পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম বিদ্বেষের মূল কারণ অজ্ঞতা by ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ
ইসলাম
বা মুসলমান সম্পর্কে পশ্চিমাদের বৈরিতা বা দ্বিমুখী নীতি নতুন নয়। যুগ যুগ
ধরে এ বৈরিতা, ঘৃণা, অবজ্ঞা ও দ্বিমুখী নীতি চলে আসছে। কয়েক বছর আগে ইরানে
বিরোধী দলের গণআন্দোলনের সময় কোনো এক অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে নেদা সোলতানা
নামের একজন অল্পবয়সী নারী প্রাণ হারায়। সঙ্গে সঙ্গে এ খবর বিশ্বব্যাপী
গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের মধ্যে এই
মর্মান্তিক ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করা ছাড়াও তাদের মনকে আন্দোলিত করে তোলে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নেদা সোলতানার মৃত্যুদৃশ্য দেখে ও শুনে
প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন, ঘটনাটি হৃদয়বিদারক। কয়েক সপ্তাহ পর
জার্মানির ড্রেসডেন শহরে আরও মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে। মারওয়া-এল-শেরবিনি
নামের এক মিসরীয় ভদ্রমহিলাকে হিজাব পরার কারণে এক জার্মান সাম্প্রদায়িক
মনোভাব নিয়ে গালাগাল করেন। মারওয়া-এল-শেরবিনিকে অপমান করার কারণে ওই
চরমপন্থী জার্মান নাগরিককে আদালত ২ হাজার ৮০০ ইউরো জরিমানা করেন। আদালতে
উপস্থিত মারওয়া ও তার স্বামীকে উগ্রপন্থী এ জার্মান নাগরিক ক্রোধান্ধ হয়ে
ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। মারওয়া তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে মৃত্যুবরণ করেন।
জার্মানিতে মারওয়া ও ইরানে নেদা হত্যাকাণ্ডকে সমান বর্বরোচিত অপরাধ হিসেবে
গণ্য করা দরকার ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মিসরের হিজাব পরা মারওয়া-এল-শেরবিনির
নির্মম হত্যাকাণ্ড বারাক ওবামার চোখে পানি আনতে পারেনি এবং ঘটনাটি তার মনে
তেমন কোনো প্রভাবও ফেলতে পারেনি। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা বিশ্বে এত বড় একটি
মর্মান্তিক ঘটনা প্রচার মাধ্যমে শিরোনাম তো দূরের কথা, তেমন কোনো প্রচারও
পায়নি। নেদা হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে পশ্চিমা দেশগুলো সম্পূর্ণ দোষ ইরানের
রক্ষণশীল ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বেশ কয়েক মাস বিশ্ববাসীর কাছে
ইরানকে হেয় করার অপতৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মারওয়ার হত্যাকাণ্ড
প্রমাণ করে, সন্ত্রাস শুধু আরব বা মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাদা
চামড়ার একজন জার্মানও সন্ত্রাসী হতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো প্রায়ই বলে
থাকে, মুসলমান সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে। মারওয়া কি একজন নিরীহ
মানুষ ছিলেন না? মারওয়ার কী অপরাধ ছিল? তিনি হিজাব পরতেন, তিনি মুসলমান
ছিলেন- এই কি তার অপরাধ? মুসলমান হিসেবে হিজাব পরার কারণে জার্মানির মতো
একটি দেশে একজন নিরীহ মহিলাকে হত্যা এবং তার স্বামীকে হত্যার চেষ্টার ঘটনা
পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার পায়নি বললেই চলে। কেন এই বৈরিতা,
কেন এই বৈষম্য বা দ্বৈতনীতি? পশ্চিমা দেশগুলোতে ওইসব খবরই ফলাও করে প্রচার
করা হয়, যা আরব বা মুসলমানদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু আরব বা মুসলমানরা
কি সত্যিকার অর্থে সব পশ্চিমা নাগরিকের পক্ষপাতমূলক আচরণের নিরীহ শিকার?
তা অবশ্যই নয়। আমরা পশ্চিমা শব্দটি অবশ্যই ওই অর্থে ব্যবহার করব না, যার
অর্থ একচেটিয়ার পর্যায়ে চলে যায়। পাশ্চাত্যের লাখো কোটি মানুষ রয়েছে যারা
ইসলামকে ভালোবাসে না, ঘৃণাও করে না। এর কারণ ইসলাম সম্পর্কে তাদের কোনো
ধারণাই নেই।
পাশ্চাত্যের মানুষদের কাছে মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত ইমেজ বা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারছে না। মুসলমানরা যা করে ও যা বলে এবং সেটাকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা থেকে যদি একজন পশ্চিমা নাগরিক প্রকৃত সত্যটি জানতে চেষ্টা করে, তাহলে তিনি উপসংহারে আসবেন? তিনি মনে করবেন, ওসামা বিন লাদেন বা বোকো হারাম অনুসারীরা মধ্যযুগীয় কোনো গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দেবেন- ইসলাম তাকে যত বেশি সম্ভব ইসলামবিরোধী পশ্চিমা ক্রুসেডারকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে, যদিও তারা শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেনি। হয়তো বা তাদের সামনে ফুটে উঠবে- বিশ্বের সব মুসলমান তালেবান মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে গেছে, যারা মেয়েদের সব স্কুল বন্ধ করে দিতে সচেষ্ট। কারণ মহিলারা ধর্মীয় বা বৌদ্ধিকভাবে (Intellectually) পুরুষের সমকক্ষ নয় বলে ইসলাম তাদের শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপর পশ্চিমারা কিছুসংখ্যক স্বঘোষিত আইন বা ইসলাম বিশেষজ্ঞের বাণী পড়বেন এবং জানবেন, কোনো মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে তাকে অনুশোচনা করতে হবে অথবা তার গলা কেটে ফেলতে হবে। অনেক তথাকথিত ইসলাম আইনজ্ঞের ভাষায় তারা পড়বেন- ইসলাম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং একজন মুসলমানের দায়িত্ব হল তার শাসককে মেনে চলা, হোন তিনি শোষক বা প্রজা নিষ্পেষণকারী। তারা চান মহিলারা নেকাবের মাধ্যমে তাদের চেহারা ঢেকে রাখবে, যাতে করে তাদের দেখে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা জন্ম না নেয়।
কিন্তু পশ্চিমারা জানে না- ইসলামে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং কর্তব্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা এও খুঁজে পাবে না, ইসলামের দৃষ্টিতে কেউ যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে মূলত পুরো মানব সভ্যতাকে হত্যা করল। পশ্চিমারা কখনও পড়েনি- ইসলামের মূলমন্ত্র হল মুক্তি, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার। ইসলাম স্বাধীন চিন্তার ধারক-বাহক। যার ইচ্ছা সে ইসলাম গ্রহণ করবে, যার ইচ্ছা সে তা বর্জন করবে। ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অনুসারীদের মতামত বা স্বীকৃতি ছাড়া কোনো শাসক ক্ষমতায় আসীন হতে পারেন না। এরপরও কি ইসলামকে পশ্চাৎপদ, সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে আমরা পশ্চিমাদের দোষ দেব না?
গত বছর একজন ধর্মবিশেষজ্ঞ অস্ট্রিয়ায় বাস্তবতার নিরিখে ইসলামের ওপর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন অতি দয়ালু ও সহনশীল মানুষ। নামাজ পড়ার সময় তিনি যখন সেজদায় যেতেন, তখন তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.) খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসতেন। তারা স্বেচ্ছায় না নামা পর্যন্ত তিনি সেজদায় পড়ে থাকতেন, যাতে করে নাতিদের খেলাধুলায় বিঘœ না ঘটে। তারা নেমে গেলে তিনি নামাজ চালিয়ে যেতেন। সেই বিশেষজ্ঞ শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনারা কি বিশ্বাস করেন, যে মানুষটি শিশুদের খেলাধুলায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করার জন্য নামাজ পড়া বন্ধ রাখতেন, তিনি নিরীহ মানুষকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করার জন্য ওকালতি করবেন? অনেকেই বক্তৃতাটি শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন এবং পরে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে কী করতে হবে? এটা সত্য, পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের ঔপনিবেশিক প্রজা বলে মনে করে। সুতরাং নাগরিক হিসেবে আমাদের কোনো অধিকার প্রত্যাশা করা তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় নয়। এটাও সত্য, এসব সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশ তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোকে পক্ষপাতমূলক ও ইসলাম বা মুসলমানবিদ্বেষী ভাবধারায় গড়ে তুলেছে। এসব প্রচার মাধ্যমে অনেক বিকৃত ও অসত্য ধারণা দীর্ঘদিন ধরে বারবার উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনগণের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা- চেতনায় এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জোর চেষ্ট চালানো হয়। এসব ধারণার মধ্যে থাকে- মুসলমানরা সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিপন্থী। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে মুসলমানদের ভিন্নধর্মী মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে মূল্যায়নপূর্বক যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের ৭ জুলাই লন্ডনে বোমা হামলার পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০০৫ সালের জুলাই থেকে যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে মুসলমানদের বৈরীভাব ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৬ শতাংশ মুসলমান জানিয়েছেন, তারা বা তাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে অপমানের শিকার হতে হয়েছে।
ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি ইসলাম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে সব সময়ই ফায়দা লুটতে সচেষ্ট থাকে। এ দলের নেতা নিক প্রিফিন বলেন, আমরা ইসলাম ও মুসলমানদের আঘাত করি কেন জানেন? সাধারণ মানুষ ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ অতি সহজে বোঝে ও গ্রহণ করে। পত্রিকার সম্পাদকরা ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষকে পুঁজি করে অতি সহজে মুনাফা লুটতে সক্ষম হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকার প্রতিবাদে ফ্রান্সের কার্টুন ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয় ও অন্যান্য স্থানে ইসলামপন্থী বন্দুকধারীদের গুলিতে সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা আরও বেড়েছে। ১১ ফেব্র“য়ারি পত্রিকায় পড়লাম, নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপল হিল শহরে একই পরিবারের তিনজন মুসলমান সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মুসলমান হওয়াই ছিল তাদের অপরাধ!
পাশ্চাত্যের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় বিশ্বের বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে উসকে দিয়েছে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এ প্রচার মাধ্যমগুলোকে কোনোমতেই গণতন্ত্র, সাম্য, মুক্তির সহায়ক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
আজকাল মুসলমানদের এক কথায় সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সাধারণ ভাষায় সন্ত্রাস কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট নয়- সন্ত্রাস হল পলিটিক্যাল অ্যাক্ট, যা পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্যের দেশগুলো যতদিন তাদের সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতি পরিহার না করবে, ততদিন ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ও সংঘাত বাড়তে থাকবে। এই দূরত্ব ও সংঘাত বিশ্বশান্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়- এ কথা পশ্চিমা দেশগুলো যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাশ্চাত্যের মানুষদের কাছে মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত ইমেজ বা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারছে না। মুসলমানরা যা করে ও যা বলে এবং সেটাকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা থেকে যদি একজন পশ্চিমা নাগরিক প্রকৃত সত্যটি জানতে চেষ্টা করে, তাহলে তিনি উপসংহারে আসবেন? তিনি মনে করবেন, ওসামা বিন লাদেন বা বোকো হারাম অনুসারীরা মধ্যযুগীয় কোনো গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দেবেন- ইসলাম তাকে যত বেশি সম্ভব ইসলামবিরোধী পশ্চিমা ক্রুসেডারকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে, যদিও তারা শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেনি। হয়তো বা তাদের সামনে ফুটে উঠবে- বিশ্বের সব মুসলমান তালেবান মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে গেছে, যারা মেয়েদের সব স্কুল বন্ধ করে দিতে সচেষ্ট। কারণ মহিলারা ধর্মীয় বা বৌদ্ধিকভাবে (Intellectually) পুরুষের সমকক্ষ নয় বলে ইসলাম তাদের শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপর পশ্চিমারা কিছুসংখ্যক স্বঘোষিত আইন বা ইসলাম বিশেষজ্ঞের বাণী পড়বেন এবং জানবেন, কোনো মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে তাকে অনুশোচনা করতে হবে অথবা তার গলা কেটে ফেলতে হবে। অনেক তথাকথিত ইসলাম আইনজ্ঞের ভাষায় তারা পড়বেন- ইসলাম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং একজন মুসলমানের দায়িত্ব হল তার শাসককে মেনে চলা, হোন তিনি শোষক বা প্রজা নিষ্পেষণকারী। তারা চান মহিলারা নেকাবের মাধ্যমে তাদের চেহারা ঢেকে রাখবে, যাতে করে তাদের দেখে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা জন্ম না নেয়।
কিন্তু পশ্চিমারা জানে না- ইসলামে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং কর্তব্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা এও খুঁজে পাবে না, ইসলামের দৃষ্টিতে কেউ যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে মূলত পুরো মানব সভ্যতাকে হত্যা করল। পশ্চিমারা কখনও পড়েনি- ইসলামের মূলমন্ত্র হল মুক্তি, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার। ইসলাম স্বাধীন চিন্তার ধারক-বাহক। যার ইচ্ছা সে ইসলাম গ্রহণ করবে, যার ইচ্ছা সে তা বর্জন করবে। ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অনুসারীদের মতামত বা স্বীকৃতি ছাড়া কোনো শাসক ক্ষমতায় আসীন হতে পারেন না। এরপরও কি ইসলামকে পশ্চাৎপদ, সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে আমরা পশ্চিমাদের দোষ দেব না?
গত বছর একজন ধর্মবিশেষজ্ঞ অস্ট্রিয়ায় বাস্তবতার নিরিখে ইসলামের ওপর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন অতি দয়ালু ও সহনশীল মানুষ। নামাজ পড়ার সময় তিনি যখন সেজদায় যেতেন, তখন তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.) খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসতেন। তারা স্বেচ্ছায় না নামা পর্যন্ত তিনি সেজদায় পড়ে থাকতেন, যাতে করে নাতিদের খেলাধুলায় বিঘœ না ঘটে। তারা নেমে গেলে তিনি নামাজ চালিয়ে যেতেন। সেই বিশেষজ্ঞ শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনারা কি বিশ্বাস করেন, যে মানুষটি শিশুদের খেলাধুলায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করার জন্য নামাজ পড়া বন্ধ রাখতেন, তিনি নিরীহ মানুষকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করার জন্য ওকালতি করবেন? অনেকেই বক্তৃতাটি শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন এবং পরে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে কী করতে হবে? এটা সত্য, পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের ঔপনিবেশিক প্রজা বলে মনে করে। সুতরাং নাগরিক হিসেবে আমাদের কোনো অধিকার প্রত্যাশা করা তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় নয়। এটাও সত্য, এসব সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশ তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোকে পক্ষপাতমূলক ও ইসলাম বা মুসলমানবিদ্বেষী ভাবধারায় গড়ে তুলেছে। এসব প্রচার মাধ্যমে অনেক বিকৃত ও অসত্য ধারণা দীর্ঘদিন ধরে বারবার উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনগণের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা- চেতনায় এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জোর চেষ্ট চালানো হয়। এসব ধারণার মধ্যে থাকে- মুসলমানরা সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিপন্থী। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে মুসলমানদের ভিন্নধর্মী মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে মূল্যায়নপূর্বক যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের ৭ জুলাই লন্ডনে বোমা হামলার পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০০৫ সালের জুলাই থেকে যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে মুসলমানদের বৈরীভাব ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৬ শতাংশ মুসলমান জানিয়েছেন, তারা বা তাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে অপমানের শিকার হতে হয়েছে।
ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি ইসলাম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে সব সময়ই ফায়দা লুটতে সচেষ্ট থাকে। এ দলের নেতা নিক প্রিফিন বলেন, আমরা ইসলাম ও মুসলমানদের আঘাত করি কেন জানেন? সাধারণ মানুষ ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ অতি সহজে বোঝে ও গ্রহণ করে। পত্রিকার সম্পাদকরা ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষকে পুঁজি করে অতি সহজে মুনাফা লুটতে সক্ষম হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকার প্রতিবাদে ফ্রান্সের কার্টুন ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয় ও অন্যান্য স্থানে ইসলামপন্থী বন্দুকধারীদের গুলিতে সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা আরও বেড়েছে। ১১ ফেব্র“য়ারি পত্রিকায় পড়লাম, নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপল হিল শহরে একই পরিবারের তিনজন মুসলমান সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মুসলমান হওয়াই ছিল তাদের অপরাধ!
পাশ্চাত্যের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় বিশ্বের বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে উসকে দিয়েছে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এ প্রচার মাধ্যমগুলোকে কোনোমতেই গণতন্ত্র, সাম্য, মুক্তির সহায়ক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
আজকাল মুসলমানদের এক কথায় সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সাধারণ ভাষায় সন্ত্রাস কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট নয়- সন্ত্রাস হল পলিটিক্যাল অ্যাক্ট, যা পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্যের দেশগুলো যতদিন তাদের সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতি পরিহার না করবে, ততদিন ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ও সংঘাত বাড়তে থাকবে। এই দূরত্ব ও সংঘাত বিশ্বশান্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়- এ কথা পশ্চিমা দেশগুলো যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments