দিল্লি নির্বাচনে কেন বিজেপির ভরাডুবি by বদরুদ্দীন উমর

দিলি্ল বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন এবং বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। ৭০টি আসনের মধ্যে আম আদমি পার্টি (আপ) ৬৭টি আসন ও বিজেপি তিনটি আসনে জয়লাভ করেছে। কংগ্রেস কোনো আসনেই জয়লাভ করেনি। যদিও ইতিপূর্বে একটানা ১৫ বছর দিলি্লতে তারা ক্ষমতাসীন ছিল। বিগত নির্বাচনে বিজেপি ৩২টি আসন পেলেও তা নেমে এসেছে তিনটিতে। ২০১৪ সালের মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য এবং পরবর্তীকালে কয়েকটি রাজ্য নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দিলি্লর নির্বাচনে তাদের প্রান্তিকীকরণ এবারের রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস কয়েক যুগ ধরে অঘোষিত সাম্প্রদায়িক নীতি এবং বড় পুঁজির খেদমতকারী করে এবং চরম দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার শক্তি বৃদ্ধির পরিণতিতে বিজেপির মতো একটি ফ্যাসিস্ট ও চরম সাম্প্রদায়িক দলের উত্থানের শর্ত তৈরি করেছিল। বিজেপির বিজয় সে হিসেবে ছিল কংগ্রেসের অনুসৃত শাসন নীতিরই চূড়ান্ত পরিণতি। এই পরিস্থিতিতে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় এবং দিলি্লর নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিহ্ন হওয়া কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে যে হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতারই জয়জয়কার হয়েছিল, এতে সন্দেহ নেই।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ, দেশের উন্নয়ন ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে বিজেপি তাদের নির্বাচনের লড়াই করেছিল। এই কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচন জয়ের পর তারা জোরেশোরে ভারতকে একমাত্র হিন্দুদের দেশ ও গীতাকে ভারতের জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণা করে তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের রথযাত্রা শুরু করেছিল। তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আরএসএস সংঘ পরিবারভুক্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, বজরং দল ইত্যাদি ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িকতাবাদী দলগুলো 'ঘর ওয়াপসি' বা 'গৃহে প্রত্যাবর্তন' কর্মসূচি নামে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ধর্মান্তকরণ শুরু করে গুজরাট, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বহু গরিব মুসলমান ও খ্রিস্টানকে ইতিমধ্যেই জোরপূর্বক হিন্দু বানিয়েছে। দিলি্লতে তারা তিনটি চার্চ আক্রমণ করে ভাংচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ক্ষমতায় থাকার কারণে সরাসরি এসব কাজ করতে অসুবিধা থাকায় সংঘ পরিবারের এই দলগুলোকে দিয়েই তারা এসব করিয়েছে। বিজেপির পূর্ণ সহযোগিতা এবং প্ররোচনাতেই যে উপরোক্ত দলগুলো এ কাজ করেছে তার প্রমাণ, তারা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি এবং সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপও তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি। দিলি্লর নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ যে এর বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া, এটা ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্র ও সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের নানা বিশ্লেষণমূলক বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে।
ভারতের উন্নয়ন বলতে যে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার সে দেশের বড় বুর্জোয়া ও করপোরেট হাউসগুলোর খেদমতকারী ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না আর তারা যে জনগণের শত্রু এটা ক্ষমতায় থাকার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তারা প্রমাণ করেছে। মোদি সরকার রেল ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। তারা জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা বাজেট ভয়াবহভাবে কাটছাঁট করেছে; ভয়াবহভাবে তারা জনগণের খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থা সংকুচিত করেছে এবং শ্রমিকদের সকল প্রকার রক্ষাকবচ বাতিল করেছে। সরকারি জমি অধিগ্রহণ বিল অনুযায়ী তারা কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে তাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেছে। দিলি্ল বিধানসভার গ্রামীণ নির্বাচনী এলাকাগুলোতে তারা ১৪টি আসনের প্রত্যেকটিতেই পরাজিত হয়েছে। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সেখানে ১৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল! কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ বিলই যে তাদের এই পরাজয়ের কারণ, এতে সন্দেহ নেই।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর দিলি্লতে যে হঠাৎ করে বিজেপির এই শোচনীয় অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তা নয়। কয়েকটি রাজ্য নির্বাচনে তাদের জয় সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজ্যে ৫০টি উপনির্বাচনে তারা পরাজিত হয়েছে। এর থেকেই দেখা যায় যে, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে যে বাতাস ঝড়ের মতো উঠেছিল দ্রুত তার গতি কমে আসা ইতিপূর্বেই শুরু হয়েছিল। দিলি্লর নির্বাচনে তাদের নিম্নগামী জনপ্রিয়তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
মোদির ব্যক্তিগত আচরণও দিলি্লর নির্বাচনে একটা নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। কেজরিওয়াল মোদি ও বিজেপির ঔদ্ধত্যের কথা তার নির্বাচনী প্রচারণায় সাধারণভাবে উল্লেখ করেন। জনগণের কাছে মোদি তার এই ঔদ্ধত্যের পরিচয় নানাভাবে রাখেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে ভারতের, বিশেষ করে দিলি্লর জনগণের কাছে চমক সৃষ্টির যে চেষ্টা করেন, সেটা মাঠে মারা যায় সে উপলক্ষে তিনি যে পোশাক পরিধান করেন তার কথা প্রচার হওয়ার পর। তিনি হামবড়ামি করে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে যে কোট পরেন, তার মূল্য দশ লাখ টাকা। কারুকার্য ভূষিত সেই কোটে মোদির নামও সোনার সুতোয় বোনা ছিল। দশ লাখ টাকার কোট পরিধান করা লোক যে জনগণের বন্ধু হতে পারে না, সেটা বোঝার অসুবিধা কার হতে পারে? শুধু তাই নয়, সাধারণভাবে প্রতিদিনই তিনি অন্তত তিনবার পোশাক পরিবর্তন করেন। তার প্রত্যেকটি পোশাকই খুব মূল্যবান। যে দরজিরা মুম্বাই ফিল্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোশাক তৈরি করেন, তারাই হলেন মোদির দরজি। কিন্তু মুম্বাইয়ের এই অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও কেউ দশ লাখ টাকার পোশাক পরিধান করেন এমন তথ্য কোথাও নেই। মোদির পোশাক সম্পর্কিত এই তথ্য বেশ বড় আকারে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কমিয়ে আনার কাজ করেছে। এই অরাজনৈতিক কাজ তার রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ করে এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে নানা ধরনের জৌলুস দেখিয়ে তিনি দিলি্লর জনগণকে যেভাবে চমক দেখাবার চেষ্টা করেছেন, সেটা কোনো কাজে আসেনি। তার পোশাকই জনগণের কাছে তার স্বরূপ উন্মোচন করেছে। দিলি্লর নির্বাচনে এই 'তুচ্ছ' ব্যাপারটি তাদের পরাজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা কোনো কাজে আসেনি।
কেজরিওয়াল তার নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্নীতিবিরোধী, বড় পুঁজির খেদমতকারী বিরোধী এবং জনগণের বাস্তব জীবনের জন্য সমস্যাবলির সমাধানের কথা তার নির্বাচনী প্রচারে সামনে এনেছেন। তার প্রথম দফা ৪৯ দিনের মুখ্য মন্ত্রিত্বের সময় তিনি দিলি্লর বস্তিবাসীদের জন্য খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। সুলভে ও সহজে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলেছিলেন। এসব তার এই নির্বাচনেও ইস্যু ছিল। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি গরিব জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দিলি্লতে বস্তিবাসী গরিব, দলিত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ কেজরিওয়ালকে ভোট দিয়েছেন। দিলি্লতে মুসলমানের সংখ্যা ১২ শতাংশ। তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ তাদের ভোট দিয়েছেন। তারা শিখদের ভোট পেয়েছেন ৫৭ শতাংশ। নিম্নমধ্যবিত্তদের ভোটও ৫৭ শতাংশ ভাগ পড়েছে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির পক্ষে। এদিক থেকে দেখা যায় যে, বড়লোকদের নয়, গরিবদের পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে সামনে এসেই তারা নির্বাচনে এই সাফল্য অর্জন করেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন কেজরিওয়াল। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই শুধু নয়, দিলি্লর জামে মসজিদের ইমামের সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে তিনি নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করার চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছেন। ইমামের সমর্থন প্রত্যাখ্যানের পরও যে দিলি্লর মুসলমানরা বিপুল সংখ্যায় কেজরিওয়ালকে ভোট দিয়েছেন এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমামের সমর্থন প্রত্যাখানে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে হয়নি। এসব কিছু থেকেই দেখা যায় যে, দিলি্লর নির্বাচন শুধু কোনো স্থানীয় ব্যাপার নয়, ভারতের রাজনীতিতেই এটা এক মোড় পরিবর্তনের মতো ঘটনা।
১৬.২.২০১৫
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.