অমর একুশে গ্রন্থমেলা- রাজনৈতিক মেঘেও আলো ছড়াক
রাজনৈতিক
অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ও হতাশার মধ্যেও আজ বাংলা একাডেমির আয়োজনে শুরু হওয়া
'অমর একুশে গ্রন্থ্থমেলা ২০১৫' নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা জানি,
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে যে টানা অবরোধ চলছে, তাতে করে দেশজুড়েই
স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যথেষ্ট ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে জীবন
থেমে থাকে না। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
অনিশ্চয়তায় জীবন সাময়িক থমকে যায় বটে, থেমে থাকে না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
আয়োজন, উৎসব, পার্বণ নিজের নিয়মেই এগিয়ে চলে। আমরা আশা করি, ঐতিহ্যবাহী
বইমেলাও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মেঘ সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও প্রেরণার আলো
ছড়াবে। আমরা আনন্দিত যে, বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
পর্যন্ত সম্প্রসারিত বইমেলায় গত বছর যেসব বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল,
কর্তৃপক্ষ এবার আগে থেকে তা নিরসনে উদ্যোগী হয়েছে। শনিবার বইমেলা উপলক্ষে
এক সংবাদ সম্মেলনে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান আশা প্রকাশ
করেছেন, এবারের মেলা ইতিহাস সৃষ্টি করবে। অন্য বছরগুলোর তুলনায় স্টলের
সংখ্যা, আকার ও পরিধি বাড়ায় তার এই আশাবাদ। আমরাও চাই বইমেলার প্রতিবছরের
বৃদ্ধি এবারও অব্যাহত থাকুক। মানুষ যেন স্বস্তির সঙ্গে, উৎসবমুখর পরিবেশে
বই দেখতে, কিনতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিরাপত্তার দিকে
বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে। আর্চওয়ে, নিরাপত্তা প্রহরা, অগি্ননির্বাপক
ব্যবস্থা যেন নিছক প্রদর্শন না হয়, সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে বলি। সব পক্ষ
আন্তরিক হলে বইমেলার পরিবেশ নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর করা কঠিন নয়। আমরা জানি,
বইমেলা 'জমতে' কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানের সম্প্রসারিত পরিসরে যে জ্ঞান, প্রাণ ও প্রেরণার সম্মিলন ঘটে, তার
অনুরণন বইপ্রেমী বাঙালি হৃদয়ে মেলার ফটক খোলার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু
হয়। কারণ বাংলাদেশে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের সবচেয়ে বড় আয়োজন এটি। ফেব্রুয়ারি
আসার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় মেলার প্রস্তুতি। নতুন বই নিয়ে
প্রকাশকরা হাজির হন, ক্রেতারাও জ্ঞান ও সৃজনশীল চর্চার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত
করে সমৃদ্ধ হন। তবে এও আমরা জানি, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার এই মাসে
আয়োজিত বইমেলা নিছক বিক্রেতা-ক্রেতার বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় গৌরব। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার
অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রক্তাক্ত আন্দোলন যে পরিণতি পেয়েছিল তা বাঙালিকে
পেঁৗছে দিয়েছিল নতুন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। বায়ান্নর তীব্র স্রোতধারাই যে
একাত্তরের সমুদ্রগর্জনকে ডেকে এনেছিল তা এখন ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য।
বাঙালির স্বাধিকার ও স্বকীয়তার সঙ্গে তাই ২১ ফেব্রুয়ারির অসামান্য যোগ। আর
২১ ফেব্রুয়ারি যে চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে তা সবসময়ই
প্রাসঙ্গিক থেকেছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে
কাজ করেছে ভাষার চেতনা। ফেব্রুয়ারি আজ শুধু শোকের নয়, বাঙালির জ্ঞানচর্চা ও
প্রাণস্ফুরণের মাসও। এ মাসটির প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নানা
উৎসব-আয়োজনে ব্যস্ত থাকে দেশ। সবচেয়ে বড় যে আয়োজনটি ফেব্রুয়ারিকে আলোকিত
করে তা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। গত দুই বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় মেলা খানিকটা
মিইয়ে থাকলেও প্রেরণার আলো ছড়াতে দ্বিধা করেনি। আমরা আশা করি, এবারও সব
শঙ্কা বাঙালির বইপ্রেমের কাছে হার মানবে।
No comments