কোকোর মৃত্যু এবং অমানবিক রাজনীতির অসৌজন্যতা by গোলাম মাওলা রনি
কোকোর
মৃত্যুসংবাদ আমি প্রথম জানতে পারি ফেসবুকের মাধ্যমে। আর তখনই আমার মনে
হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী রাজনীতির এক মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করবেন
না। বাস্তবে হলোও তা-ই- তিনি হুট করে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে
চার দিকে হইচই ফেলে দিলেন। দেশবাসীর কারো পক্ষে জানার সুযোগ হলো না যে
বিএনপি অফিসের মূল ফটকের তালাটি কি তখন খোলা ছিল নাকি বন্ধ ছিল! দেশবাসী এ
কথাও জানল না যে, দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো বাড়িতে গেলে সেই বাড়ির আশপাশের
সব ভবনে নিরাপত্তা তল্লাশি চালানোর পর ভবনগুলোতে এসএসএফ অবস্থান নেয়। অন্য
দিকে যে বাড়িতে তিনি যাবেন সেই বাড়ির প্রতিটি কামরা তারা যথাসাধ্য
নিরাপত্তা তল্লাশি করার পর সব শেষে প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে তল্লাশি চালায়।
বাড়ির ভেতরকার খাবারদাবার, পানীয়, ফুলদানি এমনকি টয়লেটের পাইপগুলোতেও
তল্লাশি চালানোর পর সব কিছু ঠিকঠাক পেলেই ওয়্যারলেসে গ্রিন সিগন্যাল পাঠানো
হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর নির্ধারিত গন্তব্যে রওনা করে। বিএনপির
অভিযোগ মতে- কেবল লোকদেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার
কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। বিএনপির অভিযোগের বিপরীতে আওয়ামী লীগের অনেক কথা
থাকতে পারে। কিন্তু তারা সেসব কথা বলেননি। তারা কেবল তাদের নেত্রীকে কেন
যথাযোগ্য সম্মান ও সৌজন্যতা প্রদর্শন করা হলো না- এই ক্ষোভে বিএনপির সবাইকে
তুলোধুনো করছেন। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী তার দলের কারো সঙ্গে পরামর্শ
না করেই একক সিদ্ধান্তে হুট করে বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের দিকে রওনা
দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো গভীর মাতৃত্ববোধের প্রবল অনুরাগ থেকেই ওমনটি
করেছিলেন। অথবা রাজনৈতিকভাবে নিজের উদারতা, শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা অতিমানবিকতা
প্রমাণের জন্যও যেতে পারেন। এর বাইরে কূটকৌশল, ভাঁওতাবাজি কিংবা চমক
দেখানোর জন্যও যেতে পারেন, যা, কিনা বিএনপির লোকেরা এখন জোরগলায় প্রচার
করার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী যদি একটু ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করতেন তবে
নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারতেন যে বিএনপির কাপুরুষ বা কামহিলা জাতের লোকসকল
তাকে যমদূতের মতো ভয় করে। তার নাম শুনলে ওই সব কাপুরুষ এবং কামহিলার
কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে বিএনপির মধ্যে এমন লোকও আছে যারা বেগম
খালেদা জিয়ার চেয়ে তাকেই বেশি পছন্দ করে। কারণ বিএনপির আমলে উপার্জিত অর্থ,
লাইসেন্স এবং ব্যবসাবাণিজ্য এখন শেখ হাসিনার সরকারের কল্যাণে ফুলে-ফেঁপে
বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে তাদের বড়ই ক্ষতি হয়।
অন্য দিকে দলীয় সরকার না থাকায় তাদের ঝক্কিঝামেলাও কম। সরকারি দলের বেকুব
শ্রেণীর পাণ্ডাদের নামমাত্র কমিশন বা লভ্যাংশ দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে
বিরাট অঙ্কের মুনাফা। এই দুই শ্রেণীর বাইরে সংখ্যায় অল্প হলেও আরেকটি
শ্রেণী রয়েছে, যারা প্রকৃতই সাহসী এবং আওয়ামী লীগ ও তার প্রধানকে মনেপ্রাণে
ঘৃণা করে। তারা মরে যাবে কিন্তু আওয়ামী-অনুগ্রহ কিংবা ভিক্ষার দান গ্রহণ
করবে না।
প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে খালেদা জিয়া সম্পর্কেও একটু চিন্তা করতে পারতেন। পারিবারিক জীবনে খালেদা জিয়া সব সময় তার স্বামীর আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতেন। দুই পুত্রসন্তান, পুত্রবধূ ও নাতিনদের সঙ্গে তার রয়েছে চমৎকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক লোকদেখানো নয়Ñ সত্যিকার অর্থেই আবহমান বাংলার চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি কাজ ও অবসর দুটোই উপভোগ করেন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে দলীয় লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সব কিছু করে থাকেন। কথা বলেন কম এবং শোনেন বেশি। নিজের প্রতিশ্রুতি, সিদ্ধান্ত, নীতি বা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন না। একবার যা বলেন তার ওপর অটল থাকেন শেষ দিন পর্যন্ত। জাতীয় রাজনীতিতে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের নজির নেই একটিও। অন্য দিকে, ক্ষমতাকালীন সময়ে বিরোধী দলের দুটো দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে নিজের গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন জাতির কাছে। প্রথমটি ছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনে রাজি হওয়া আর দ্বিতীয়টি ছিল তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি মেনে নেয়া। আওয়ামী লীগ যদি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আরো একটু গবেষণা করে তবে দেখতে পাবে যে, বিএনপি নেত্রী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী একজন অস্থির চিত্তের মানবী, যার কারণে তার জীবন-যৌবন শেষ হয়ে গেছে। এরশাদ আমলে তারা যুগপৎভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করলেন এবং মাঝপথে হঠাৎ রণে ভঙ্গ দিয়ে এরশাদের সঙ্গে মিলে গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ফলে রাজপথে বেগম জিয়া একা হয়ে গেলেন এবং সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হলেন। খালেদা জিয়া মনে করেন যে, শেখ হাসিনার জন্যই এরশাদ অতিরিক্ত তিন-চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনা এরশাদকে জেলে পাঠানোর জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। অন্য দিকে, এরশাদকে জেলে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে পর্দার অন্তরালে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটান। খালেদা জিয়া এবং তার অন্ধ সমর্থকগণ মনে করেন যে, শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্যই লগি-বৈঠা এবং তারপর ১/১১-এর উদ্ভব হয়। ১/১১-এর কুশিলবেরা প্রথমে চেষ্টা করেন বিএনপি-আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নিজেরা কিছু করার জন্য। ব্যর্থ হয়ে তারা প্রথমে আপস প্রস্তাব নিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে যান এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরান। এরই ধারাবাহিকতায় যখন ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয় তখন বেগম জিয়া প্রথমে বেঁকে বসেন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার জন্য। কিন্তু দলের সুবিধাবাদী গ্রুপের প্রবল চাপে তিনি নতিস্বীকার করেন।
১/১১-এর ঘটনা জিয়াপরিবারকে তছনছ করে দেয়। তারেক রহমান ওরফে পিনু এবং আরাফাত রহমান ওরফে কোকোর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন করা হয় যাতে করে তাদের জীবননাশের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তারেক বরাবরই কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের। অন্য দিকে কোকো সে তুলনায় অনেক নিরীহ এবং গোবেচারা প্রকৃতির ছিলেন। মা হিসেবে তাই কোকোর প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার ছিল একধরনের অতিরিক্ত মমত্ববোধ ও স্নেহের দুর্বলতা। আর তাই ১/১১-এর সময় বিশেষ আদালতের কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারে বসা অসুস্থ কোকোকে দেখে তিনি তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। নিয়মকানুন ভেঙে নিজের কাঠগড়া থেকে ছুটে গিয়েছিলেন কোকোর হুইল চেয়ারের কাছে। অসুস্থ ছেলের মুখমণ্ডলে হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানিতে অবগাহন করেছিলেন। এরপরই হয়তো সেনাকর্মকর্তাদের চাপের কাছে আংশিক নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে রাজি হলেও যেকোনো মূল্যে নিজে থেকে যান বাংলাদেশে। সেই সব দুঃসহ স্মৃতি, দুর্ভোগ এবং সব বঞ্চনার জন্য তিনি মনে-প্রাণে শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেন।
নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শতকরা হিসাবে উল্লেখযোগ্য হারে পপুলার ভোট পেলেও আসনসংখ্যার হিসাবে গো-হারা হারে। এটাকে খালেদা জিয়া একটি সাজানো ও পাতানো ঘটনা মনে করলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় সব কিছু মেনে নিয়ে সংসদে উপস্থিত হন। তার বিশ্বাস ছিল ১/১১-এর সময়ে জিয়াপরিবারের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার তা প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো। সরকার বিএনপিকে বিরোধী দল মনে না করে তাদেরকে দেশ-জাতি ও সরকারের শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করল। বিএনপির বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোকে সরকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করলে শেখ হাসিনার ওপর ক্ষণিকের তরে সৃষ্টি হওয়া বেগম খালেদা জিয়ার বিশ্বাস ও আস্থায় ফাটল ধরে গেল। তিনি সংসদে আসা বন্ধ করে দিলেন।
বিএনপি কর্তৃক সংসদ বর্জনে আওয়ামী লীগ ভারি মজা পেল। তারা মনের আনন্দে বিএনপির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নানামুখী বক্তব্য দিতে লাগল। জিয়াপরিবারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা রকম কুৎসাকে কিচ্ছাকাহিনী বানিয়ে সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল। পরিস্থিতি এমন হলো যে, সরকারি দলের যে সদস্য যত বেশি মন্দ কথা বলতে পারবেন তারই মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। অন্য দিকে কিছু দিন পর বিএনপি সংসদে ফিরে বঙ্গবন্ধু পরিবার সম্পর্কে নানান কুৎসা ও কিচ্ছাকাহিনী বলতে আরম্ভ করল। তখন সরকারি দল মনে-প্রাণে চাইল বিএনপি যেন সংসদে না আসে। এরই মধ্যে একদিন পুলিশ কর্তৃক বিএনপিদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। ফলে উভয় দলের সম্পর্কে মারাত্মক অবনতি দেখা দেয়। এরই মধ্যে বেগম জিয়া তার সুদীর্ঘকালের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর সরকারি টেলিভিশনে এমন সব ছবি, প্রতিবেদন ও মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যাতে স্পষ্টতই দেশের সম্মানিত একজন প্রধানকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়।
বিএনপি নেত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর তার চরিত্র, পারিবারিক জীবন ও রাজনীতিকে কলঙ্কময় করার জন্য হেন কাজ নেই যা সরকারি দলের লোকজন করেনি। ফলে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক দূরত্বÑ হয়তো আটলান্টিক মহাসাগরের মতো দূরত্ব। সেই দূরত্ব আবার অতিক্রম করা সম্ভব নয় কারণ দু’জনের মাঝে রয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো ভয়াবহ এক রহস্যময় উপাখ্যান। শেখ হাসিনা সব সময় বেগম জিয়াকে একজন মেজরের বিধবা স্ত্রী ছাড়া বেশি কিছু মনে করেন না। তিনি যে সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী কিংবা দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সে কথা শেখ হাসিনা ও তার কট্টর সমর্থকবৃন্দ ভুলেও স্মরণ করতে চান না। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের লোকজন শেখ হাসিনাকে যতই বঙ্গবন্ধুকন্যা বা জাতির জনকের কন্যা বলে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে বসাতে চান না কেন, বিএনপির লোকজন কিন্তু ওমনটি মনে করেন না। তারা তাকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক দরিদ্র গেরস্থ ঘরের কন্যা এবং উত্তরবঙ্গের আরেক নিন্মবিত্ত গেরস্থ ঘরের পুত্রবধূ মনে করে থাকেন।
শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে এত বিভেদ-বিসম্বাদ, এত পারস্পরিক ঘৃণা, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার মাঝে কোকোর মৃত্যু এবং সেই মৃত্যুতে শোক জানানোর জন্য শেখ হাসিনা কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে হুট করে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে যারা সৌজন্যতা বা অসৌজন্যতার প্রশ্ন তুলছেন তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার জন্য আমার করুণা হয়। আওয়ামী লীগের শুভার্থীদের উচিত তাদেরকে সমালোচনা করা, যারা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অতিমানবীয় কিছু করাতে গিয়ে একটি দলের প্রধান, জাতির জনকের কন্যা এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করিয়ে আনল। সাংবাদিকেরা যদি একটু খোঁজ নিতেন তবে দেখতে পেতেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস শেখর এবং বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে মোট তিনবারে কী কী কথা হয়েছে! কত মিনিটের মাথায় তারা কথা শেষ করেছেন এবং শেষমেশ কী কথার ওপর নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রী এলেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন? তার আগমনের আগে এসএসএফ কি বাড়ির ভেতরে গিয়েছিল নাকি এসএসএফ শুধু প্রধানমন্ত্রীর বহরের সঙ্গে এসেছিল এবং আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল? এসব বিবেচনায় পুরো মানুষটিকে নিয়ে দেখা দিয়েছে একধরনের অমর্যাদাকর বিশ্বাসহীনতা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণীপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বললাম, আচ্ছা ধরে নিলাম প্রধানমন্ত্রী চমৎকার অভিনয়শৈলী ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আপনাদের দরজায় এসে আপনাদেরকে জাতির সামনে হেয় করার এক প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। কিন্তু আপনারাও তো তার সঙ্গে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতে পারতেন! তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে ঢোকাতে পারতেন। তারপর একটি রুমে ঘণ্টাখানেক ধরে তাকে বসিয়ে আপ্যায়ন ও টুকটাক কথাবার্তা বলে সময় পার করে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মনের গহিনে মারাত্মকভাবে আপনাদের ব্যবহার স্পর্শ করত এবং আপনারাও আরো অধিক পরিমাণ আনন্দ লাভ করতে পারতেন। আমি আশা করেছিলাম ভদ্রলোক আমার কথা শুনে হাসবেন কিংবা যুৎসই একটি উত্তর দেবেন। কিন্তু তিনি তা না করে একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেনÑ রনি ভাই! আপনিও দেখছি ক্ষমতাসীনদের মতো আমাদের শোক ও দুর্বলতা নিয়ে মশকরা করছেন। সারা দেশে প্রায় দশ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৭০-৮০ হাজার মামলা। বিএনপির কোনো নেতা ঘরে থাকতে পারছেন না। সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা জেলে। বাকিরা পলাতক। শিমুল বিশ্বাস ও মারুফ কামাল খান নেত্রীর সঙ্গে গত প্রায় এক মাস অবরুদ্ধ। প্রতি মুহূর্তে তারা গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন প্রায় এক কাপড়ে। মূল গেটের চাবি পুলিশের কাছে। তারা সকালে তালা মারে আবার বিকেলে খোলে। বাড়ির সামনে একবার মাটির ট্রাক, আবার বালুর ট্রাক এবং মাঝে মধ্যে ময়লার ট্রাক। পুরো এলাকায় সার্কিট ক্যামেরা লাগানো। ফলে সাধারণ মানুষ ভয়ে ওদিকে পা বাড়ায় না। দলীয় নেতাকর্মীরা অফিসমুখী হলেই গ্রেফতার করা হন। বি চৌধুরীর মতো বিশিষ্টজনদের পুলিশ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেয় না। পুলিশের অনুমতি ছাড়া বাড়ির ভেতর ও বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারো নেই। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, গুলশান থানার একজন কনস্টেবলকে বাড়ির মধ্যে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধ করার ক্ষমতা, সাহস ও কৃতিত্ব বিএনপির কেউ রাখে না। আমাদের নাকে দড়ি বেঁধে সরকার ঘোরাচ্ছে এবং তাদের ইচ্ছেমতো সব কিছু করিয়ে নিচ্ছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি যুৎসই একটি জবাব দেয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই তিনি পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন আমাদের রাজনীতি বড়ই অমানবিক হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষ আগে জীবন্ত মানুষের গায়ের চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজাতে চাইত। মানুষের মৃত্যুর পর নাচগানের উৎসব করতÑ অনেকে তো ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করেছে। অতীতের সব নিষ্ঠুরতা ম্লান হয়ে গিয়েছিল ১/১১-এর আগে যখন একদল মানুষ তাদের হাতের লাঠি দিয়ে অন্য দলকে পিটিয়ে মেরে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করেছে। এই লোকগুলো কারা? কোন দলের? তারা এখন কোথায় এবং কাদের সঙ্গে আছেন সেই লোকগুলো যে মৃত কোকোর লাশের সঙ্গে নৃশংসতা দেখায়নিÑ এটাই আমাদের চরম এবং পরম পাওনা। আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, কোকো একে তো অসুস্থ ছিলেন। তার ওপর ৭০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের ওপর সরকারের একের পর এক নৃশংশ চাপ ও গ্রেফতারের হুমকি তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সময় খালেদা জিয়ার বয়স মাত্র ৩৫ বছর আর কোকোর ১২ বছর। অসহায় বিধবা হিসেবে খালেদা জিয়া সব সময় অন্ধের যষ্টির মতো তার বালকপুত্রটিকে বুকে চেপে নিজের সব বেদনা ভুলতে চেষ্টা করেছেন। কোকোর সাথে তার বন্ধন এবং সম্পর্ক বোঝার জন্য মানুষের মতো মন থাকার দরকার। হায়েনার হিংস্রতা দিয়ে মা-ছেলের সেই বিশেষ সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যায় না। কোকোর মৃত্যু তাই বেগম জিয়াকে সংজ্ঞাহীন কিংবা অস্থির করবে এটাই স্বাভাবিক। অন্য দিকে মৃত্যু নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের বিচারের ভার বেগম জিয়া জীবনমৃত্যুর মালিকের কাছে সমর্পণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে খালেদা জিয়া সম্পর্কেও একটু চিন্তা করতে পারতেন। পারিবারিক জীবনে খালেদা জিয়া সব সময় তার স্বামীর আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতেন। দুই পুত্রসন্তান, পুত্রবধূ ও নাতিনদের সঙ্গে তার রয়েছে চমৎকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক লোকদেখানো নয়Ñ সত্যিকার অর্থেই আবহমান বাংলার চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি কাজ ও অবসর দুটোই উপভোগ করেন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবর্তে দলীয় লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সব কিছু করে থাকেন। কথা বলেন কম এবং শোনেন বেশি। নিজের প্রতিশ্রুতি, সিদ্ধান্ত, নীতি বা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন না। একবার যা বলেন তার ওপর অটল থাকেন শেষ দিন পর্যন্ত। জাতীয় রাজনীতিতে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের নজির নেই একটিও। অন্য দিকে, ক্ষমতাকালীন সময়ে বিরোধী দলের দুটো দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে নিজের গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন জাতির কাছে। প্রথমটি ছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনে রাজি হওয়া আর দ্বিতীয়টি ছিল তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি মেনে নেয়া। আওয়ামী লীগ যদি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আরো একটু গবেষণা করে তবে দেখতে পাবে যে, বিএনপি নেত্রী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী একজন অস্থির চিত্তের মানবী, যার কারণে তার জীবন-যৌবন শেষ হয়ে গেছে। এরশাদ আমলে তারা যুগপৎভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করলেন এবং মাঝপথে হঠাৎ রণে ভঙ্গ দিয়ে এরশাদের সঙ্গে মিলে গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ফলে রাজপথে বেগম জিয়া একা হয়ে গেলেন এবং সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হলেন। খালেদা জিয়া মনে করেন যে, শেখ হাসিনার জন্যই এরশাদ অতিরিক্ত তিন-চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনা এরশাদকে জেলে পাঠানোর জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। অন্য দিকে, এরশাদকে জেলে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে পর্দার অন্তরালে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটান। খালেদা জিয়া এবং তার অন্ধ সমর্থকগণ মনে করেন যে, শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্যই লগি-বৈঠা এবং তারপর ১/১১-এর উদ্ভব হয়। ১/১১-এর কুশিলবেরা প্রথমে চেষ্টা করেন বিএনপি-আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নিজেরা কিছু করার জন্য। ব্যর্থ হয়ে তারা প্রথমে আপস প্রস্তাব নিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে যান এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরান। এরই ধারাবাহিকতায় যখন ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয় তখন বেগম জিয়া প্রথমে বেঁকে বসেন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার জন্য। কিন্তু দলের সুবিধাবাদী গ্রুপের প্রবল চাপে তিনি নতিস্বীকার করেন।
১/১১-এর ঘটনা জিয়াপরিবারকে তছনছ করে দেয়। তারেক রহমান ওরফে পিনু এবং আরাফাত রহমান ওরফে কোকোর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন করা হয় যাতে করে তাদের জীবননাশের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তারেক বরাবরই কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের। অন্য দিকে কোকো সে তুলনায় অনেক নিরীহ এবং গোবেচারা প্রকৃতির ছিলেন। মা হিসেবে তাই কোকোর প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার ছিল একধরনের অতিরিক্ত মমত্ববোধ ও স্নেহের দুর্বলতা। আর তাই ১/১১-এর সময় বিশেষ আদালতের কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারে বসা অসুস্থ কোকোকে দেখে তিনি তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। নিয়মকানুন ভেঙে নিজের কাঠগড়া থেকে ছুটে গিয়েছিলেন কোকোর হুইল চেয়ারের কাছে। অসুস্থ ছেলের মুখমণ্ডলে হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানিতে অবগাহন করেছিলেন। এরপরই হয়তো সেনাকর্মকর্তাদের চাপের কাছে আংশিক নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে রাজি হলেও যেকোনো মূল্যে নিজে থেকে যান বাংলাদেশে। সেই সব দুঃসহ স্মৃতি, দুর্ভোগ এবং সব বঞ্চনার জন্য তিনি মনে-প্রাণে শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেন।
নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শতকরা হিসাবে উল্লেখযোগ্য হারে পপুলার ভোট পেলেও আসনসংখ্যার হিসাবে গো-হারা হারে। এটাকে খালেদা জিয়া একটি সাজানো ও পাতানো ঘটনা মনে করলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় সব কিছু মেনে নিয়ে সংসদে উপস্থিত হন। তার বিশ্বাস ছিল ১/১১-এর সময়ে জিয়াপরিবারের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার তা প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো। সরকার বিএনপিকে বিরোধী দল মনে না করে তাদেরকে দেশ-জাতি ও সরকারের শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করল। বিএনপির বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোকে সরকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করলে শেখ হাসিনার ওপর ক্ষণিকের তরে সৃষ্টি হওয়া বেগম খালেদা জিয়ার বিশ্বাস ও আস্থায় ফাটল ধরে গেল। তিনি সংসদে আসা বন্ধ করে দিলেন।
বিএনপি কর্তৃক সংসদ বর্জনে আওয়ামী লীগ ভারি মজা পেল। তারা মনের আনন্দে বিএনপির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নানামুখী বক্তব্য দিতে লাগল। জিয়াপরিবারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা রকম কুৎসাকে কিচ্ছাকাহিনী বানিয়ে সংসদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল। পরিস্থিতি এমন হলো যে, সরকারি দলের যে সদস্য যত বেশি মন্দ কথা বলতে পারবেন তারই মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। অন্য দিকে কিছু দিন পর বিএনপি সংসদে ফিরে বঙ্গবন্ধু পরিবার সম্পর্কে নানান কুৎসা ও কিচ্ছাকাহিনী বলতে আরম্ভ করল। তখন সরকারি দল মনে-প্রাণে চাইল বিএনপি যেন সংসদে না আসে। এরই মধ্যে একদিন পুলিশ কর্তৃক বিএনপিদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। ফলে উভয় দলের সম্পর্কে মারাত্মক অবনতি দেখা দেয়। এরই মধ্যে বেগম জিয়া তার সুদীর্ঘকালের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর সরকারি টেলিভিশনে এমন সব ছবি, প্রতিবেদন ও মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যাতে স্পষ্টতই দেশের সম্মানিত একজন প্রধানকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়।
বিএনপি নেত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর তার চরিত্র, পারিবারিক জীবন ও রাজনীতিকে কলঙ্কময় করার জন্য হেন কাজ নেই যা সরকারি দলের লোকজন করেনি। ফলে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক দূরত্বÑ হয়তো আটলান্টিক মহাসাগরের মতো দূরত্ব। সেই দূরত্ব আবার অতিক্রম করা সম্ভব নয় কারণ দু’জনের মাঝে রয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো ভয়াবহ এক রহস্যময় উপাখ্যান। শেখ হাসিনা সব সময় বেগম জিয়াকে একজন মেজরের বিধবা স্ত্রী ছাড়া বেশি কিছু মনে করেন না। তিনি যে সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী কিংবা দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সে কথা শেখ হাসিনা ও তার কট্টর সমর্থকবৃন্দ ভুলেও স্মরণ করতে চান না। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের লোকজন শেখ হাসিনাকে যতই বঙ্গবন্ধুকন্যা বা জাতির জনকের কন্যা বলে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে বসাতে চান না কেন, বিএনপির লোকজন কিন্তু ওমনটি মনে করেন না। তারা তাকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক দরিদ্র গেরস্থ ঘরের কন্যা এবং উত্তরবঙ্গের আরেক নিন্মবিত্ত গেরস্থ ঘরের পুত্রবধূ মনে করে থাকেন।
শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে এত বিভেদ-বিসম্বাদ, এত পারস্পরিক ঘৃণা, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার মাঝে কোকোর মৃত্যু এবং সেই মৃত্যুতে শোক জানানোর জন্য শেখ হাসিনা কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে হুট করে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে যারা সৌজন্যতা বা অসৌজন্যতার প্রশ্ন তুলছেন তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার জন্য আমার করুণা হয়। আওয়ামী লীগের শুভার্থীদের উচিত তাদেরকে সমালোচনা করা, যারা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অতিমানবীয় কিছু করাতে গিয়ে একটি দলের প্রধান, জাতির জনকের কন্যা এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করিয়ে আনল। সাংবাদিকেরা যদি একটু খোঁজ নিতেন তবে দেখতে পেতেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস শেখর এবং বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে মোট তিনবারে কী কী কথা হয়েছে! কত মিনিটের মাথায় তারা কথা শেষ করেছেন এবং শেষমেশ কী কথার ওপর নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রী এলেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন? তার আগমনের আগে এসএসএফ কি বাড়ির ভেতরে গিয়েছিল নাকি এসএসএফ শুধু প্রধানমন্ত্রীর বহরের সঙ্গে এসেছিল এবং আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল? এসব বিবেচনায় পুরো মানুষটিকে নিয়ে দেখা দিয়েছে একধরনের অমর্যাদাকর বিশ্বাসহীনতা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণীপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বললাম, আচ্ছা ধরে নিলাম প্রধানমন্ত্রী চমৎকার অভিনয়শৈলী ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আপনাদের দরজায় এসে আপনাদেরকে জাতির সামনে হেয় করার এক প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। কিন্তু আপনারাও তো তার সঙ্গে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতে পারতেন! তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে ঢোকাতে পারতেন। তারপর একটি রুমে ঘণ্টাখানেক ধরে তাকে বসিয়ে আপ্যায়ন ও টুকটাক কথাবার্তা বলে সময় পার করে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মনের গহিনে মারাত্মকভাবে আপনাদের ব্যবহার স্পর্শ করত এবং আপনারাও আরো অধিক পরিমাণ আনন্দ লাভ করতে পারতেন। আমি আশা করেছিলাম ভদ্রলোক আমার কথা শুনে হাসবেন কিংবা যুৎসই একটি উত্তর দেবেন। কিন্তু তিনি তা না করে একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেনÑ রনি ভাই! আপনিও দেখছি ক্ষমতাসীনদের মতো আমাদের শোক ও দুর্বলতা নিয়ে মশকরা করছেন। সারা দেশে প্রায় দশ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৭০-৮০ হাজার মামলা। বিএনপির কোনো নেতা ঘরে থাকতে পারছেন না। সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা জেলে। বাকিরা পলাতক। শিমুল বিশ্বাস ও মারুফ কামাল খান নেত্রীর সঙ্গে গত প্রায় এক মাস অবরুদ্ধ। প্রতি মুহূর্তে তারা গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন প্রায় এক কাপড়ে। মূল গেটের চাবি পুলিশের কাছে। তারা সকালে তালা মারে আবার বিকেলে খোলে। বাড়ির সামনে একবার মাটির ট্রাক, আবার বালুর ট্রাক এবং মাঝে মধ্যে ময়লার ট্রাক। পুরো এলাকায় সার্কিট ক্যামেরা লাগানো। ফলে সাধারণ মানুষ ভয়ে ওদিকে পা বাড়ায় না। দলীয় নেতাকর্মীরা অফিসমুখী হলেই গ্রেফতার করা হন। বি চৌধুরীর মতো বিশিষ্টজনদের পুলিশ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেয় না। পুলিশের অনুমতি ছাড়া বাড়ির ভেতর ও বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারো নেই। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, গুলশান থানার একজন কনস্টেবলকে বাড়ির মধ্যে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধ করার ক্ষমতা, সাহস ও কৃতিত্ব বিএনপির কেউ রাখে না। আমাদের নাকে দড়ি বেঁধে সরকার ঘোরাচ্ছে এবং তাদের ইচ্ছেমতো সব কিছু করিয়ে নিচ্ছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি যুৎসই একটি জবাব দেয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই তিনি পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন আমাদের রাজনীতি বড়ই অমানবিক হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষ আগে জীবন্ত মানুষের গায়ের চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজাতে চাইত। মানুষের মৃত্যুর পর নাচগানের উৎসব করতÑ অনেকে তো ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করেছে। অতীতের সব নিষ্ঠুরতা ম্লান হয়ে গিয়েছিল ১/১১-এর আগে যখন একদল মানুষ তাদের হাতের লাঠি দিয়ে অন্য দলকে পিটিয়ে মেরে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করেছে। এই লোকগুলো কারা? কোন দলের? তারা এখন কোথায় এবং কাদের সঙ্গে আছেন সেই লোকগুলো যে মৃত কোকোর লাশের সঙ্গে নৃশংসতা দেখায়নিÑ এটাই আমাদের চরম এবং পরম পাওনা। আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, কোকো একে তো অসুস্থ ছিলেন। তার ওপর ৭০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের ওপর সরকারের একের পর এক নৃশংশ চাপ ও গ্রেফতারের হুমকি তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সময় খালেদা জিয়ার বয়স মাত্র ৩৫ বছর আর কোকোর ১২ বছর। অসহায় বিধবা হিসেবে খালেদা জিয়া সব সময় অন্ধের যষ্টির মতো তার বালকপুত্রটিকে বুকে চেপে নিজের সব বেদনা ভুলতে চেষ্টা করেছেন। কোকোর সাথে তার বন্ধন এবং সম্পর্ক বোঝার জন্য মানুষের মতো মন থাকার দরকার। হায়েনার হিংস্রতা দিয়ে মা-ছেলের সেই বিশেষ সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যায় না। কোকোর মৃত্যু তাই বেগম জিয়াকে সংজ্ঞাহীন কিংবা অস্থির করবে এটাই স্বাভাবিক। অন্য দিকে মৃত্যু নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের বিচারের ভার বেগম জিয়া জীবনমৃত্যুর মালিকের কাছে সমর্পণ করেছেন।
No comments