বেগম খালেদা জিয়া বিচ্ছিন্ন- বিদ্যুৎহীন ১৯ ঘণ্টা, ইন্টারনেট, মোবাইল সংযোগ, ডিশ লাইন বন্ধ, ফটকে গ্রেপ্তার ১৩, অন্ধকারে দেড় ঘণ্টা
শুক্রবার
রাত ২টা ৪২ মিনিট। হঠাৎ করেই অন্ধকারে ডুবে যায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম
খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়। ডেসকোর লাইনম্যান কেটে দেন বিদ্যুতের লাইন।
দেড় ঘণ্টা অন্ধকারেই কাটান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এরপর একে একে বিচ্ছিন্ন
করা হয় কার্যালয়ের ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভির সংযোগ। দিনে বন্ধ করা হয় মোবাইল
নেটওয়ার্ক। অসহনীয় এক পরিস্থিতি চলে দিনভর। প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর গতরাত ১০টা
১২ মিনিটে আবারও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। যেখানে প্রায় এক মাস ধরে অবস্থান
করছেন তিনি। একদিকে বিদ্যুৎ, টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন অন্যদিকে
তার কার্যালয়ের পাশে মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা। কার্যালয়ের চারপাশে
বাড়ানো হয়েছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা। চেয়ারপারসন কার্যালয় থেকে বের
হওয়ার সময় গতকাল সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬ মহিলা আইনীজীবীসহ ৭ জনকে।
এর কিছুক্ষণ পর আরও ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া কার্যালয়ের বিদ্যুৎ
সংযোগ বিচ্ছিন্নের একই সময়ে বারিধারার একটি বাসা থেকে দলের দপ্তরের
দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এদিকে
গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ ও বিলুপ্তপ্রায় আখ্যায়িত করে তা পুনরুদ্ধারের দাবিতে
সকল রাজনৈতিক দল, জোটসহ দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে
যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব
সালাহউদ্দিন আহমেদ এ আহ্বান জানান। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট-ডিশ
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় ‘স্তম্ভিত’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান জানিয়েছেন, খালেদা
জিয়া বলেছেন- ‘সরকারের এ নিষ্ঠুর আচরণে আমি স্তম্ভিত। এটা নজিরবিহীন, সব
ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত। কোন সভ্য সরকার এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে
না।’
শেষ রাতে বিচ্ছিন্ন হলো বিদ্যুৎ সংযোগ
রাত তখন ২টা ৪২ মিনিট। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)’র এক লাইনম্যান। কার্যালয়ের সামনের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে মই বেয়ে ওঠেন ডেসকোর লাইনম্যান মাকসুদ আলী। তিনি সড়কের মূল বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন কার্যালয়ের লাইনটি। এরপর পুরো কার্যালয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কোন ধরনের অনুমতিপত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মাকসুদ আলী জানান, আমরা কিছু জানি না। গুলশান থানা পুলিশের নির্দেশেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নের সময় গুলশান থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা তার সঙ্গে ছিলেন। ফলে শুক্রবার শেষ রাত থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় ডুবে থাকে নিকষ অন্ধকারে। অনিরাপদ হয়ে পড়ে চেয়ারপারসন কার্যালয়। এরপর গতকাল ভোর ৪টার দিকে কার্যালয়ে জেনারেটর চালু করা হয়। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের সমাবেশে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করলে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়ার হুমকি দেন। এরপর মধ্যরাতেই ওই কার্যালয়ের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এদিকে জেনারেটরের জ্বালানি হিসেবে গতকাল দুপুরে ভ্যানে করে দুই ড্রাম তেল নেয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর থেকে জেনারেটরের বিদ্যুতেই চলছে খালেদা জিয়ার কার্যালয়। সকালে জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় এ তেল নেয়া হয়। ওদিকে গতকাল গুলশান থানার ডিউটি অফিসার এএসআই মো. ফারুক খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, গুলশান থানা পুলিশের নির্দেশ তো দূরের কথা, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরই আমাদের জানা নেই। এ ঘটনার পর ওই কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানো হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে যদি কোন অভিযোগ করা হয় কিংবা তার নিরাপত্তা বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়, তখন পুলিশ বিষয়টি ভেবে দেখবে।
বিচ্ছিন্ন ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ
এদিকে সকালে কোন এক সময় বিচ্ছিন্ন করা হয় কার্যালয়ের টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সংযোগ। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্র্যালয় সূত্র জানায়, সকালে টেলিভিশন চালাতে গিয়ে প্রথমে বিষয়টি নজরে আসে। পরে দেখা যায় টিভি’র পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও। শুক্রবার শেষ রাতে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর জেনারেটরের বিদ্যুতে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের খবরাখবর দেখার সুযোগ পাচ্ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনসহ কার্যালয়ের লোকজন। চালু ছিল ইন্টারনেট সংযোগও। কিন্তু ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি আশপাশে জ্যামার লাগিয়ে মোবাইল যোগাযোগই ব্যাহত করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় বাংলা লিংক, গ্রামীণ ফোন সার্ভিস দু’টো ছিল পুরোপুরি বন্ধ। অন্যান্য সার্ভিসগুলোর ব্যাহত হয়েছে বেশির ভাগ সময়। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অফিস সংলগ্ন এলাকায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে গুলশানের বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিস ও তার চারপাশের প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইলের নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি অফিসের চারপাশের ৬০ ট্রান্সিভার বেস স্টেশনের তরঙ্গ অকেজো করা হয়। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ২০ টি, ১৫ টি রবি’র এবং বাংলালিংক এর ১৮ টি বেস স্টেশন রয়েছে। মূলত ৩রা জানুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি মৌখিকভাবে ওই জোনে নেটওয়ার্ক সীমিত করার অনুরোধ করা হয়। একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের কাছে মোবাইল ফোনের কল এবং ডাটা নেটওয়ার্ক বন্ধ করার জন্য তাদের কাছে নির্দেশ এসেছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের একটি নির্দেশ জারি করেছে বলে জানান তিনি। এদিকে গতকাল পর্যন্ত পানি ও গ্যাস সংযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। কেবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর কার্যালয়ে নেয়া হয় ৪৮টি ফিল্টার পানির জার। সেই সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার।
রাতভর জেগে ছিলেন খালেদা জিয়া
রাত পৌনে ৩টার সময় যখন কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয় তখন নিজ কক্ষে জেগে ছিলেন খালেদা জিয়া। হঠাৎ করে কার্যালয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হলে অন্যরা খবর নেন। তার সঙ্গে অবস্থানকারীদের মাধ্যমেই তিনি জানতে পারেন কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। এরপর বিদ্যুৎহীনভাবে তিনি অন্তত দেড় ঘণ্টা সময় কাটে তাদের। এরপর রাত ৪টার দিকে জেনারেটর চালু করে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করে কার্যালয় সংশ্লিষ্টরা। সাময়িকভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলেও তিনি আর ঘুমোননি। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে রয়েছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান প্রমুখ। এছাড়াও সেখানে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের সদস্য ও কার্যালয়ের কর্মচারীরা রয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। আসন্ন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার মধ্যেও বিএনপি অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় এ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাড্ডা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের পাশের সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল নানা স্লোগান ও দাবি লেখা ফেস্টুন। এছাড়াও মতিঝিল আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ও ধানম-ি গভর্নমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক অভিভাবক খালেদা জিয়ার কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। অভিভাবকদের পক্ষে সৈয়দা শামীমা জামান এ স্মারকলিপি দেন। বিএনপি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেন। এ সময় সেখানে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে বেশ তৎপর।
পুলিশের তৎপরতা ও গ্রেপ্তার
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের আশপাশে মোতায়েন করা হয় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। শেষ রাতে পুলিশের উপস্থিতিতেই বিচ্ছিন্ন করা হয় কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘিরে পোশাকে ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়। তবে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় গ্রেপ্তার। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বের হওয়ার পর কার্যালয়ের কিছু সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৬ মহিলা আইনজীবীকে। পরে কার্যালয়ের ঢোকার মুখে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদা ইয়াসমিনকে। এর কিছুক্ষণ পর আরও ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে সন্ধ্যার পর সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন সাংবাদিক খালেদা জিযার কার্যালয়ে যান। কিছুক্ষণ পর তারা বেরিয়ে যান। এ সময় মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি আবদুল হাই সিকদার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান।
কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ
ওদিকে বিদ্যুৎ, ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের প্রতিবাদে গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। বিকাল সাড়ে ৫টায় তারা এ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। নারায়ণগঞ্জ মহিল?া দলের সভাপতি রাশিদা জামানের নেতৃত্বে মহিলা দলের নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন। উল্লেখ্য, ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি রাত থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। ৩রা জানুয়ারি কার্যালয়ের দু’পাশের রাস্তায় বালু, ইট ও মাটিভর্তি ট্রাক দাঁড় করিয়ে তাকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে কার্যালয়ের মূল ফটকে লাগানো হয় তালা। ৫ই জানুয়ারি তিনি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে সেখানে কথা বলার সময় তার ওপর পেপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। দীর্ঘ ১৬দিন পর ১৮ই জানুয়ারি পুলিশ কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যায়। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে তাকে সমবেদনা জানাতে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়নি। এদিকে শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ফের বিদ্যুৎ, টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে।
শেষ রাতে বিচ্ছিন্ন হলো বিদ্যুৎ সংযোগ
রাত তখন ২টা ৪২ মিনিট। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)’র এক লাইনম্যান। কার্যালয়ের সামনের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে মই বেয়ে ওঠেন ডেসকোর লাইনম্যান মাকসুদ আলী। তিনি সড়কের মূল বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন কার্যালয়ের লাইনটি। এরপর পুরো কার্যালয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কোন ধরনের অনুমতিপত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মাকসুদ আলী জানান, আমরা কিছু জানি না। গুলশান থানা পুলিশের নির্দেশেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নের সময় গুলশান থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা তার সঙ্গে ছিলেন। ফলে শুক্রবার শেষ রাত থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় ডুবে থাকে নিকষ অন্ধকারে। অনিরাপদ হয়ে পড়ে চেয়ারপারসন কার্যালয়। এরপর গতকাল ভোর ৪টার দিকে কার্যালয়ে জেনারেটর চালু করা হয়। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের সমাবেশে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করলে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়ার হুমকি দেন। এরপর মধ্যরাতেই ওই কার্যালয়ের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এদিকে জেনারেটরের জ্বালানি হিসেবে গতকাল দুপুরে ভ্যানে করে দুই ড্রাম তেল নেয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর থেকে জেনারেটরের বিদ্যুতেই চলছে খালেদা জিয়ার কার্যালয়। সকালে জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় এ তেল নেয়া হয়। ওদিকে গতকাল গুলশান থানার ডিউটি অফিসার এএসআই মো. ফারুক খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, গুলশান থানা পুলিশের নির্দেশ তো দূরের কথা, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরই আমাদের জানা নেই। এ ঘটনার পর ওই কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানো হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে যদি কোন অভিযোগ করা হয় কিংবা তার নিরাপত্তা বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়, তখন পুলিশ বিষয়টি ভেবে দেখবে।
বিচ্ছিন্ন ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ
এদিকে সকালে কোন এক সময় বিচ্ছিন্ন করা হয় কার্যালয়ের টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সংযোগ। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্র্যালয় সূত্র জানায়, সকালে টেলিভিশন চালাতে গিয়ে প্রথমে বিষয়টি নজরে আসে। পরে দেখা যায় টিভি’র পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও। শুক্রবার শেষ রাতে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর জেনারেটরের বিদ্যুতে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের খবরাখবর দেখার সুযোগ পাচ্ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনসহ কার্যালয়ের লোকজন। চালু ছিল ইন্টারনেট সংযোগও। কিন্তু ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি আশপাশে জ্যামার লাগিয়ে মোবাইল যোগাযোগই ব্যাহত করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় বাংলা লিংক, গ্রামীণ ফোন সার্ভিস দু’টো ছিল পুরোপুরি বন্ধ। অন্যান্য সার্ভিসগুলোর ব্যাহত হয়েছে বেশির ভাগ সময়। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অফিস সংলগ্ন এলাকায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে গুলশানের বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিস ও তার চারপাশের প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইলের নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি অফিসের চারপাশের ৬০ ট্রান্সিভার বেস স্টেশনের তরঙ্গ অকেজো করা হয়। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ২০ টি, ১৫ টি রবি’র এবং বাংলালিংক এর ১৮ টি বেস স্টেশন রয়েছে। মূলত ৩রা জানুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি মৌখিকভাবে ওই জোনে নেটওয়ার্ক সীমিত করার অনুরোধ করা হয়। একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের কাছে মোবাইল ফোনের কল এবং ডাটা নেটওয়ার্ক বন্ধ করার জন্য তাদের কাছে নির্দেশ এসেছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের একটি নির্দেশ জারি করেছে বলে জানান তিনি। এদিকে গতকাল পর্যন্ত পানি ও গ্যাস সংযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। কেবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর কার্যালয়ে নেয়া হয় ৪৮টি ফিল্টার পানির জার। সেই সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার।
রাতভর জেগে ছিলেন খালেদা জিয়া
রাত পৌনে ৩টার সময় যখন কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয় তখন নিজ কক্ষে জেগে ছিলেন খালেদা জিয়া। হঠাৎ করে কার্যালয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হলে অন্যরা খবর নেন। তার সঙ্গে অবস্থানকারীদের মাধ্যমেই তিনি জানতে পারেন কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। এরপর বিদ্যুৎহীনভাবে তিনি অন্তত দেড় ঘণ্টা সময় কাটে তাদের। এরপর রাত ৪টার দিকে জেনারেটর চালু করে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করে কার্যালয় সংশ্লিষ্টরা। সাময়িকভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলেও তিনি আর ঘুমোননি। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে রয়েছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান প্রমুখ। এছাড়াও সেখানে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের সদস্য ও কার্যালয়ের কর্মচারীরা রয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। আসন্ন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার মধ্যেও বিএনপি অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় এ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাড্ডা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের পাশের সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল নানা স্লোগান ও দাবি লেখা ফেস্টুন। এছাড়াও মতিঝিল আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ও ধানম-ি গভর্নমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক অভিভাবক খালেদা জিয়ার কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। অভিভাবকদের পক্ষে সৈয়দা শামীমা জামান এ স্মারকলিপি দেন। বিএনপি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেন। এ সময় সেখানে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে বেশ তৎপর।
পুলিশের তৎপরতা ও গ্রেপ্তার
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের আশপাশে মোতায়েন করা হয় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। শেষ রাতে পুলিশের উপস্থিতিতেই বিচ্ছিন্ন করা হয় কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘিরে পোশাকে ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়। তবে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় গ্রেপ্তার। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বের হওয়ার পর কার্যালয়ের কিছু সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৬ মহিলা আইনজীবীকে। পরে কার্যালয়ের ঢোকার মুখে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদা ইয়াসমিনকে। এর কিছুক্ষণ পর আরও ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে সন্ধ্যার পর সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন সাংবাদিক খালেদা জিযার কার্যালয়ে যান। কিছুক্ষণ পর তারা বেরিয়ে যান। এ সময় মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি আবদুল হাই সিকদার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান।
কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ
ওদিকে বিদ্যুৎ, ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের প্রতিবাদে গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। বিকাল সাড়ে ৫টায় তারা এ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। নারায়ণগঞ্জ মহিল?া দলের সভাপতি রাশিদা জামানের নেতৃত্বে মহিলা দলের নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন। উল্লেখ্য, ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি রাত থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। ৩রা জানুয়ারি কার্যালয়ের দু’পাশের রাস্তায় বালু, ইট ও মাটিভর্তি ট্রাক দাঁড় করিয়ে তাকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে কার্যালয়ের মূল ফটকে লাগানো হয় তালা। ৫ই জানুয়ারি তিনি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে সেখানে কথা বলার সময় তার ওপর পেপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। দীর্ঘ ১৬দিন পর ১৮ই জানুয়ারি পুলিশ কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যায়। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে তাকে সমবেদনা জানাতে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়নি। এদিকে শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ফের বিদ্যুৎ, টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে।
No comments