জলবায়ু পরিবর্তন- দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা by জেফরি ডি স্যাকস ও লিসা স্যাকস
দুনিয়াজুড়ে
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন।
সেটি হচ্ছে তেল, গ্যাস ও কয়লা কোম্পানি থেকে তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ
প্রত্যাহার করবেন কি না। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আছে পেনশন ফান্ড, বিমা
কোম্পানি, লোকহিতকর এন্ডাওমেন্ট ও এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়। কারণটি
নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তন। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপকহারে না
কমালে ও ২০৭০ সালের মধ্যে তার ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা না হলে
দুনিয়া মনুষ্যসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকির মুখে পড়বে, এটা মোটেই
গ্রহণযোগ্য নয়। এমন নজিরবিহীন ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্বশীল
বিনিয়োগকারীরা কী করবেন? এর একটি উত্তর হতে পারে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়া,
নানা কারণেই। এর একটি কারণ খুবই সহজ-সরল। নিছক নিজ স্বার্থেই তা করা যেতে
পারে। কারণ, দুনিয়া নিশ্চিতভাবেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, এক
পালাবদল ঘটছে। (এর বিকল্পও আছে। ধনী দেশগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার
কমানোর দাবি থাকলেও দরিদ্র দেশগুলোতে এর ব্যবহার চলতেই থাকবে। দারিদ্র্য
বিমোচনের লক্ষ্যে এটা তাদের করতে হবে।) তদুপরি, এই বিনিয়োগ-প্রত্যাহার এই
পালাবদলে সহায়তা করবে। এতে অন্তত জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প পুঁজি সংকটে
পড়বে বা এসব কোম্পানির পুঁজি প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়বে। যদিও জীবাশ্ম
জ্বালানি ব্যবহারের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। এককভাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক
বিনিয়োগকারীর পক্ষে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, তবে তারা
সম্মিলিতভাবে নিশ্চয়ই কিছু করতে পারে—তাদের হাতে ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ
রয়েছে। হ্যাঁ, বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিলে তা
দুনিয়ার জন্য শক্তিশালী বার্তা হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের
ব্যাপারটা এত বিপজ্জনক যে কার্বন নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে কোনো আপস চলবে
না। বিনিয়োগ প্রত্যাহারই এই বার্তা দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম নয়, কিন্তু তা
নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী মাধ্যম। শেষমেশ, বিনিয়োগকারীরা নৈতিক কারণেও
সরে যেতে পারেন। অনেক বিনিয়োগকারীই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী শিল্পের সঙ্গে
সম্পর্কিত হতে চায় না। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি জলবায়ু পরিবর্তনের
পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের টাকা ও প্রভাব খাটায়, তাদের সঙ্গে। একই কারণে,
অনেক বিনিয়োগকারীই তাঁদের বিনিয়োগ-তালিকায় বন্দুক নির্মাতা ও তামাক
উৎপাদনকারীদের রাখতে চাইবে না। তার পরও এই বিনিয়োগ-প্রত্যাহারের বিকল্প
রয়েছে, এটি নৈতিকতার বিচারে দায়িত্বশীল ও এর চারিত্রিকভাবে ব্যবহারিক। যার
মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্ন কার্বন নিঃসরণের দিকে যেতে
পারে। সক্রিয় ও বিজড়িত শেয়ারহোল্ডার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা
তাঁদের মালিকানার ক্ষমতা (আর বড় বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে তাঁদের গণচরিত্র)
ব্যবহার করে কোম্পানিগুলোকে জলবায়ু-নিরাপদ নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করতে
পারেন। এই বিতর্কের সামনের সারিতে আছে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
সেখানকার ছাত্রদের চাপাচাপিতেই তারা এটা করছে। আগামী দিনগুলোতে এই
তরুণেরাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝাপটা মোকাবিলা করবে। ছাত্ররা হতাশ যে অধিকাংশ
বিশ্ববিদ্যালয় এন্ডাওমেন্ট এ ব্যাপারে নিশ্চুপ, তাদের এ হতাশা সঠিক।
বিশ্ববিদ্যালয় না করছে বিনিয়োগ-প্রত্যাহার, আবার না হচ্ছে সক্রিয়
বিনিয়োগকারী। যেমন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড্রিউ জিলপিন
ফাউস্ট ২০১৩ সালে জোরের সঙ্গে বিনিয়োগ-প্রত্যাহারের সম্ভাবনা নাকচ করে
দেন। তিনি বলেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডাওমেন্টের লক্ষ্য হচ্ছে,
একাডেমিক কার্যক্রমে অর্থায়ন করা। যদিও তিনি বলেন যে বিনিয়োগকারী হিসেবে
হার্ভার্ড দায়িত্বশীল হবে, এর কোনো রূপরেখা তিনি দেননি। হার্ভার্ডসহ
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বহুদিন আগেই (আমাদের কলাম্বিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়সহ) বিনিয়োগকারী হিসেবে দায়িত্বশীল হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েরই কমিটি রয়েছে। যাদের কাজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের
ট্রাস্টিদের বিনিয়োগ-তালিকায় পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসন প্রভৃতি
বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়া। এই তিনটি বিষয়কে
একত্রে বলে ইএসজি (এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও গভর্নেন্স)। ইএসজি-বিষয়ক
প্রতিনিধি ভোটের সময় ওই কমিটি তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকে। কিন্তু খুব কম
বিশ্ববিদ্যালয়ই জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব কমিটির কথায়
কান দেয়। ফাউস্ট বিনিয়োগ প্রত্যাহারের বিষয়টি নাকচ করে দিলেও হার্ভার্ডসহ
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক আগেই এটা স্বীকার করেছে যে কিছু কিছু
ক্ষেত্রে প্রত্যাহারই সঠিক সিদ্ধান্ত। ১৯৯০ সালে হার্ভার্ড তামাক
কোম্পানিতে কৃত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে। হার্ভার্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট
ডেরেক বক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত ‘এক আকাঙ্ক্ষা দ্বারা তাড়িত
হয়েছে যে আমরা এমন কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনে তার সঙ্গে জড়াব না, যাদের
বিক্রীত পণ্য অন্য মানুষের প্রভূত ও অন্যায্য ক্ষতির কারণ হয়।’
কলাম্বিয়াসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও সে পথে হেঁটেছে। আজকের ছাত্রদের
জোরালো যুক্তি হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি খাত থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার আর
তামাক খাত থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার একই কথা। উভয়ই মানব অস্তিত্বের জন্য
চরম ঝুঁকি। তামাক কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আগে হার্ভার্ড
তাদের চিঠি লেখে। তারা অনুরোধ করে, তামাক কোম্পানি যেন তামাক বিক্রির
নৈতিক বিষয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা আমলে নেয়। কোম্পানিগুলো
হয় সাড়া দেয়নি, না হয় ধূমপানে মৃত্যু হয়—এই সত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানায়।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারীদের তেল, গ্যাস ও
কয়লা কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে চারটি প্রশ্ন উত্থাপন করা উচিত:
ক) কোম্পানিটি কি জলবায়ু পরিবর্তনের হার প্রাক শিল্প যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্যে জনসমক্ষে পরিষ্কারভাবে সায় দিয়েছে? আর সেই লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমাতে রাজি হয়েছে?
খ) এই ২ ডিগ্রির সীমা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেয়?
গ) কোম্পানিটি কি প্রথাগত নয় এমন মজুত উত্তোলনে গররাজি হয়েছে, যেটা সেই ২ ডিগ্রির সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
ঘ) নিম্ন কার্বন উদ্গিরণকারী শক্তির উৎস প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও কি কোম্পানিটি বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে?
উপর্যুক্ত চারটি প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা যায়। দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারীরা এদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। যারা এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন বা দাবি করবে যে দুনিয়া ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির এই সীমা আরোপ করতে পারবে না, তাহলে আর্থিক ও নৈতিক দুই কারণেই সেখান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা ভালো। কারণ, এসব কোম্পানি নিম্ন কার্বন উদ্গিরণকারী অর্থনীতি তৈরিতে কোনো ভূমিকা পালন করতে চায় না।
অবশ্যই, জলবায়ুবিষয়ক কর্মোদ্যোগ শুধু বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সমাধানের অংশ হিসেবে ব্যক্তি ও কোম্পানির তরফ থেকে টেকসই ভোগ ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ ও নিম্ন কার্বনের ভবিষ্যতের দিকে যেতে হলে সমাজের সব অংশকেই দূরদৃষ্টির সঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা ও সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। ফলে তাদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অন্যান্য সুযোগ রয়েছে। দায়িত্বশীল ও নৈতিক বিনিয়োগকারী হিসেবেও তার নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
লিসা স্যাকস: কলাম্বিয়া সেন্টার অন সাসটেইনেবল ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক।
ক) কোম্পানিটি কি জলবায়ু পরিবর্তনের হার প্রাক শিল্প যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্যে জনসমক্ষে পরিষ্কারভাবে সায় দিয়েছে? আর সেই লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমাতে রাজি হয়েছে?
খ) এই ২ ডিগ্রির সীমা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেয়?
গ) কোম্পানিটি কি প্রথাগত নয় এমন মজুত উত্তোলনে গররাজি হয়েছে, যেটা সেই ২ ডিগ্রির সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
ঘ) নিম্ন কার্বন উদ্গিরণকারী শক্তির উৎস প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও কি কোম্পানিটি বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে?
উপর্যুক্ত চারটি প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা যায়। দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারীরা এদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। যারা এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন বা দাবি করবে যে দুনিয়া ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির এই সীমা আরোপ করতে পারবে না, তাহলে আর্থিক ও নৈতিক দুই কারণেই সেখান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা ভালো। কারণ, এসব কোম্পানি নিম্ন কার্বন উদ্গিরণকারী অর্থনীতি তৈরিতে কোনো ভূমিকা পালন করতে চায় না।
অবশ্যই, জলবায়ুবিষয়ক কর্মোদ্যোগ শুধু বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সমাধানের অংশ হিসেবে ব্যক্তি ও কোম্পানির তরফ থেকে টেকসই ভোগ ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ ও নিম্ন কার্বনের ভবিষ্যতের দিকে যেতে হলে সমাজের সব অংশকেই দূরদৃষ্টির সঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা ও সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। ফলে তাদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অন্যান্য সুযোগ রয়েছে। দায়িত্বশীল ও নৈতিক বিনিয়োগকারী হিসেবেও তার নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
লিসা স্যাকস: কলাম্বিয়া সেন্টার অন সাসটেইনেবল ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক।
No comments