বাঙালির ভাষা ও একুশের কথা by ড. আব্দুস সাত্তার
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারার মধ্যে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জমায়েত |
বিশ্বে
যতগুলো ভাষা আছে, তার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ ভাষা বাংলা
ভাষায় যারা কথা বলেন তারা বাঙালি। এই বাঙালি জাতির উদ্ভব এবং তাদের ভাষা
বাংলার কথা ইতিহাসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইতিহাসের তথ্য হচ্ছেÑ
বাংলা সনের প্রবর্তন ও প্রচারের আগে এই উপমহাদেশে হিজরি সনের প্রচলন ছিল।
আরবরা সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন।
তারা ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে হিজরি সনেরও প্রচলন করেন। কিন্তু হিজরি সন
জনগণের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। কারণ যারা ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন,
তাদেরই সহযোগিতায় বাঙালি জাতি এবং তাদের ভাষা বাংলার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু
বাংলা ভাষা খুব সহজে স্বীকৃতি পায়নি। এর প্রধান কারণ বিশেষত সেন বংশের
সহায়তায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে সব
শক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
কারণ, যথাসময়ে মুসলিম শাসকদের হস্তক্ষেপের ফলে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষাকে শুধু রক্ষা করেননি, তারা বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও দান করেছিলেন। তাদের প্রচেষ্টাতেই বাংলা ভাষা সমাজে
প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
পাঠান ও সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও বাংলা সনের প্রচলন ছিল না। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সনের পরিবর্তে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। এর উদ্ভাবক ছিলেন পণ্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজী। এটা স্পষ্ট যে, বাংলা ভাষার ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। তা ছাড়া বাঙালি মুসলমান সমাজে বাংলার খুব বেশি সমাদরও ছিল না। কারণ, তারা আরবি, ফার্সি ও উর্দুকে গুরুত্ব দিতেন। এর স্পষ্ট প্রমাণ উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে দেয়া সভাপতির ভাষণ। সভাপতি তার দীর্ঘ ভাষণের এক স্থানে বলেছেনÑ ‘মুসলমান ভ্রাতৃগণ। আপনাদের ধর্ম যাহাই হউক না কেন, আপনাদের পূর্বপুরুষগণ যে দেশ হইতেই আসিয়া থাকুন না কেন, এখন আপনারা বাঙ্গালী হইয়াছেন। আপনাদের পক্ষে এ হেন বাঙ্গালা ভাষা ত্যাগ করিয়া উর্দু ধরিবার চেষ্টা যেন নিজের সোনার বাড়িতে আগুন লাগাইয়া পরের কুঁড়েঘরের এক কোণে অতিথির মত, পরদেশীর মত থাকিবার একটু স্থান ভিক্ষা করা’ (চতুর্থ অধিবেশন, মালদহ, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩৭-৩৮)। শুধু যে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে তা নয়, ইংরেজির ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। ফলে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিল। ফলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমান বাঙালিদের তেমন একটা ভূমিকা দেখা যায়নি। আরো একটি বিষয় মুসলমান বাঙালিদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে সময়, আর তা হচ্ছে ধর্ম। আরবদের আগমন এবং তাদের কার্যক্রম মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হচ্ছিল। সেই সাথে বাংলা ভাষার প্রচলনও শুরু হয়েছিল। সুতরাং দুটো বিষয়ই বাঙালিদের কাছে ছিল নতুন। কিন্তু ধর্মের সাথে আরবি ও উর্দুর ঘনিষ্ঠতার কারণে মুসলমান বাঙালিরা উর্দুকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের দৃষ্টান্ত থেকেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ সম্মেলনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব পণ্ডিত যোগদান করেছিলেন তাদের তালিকায় দেখা যায়, রংপুর থেকে মোট ২৪ জন যোগদান করেছিলেন। কিন্তু এই ২৪ জনের মধ্যে মুসলমান ছিলেন দু’জন। এরা হলেনÑ মৌলভী সৈয়দ আবুল ফাত্তাহ জমিদার ও মৌলভী হেমায়েত উদ্দীন আহাম্মদ। দিনাজপুর থেকে যোগদান করেছিরেন তিনজন, বগুড়া থেকে পাঁচজন, রাজশাহী থেকে চারজন, শ্রীহট্ট-আসাম থেকে তিনজন, বিহারের পূর্ণিয়া থেকে একজন। কিন্তু এদের মধ্যে একজনও মুসলমান পণ্ডিত ছিলেন না। মালদহ থেকে যে ৩৮ জন যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন চারজন। এরা হলেনÑ মৌলভী কাদের বক্স, মৌলভী আবদুল আজিজ খাঁ, মৌলভী আব্দুল গণি ও মুন্সী আবেদ আলী খাঁ। কলকাতা থেকে ছিলেন ১৫ জন, ময়মনসিংহের একজন, পাটনার দু’জন ও মুর্শিদাবাদের একজন। এদের মধ্যে একজনও মুসলমান সাহিত্যিক ছিলেন না। অর্থাৎ সম্মেলনে যোগদানকারী ৯৭ জন পণ্ডিতের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়জন। এ অবস্থা ভারত ভাগের ৩৬ বছর আগের। ১৯৪৭ সালের আগের এই ৩৬ বছরে বাংলার মুসলমান তথা বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা কতটা বাংলাপ্রেমী হতে পেরেছিলেন, বাঙালি সংস্কৃতির কতটা উন্নয়ন করতে পেরেছিলেন কিংবা বাংলা ভাষার জন্য কতটা গৌরব অনুভব করার মানসিকতা অর্জন করতে পেরেছিলেন, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত ভাগের পর, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলার প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসার কথা দেশবাসী জানতে পেরেছিলেন। জানতে পেরেছিলেন বিশ্ববাসীও। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,্ একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মদান প্রমাণ করতে পেরেছিল যে, বাঙালি ক্রমান্বয়ে ১৯৫২ সালের আগেকার ৩৬+৫=৪১ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাকে তাদের প্রাণের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। সব ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন আর নিজস্ব সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দাবি তুলে বাংলা মায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছিলেন। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাঙালির গর্বের ও অহঙ্কারের শহীদ মিনার।
শহীদ মিনার বাংলাদেশের বাঙালি সম্প্রদায়ের গর্বের বিষয়। ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত হন শহীদ মিনারে। ফুল দিয়ে শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে জাতি বাঙলা ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষাবিদ্বেষী পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাল, সেই জাতি বাংলার শিল্পভাষা পশ্চিমাদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করল না। সেই আদিকাল থেকেই শিল্পকলা ভাষা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। ধূর্ত ব্রিটিশরা ভারত দখল করে শিল্পকলার ওপর যখন আঘাত করল, শিল্পকলা চর্চার কেন্দ্রগুলোকে পশ্চিমাকরণ করল, তখন ইংরেজদেরই একজন পণ্ডিত ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করলেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বাঙালির নিজস্ব শিল্প ভাষাকে রক্ষা করতে বেঙ্গল স্কুল নামে আন্দোলন গড়ে তুললেন। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে বাঙালি মুসলমানদের উর্দু ছেড়ে বাংলাকে গ্রহণ করতে সভাপতি যেমন উপদেশ দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই ই বি হ্যাভেল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তি পশ্চিমা ধারার চর্চাকারীদের পশ্চিমা তথা বিদেশী ধারা ছেড়ে নিজেদের শিল্পধারায় ফিরে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় যারা শিল্পকলা চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়লেন, যারা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করলেন তাদের কারো পক্ষ থেকে পশ্চিমা ধারার অনুকরণের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের পক্ষ থেকেও কেউ এমন বক্তব্য উত্থাপন করলেন না। দেখা গেল, যেসব শিল্পী বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যানার, ফেস্টুন ও চিত্র এঁকে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করলেন সেই সব শিল্পী শিল্প ভাষার ক্ষেত্রে পশ্চিমা আগ্রাসন মেনে নিয়ে পশ্চিমকে অনুকরণ করতে থাকলেন! শিল্পভাষার প্রতি পশ্চিমাদের আগ্রাসন অবমাননাকর মনে হলো না তাদের কাছে। এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি। তবে পশ্চিম বাংলার শিল্পীরা তাদের জন্য পশ্চিমা আগ্রাসন অবমাননাকর মনে করে ুব্ধ হয়েছিলেন। যারা পশ্চিমা ধারার অনুসরণ করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এ দেশে বসে জার্মানি বা আমেরিকার আর্থ-সামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ছবি আঁকেন যারা, আমরা তাদের সঙ্গে নেই। পোস্ট-মডার্নিজমের নামে এক ধরনের নকলনবিসি কাজ আমাদের সংস্কৃতির ক্ষতি করছে। আমরা সোসাইটির সদস্যরা সব সময় এই চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। গ্লোবালাইজেশনের নামে এই কুম্ভিলক (চুরির) প্রথা একদিন আমাদের দেশীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে’ (রোদে ধান ছায়ায় পান, নবম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪১৬, কলকাতা, পৃ. ৫৬)। প্রিয় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখা ভালো যে, ভারতীয় শিল্পীদের প্রায় শতভাগ ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে অবলম্বন করে শিল্পচর্চা করেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, কে জি সুব্রমন্যম, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, শ্যামল দত্ত রায়, সুধাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা ভট্টাচার্য, সাধনা চক্রবর্তী, এস প্রণাম সিং, আলী জে. সুলতান, পরেশ মাইতিসহ অসংখ্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যাবে, যারা নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পকর্ম করেছেন। অথচ কুম্ভিলক প্রথার অনুসারী বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম সব সময়ই অবহেলিত হয়েছে। ভারতের শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন শিল্পী ক্যালিগ্রাফিকে প্রাধান্য দিয়ে চিত্র রচনা করলেও বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প অবহেলিত। শুধু তা-ই নয়, বিচ্ছিন্নভাবে কেউ ক্যালিগ্রাফি করলেও সেই শিল্পকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করতে কোনো প্রতিষ্ঠান জায়গা পর্যন্ত দিতে চায় না। যারা ক্যালিগ্রাফি করেন, তাদের সাথে কুম্ভিলক প্রথার অনুসারী শিল্পীরা বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। এ অবস্থার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী মুর্তজা বশীর একবার ক্যালিগ্রাফি এঁকে একক প্রদর্শনী করার সিদ্ধান্ত নেন। তার এ উদ্যোগকে যে কুম্ভিলক প্রথার অনুসারীরা পছন্দ করবেন না, সে কথা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। বলেছেনÑ ‘আমার ২৯টা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ২৮ রকম করে লেখা।... ইনশাআল্লাহ আমার মনে হয় এই কাজটা, আমার ইচ্ছা এবার ৩রা নভেম্বর ১লা রমজান... অন দ্য অকেশন অব রমজান আমি এটা করব। আমি জানি, আমার ওপর দিয়ে আরেকটা ঝড় বয়ে যাবে। সেই কেয়ার আমি করি না’ (সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন শিল্পী আবদুর রহীম)। শিল্পী মুর্তজা বশীরের মতো শিল্পী যদি বলেন, ধর্মীয় শিল্প ক্যালিগ্রাফি করলে পশ্চিমা ধারার অনুসারীদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন, তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশে বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার কী দুরবস্থা।
বাংলাদেশে দেশীয় বিষয়বস্তু অবলম্বনে শিল্পচর্চা অবহেলিত হলেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাজী আবুল কাশেম, এস এম সুলতান প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি অবলম্বনে চিত্র চর্চা করেছেন (পরবর্তী সময়ের শিল্পীরা প্রথম পর্যায়ে বাস্তব ধর্মীয় ছবি আঁকলেও পরবর্তী সময়ে আর সে পথে অগ্রসর হননি)। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কাজী আবুল কাশেম, কামরুল হাসান, এস এম সুলতানের ক্যানভাসজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সমাজ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলার প্রকৃতি এবং ধর্ম বিভিন্নভাবে এদের চিত্রে উঠে এসেছে। এসব পথপদর্শক শিল্পী ছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মের কিছু শিল্পী বাংলাদেশকে তাদের ক্যানভাসে স্থান দিয়ে তারাও যে দেশপ্রেমিক, সে কথা প্রমাণ করেছেন। তবে এদের সংখ্যা অতি নগণ্য।
বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম যারা চর্চা করেছেন এবং করছেন, বিশেষ করে যারা দেশ, দেশের সংস্কৃতি ও ধর্মকে অবলম্বন করে দেশমাতৃকাকে মূল্য দিয়েছেন, তারা কিন্তু পশ্চিমা ধারার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেননি। তবে শিল্পী কামরুল হাসান একবার প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে প্রতিবাদ জোরালো ছিল না। তা ছাড়া তিনি যেভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, সে প্রতিবাদ সার্বিকভাবে পশ্চিমা ধারার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল নবীন শিল্পীদের বিরুদ্ধে। তিনি ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে সাপ্তাহিক পূর্বাণী পত্রিকায় বলেছেন, ‘তরুণ শিল্পীদের কাজে বিমূর্ত রীতির প্রভাব বেশি।... এদের ছবির মধ্যে কোনো বক্তব্য নেই এবং কালের বিচারে এসব ছবি টিকবে না। ... রং মাখলে আর টেক্সচার তৈরি করলেই শিল্পী হয় না’ (এ সাত্তার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পৃ. ৭১)। এ বক্তব্য একটি জেনারেশনের বিরুদ্ধে হলেও বাংলাদেশে যে শিল্পীরা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভুলে বিদেশী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করছেন, সে কথা স্পষ্ট হয়েছে। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতরাজ যাদবেশ্বর তর্করতœ বলেছেনÑ ‘যাঁহারা বঙ্গকে নিজের দেশ করিয়াছেন, যাঁহারা বাঙ্গলার মাটি বাংলার জল হইতেই শক্তি সঞ্চার করেন, এই সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা দেশ ভিন্ন যাঁহারা অনন্যমাতৃক, এ দেশ ভিন্ন যাঁহাদের অন্যত্র গতি নাই,Ñ তাঁহারাই বাঙ্গালী, আর তাহাদের ভাষাই বাঙ্গলা’। এ বক্তব্যের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট, যারা ভিন দেশের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করেন, লালন করেন, যারা ভিন দেশের শিল্প ভাষাকে অনুসরণ করেন, চর্চা করেন, তারা বাঙালি নন এবং তাদের ভাষাও বাংলা নয়। তিনিই বাঙালি যিনি বাংলার শিল্প সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেন এবং চর্চা করেন।
লেখক : সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠান ও সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও বাংলা সনের প্রচলন ছিল না। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সনের পরিবর্তে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। এর উদ্ভাবক ছিলেন পণ্ডিত ফতেহ উল্লাহ সিরাজী। এটা স্পষ্ট যে, বাংলা ভাষার ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। তা ছাড়া বাঙালি মুসলমান সমাজে বাংলার খুব বেশি সমাদরও ছিল না। কারণ, তারা আরবি, ফার্সি ও উর্দুকে গুরুত্ব দিতেন। এর স্পষ্ট প্রমাণ উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে দেয়া সভাপতির ভাষণ। সভাপতি তার দীর্ঘ ভাষণের এক স্থানে বলেছেনÑ ‘মুসলমান ভ্রাতৃগণ। আপনাদের ধর্ম যাহাই হউক না কেন, আপনাদের পূর্বপুরুষগণ যে দেশ হইতেই আসিয়া থাকুন না কেন, এখন আপনারা বাঙ্গালী হইয়াছেন। আপনাদের পক্ষে এ হেন বাঙ্গালা ভাষা ত্যাগ করিয়া উর্দু ধরিবার চেষ্টা যেন নিজের সোনার বাড়িতে আগুন লাগাইয়া পরের কুঁড়েঘরের এক কোণে অতিথির মত, পরদেশীর মত থাকিবার একটু স্থান ভিক্ষা করা’ (চতুর্থ অধিবেশন, মালদহ, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩৭-৩৮)। শুধু যে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে তা নয়, ইংরেজির ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। ফলে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিল। ফলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমান বাঙালিদের তেমন একটা ভূমিকা দেখা যায়নি। আরো একটি বিষয় মুসলমান বাঙালিদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে সময়, আর তা হচ্ছে ধর্ম। আরবদের আগমন এবং তাদের কার্যক্রম মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হচ্ছিল। সেই সাথে বাংলা ভাষার প্রচলনও শুরু হয়েছিল। সুতরাং দুটো বিষয়ই বাঙালিদের কাছে ছিল নতুন। কিন্তু ধর্মের সাথে আরবি ও উর্দুর ঘনিষ্ঠতার কারণে মুসলমান বাঙালিরা উর্দুকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের দৃষ্টান্ত থেকেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ সম্মেলনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব পণ্ডিত যোগদান করেছিলেন তাদের তালিকায় দেখা যায়, রংপুর থেকে মোট ২৪ জন যোগদান করেছিলেন। কিন্তু এই ২৪ জনের মধ্যে মুসলমান ছিলেন দু’জন। এরা হলেনÑ মৌলভী সৈয়দ আবুল ফাত্তাহ জমিদার ও মৌলভী হেমায়েত উদ্দীন আহাম্মদ। দিনাজপুর থেকে যোগদান করেছিরেন তিনজন, বগুড়া থেকে পাঁচজন, রাজশাহী থেকে চারজন, শ্রীহট্ট-আসাম থেকে তিনজন, বিহারের পূর্ণিয়া থেকে একজন। কিন্তু এদের মধ্যে একজনও মুসলমান পণ্ডিত ছিলেন না। মালদহ থেকে যে ৩৮ জন যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন চারজন। এরা হলেনÑ মৌলভী কাদের বক্স, মৌলভী আবদুল আজিজ খাঁ, মৌলভী আব্দুল গণি ও মুন্সী আবেদ আলী খাঁ। কলকাতা থেকে ছিলেন ১৫ জন, ময়মনসিংহের একজন, পাটনার দু’জন ও মুর্শিদাবাদের একজন। এদের মধ্যে একজনও মুসলমান সাহিত্যিক ছিলেন না। অর্থাৎ সম্মেলনে যোগদানকারী ৯৭ জন পণ্ডিতের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়জন। এ অবস্থা ভারত ভাগের ৩৬ বছর আগের। ১৯৪৭ সালের আগের এই ৩৬ বছরে বাংলার মুসলমান তথা বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা কতটা বাংলাপ্রেমী হতে পেরেছিলেন, বাঙালি সংস্কৃতির কতটা উন্নয়ন করতে পেরেছিলেন কিংবা বাংলা ভাষার জন্য কতটা গৌরব অনুভব করার মানসিকতা অর্জন করতে পেরেছিলেন, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত ভাগের পর, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলার প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসার কথা দেশবাসী জানতে পেরেছিলেন। জানতে পেরেছিলেন বিশ্ববাসীও। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,্ একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মদান প্রমাণ করতে পেরেছিল যে, বাঙালি ক্রমান্বয়ে ১৯৫২ সালের আগেকার ৩৬+৫=৪১ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাকে তাদের প্রাণের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। সব ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন আর নিজস্ব সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দাবি তুলে বাংলা মায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছিলেন। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাঙালির গর্বের ও অহঙ্কারের শহীদ মিনার।
শহীদ মিনার বাংলাদেশের বাঙালি সম্প্রদায়ের গর্বের বিষয়। ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত হন শহীদ মিনারে। ফুল দিয়ে শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে জাতি বাঙলা ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষাবিদ্বেষী পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাল, সেই জাতি বাংলার শিল্পভাষা পশ্চিমাদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করল না। সেই আদিকাল থেকেই শিল্পকলা ভাষা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। ধূর্ত ব্রিটিশরা ভারত দখল করে শিল্পকলার ওপর যখন আঘাত করল, শিল্পকলা চর্চার কেন্দ্রগুলোকে পশ্চিমাকরণ করল, তখন ইংরেজদেরই একজন পণ্ডিত ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করলেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বাঙালির নিজস্ব শিল্প ভাষাকে রক্ষা করতে বেঙ্গল স্কুল নামে আন্দোলন গড়ে তুললেন। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে বাঙালি মুসলমানদের উর্দু ছেড়ে বাংলাকে গ্রহণ করতে সভাপতি যেমন উপদেশ দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই ই বি হ্যাভেল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তি পশ্চিমা ধারার চর্চাকারীদের পশ্চিমা তথা বিদেশী ধারা ছেড়ে নিজেদের শিল্পধারায় ফিরে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় যারা শিল্পকলা চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়লেন, যারা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করলেন তাদের কারো পক্ষ থেকে পশ্চিমা ধারার অনুকরণের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের পক্ষ থেকেও কেউ এমন বক্তব্য উত্থাপন করলেন না। দেখা গেল, যেসব শিল্পী বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যানার, ফেস্টুন ও চিত্র এঁকে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করলেন সেই সব শিল্পী শিল্প ভাষার ক্ষেত্রে পশ্চিমা আগ্রাসন মেনে নিয়ে পশ্চিমকে অনুকরণ করতে থাকলেন! শিল্পভাষার প্রতি পশ্চিমাদের আগ্রাসন অবমাননাকর মনে হলো না তাদের কাছে। এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি। তবে পশ্চিম বাংলার শিল্পীরা তাদের জন্য পশ্চিমা আগ্রাসন অবমাননাকর মনে করে ুব্ধ হয়েছিলেন। যারা পশ্চিমা ধারার অনুসরণ করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এ দেশে বসে জার্মানি বা আমেরিকার আর্থ-সামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ছবি আঁকেন যারা, আমরা তাদের সঙ্গে নেই। পোস্ট-মডার্নিজমের নামে এক ধরনের নকলনবিসি কাজ আমাদের সংস্কৃতির ক্ষতি করছে। আমরা সোসাইটির সদস্যরা সব সময় এই চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। গ্লোবালাইজেশনের নামে এই কুম্ভিলক (চুরির) প্রথা একদিন আমাদের দেশীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে’ (রোদে ধান ছায়ায় পান, নবম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪১৬, কলকাতা, পৃ. ৫৬)। প্রিয় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখা ভালো যে, ভারতীয় শিল্পীদের প্রায় শতভাগ ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে অবলম্বন করে শিল্পচর্চা করেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, কে জি সুব্রমন্যম, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, শ্যামল দত্ত রায়, সুধাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা ভট্টাচার্য, সাধনা চক্রবর্তী, এস প্রণাম সিং, আলী জে. সুলতান, পরেশ মাইতিসহ অসংখ্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যাবে, যারা নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পকর্ম করেছেন। অথচ কুম্ভিলক প্রথার অনুসারী বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম সব সময়ই অবহেলিত হয়েছে। ভারতের শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন শিল্পী ক্যালিগ্রাফিকে প্রাধান্য দিয়ে চিত্র রচনা করলেও বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প অবহেলিত। শুধু তা-ই নয়, বিচ্ছিন্নভাবে কেউ ক্যালিগ্রাফি করলেও সেই শিল্পকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করতে কোনো প্রতিষ্ঠান জায়গা পর্যন্ত দিতে চায় না। যারা ক্যালিগ্রাফি করেন, তাদের সাথে কুম্ভিলক প্রথার অনুসারী শিল্পীরা বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। এ অবস্থার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী মুর্তজা বশীর একবার ক্যালিগ্রাফি এঁকে একক প্রদর্শনী করার সিদ্ধান্ত নেন। তার এ উদ্যোগকে যে কুম্ভিলক প্রথার অনুসারীরা পছন্দ করবেন না, সে কথা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। বলেছেনÑ ‘আমার ২৯টা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ২৮ রকম করে লেখা।... ইনশাআল্লাহ আমার মনে হয় এই কাজটা, আমার ইচ্ছা এবার ৩রা নভেম্বর ১লা রমজান... অন দ্য অকেশন অব রমজান আমি এটা করব। আমি জানি, আমার ওপর দিয়ে আরেকটা ঝড় বয়ে যাবে। সেই কেয়ার আমি করি না’ (সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন শিল্পী আবদুর রহীম)। শিল্পী মুর্তজা বশীরের মতো শিল্পী যদি বলেন, ধর্মীয় শিল্প ক্যালিগ্রাফি করলে পশ্চিমা ধারার অনুসারীদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন, তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশে বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার কী দুরবস্থা।
বাংলাদেশে দেশীয় বিষয়বস্তু অবলম্বনে শিল্পচর্চা অবহেলিত হলেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাজী আবুল কাশেম, এস এম সুলতান প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি অবলম্বনে চিত্র চর্চা করেছেন (পরবর্তী সময়ের শিল্পীরা প্রথম পর্যায়ে বাস্তব ধর্মীয় ছবি আঁকলেও পরবর্তী সময়ে আর সে পথে অগ্রসর হননি)। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কাজী আবুল কাশেম, কামরুল হাসান, এস এম সুলতানের ক্যানভাসজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সমাজ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলার প্রকৃতি এবং ধর্ম বিভিন্নভাবে এদের চিত্রে উঠে এসেছে। এসব পথপদর্শক শিল্পী ছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মের কিছু শিল্পী বাংলাদেশকে তাদের ক্যানভাসে স্থান দিয়ে তারাও যে দেশপ্রেমিক, সে কথা প্রমাণ করেছেন। তবে এদের সংখ্যা অতি নগণ্য।
বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম যারা চর্চা করেছেন এবং করছেন, বিশেষ করে যারা দেশ, দেশের সংস্কৃতি ও ধর্মকে অবলম্বন করে দেশমাতৃকাকে মূল্য দিয়েছেন, তারা কিন্তু পশ্চিমা ধারার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেননি। তবে শিল্পী কামরুল হাসান একবার প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে প্রতিবাদ জোরালো ছিল না। তা ছাড়া তিনি যেভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, সে প্রতিবাদ সার্বিকভাবে পশ্চিমা ধারার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল নবীন শিল্পীদের বিরুদ্ধে। তিনি ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে সাপ্তাহিক পূর্বাণী পত্রিকায় বলেছেন, ‘তরুণ শিল্পীদের কাজে বিমূর্ত রীতির প্রভাব বেশি।... এদের ছবির মধ্যে কোনো বক্তব্য নেই এবং কালের বিচারে এসব ছবি টিকবে না। ... রং মাখলে আর টেক্সচার তৈরি করলেই শিল্পী হয় না’ (এ সাত্তার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পৃ. ৭১)। এ বক্তব্য একটি জেনারেশনের বিরুদ্ধে হলেও বাংলাদেশে যে শিল্পীরা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভুলে বিদেশী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করছেন, সে কথা স্পষ্ট হয়েছে। উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতরাজ যাদবেশ্বর তর্করতœ বলেছেনÑ ‘যাঁহারা বঙ্গকে নিজের দেশ করিয়াছেন, যাঁহারা বাঙ্গলার মাটি বাংলার জল হইতেই শক্তি সঞ্চার করেন, এই সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা দেশ ভিন্ন যাঁহারা অনন্যমাতৃক, এ দেশ ভিন্ন যাঁহাদের অন্যত্র গতি নাই,Ñ তাঁহারাই বাঙ্গালী, আর তাহাদের ভাষাই বাঙ্গলা’। এ বক্তব্যের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট, যারা ভিন দেশের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করেন, লালন করেন, যারা ভিন দেশের শিল্প ভাষাকে অনুসরণ করেন, চর্চা করেন, তারা বাঙালি নন এবং তাদের ভাষাও বাংলা নয়। তিনিই বাঙালি যিনি বাংলার শিল্প সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেন এবং চর্চা করেন।
লেখক : সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments