খালেদা জিয়া যদি যান গণভবনে by আব্দুল কাইয়ুম
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের দিকে ফুটন্ত পানি ছুড়ে মারেন |
একটা
অবাস্তব চিন্তা বলে মনে হবে প্রথমেই। খালেদা জিয়া হলেন আপসহীন নেত্রী।
তাঁকে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আবদার করা অনেকের চোখে
হয়তো ধৃষ্টতা বলে মনে হবে। মানলাম তিনি আপসহীন নেত্রী। তিনি কেন যাবেন
সেখানে, এই তো প্রশ্ন?
কিন্তু পাল্টা প্রশ্নও তো উঠতে পারে, কেন যাবেন না? কোকোর মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসে যেতে পারেন, তাতে যদি প্রধানমন্ত্রীর মানমর্যাদা এতটুকু ক্ষুণ্ন না হয়ে থাকে, বরং তাঁর ভাবমূর্তি যদি কিছুটা উজ্জ্বলও হয়ে থাকে, তাহলে খালেদা জিয়া এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে গেলে দোষটা কী?
যদিও তাঁর এই যাওয়ার প্রেক্ষাপট হবে ভিন্ন। তিনি যাবেন দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। পেট্রলবোমায় মানুষ মরছে। অন্যদিকে ‘ক্রসফায়ারেও’ মানুষ মরছে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সামান্য দরদ থাকলে যে–কেউ এসব বন্ধের জন্য কাজ করতে চাইবেন। এই জরুরি একটা দায়িত্ববোধ থেকে খালেদা জিয়া যদি গণভবনে গিয়ে কথা শুরু করেন, সারা দেশে তাঁর নামে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। একটা নতুন জাগরণ আসবে। এটা হতে পারে নতুন ধরনের এক আন্দোলনের সূচনা।
মনে রাখতে হবে, সব সময় ছকে বাঁধা আন্দোলন চলে না। আমাদের দেশের অতীতের আন্দোলনগুলোর অভিজ্ঞতা যাচাই করলে দেখা যাবে, কখনো রাজপথের আন্দোলনে, কখনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৯ সালে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের মধ্যেও নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। সংসদে গিয়ে যা হোক কিছু কথা বলতে পেরেছিল। আবার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথমে উপজেলা নির্বাচন বর্জন। পরে ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, বিএনপির জয়জয়কার। পরে আবার আওয়ামী লীগের সাংসদদের পদত্যাগ।
পরিশেষে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন। ওই সময় ভীষণ তিক্ততা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংলাপ হয়েছে। সুতরাং, আমাদের দেশে আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ ও পদ্ধতি পরীক্ষিত হয়েছে। কখনো এক ধারায় আন্দোলনে সাফল্য আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আন্দোলনের সব দরজা খোলা রাখতে হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল। এবার খালেদা জিয়াকে যদি গণভবনে ঢুকতে না দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা নেই। তিনি পরাজিত হবেন না; বরং বিজয়ীর বেশেই ফিরে আসবেন। গণভবনে খালেদা জিয়াকে যেতে সম্ভাব্য বাধার কথা উঠছে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, কার সাথে আলোচনা করব? খুনির সাথে? আর তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট একাধারে বলে চলেছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। নির্বাচন হতে হবে বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী। তাই বাহ্যত আওয়ামী লীগের অবস্থান কোনো ধরনের সংলাপের বিরুদ্ধে। যদি তা-ই হয়, তাহলে খালেদা জিয়াকে হয়তো গণভবনের গেট থেকেই ফিরে আসতে হবে। এটা বিএনপির রাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাসভবনের দরজা খালেদা জিয়ার জন্য খোলা রাখলে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবেন। কারণ, দেশ ঠিকভাবে চালানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সংলাপ প্রত্যাখ্যান কোনো রাজনীতির ব্যাকরণে পড়ে না।
আলোচনাটা আসলে দুই পক্ষের জন্যই এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট একটানা অবরোধ-হরতাল ডেকে চলেছে; লোকে মানুক বা না মানুক। রাস্তায় গাড়ি, অফিস-আদালত সবই চলছে। নামেমাত্র হরতাল। মাঝেমধ্যে পেট্রলবোমা, আগুন। এই আর কি। শুধু এই ভয়ে হয়তো খাপছাড়াভাবে কোথাও হরতালের দেখা পাওয়া যাবে। বাস্তবে হরতাল-অবরোধের অস্তিত্ব নেই। তা-ও বিএনপি বিবেকহীনভাবে হরতাল ডেকে চলেছে। ফলে সরকারের অবশ্য কিছু অসুবিধা হচ্ছে। কেনাকাটায় ভাটা। খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমে গেছে। স্কুলগুলো বন্ধ। এসএসসি পরীক্ষায় বাধা। এখন বলা যায়, বিএনপি পারছে না অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যেতে, আবার সরকারও পারছে না মানুষের নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ রকম একটা অবস্থাই আসলে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বিএনপির স্বাভাবিক রাজনীতির জন্য এবং সরকারের দায়িত্ব হিসেবে দেশে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা কথা হওয়া দরকার। এটা দুই পক্ষেরই অভিন্ন স্বার্থ।
কিন্তু মুশকিল হলো, সংলাপের বিরুদ্ধে শুধু আওয়ামী লীগই না, এক অর্থে বিএনপিও। কারণ, ওরা বলেছে, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনেই কেবল নির্বাচন হতে পারে। এর বাইরে তাদের আলোচনার কিছু নেই। এই অবস্থানে অবিচল থাকলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের পক্ষে আলোচনায় এগিয়ে আসা কঠিন। কারণ, তারা তো সংবিধানের বাইরে যাবে না। সেখানে বলা আছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তাহলে ‘নির্দলীয়’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো হতে পারে না। কী করা যায়?
এখানে আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে পারি দুই বিপরীত অবস্থানের মধ্যেও কোনো অভিন্ন সূত্র পাওয়া যায় কি না। লক্ষ করলে দেখব, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে সরকার বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধানের মধ্যে থেকেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার কথা বলেছিল। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে থাকবেন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হবেন সংসদে বিরোধী দলের সাংসদেরা। এমনকি স্বরাষ্ট্র, প্রশাসন প্রভৃতি মন্ত্রণালয় বিরোধীদলীয় মন্ত্রীদের অধীনে থাকতে পারে। একে একধরনের সর্বদলীয় সরকার বলা যেতে পারে, যদিও সেখানে মূল শক্তি হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
কিন্তু ২০১৩-১৪ সালের আলোচনায় এই বিকল্প নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং বিএনপির নেতৃত্বে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই চেষ্টা সফল হয়নি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনে সরকার গঠন করেছে। এখন বিএনপি যে চেষ্টা করছে, সেটাও হোঁচট খেতে বাধ্য। কারণ, অচল হরতাল-অবরোধ কৃত্রিমভাবে আর কত দিন টিকিয়ে রাখা যাবে। তাই কিছু নতুন চিন্তার সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষেও একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকার চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ, এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। দেশে-বিদেশে সমালোচনা রয়েছে। এটা ঠিক যে এই অবস্থায় রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো পথ খুঁজে বের করা বস্তুত খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া কোনো আলপিনের অনুসন্ধানের মতোই কঠিন। তার পরও হয়তো কিছু সূত্র পাওয়া যাবে।
যেমন কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও জনপ্রশাসন নিশ্চিত করা সাপেক্ষে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা সম্ভব’ (১১ জানুয়ারি ও ১৩ জানুয়ারি ২০১৫)।
এ ধরনের চিন্তা এই মুহূর্তে বেশ কাজে লাগতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রধান শর্ত হলো স্বাধীন ও দলীয় আনুগত্যবিহীন নির্বাচন কমিশন, দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন। এ দুটির একটি শর্তও বর্তমানে কার্যত নেই। যদি সে রকম কোনো পরিবর্তন ঘটানো যায়, তাহলে হয়তো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চিন্তা কাছাকাছি আসতে পারে। এই উদ্যোগ আসতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই। এবং সেটা হতে হবে আন্তরিক। এখানে চালাক-চাতুরীর কোনো সুযোগ নেই। দেশ বাঁচাতে হলে এ রকম কিছু একটা করতে হবে।
সরকার যদি এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং সে বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চায়, তাহলে পরিবর্তনের প্রাথমিক সূচনা ঘটতে পারে। এর বিনিময়ে বিএনপি তাদের অবরোধ-হরতাল বন্ধ রাখবে। সরকার প্রত্যুত্তরে বিরোধী দল বিএনপির মূল নেতাদের মুক্তি দেবে, রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেবে। এভাবে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
এই সুযোগ সৃষ্টি করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা রাজি, সেটাই প্রশ্ন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
কিন্তু পাল্টা প্রশ্নও তো উঠতে পারে, কেন যাবেন না? কোকোর মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসে যেতে পারেন, তাতে যদি প্রধানমন্ত্রীর মানমর্যাদা এতটুকু ক্ষুণ্ন না হয়ে থাকে, বরং তাঁর ভাবমূর্তি যদি কিছুটা উজ্জ্বলও হয়ে থাকে, তাহলে খালেদা জিয়া এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে গেলে দোষটা কী?
যদিও তাঁর এই যাওয়ার প্রেক্ষাপট হবে ভিন্ন। তিনি যাবেন দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। পেট্রলবোমায় মানুষ মরছে। অন্যদিকে ‘ক্রসফায়ারেও’ মানুষ মরছে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সামান্য দরদ থাকলে যে–কেউ এসব বন্ধের জন্য কাজ করতে চাইবেন। এই জরুরি একটা দায়িত্ববোধ থেকে খালেদা জিয়া যদি গণভবনে গিয়ে কথা শুরু করেন, সারা দেশে তাঁর নামে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। একটা নতুন জাগরণ আসবে। এটা হতে পারে নতুন ধরনের এক আন্দোলনের সূচনা।
মনে রাখতে হবে, সব সময় ছকে বাঁধা আন্দোলন চলে না। আমাদের দেশের অতীতের আন্দোলনগুলোর অভিজ্ঞতা যাচাই করলে দেখা যাবে, কখনো রাজপথের আন্দোলনে, কখনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৯ সালে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের মধ্যেও নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। সংসদে গিয়ে যা হোক কিছু কথা বলতে পেরেছিল। আবার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথমে উপজেলা নির্বাচন বর্জন। পরে ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, বিএনপির জয়জয়কার। পরে আবার আওয়ামী লীগের সাংসদদের পদত্যাগ।
পরিশেষে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন। ওই সময় ভীষণ তিক্ততা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংলাপ হয়েছে। সুতরাং, আমাদের দেশে আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ ও পদ্ধতি পরীক্ষিত হয়েছে। কখনো এক ধারায় আন্দোলনে সাফল্য আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আন্দোলনের সব দরজা খোলা রাখতে হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল। এবার খালেদা জিয়াকে যদি গণভবনে ঢুকতে না দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা নেই। তিনি পরাজিত হবেন না; বরং বিজয়ীর বেশেই ফিরে আসবেন। গণভবনে খালেদা জিয়াকে যেতে সম্ভাব্য বাধার কথা উঠছে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, কার সাথে আলোচনা করব? খুনির সাথে? আর তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট একাধারে বলে চলেছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। নির্বাচন হতে হবে বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী। তাই বাহ্যত আওয়ামী লীগের অবস্থান কোনো ধরনের সংলাপের বিরুদ্ধে। যদি তা-ই হয়, তাহলে খালেদা জিয়াকে হয়তো গণভবনের গেট থেকেই ফিরে আসতে হবে। এটা বিএনপির রাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাসভবনের দরজা খালেদা জিয়ার জন্য খোলা রাখলে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবেন। কারণ, দেশ ঠিকভাবে চালানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সংলাপ প্রত্যাখ্যান কোনো রাজনীতির ব্যাকরণে পড়ে না।
আলোচনাটা আসলে দুই পক্ষের জন্যই এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট একটানা অবরোধ-হরতাল ডেকে চলেছে; লোকে মানুক বা না মানুক। রাস্তায় গাড়ি, অফিস-আদালত সবই চলছে। নামেমাত্র হরতাল। মাঝেমধ্যে পেট্রলবোমা, আগুন। এই আর কি। শুধু এই ভয়ে হয়তো খাপছাড়াভাবে কোথাও হরতালের দেখা পাওয়া যাবে। বাস্তবে হরতাল-অবরোধের অস্তিত্ব নেই। তা-ও বিএনপি বিবেকহীনভাবে হরতাল ডেকে চলেছে। ফলে সরকারের অবশ্য কিছু অসুবিধা হচ্ছে। কেনাকাটায় ভাটা। খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমে গেছে। স্কুলগুলো বন্ধ। এসএসসি পরীক্ষায় বাধা। এখন বলা যায়, বিএনপি পারছে না অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যেতে, আবার সরকারও পারছে না মানুষের নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ রকম একটা অবস্থাই আসলে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বিএনপির স্বাভাবিক রাজনীতির জন্য এবং সরকারের দায়িত্ব হিসেবে দেশে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা কথা হওয়া দরকার। এটা দুই পক্ষেরই অভিন্ন স্বার্থ।
কিন্তু মুশকিল হলো, সংলাপের বিরুদ্ধে শুধু আওয়ামী লীগই না, এক অর্থে বিএনপিও। কারণ, ওরা বলেছে, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনেই কেবল নির্বাচন হতে পারে। এর বাইরে তাদের আলোচনার কিছু নেই। এই অবস্থানে অবিচল থাকলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের পক্ষে আলোচনায় এগিয়ে আসা কঠিন। কারণ, তারা তো সংবিধানের বাইরে যাবে না। সেখানে বলা আছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তাহলে ‘নির্দলীয়’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো হতে পারে না। কী করা যায়?
এখানে আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে পারি দুই বিপরীত অবস্থানের মধ্যেও কোনো অভিন্ন সূত্র পাওয়া যায় কি না। লক্ষ করলে দেখব, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে সরকার বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধানের মধ্যে থেকেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার কথা বলেছিল। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে থাকবেন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হবেন সংসদে বিরোধী দলের সাংসদেরা। এমনকি স্বরাষ্ট্র, প্রশাসন প্রভৃতি মন্ত্রণালয় বিরোধীদলীয় মন্ত্রীদের অধীনে থাকতে পারে। একে একধরনের সর্বদলীয় সরকার বলা যেতে পারে, যদিও সেখানে মূল শক্তি হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
কিন্তু ২০১৩-১৪ সালের আলোচনায় এই বিকল্প নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং বিএনপির নেতৃত্বে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই চেষ্টা সফল হয়নি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনে সরকার গঠন করেছে। এখন বিএনপি যে চেষ্টা করছে, সেটাও হোঁচট খেতে বাধ্য। কারণ, অচল হরতাল-অবরোধ কৃত্রিমভাবে আর কত দিন টিকিয়ে রাখা যাবে। তাই কিছু নতুন চিন্তার সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষেও একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকার চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ, এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। দেশে-বিদেশে সমালোচনা রয়েছে। এটা ঠিক যে এই অবস্থায় রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো পথ খুঁজে বের করা বস্তুত খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া কোনো আলপিনের অনুসন্ধানের মতোই কঠিন। তার পরও হয়তো কিছু সূত্র পাওয়া যাবে।
যেমন কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও জনপ্রশাসন নিশ্চিত করা সাপেক্ষে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা সম্ভব’ (১১ জানুয়ারি ও ১৩ জানুয়ারি ২০১৫)।
এ ধরনের চিন্তা এই মুহূর্তে বেশ কাজে লাগতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রধান শর্ত হলো স্বাধীন ও দলীয় আনুগত্যবিহীন নির্বাচন কমিশন, দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন। এ দুটির একটি শর্তও বর্তমানে কার্যত নেই। যদি সে রকম কোনো পরিবর্তন ঘটানো যায়, তাহলে হয়তো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চিন্তা কাছাকাছি আসতে পারে। এই উদ্যোগ আসতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই। এবং সেটা হতে হবে আন্তরিক। এখানে চালাক-চাতুরীর কোনো সুযোগ নেই। দেশ বাঁচাতে হলে এ রকম কিছু একটা করতে হবে।
সরকার যদি এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং সে বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চায়, তাহলে পরিবর্তনের প্রাথমিক সূচনা ঘটতে পারে। এর বিনিময়ে বিএনপি তাদের অবরোধ-হরতাল বন্ধ রাখবে। সরকার প্রত্যুত্তরে বিরোধী দল বিএনপির মূল নেতাদের মুক্তি দেবে, রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেবে। এভাবে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
এই সুযোগ সৃষ্টি করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা রাজি, সেটাই প্রশ্ন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments