এক শতাংশের কাছে অর্ধেকের বেশি সম্পদ কেন? by শাহ্ আব্দুল হান্নান
নয়া
দিগন্তে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বিশ্বের
ধনী এক শতাংশ মানুষ বাকি নিরানব্বই শতাংশ মানুষের চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক।
ব্রিটেন ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম এ কথা জানিয়েছে। অক্সফামের
নির্বাহী পরিচালক উইনি বিয়ানিমা জানান, বৈশ্বিক বৈষম্যের এ চিত্র স্তম্ভিত
করে দেয়ার মতো। এ বৈষম্যের কারণ কী? কিভাবে এ বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হলো।
সেটি আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। এর প্রধান কারণ পুঁজিবাদী
অর্থব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে সুদের ব্যবহার। সুদ এমন একটি ব্যবস্থা,
যা সম্পদ ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত করে। ব্যবসায় লাভ লোকসান হয় এবং ব্যবসায়ের
অংশীদার অনেক ক্ষেত্রেই লোকসান করতে পারেন। কিন্তু সুদ সব সময়ই মূল অর্থের
ওপর অতিরিক্ত সুদ নিয়ে আসে। এভাবে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এ জন্যই ইসলাম
সুদকে হারাম করেছে এবং ব্যবসায়কে বৈধ করেছে। কুরআন এ কথাও পরিষ্কার করেছে
যে, সুদ ও ব্যবসায় এক নয় (বাকারা : ২৭৫)। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি
বিষয় জানাচ্ছি। ব্যাংকিং বিভাগের সচিব অবস্থায় আমি লক্ষ করেছি যে, বেশির
ভাগ ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সুদ। সুদের ভার বহন করতে না
পেরে ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে হয়। বিশেষ করে যখন ব্যবসায়ে লোকসান হয় এবং
ব্যাংকের সুদ আর দিতে পারে না। তবে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এ রকম হয়
না। সম্পদের পুঞ্জীভূত হওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদের কিছু অবান্তর
ধারণা। যেমন পুঁজিবাদে ধরা হয়, অর্থনীতির আইনগুলো হচ্ছে ফিজিকাল লজ বা
প্রাকৃতিক আইনের মতো। পৃথিবী যেমন নিয়মমতো ঘুরছে বা বায়ুপ্রবাহ যেভাবে চলছে
বা সমুদ্রের স্রোত যেভাবে চলছে, অর্থনৈতিক আইন সে রকমই। অথচ এটা ভুল। আমরা
দেখি যে, বাজার ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে; তা প্রাকৃতিক আইনের মতো নয়;
বরং অনেক সময় তা স্পেকুলেশন (Speculation) ও ফটকাবাজারির জন্য হয়। অন্য
দিকে পুঁজিবাদে ধরা হয় যে, মানুষের কাজের তুলনা হচ্ছে তার স্বার্থপরতা
(Pecuniary interest)। এটাই হচ্ছে তথাকথিত যুক্তিবাদী মানুষ বা Rational
Economic Man-এর পরিচয়। এ ধারণাটি অনৈতিক। অথচ আমরা জানি যে মানুষ যেমন
অর্থের জন্য কাজ করে, তেমনি সে অনেক কাজ বিনা অর্থে পরিবারের জন্য, সমাজের
জন্য করে। পুঁজিবাদের আর একটি ধারণা আরো মারাত্মক। সেটা হচ্ছে
Positivism-এর ধারণা। পজিটিভিজম হচ্ছে অর্থনীতিতে কোনো মূল্যবোধ থাকবে নাÑ এ
মতবাদ। অর্থনীতিতে মূল্যবোধ থাকলে তা অবাস্তব হয়ে যাবে বলে তারা মনে করে।
এর ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। এর ফলে পুঁজিবাদ সুবিচারের ওপর গুরুত্ব দেয় না।
পুঁজিবাদের মার্কেট সিস্টেম এ জন্য কোনো নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়। পুঁজিবাদের
মার্কেট ব্যবস্থা সাধারণ জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়। এ জন্যই ইসলাম তার
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
কুরআন সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে ফরজ করেছে (কুরআন, নহল : ৯০ আয়াত)। ইনসাফের দাবি
হলো সবার জন্য সম্মানজনকভাবে প্রয়োজন পূরণ করতে হবে। অর্থনীতিকে সেভাবেই
সাজাতে হবে। মার্কেটব্যবস্থাকে অনিয়ন্ত্রিত রাখা যাবে না। যদি
বাজারব্যবস্থা লক্ষ্য পূরণে সমস্যা সৃষ্টি করে তাহলে বাজারে হস্তক্ষেপ করে
ভারসাম্য আনতে হবে। একে ইসলামের পরিভাষায় হিসবা বা বাজার পর্যবেক্ষণ বলে। এ
জন্য প্রয়োজনে মূল্য নির্ধারণ, আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রণ, মওজুদের পরিমাণ
নির্ধারণ ইত্যাদি সরকার করবে। ইসলাম তার লক্ষ্য অর্জনে আর্থিক ও অর্থনৈতিক
ব্যবস্থা পুনর্গঠন করবে। ব্যাংকিংব্যবস্থা সুদমুক্তভাবে এবং ব্যবসায়ের
নীতির ভিত্তিতে পুনর্গঠন করবে। সরকারের ব্যয়নীতি ন্যায়সঙ্গত করবে। অপচয়
থাকবে না। মুদ্রানীতি পরিবর্তন করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নতুন টাকা চালু
করে, তা বাণিজ্যিক ব্যাংক যে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে, তা জনগণের সম্পদ ধরতে
হবে এবং এ অর্থকে মুদারাবার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। লাভের যে অংশ
জনগণের অর্থের বিনিময়ে আসবে, তা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। স্টক
মার্কেট থেকে স্পেকুলেশন ও মার্জিনে (margin) এ বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
(দ্রষ্টব্য ড. উমর চাপড়ার ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং মনিটারি সিস্টেম
ইন ইসলাম)
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
No comments