বইয়ের প্রতি ভালোবাসা by জহর লাল সাহা
একুশ এলেই বিশেষভাবে মনে পড়ে যায় শহীদ সালাম, বরকত, রফিক এবং আরও নাম না জানা অসংখ্য শহীদের কথা, যারা আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি শাসকের আদেশ অমান্য করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ১৯৫২ সালে। তখন থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করা হতো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন লক্ষ্মীপুর হাই স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের ছাত্র। মনে পড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে আমাদের স্কুলে। কালো পতাকা উড়ছে স্কুলের ওপরে। ছেলেরা সবাই কালো ব্যাজ বুকে লাগিয়েছে। আমিও সবার সঙ্গে একটা কালো ব্যাজ জোগাড় করে বুকে লাগিয়েছি এবং সবার সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে বলি_ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমীনের কেল্লা (নোয়াখালীর ভাষা) চাই।' তখন কিন্তু এসব বিশেষ কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। সবার সঙ্গে শুধু স্লোগান দিয়েছি আর কালো কাপড়ের ব্যাজ ধারণ করেছি মাত্র। যখন বড় হতে লাগলাম তখন ধীরে ধীরে সব কিছু বুঝতে শিখেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বাংলা একাডেমি প্রতি বছর একদিনের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করত ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবিতা পাঠ, দেশাত্মবোধক গান ও আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তখন থেকেই ওই একদিন সমাজের সব শ্রেণী-পেশার লোকজনের আগমনের মধ্য দিয়ে ভরে উঠত বাংলা একাডেমি। অদ্ভুত একটা পরিবেশ ছিল। যাকে বলে অল্প সময়ের জন্য হলেও মুক্ত বায়ুতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতাম। প্রিয়জনের সঙ্গে বসে প্রাণের কথা বলতাম। অদ্ভুত ভালো লাগত। আমার বয়স এখন ৭২। যারা আমার বয়সী এখনও বেঁচে আছেন তাদের নিশ্চয় ওই দিনটির কথা এখনও মনে পড়ে। সেখানে বেদনা ছিল না। ছিল আনন্দ, মিলনের আনন্দ, মুক্তির আনন্দ। ভাবলে এখনও ক্ষণিকের জন্য মনের মধ্যে দোলা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই প্রাণের ভয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের (মুক্তধারার) প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহাও সপরিবারে খালি হাতে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কর্মবীর চিত্তরঞ্জন সাহা কখনোই অলস জীবন কাটাতেন না। কলকাতায় গিয়ে তিনি সেখানকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে বৈঠক করেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী বাসায়। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন এবং সেখান থেকেই 'মুক্তধারা'র ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৩৩টি বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে উৎসাহিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি ওখান থেকে মুক্তধারার বইগুলো দেশের বাইরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছেও পাঠাতে আরম্ভ করেন স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এ বইগুলো দেশে নিয়ে আসেন এবং প্রথমবারের মতো ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা একাডেমির সবুজ চত্বরে ঘাসের মধ্যে চট বিছিয়ে ওই বইগুলোর প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন করেন। বেশ সাড়াও পেয়েছিলাম আমরা। পরের বছর একই পদ্ধতিতে ওই বইগুলোর প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকের বাঁদিকের জায়গায় প্রথম একটি বইয়ের স্টল অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে তৈরি করে বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করি। ধীরে ধীরে স্টলের সংখ্যা বাড়তে থাকে, পাঠক বাড়তে থাকে, লেখক বাড়তে থাকে, প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এক সময় বাংলা একাডেমিতে স্টলের স্থান সংকুলান না হওয়ায় গত বছর থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়। শিশুতোষ বই ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ভেতরে রাখা হয়।
চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমিতে একুশের যে বইমেলার সূচনা করেন তার পেছনে কিন্তু ব্যবসা করার উদ্দেশ্য ছিল না। দেশের প্রতি, জাতির প্রতি কর্তব্যবোধের প্রেক্ষাপটে কিছুটা মনের খোরাক, কিছুটা আনন্দ এ সবকিছুই ছিল একুশের বইমেলার সূচনাকারীর একান্ত অভিপ্রায়। আর আমরা যারা এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছি তাদেরও একই অভিপ্রায়। একুশের বইমেলা হোক শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর কেন্দ্রস্থল। ব্যবসাটা আমরা অন্যভাবে, অন্য জায়গায় করি না!
প্রকাশক, মুক্তধারা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই প্রাণের ভয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের (মুক্তধারার) প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহাও সপরিবারে খালি হাতে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কর্মবীর চিত্তরঞ্জন সাহা কখনোই অলস জীবন কাটাতেন না। কলকাতায় গিয়ে তিনি সেখানকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে বৈঠক করেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী বাসায়। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন এবং সেখান থেকেই 'মুক্তধারা'র ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৩৩টি বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে উৎসাহিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি ওখান থেকে মুক্তধারার বইগুলো দেশের বাইরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছেও পাঠাতে আরম্ভ করেন স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এ বইগুলো দেশে নিয়ে আসেন এবং প্রথমবারের মতো ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা একাডেমির সবুজ চত্বরে ঘাসের মধ্যে চট বিছিয়ে ওই বইগুলোর প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন করেন। বেশ সাড়াও পেয়েছিলাম আমরা। পরের বছর একই পদ্ধতিতে ওই বইগুলোর প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকের বাঁদিকের জায়গায় প্রথম একটি বইয়ের স্টল অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে তৈরি করে বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করি। ধীরে ধীরে স্টলের সংখ্যা বাড়তে থাকে, পাঠক বাড়তে থাকে, লেখক বাড়তে থাকে, প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এক সময় বাংলা একাডেমিতে স্টলের স্থান সংকুলান না হওয়ায় গত বছর থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়। শিশুতোষ বই ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ভেতরে রাখা হয়।
চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমিতে একুশের যে বইমেলার সূচনা করেন তার পেছনে কিন্তু ব্যবসা করার উদ্দেশ্য ছিল না। দেশের প্রতি, জাতির প্রতি কর্তব্যবোধের প্রেক্ষাপটে কিছুটা মনের খোরাক, কিছুটা আনন্দ এ সবকিছুই ছিল একুশের বইমেলার সূচনাকারীর একান্ত অভিপ্রায়। আর আমরা যারা এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছি তাদেরও একই অভিপ্রায়। একুশের বইমেলা হোক শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর কেন্দ্রস্থল। ব্যবসাটা আমরা অন্যভাবে, অন্য জায়গায় করি না!
প্রকাশক, মুক্তধারা
No comments