে। এরপর আমাদের আর কী বলার আছে?
প্রথম আলো : আমরা সব সময়ই দেখি যে বিভিন্ন রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়, আবেদন জানানো হয়। এসবে আগে কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে করেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : আমার তো মনে হয় না যে আগে আমাদের কোনো উদ্যোগে ফল পাওয়া গেছে। আমরা এ ধরনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতেই আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে গেছি, আবেদন-নিবেদন করেছি, এবারও করে যাচ্ছি। অতীতের অচলাবস্থাগুলো দূর হওয়ার পেছনে অন্য বিষয় হয়তো কাজ করেছে, ব্যবসায়ীদের কথা কেউ শুনেছে বা তাঁদের কথা ভেবে কেউ সমাধানের পথে গেছে বলে তো মনে হয় না।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের রাজনীতি তো এখন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ব্যবসায়ীরাই তো রাজনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছেন। দলের পদ, সাংসদ—সবই হচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা কেন তবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না? তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেন না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেছেন, আসছেন এটা ঠিক। তাঁরা তাঁদের স্বার্থও রক্ষা করতে চান। কিন্তু যখন রাজনৈতিক বিষয় বা দলের প্রশ্ন আসে, তখন আসলে তাঁরা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেন না বা ব্যবসায়ী হিসেবে দলের মধ্যে থেকে আলাদা কোনো ভূমিকা পালন করা কঠিনও। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যবসায়ীরা তো জনগণেরও অংশ। রাজনৈতিক দলগুলো তো জনগণের স্বার্থও বিবেচনায় নিচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আর বাড়তি কী ভূমিকা পালন করবে?
প্রথম আলো : জনগণের স্বার্থই যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় না থাকে, তবে কী রাজনীতি এখন দেশে চলছে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এখন দেশে যা চলছে তা সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা আসলেই বুঝতে পারছি না যে মানুষ মেরে কিসের রাজনীতি? কোনো বিত্তশালী লোক এসবের শিকার হননি, কারা হচ্ছেন? যাঁরা সাধারণ জনগণ, বাসে করে চলাচল করেন। তাঁরা পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরছেন। আর আগুনে পুড়েও যাঁরা বেঁচে আছেন বা থাকবেন, তাঁদের সারা জীবন ভুগতে হবে। এসব লোকজন ও তাঁদের পরিবারের দায়দায়িত্ব কে নেবেন? সেদিন টিভিতে দেখলাম এক নারীর স্বামী পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরেছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি এখন কীভাবে বাঁচবেন, কীভাবে তাঁর সংসার চলবে? এটা রাজনীতি হয় কীভাবে!
প্রথম আলো : টানা অবরোধ বা এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন খাত বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে বা হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলবে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র দোকানদার থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসাতেই এর প্রভাব পড়বে, যা পুরো অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আপনাদের পত্রিকাতেই দেখলাম পর্যটন খাতের কী অবস্থা! তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসা করে থাকে। এখন পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে তাদের ব্যবসা কার্যত শূন্য। তবে তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী খাত যে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা অর্থনীতির জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। অনেক চুক্তি বাতিল হবে, সামনে নতুন কোনো অর্ডার পাওয়া যাবে না। একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের হয়তো ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্ডার রয়েছে, তারা যখন সামনের কাজ নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে তখন বলা হচ্ছে, আগে বর্তমান অর্ডারের শিপমেন্ট শেষ করুন, সামনের অর্ডার পরে দেখা যাবে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তারা সম্ভবত নতুন বা অন্য কোনো বাজার খোঁজার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
প্রথম আলো : ইতিমধ্যেই কিছু বড় ঋণ পুনঃ তফসিল করতে হয়েছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো সামনেও আরও সুযোগ পাবেন, কিন্তু ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসায়ী, যাঁরা ঋণ নিয়েছেন ব্যবসার জন্য, তাঁদের কী হবে? ঋণদাতা বা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তাঁরা ছাড় পাবেন বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো : রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত-সহিংসতা বা অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এর পরও দেশে অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেই নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : দেখুন, এ ধরনের কিছু পরিস্থিতি আমরা আগে কাটিয়ে উঠেছি ঠিকই। কিন্তু আপনি এ ধরনের চাপ একবার নিতে পারবেন, দুবার নিতে পারবেন, কিন্তু বারবার তো নিতে পারবেন না। এভাবে চলতে থাকলে তো একটা পর্যায়ে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা আর থাকবে না। দেশের দুটো বড় দলেরই বোধ-বুদ্ধি লোপ পেল কি না কে জানে। দেশের কথা কারও বিবেচনায় থাকলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের বিষয়টি তো নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সেটাও করতে পারছে না আবার আলাপ-আলোচনার পথও ধরছে না।
প্রথম আলো : এ ধরনের অবরোধ যদি চলতেই থাকে আর সরকারও যদি আলাপ-আলোচনার কোনো পথ না ধরে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এমন একটি পরিস্থিতি তো বেশি দিন চলতে পারে না এবং এটার চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও একপর্যায়ে আমাদের থাকবে না। অনেক পেশার মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকের কমে গেছে। তাদের জীবন চলবে কীভাবে? বেশি দিন এভাবে ধরে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। পেটের জ্বালায় মানুষ বের হয়ে আসবে। আমি রাজনীতির কথা বলছি না কিন্তু মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে। তবে কখন মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে, তা জানি না।
প্রথম আলো : দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনি হতাশা প্রকাশ করলেন, আপনি শুধু একজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী নন, দু-দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যদি কোনো আবেদন জানাতে চান, তবে কী বলবেন? সেই সংলাপে বসার আহ্বান?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এ ছাড়া আর কী আবেদন বা অনুরোধই করতে পারি বলুন। সমঝোতা ছাড়া সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আর এ জন্য দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। এ জন্য আলোচনায় আসতে হবে, সংলাপ করতে হবে। সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, সমস্যাটির অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো : দীর্ঘদিনের অবরোধে দেশ প্রায় অচল হয়ে আছে, হরতালও হচ্ছে, এভাবেই কি চলবে? সমাধানের কোনো আশা?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : আমি তো কোনো আশা দেখছি না। সবাই জানে, সবাই বোঝে যে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের মধ্য দিয়েই এই সমস্যা সমাধানের একটি পথ খোঁজা উচিত। কিন্তু যাদের শোনার কথা তারা তো শুনছে না। যেভাবে চলছে, তার পরিণতি কী বা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কে জানে?
প্রথম আলো : সংলাপ করার পরিস্থিতি কি আছে? বা সংলাপ করে আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : সংলাপ ছাড়া পথটাই বা কী? গত ৫ জানুয়ারি থেকে দেশ অচল হয়ে আছে। মানুষের জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার দশা। কিন্তু মানুষ করবে কী? তাকে তো রোজগার করতে হবে। মানুষ এখন এর মধ্যেই বের হচ্ছে। হরতালের মধ্যেও মতিঝিল গিয়ে মিটিং করে এসেছি। ভয় নিয়ে গেছি, কিন্তু উপায় ছিল না। আগে আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক দলের লোকজন নিজেরা নিজেরা মারামারি করত। এখন মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। বুঝতে পারি না, এটা কেমন রাজনীতি? যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা আসলে কাদের জন্য রাজনীতি করছেন? কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে তো চলতে পারে না। তাহলে পথ কী? দুই পক্ষকেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। সাধারণভাবে আমরা তো এটাই বুঝি।
প্রথম আলো : যেভাবে চলছে, মানে এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কি পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এমন একটি পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আর উপায় কী? আমরা যাঁরা ব্যবসা করি, তাঁরা চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি। শুধু বড় ব্যবসায়ীরাই নয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানমালিকদেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। সব ব্যবসায়ী সংগঠন তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার কাছে আবেদন-অনুরোধ—সবই করা হয়েছে। এরপর আমাদের আর কী বলার আছে?
প্রথম আলো : আমরা সব সময়ই দেখি যে বিভিন্ন রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়, আবেদন জানানো হয়। এসবে আগে কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে করেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : আমার তো মনে হয় না যে আগে আমাদের কোনো উদ্যোগে ফল পাওয়া গেছে। আমরা এ ধরনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতেই আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে গেছি, আবেদন-নিবেদন করেছি, এবারও করে যাচ্ছি। অতীতের অচলাবস্থাগুলো দূর হওয়ার পেছনে অন্য বিষয় হয়তো কাজ করেছে, ব্যবসায়ীদের কথা কেউ শুনেছে বা তাঁদের কথা ভেবে কেউ সমাধানের পথে গেছে বলে তো মনে হয় না।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের রাজনীতি তো এখন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ব্যবসায়ীরাই তো রাজনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছেন। দলের পদ, সাংসদ—সবই হচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা কেন তবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না? তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেন না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেছেন, আসছেন এটা ঠিক। তাঁরা তাঁদের স্বার্থও রক্ষা করতে চান। কিন্তু যখন রাজনৈতিক বিষয় বা দলের প্রশ্ন আসে, তখন আসলে তাঁরা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেন না বা ব্যবসায়ী হিসেবে দলের মধ্যে থেকে আলাদা কোনো ভূমিকা পালন করা কঠিনও। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যবসায়ীরা তো জনগণেরও অংশ। রাজনৈতিক দলগুলো তো জনগণের স্বার্থও বিবেচনায় নিচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আর বাড়তি কী ভূমিকা পালন করবে?
প্রথম আলো : জনগণের স্বার্থই যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় না থাকে, তবে কী রাজনীতি এখন দেশে চলছে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এখন দেশে যা চলছে তা সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা আসলেই বুঝতে পারছি না যে মানুষ মেরে কিসের রাজনীতি? কোনো বিত্তশালী লোক এসবের শিকার হননি, কারা হচ্ছেন? যাঁরা সাধারণ জনগণ, বাসে করে চলাচল করেন। তাঁরা পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরছেন। আর আগুনে পুড়েও যাঁরা বেঁচে আছেন বা থাকবেন, তাঁদের সারা জীবন ভুগতে হবে। এসব লোকজন ও তাঁদের পরিবারের দায়দায়িত্ব কে নেবেন? সেদিন টিভিতে দেখলাম এক নারীর স্বামী পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরেছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি এখন কীভাবে বাঁচবেন, কীভাবে তাঁর সংসার চলবে? এটা রাজনীতি হয় কীভাবে!
প্রথম আলো : টানা অবরোধ বা এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন খাত বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে বা হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলবে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এ ধরনের পরিস্থিতিতে সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র দোকানদার থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসাতেই এর প্রভাব পড়বে, যা পুরো অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আপনাদের পত্রিকাতেই দেখলাম পর্যটন খাতের কী অবস্থা! তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসা করে থাকে। এখন পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে তাদের ব্যবসা কার্যত শূন্য। তবে তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী খাত যে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা অর্থনীতির জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। অনেক চুক্তি বাতিল হবে, সামনে নতুন কোনো অর্ডার পাওয়া যাবে না। একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের হয়তো ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্ডার রয়েছে, তারা যখন সামনের কাজ নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে তখন বলা হচ্ছে, আগে বর্তমান অর্ডারের শিপমেন্ট শেষ করুন, সামনের অর্ডার পরে দেখা যাবে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তারা সম্ভবত নতুন বা অন্য কোনো বাজার খোঁজার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
প্রথম আলো : ইতিমধ্যেই কিছু বড় ঋণ পুনঃ তফসিল করতে হয়েছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো সামনেও আরও সুযোগ পাবেন, কিন্তু ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসায়ী, যাঁরা ঋণ নিয়েছেন ব্যবসার জন্য, তাঁদের কী হবে? ঋণদাতা বা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তাঁরা ছাড় পাবেন বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো : রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত-সহিংসতা বা অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এর পরও দেশে অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেই নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : দেখুন, এ ধরনের কিছু পরিস্থিতি আমরা আগে কাটিয়ে উঠেছি ঠিকই। কিন্তু আপনি এ ধরনের চাপ একবার নিতে পারবেন, দুবার নিতে পারবেন, কিন্তু বারবার তো নিতে পারবেন না। এভাবে চলতে থাকলে তো একটা পর্যায়ে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা আর থাকবে না। দেশের দুটো বড় দলেরই বোধ-বুদ্ধি লোপ পেল কি না কে জানে। দেশের কথা কারও বিবেচনায় থাকলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের বিষয়টি তো নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সেটাও করতে পারছে না আবার আলাপ-আলোচনার পথও ধরছে না।
প্রথম আলো : এ ধরনের অবরোধ যদি চলতেই থাকে আর সরকারও যদি আলাপ-আলোচনার কোনো পথ না ধরে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এমন একটি পরিস্থিতি তো বেশি দিন চলতে পারে না এবং এটার চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও একপর্যায়ে আমাদের থাকবে না। অনেক পেশার মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকের কমে গেছে। তাদের জীবন চলবে কীভাবে? বেশি দিন এভাবে ধরে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। পেটের জ্বালায় মানুষ বের হয়ে আসবে। আমি রাজনীতির কথা বলছি না কিন্তু মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে। তবে কখন মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে, তা জানি না।
প্রথম আলো : দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনি হতাশা প্রকাশ করলেন, আপনি শুধু একজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী নন, দু-দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যদি কোনো আবেদন জানাতে চান, তবে কী বলবেন? সেই সংলাপে বসার আহ্বান?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : এ ছাড়া আর কী আবেদন বা অনুরোধই করতে পারি বলুন। সমঝোতা ছাড়া সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আর এ জন্য দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। এ জন্য আলোচনায় আসতে হবে, সংলাপ করতে হবে। সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, সমস্যাটির অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী : ধন্যবাদ।
No comments