অনিশ্চিত রাজনীতি এবং উত্তরণের উপায় by ড. এম এম আকাশ
গত
১৪ জানুয়ারি অক্সফামের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ
বিভাগ 'গণতন্ত্র, সুশীল সমাজ ও উন্নয়নে'র ওপর একটি আলোচনা সভার আয়োজন
করেছিল। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে মোজাফফর আহমদ মিলনায়তনে।
শতাধিক ছাত্রছাত্রী এই প্রাণবন্ত আলোচনা অনুষ্ঠানটিতে আলোচনা ও নানা রকম
প্রশ্ন করেন। নির্ধারিত প্যানেলিস্টরাই উত্তর দেন।
দৈনিক সংবাদের সম্পাদক মনিরুজ্জামান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার এবং আমি ছিলাম ওই প্যানেলের সদস্য। মূল বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। এই আলোচনা সভায় বারবার যে প্রশ্নটি ছাত্রছাত্রীরা করছিলেন তা হচ্ছে, এই দফায় রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণতি কী হবে? ক্ষমতাসীন সরকার ও বিএনপি-জামায়াত জোটের এই অবরোধ ও গেরিলা যুদ্ধে যেই জিতুক দেশের ভবিষ্যৎ চেহারাটি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ তার সমাপনী ভাষণে কে জিতবে এই প্রশ্নের উত্তরে একটি প্রতীকী অর্থপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছি_ তিনি বলেন 'অ' এবং 'ই' পরস্পর বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। পারলে একজন আরেকজনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় সমঝোতা বা শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। 'ঈ' বা ক্যান্টনমেন্ট এখন পর্যন্ত 'অ'-এর পক্ষে। 'উ' বা গ্রিক ভাষায় ডেমোস বা বাংলায় যাদেরকে বলি জনগণ তারা তিক্ত-বিরক্ত হয়ে দাবি তুলছেন, 'আমরা শান্তি চাই।' এই অবস্থায় 'অ' এবং 'ঈ'-র শক্তি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে 'ই'-এর পক্ষে 'উ'-এর ব্যাপক সক্রিয় সমর্থন ছাড়া বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। 'উ' নিজে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দই ভেবে চুন খেতে খেতে তারা এখন আর একান্ত মরিয়া না হলে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নন। তবে ইতিবাচক কোনো নেতৃত্ব পেলে বাঙালি যে আবার উৎসাহিত হয়ে পথে নামবে না এমন কথা কে হলফ করে বলতে পারে! কিন্তু এজন্য চরম মাৎস্যন্যায়ের সময় যেমন তারা গোপালকে বেছে নিয়েছিলেন, সে রকম একজন উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন আস্থাভাজন নেতা লাগবে। ড. ইমতিয়াজের ভাষায় সেই 'ঊ' বা আইনস্টাইন এখনও তৈরি হয়নি। আমাদের এই উত্তরটি ছাত্রছাত্রীদের করতালি শুনে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো। পরে প্যানেলিস্ট হিসেবে আমার বক্তব্যে শুধু এটুকুই যোগ করেছিলাম, আইনস্টাইনকে সমাজে 'সম্মতিভিত্তিক আধিপত্য (ঐবমবসড়হু) তৈরি করতে হবে। সে জন্য দরকার জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও জবাবদিহিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা।
আমরা বাংলাদেশ তৈরি করেছিলাম গণতন্ত্রের ইস্যুতে। পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে থাকলেও এবং ভোটে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তাকে শাসন ক্ষমতা দিতে চায়নি। তদুপরি নিরস্ত্র জনগণের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নির্বিচারে এ দেশের মানুষদের গুলি করে মেরেছে। পরিণতিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছি। সেই পাকিস্তান এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের নেতৃত্বে দীর্ঘকাল ছিল এবং এখনও অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষমতা নিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। সেই পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তি যে দুর্বল থাকবে তা বলাই বাহুল্য। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সেখানে তৈরি হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তালেবান, আল কায়দা, আইএসআই ইত্যাদি নানাবিধ ইসলামী জঙ্গিবাদী শক্তি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়। অনেক ক্ষেত্রে শরিয়া আইন চালু আছে। নারীর অধিকার এখনও খুবই সীমিত। আবার পাকিস্তানের এলিট বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পদে বৈভবে আধুনিকতায় অনেক উঁচুতে আরোহণ করে গেছে। তলের মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। পাকিস্তানে রয়েছে বিভিন্ন ভাষাভাষী একাধিক জাতিগোষ্ঠী। তাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও একটি বহুদিনের অমীমাংসিত সমস্যা। এসব নিয়ে দেশটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে এক চির অস্থিরতার দেশে। কিন্তু এত কিছুর পরও তাতে আমাদের কি কোনো আত্মপ্রসাদের সুযোগ আছে?
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আজ আমাদের দেশের একটি শক্তি সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানি আদর্শের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আরও দুঃখের বিষয়, দক্ষিণপন্থি দল বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এই শক্তিটির সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধেছে। তাই তাদের কাঁধেই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তাদের বন্দুকটি রেখেছে। এই শক্তির সঙ্গে ঐক্য করতে গিয়ে বিএনপির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং বিএনপিকে তা দুর্বল করেছে। বিদেশিরাও (একমাত্র পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সম্ভবত সৌদি আরব ছাড়া সবাই) এর বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে ইসলামের শক্তি বিরাট হলেও জামায়াতকে তারা সবাই প্রকৃত ইসলামপন্থি বলে মনে করেন না। এককভাবে জামায়াত ও জামায়াতপন্থিদের ভোটের শক্তি কতটুকু? সর্বোচ্চ তিন-চার শতাংশ হবে (যদিও ১৯৭০-এর নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বলে কথিত আছে!)। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির ভোটের সমর্থন শক্তি সর্বদাই অনেক বেশি, প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিএনপির ভোট থাকলেও গ্রাম-গ্রামান্তরে সংগঠন নেই। কিন্তু জামায়াতের বিপুল আর্থিক শক্তি ও শক্ত সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে, ভোট যদিও কম। তাই জামায়াত এবং বিএনপি পরস্পর পরিপূরক স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত হয়েছে। এই মৈত্রী সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না আর এটা না ভাঙলে বিএনপির 'গণতান্ত্রিক আন্দোলনে' পেট্রোল বোমা, সন্ত্রাস অনিবার্যভাবে ঢুকে যাবে। কারণ, জামায়াতের বর্তমান এজেন্ডা গণতন্ত্র নয়। তার মূল এজেন্ডা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় বাতিল এবং তাদের মুক্ত করে আনা, যেটা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ চায় না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ, বিশ্বের ১১টি উদীয়মান দেশের মধ্যে একটি দেশের স্থান দখলকারী বাংলাদেশ, নানা রকম সামাজিক সূচকের বিচারে ভারতের চেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এত কৃতিত্ব সত্ত্বেও কেন আওয়ামী লীগ সমগ্র সমাজের ভেতরে তাদের গণতান্ত্রিক সম্মতিভিত্তিক আধিপত্য (ঐবমবসড়হু) প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি একটু থেমে পেছনের ইতিহাসের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে, তখন তা ছিল ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি দল। বঞ্চিত শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তরা তখন সেই দলে ছিলেন। তার মূল নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়লে বোঝা যায়, তিনি এলিট ছিলেন না। তিনি নেতা হয়েছিলেন দীর্ঘদিন জেল খেটে এবং জেলায় জেলায় অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে। তার সঙ্গে বামপন্থি দলগুলোর একটি অংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও ঐক্য ছিল। সুতরাং একটি গণমুখী দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল। ১৯৭১-৭৫ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হয়। তখন বঙ্গবন্ধুর জীবিত থাকা অবস্থাতেই দলের ভেতরে একটি নব্য ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক বাহিনী এবং বিপক্ষে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আমাদের দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দীনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মোশতাকপন্থিরা ফারুক বাহিনী ও আমেরিকার গোপন সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিল। ১৯৭৫-এর পর দেশ এভাবেই উল্টোপথে পরিচালিত হয়েছিল।
এ কথা ঠিক, আমরা এই মুহূর্তে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বিপুল জাতীয়করণের রাস্তায় ফিরে আসতে পারব না। আমাদের বর্তমানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো আগে সমাপ্ত করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠা। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'কল্যাণ ধনতন্ত্র', 'মধ্যম আয়ের দেশ'_ এসব স্লোগান দিয়ে শেখ হাসিনা সেই কথাটি বোঝাতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়; কিন্তু এগুলো অর্জন করার জন্য তিনি হয়তো এখন 'কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের' পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। এই পথে কোথাও কোথাও এ ধরনের লক্ষ্য আদায় করা সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং এক অর্থে চীনও সেই ধরনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে শেখ হাসিনা চীনের প্রতিনিধির কাছে বলেছিলেন, তিনি চীনের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করতে চান।
কিন্তু সব দেশ একই কায়দায় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারবে না। আমার মতে, বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন গণতন্ত্রহীনতা সহ্য করবে না, একদলীয় শাসন তো নয়ই। তাই এ দফায় বিএনপিকে হারানো সহজ হলেও কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের মডেল অব্যাহত রাখা সহজ হবে না। ধর্মের প্রভাবও বাংলাদেশে প্রবল। বিশেষ করে হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসার বিশাল শক্তি এ দেশে রয়েছে। এটি যদি জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজপথে নেমে আসে, তাহলে তা সত্যিকার বিপদের জন্ম দেবে। তাই একটি নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ৬৪ হাজার কওমি মাদ্রাসার নবায়ন, তৃণমূলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান, বিদ্যুতের সুযোগ জনগণের জন্য অবারিত করা এবং সর্বোপরি দুর্নীতি ও লুটপাট কমানো ব্যতিরেকে দেশের বিপদ থেকে স্থায়ী পরিত্রাণ লাভ সম্ভব হবে না। আশু সমস্যা গণতন্ত্রহীনতাকে দূর করার জন্য ধাপে ধাপে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত এক সময় না এক সময় করতেই হবে। পরবর্তী নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো নতুন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন হবে। যার অন্যতম হচ্ছে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার ফলে নির্বাচনে ব্যক্তির গুরুত্ব কমে যাবে, দলের বা আদর্শের গুরুত্ব বাড়বে, অর্থের গুরুত্ব কমে যাবে, প্রার্থীর যোগ্যতার গুরুত্ব বাড়বে। এখন যেমন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮০ শতাংশ আসন পাওয়া যায়, তখন আর তা হবে না। সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধী শক্তি এবং প্রধান বিরোধী দল ভোটের শতাংশ অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষমতা রক্ষা করতে পারবে। এই সিস্টেমের ফলে রিহহবৎ ঃধশব ধষষ ব্যবস্থাটি রহিত হবে। এভাবে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক শক্তির পরস্পরকে জায়গা (ঝঢ়ধপব) করে দেওয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রের আশু সংকট নিরসন হতে পারে। তবে তার আগে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানিপ্রবণতা আমাদের ঠেকাতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। পেট্রোল বোমা থামাতে হবে। বাংলাদেশের মৌলিক ঐতিহাসিক ভিত্তিগুলো নিয়ে কোনো অনাহূত বিতর্ক করা চলবে না।
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক সংবাদের সম্পাদক মনিরুজ্জামান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার এবং আমি ছিলাম ওই প্যানেলের সদস্য। মূল বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। এই আলোচনা সভায় বারবার যে প্রশ্নটি ছাত্রছাত্রীরা করছিলেন তা হচ্ছে, এই দফায় রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণতি কী হবে? ক্ষমতাসীন সরকার ও বিএনপি-জামায়াত জোটের এই অবরোধ ও গেরিলা যুদ্ধে যেই জিতুক দেশের ভবিষ্যৎ চেহারাটি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ তার সমাপনী ভাষণে কে জিতবে এই প্রশ্নের উত্তরে একটি প্রতীকী অর্থপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছি_ তিনি বলেন 'অ' এবং 'ই' পরস্পর বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। পারলে একজন আরেকজনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় সমঝোতা বা শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। 'ঈ' বা ক্যান্টনমেন্ট এখন পর্যন্ত 'অ'-এর পক্ষে। 'উ' বা গ্রিক ভাষায় ডেমোস বা বাংলায় যাদেরকে বলি জনগণ তারা তিক্ত-বিরক্ত হয়ে দাবি তুলছেন, 'আমরা শান্তি চাই।' এই অবস্থায় 'অ' এবং 'ঈ'-র শক্তি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে 'ই'-এর পক্ষে 'উ'-এর ব্যাপক সক্রিয় সমর্থন ছাড়া বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। 'উ' নিজে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দই ভেবে চুন খেতে খেতে তারা এখন আর একান্ত মরিয়া না হলে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নন। তবে ইতিবাচক কোনো নেতৃত্ব পেলে বাঙালি যে আবার উৎসাহিত হয়ে পথে নামবে না এমন কথা কে হলফ করে বলতে পারে! কিন্তু এজন্য চরম মাৎস্যন্যায়ের সময় যেমন তারা গোপালকে বেছে নিয়েছিলেন, সে রকম একজন উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন আস্থাভাজন নেতা লাগবে। ড. ইমতিয়াজের ভাষায় সেই 'ঊ' বা আইনস্টাইন এখনও তৈরি হয়নি। আমাদের এই উত্তরটি ছাত্রছাত্রীদের করতালি শুনে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো। পরে প্যানেলিস্ট হিসেবে আমার বক্তব্যে শুধু এটুকুই যোগ করেছিলাম, আইনস্টাইনকে সমাজে 'সম্মতিভিত্তিক আধিপত্য (ঐবমবসড়হু) তৈরি করতে হবে। সে জন্য দরকার জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও জবাবদিহিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা।
আমরা বাংলাদেশ তৈরি করেছিলাম গণতন্ত্রের ইস্যুতে। পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে থাকলেও এবং ভোটে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তাকে শাসন ক্ষমতা দিতে চায়নি। তদুপরি নিরস্ত্র জনগণের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নির্বিচারে এ দেশের মানুষদের গুলি করে মেরেছে। পরিণতিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছি। সেই পাকিস্তান এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের নেতৃত্বে দীর্ঘকাল ছিল এবং এখনও অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষমতা নিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। সেই পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তি যে দুর্বল থাকবে তা বলাই বাহুল্য। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সেখানে তৈরি হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তালেবান, আল কায়দা, আইএসআই ইত্যাদি নানাবিধ ইসলামী জঙ্গিবাদী শক্তি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়। অনেক ক্ষেত্রে শরিয়া আইন চালু আছে। নারীর অধিকার এখনও খুবই সীমিত। আবার পাকিস্তানের এলিট বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পদে বৈভবে আধুনিকতায় অনেক উঁচুতে আরোহণ করে গেছে। তলের মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। পাকিস্তানে রয়েছে বিভিন্ন ভাষাভাষী একাধিক জাতিগোষ্ঠী। তাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও একটি বহুদিনের অমীমাংসিত সমস্যা। এসব নিয়ে দেশটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে এক চির অস্থিরতার দেশে। কিন্তু এত কিছুর পরও তাতে আমাদের কি কোনো আত্মপ্রসাদের সুযোগ আছে?
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আজ আমাদের দেশের একটি শক্তি সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানি আদর্শের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আরও দুঃখের বিষয়, দক্ষিণপন্থি দল বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এই শক্তিটির সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধেছে। তাই তাদের কাঁধেই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তাদের বন্দুকটি রেখেছে। এই শক্তির সঙ্গে ঐক্য করতে গিয়ে বিএনপির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং বিএনপিকে তা দুর্বল করেছে। বিদেশিরাও (একমাত্র পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সম্ভবত সৌদি আরব ছাড়া সবাই) এর বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে ইসলামের শক্তি বিরাট হলেও জামায়াতকে তারা সবাই প্রকৃত ইসলামপন্থি বলে মনে করেন না। এককভাবে জামায়াত ও জামায়াতপন্থিদের ভোটের শক্তি কতটুকু? সর্বোচ্চ তিন-চার শতাংশ হবে (যদিও ১৯৭০-এর নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বলে কথিত আছে!)। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির ভোটের সমর্থন শক্তি সর্বদাই অনেক বেশি, প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিএনপির ভোট থাকলেও গ্রাম-গ্রামান্তরে সংগঠন নেই। কিন্তু জামায়াতের বিপুল আর্থিক শক্তি ও শক্ত সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে, ভোট যদিও কম। তাই জামায়াত এবং বিএনপি পরস্পর পরিপূরক স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত হয়েছে। এই মৈত্রী সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না আর এটা না ভাঙলে বিএনপির 'গণতান্ত্রিক আন্দোলনে' পেট্রোল বোমা, সন্ত্রাস অনিবার্যভাবে ঢুকে যাবে। কারণ, জামায়াতের বর্তমান এজেন্ডা গণতন্ত্র নয়। তার মূল এজেন্ডা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় বাতিল এবং তাদের মুক্ত করে আনা, যেটা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ চায় না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ, বিশ্বের ১১টি উদীয়মান দেশের মধ্যে একটি দেশের স্থান দখলকারী বাংলাদেশ, নানা রকম সামাজিক সূচকের বিচারে ভারতের চেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এত কৃতিত্ব সত্ত্বেও কেন আওয়ামী লীগ সমগ্র সমাজের ভেতরে তাদের গণতান্ত্রিক সম্মতিভিত্তিক আধিপত্য (ঐবমবসড়হু) প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি একটু থেমে পেছনের ইতিহাসের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে, তখন তা ছিল ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি দল। বঞ্চিত শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তরা তখন সেই দলে ছিলেন। তার মূল নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়লে বোঝা যায়, তিনি এলিট ছিলেন না। তিনি নেতা হয়েছিলেন দীর্ঘদিন জেল খেটে এবং জেলায় জেলায় অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে। তার সঙ্গে বামপন্থি দলগুলোর একটি অংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও ঐক্য ছিল। সুতরাং একটি গণমুখী দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল। ১৯৭১-৭৫ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হয়। তখন বঙ্গবন্ধুর জীবিত থাকা অবস্থাতেই দলের ভেতরে একটি নব্য ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক বাহিনী এবং বিপক্ষে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আমাদের দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দীনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মোশতাকপন্থিরা ফারুক বাহিনী ও আমেরিকার গোপন সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিল। ১৯৭৫-এর পর দেশ এভাবেই উল্টোপথে পরিচালিত হয়েছিল।
এ কথা ঠিক, আমরা এই মুহূর্তে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বিপুল জাতীয়করণের রাস্তায় ফিরে আসতে পারব না। আমাদের বর্তমানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো আগে সমাপ্ত করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠা। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'কল্যাণ ধনতন্ত্র', 'মধ্যম আয়ের দেশ'_ এসব স্লোগান দিয়ে শেখ হাসিনা সেই কথাটি বোঝাতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়; কিন্তু এগুলো অর্জন করার জন্য তিনি হয়তো এখন 'কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের' পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। এই পথে কোথাও কোথাও এ ধরনের লক্ষ্য আদায় করা সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং এক অর্থে চীনও সেই ধরনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে শেখ হাসিনা চীনের প্রতিনিধির কাছে বলেছিলেন, তিনি চীনের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করতে চান।
কিন্তু সব দেশ একই কায়দায় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারবে না। আমার মতে, বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন গণতন্ত্রহীনতা সহ্য করবে না, একদলীয় শাসন তো নয়ই। তাই এ দফায় বিএনপিকে হারানো সহজ হলেও কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের মডেল অব্যাহত রাখা সহজ হবে না। ধর্মের প্রভাবও বাংলাদেশে প্রবল। বিশেষ করে হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসার বিশাল শক্তি এ দেশে রয়েছে। এটি যদি জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজপথে নেমে আসে, তাহলে তা সত্যিকার বিপদের জন্ম দেবে। তাই একটি নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ৬৪ হাজার কওমি মাদ্রাসার নবায়ন, তৃণমূলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান, বিদ্যুতের সুযোগ জনগণের জন্য অবারিত করা এবং সর্বোপরি দুর্নীতি ও লুটপাট কমানো ব্যতিরেকে দেশের বিপদ থেকে স্থায়ী পরিত্রাণ লাভ সম্ভব হবে না। আশু সমস্যা গণতন্ত্রহীনতাকে দূর করার জন্য ধাপে ধাপে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত এক সময় না এক সময় করতেই হবে। পরবর্তী নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো নতুন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন হবে। যার অন্যতম হচ্ছে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার ফলে নির্বাচনে ব্যক্তির গুরুত্ব কমে যাবে, দলের বা আদর্শের গুরুত্ব বাড়বে, অর্থের গুরুত্ব কমে যাবে, প্রার্থীর যোগ্যতার গুরুত্ব বাড়বে। এখন যেমন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮০ শতাংশ আসন পাওয়া যায়, তখন আর তা হবে না। সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধী শক্তি এবং প্রধান বিরোধী দল ভোটের শতাংশ অনুযায়ী নিজ নিজ ক্ষমতা রক্ষা করতে পারবে। এই সিস্টেমের ফলে রিহহবৎ ঃধশব ধষষ ব্যবস্থাটি রহিত হবে। এভাবে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক শক্তির পরস্পরকে জায়গা (ঝঢ়ধপব) করে দেওয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রের আশু সংকট নিরসন হতে পারে। তবে তার আগে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানিপ্রবণতা আমাদের ঠেকাতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। পেট্রোল বোমা থামাতে হবে। বাংলাদেশের মৌলিক ঐতিহাসিক ভিত্তিগুলো নিয়ে কোনো অনাহূত বিতর্ক করা চলবে না।
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments