এক বছরেই মোদি-হাওয়া পাল্টাচ্ছে by মাসুমুর রহমান খলিলী
এক
বছরের কম সময় আগে ভারতে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে ঝড় তোলার পর মোদির
বিজেপি পালে হাওয়া যেন উল্টো বইতে শুরু করেছে। সরকার গঠনের পর কয়েকটি
রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি সাফল্য পেলেও, এখন একের পর এক বিপর্যয়কর ফল দেখা
যাচ্ছে। এমনকি বেশ ক’টি রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভার যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত
হচ্ছে, তাতেও আশানুরূপ ফল আসছে না বিজেপির পদ্মফুলের অনুকূলে। বরং ভারতীয়
কংগ্রেস লোকসভার বিপর্যয় কাটাতে না পারলেও আঞ্চলিক দলগুলো ঘুরে দাঁড়াতে
শুরু করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচনী রাজনীতিতে লক্ষ করা যাচ্ছে নতুন নতুন
মেরুকরণ।
লোকসভা নির্বাচনের পর যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে মহারাষ্ট্র হরিয়ানা আর ঝাড়খণ্ডে বিজেপি তার অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পেরেছে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনে সাফল্যের পথ ধরে কংগ্রেস জোটকে হারিয়ে সরকার গঠন করেছে এনডিএ। যদিও সেখানে বিজেপির সাথে শরিক দল শিবসেনার চলছে টানাপড়েন। হরিয়ানায়ও কংগ্রেসের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পেরেছে বিজেপি। বাকি দুটো রাজ্যে আগে থেকেই বিজেপির সরকার ছিল। তারা এবারো ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে। এর বাইরে জম্মু কাশ্মীরে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মুতে সাফল্য পেলেও কাশ্মীর উপত্যকার একটি সিটও পায়নি বিজেপি। ফলে তাদের ক্ষমতায় যেতে পিডিপি’র জুনিয়র পার্টনার হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে আসে সদ্য অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতে জয় পায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ)। লোকসভার সাত আসনের মধ্যে যেখানে সব ক’টিতে বিজেপি জয় পেয়েছিল, সেখানে বিধানসভায় এভাবে গো-হারা প্রধানমন্ত্রী মোদি আর বিজেপি উভয়ের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনের ফলাফল বিজেপির স্বপ্নযাত্রায় যেন আরো বড় আঘাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত বনগাঁওয়ের লোকসভা উপনির্বাচনে দুই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। একই সাথে কৃষ্ণপুরের বিধানসভা উপনির্বাচনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে বিজেপি তৃণমূলকে তছনছ করার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তার মাঝপথেই এসেছিল এই উপনির্বাচন। নির্বাচনের আগে মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে যেন দলত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। কেউ সারদার আঘাত থেকে বাঁচতে কেউবা তৃণমূলের ‘ডুবন্ত তরী’ থেকে সময়ের আগেই লাফ দিতে চেয়েছিল। এমনকি রাজ্যে মমতার ডান হাত বলে খ্যাত আর ইন্ডিয়া তৃণমূলের সেক্রেটারি মুকুল রায়ের দলত্যাগের গুঞ্জনও দিন দিন বাড়ছিল। এ সময়ে উপনির্বাচনের এই ফলাফল এক দিকে যেমন মমতার জন্য স্বস্তিকর, অন্য দিকে তেমনি শাসক দল ভেঙে ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ দখলের গেরোয়া স্বপ্নে একটি বড় ধরনের আঘাত।
সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে তৃণমূল বধ করার প্রচেষ্টায় মনে হয় উল্টো ফলই এসেছে। বরং মমতা সারদার কর্ণধারদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া এবং অন্যভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, তার প্রতি ভোটারদের আস্থার প্রকাশ পেয়েছে। বিজেপির সামনে এই বার্তা গেছে যে, সারদা দিয়ে তৃণমূলের সামনে খড়ক দাঁড় করানোর ফলাফল বিজেপির জন্য উল্টো ফলতে পারে। বছরখানেক পর পশ্চিম বঙ্গের নতুন বিধানসভা নির্বাচন আসার আগে হয়তো পানি আরো অনেকদূর গড়াবে। তত দিনে মোদি-হাওয়া আরো শীতল হয়ে যাবে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে গেরোয়া পতাকা উড়ানোর স্ব^প্ন অধরা থেকে যাওয়ার বার্তাই এখন মিলছে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্বাচন হবে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য বিহারে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি খেলার নতুন ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার দলের একবারে নি¤œবর্ণের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নেতা জিতেন রাম মানজিকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন। লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডির সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে তিনি এই পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে তিনি বিজেপির সাথে গোপন যোগসূত্র তৈরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত জেডিইউ’র এমপিদের এক সভায় তাকে দল ও মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ না করে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ধরে রেখেছে তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আস্থা ভোটে নিতিশেরই জয় হওয়ার কথা। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার জিতেনের পরামর্শে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি এবং নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। অথবা আস্থা ভোটে জিতেন ও নিতিশের ভাগ্য পরীক্ষা করতে পারে। অন্তরাল থেকে বিহারে বিজেপির জন্য এই খেলাধুলার ফল খুব একটা ভালো বলে মনে হচ্ছে না।
রাজ্যটিতে বিগত লোকসভা নির্বাচনে নিতিশের জেডিইউ এবং লালু প্রসাদের আরজেডি-কংগ্রেস জোটের মধ্যে ভোট বিভাজনের সুযোগে বিজেপি ও রাম বিলাস পাসোয়ানের কোয়ালিশন ভালো ফল করে। এখন নিতিশ লালুর সমঝোতা রাজ্যে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। জিতেন তার সহযোগীদের নিয়ে আলাদা দল তৈরি করার পর তাদের সাথে কোনো সমঝোতা করলেও বিহারে বিজেপি ভালো কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১৬ সালের মে মাসে আসাম কেরালা ও তামিলনাড়–তে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে তামিলনাড়–তে বিজেপির ভালো করার কোনো লক্ষণ নেই। একটি দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে জেলে পাঠানোর বিষয়টি বিজেপির জন্য খুব ভালো ফল আনতে পারেনি। ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতার এআইডিএমকের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।
কেরালায় বিজেপির কোনোকালেই ভালো ফলাফলের রেকর্ড নেই। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মোদি-হাওয়ার সময়ও সেখানে বিজেপি কিছুই করতে পারেনি। ভবিষ্যতে তেমন কিছু করতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই। আসামের রাজ্যক্ষমতা দখল করা বিজেপির অন্যতম লক্ষ্য। সেখানে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেস সরকার কার্যকর কিছু করতে পারছে না। এই স্থানিক বাস্তবতা ২০১৬ সালে বিজেপিকে একটি ইতিবাচক ফলে লাভের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
২০১৭ সালে অনেক রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মোদি বিদায় হওয়ার পর প্রথমবার রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হবে গুজরাটে। এই রাজ্যে বিজেপির শক্ত প্রভাব বলয় থাকায় পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা হয়তো দলটির নেই। তবে অন্য দলগুলো যেকোনো ঐক্য করে সম্মিলিতভাবে নির্বাচন করলে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আম আদমি পার্টি রাজ্য দখলের জন্য টার্গেট করেছে পাঞ্জাবকে। বিগত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে আপ চারটি আসনে জয় পেয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এগোতে পারলে সেখানে ভালো ফল করতে পারে দলটি। এখানে বিজেপির প্রভাব প্রতিপত্তি দল ক্ষমতায় থাকার পরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে।
ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন হবে বিজেপির জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানকার দুই বৃহৎ স্থানিক দল এসপি ও বিএসপির মধ্যে সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর সাথে কংগ্রেস যুক্ত হয়ে বৃহৎ কোনো নির্বাচনী জোট হলে বিজেপির লোকসভার সাফল্যের ঠিক উল্টো ফল হতে পারে সেখানে।
মাত্র এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কেন মোদি-হাওয়া উল্টোমুখী বইতে শুরু করল সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। ভারতের করপোরেট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় মোদি লোকসভা নির্বাচনের সময় যে আগ্রাসী প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন তার মূল ছিল উন্নয়ন সুশাসন কর্মসংস্থান। এর সাথে অন্তরালে সংঘ পরিবার হিন্দু জাতীয়তাবোধকে জাগাতে চেয়েছিল। ক্ষমতায় যাওয়ার পর মোদি এক বছরেও উন্নয়ন সুশাসনে বা কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সেভাবে কোনো কিছু করতে পারেননি। বরং এর মধ্যে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ব এজেন্ডা অনেকটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে, যার ফলে সংখ্যালঘু এবং সেকুলার ভারতীয়রা বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত আরএসএস প্রধান ভগবত সব ভারতীয়ের পরিচয় হিন্দু হতে হবে বলে উল্লেখ করার পর এ ব্যাপরে মোদির কোনো বক্তব্য না থাকাটা তার এজেন্ডা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে। এর সাথে ভারতের মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচির নামে হিন্দু করে ফেলার যে কর্মসূচি, সেটা মোদি শাসনের ব্যাপারে ভুল বার্তা দিয়েছে। দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে। এই আবহ থেকে সরে আসতে হলে হিন্দুত্ব এজেন্ডার রাস টানতে হবে মোদিকে। কিন্তু সংঘ পরিবারের ওপর সে ধরনের প্রভাব মোদি রাখেন কিনা তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে।
বিজেপির পালে এই ঠাণ্ডা হাওয়ার কোনো সুফল কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছে না কংগ্রেস। বিভিন্ন রাজ্য নির্বাচনে তাদের আরো অবক্ষয়ের চিত্র ফুুটে উঠছে। দুই মেয়াদ দিল্লি শাসন করার পরও রাজ্য বিধানসভায় একটি আসনও দখল করতে পারেনি দলটি। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়াসও নজরে আসছে না কারো। এ অবস্থায় তাদের নতুন কিছু করতে হলে রাহুলকে দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প হলো প্রিয়াঙ্কাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা। তার খ্রিষ্টান স্বামী রবার্ট ভদ্রকে নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও তার পক্ষে এক ধরনের পুনরুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া হয়তোবা সম্ভব।
ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা হলো বিকল্প সেকুলার রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। দিল্লিতে আপের ভমিধস জয়, পশ্চিমবঙ্গে মমতার ভিত শক্ত থেকে যাওয়া, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে নতুন মেরুকরণ শক্তিমান তৃতীয় বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে ভারতের জন্য। চার প্রদেশের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে জয়ললিতা ও নবীন পট্টনায়কের অভিন্ন ফোরাম হলে চার বছর পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ভালো একটি সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবে তারা। এটি অবশ্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে।
লোকসভা নির্বাচনের পর যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে মহারাষ্ট্র হরিয়ানা আর ঝাড়খণ্ডে বিজেপি তার অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পেরেছে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনে সাফল্যের পথ ধরে কংগ্রেস জোটকে হারিয়ে সরকার গঠন করেছে এনডিএ। যদিও সেখানে বিজেপির সাথে শরিক দল শিবসেনার চলছে টানাপড়েন। হরিয়ানায়ও কংগ্রেসের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পেরেছে বিজেপি। বাকি দুটো রাজ্যে আগে থেকেই বিজেপির সরকার ছিল। তারা এবারো ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে। এর বাইরে জম্মু কাশ্মীরে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মুতে সাফল্য পেলেও কাশ্মীর উপত্যকার একটি সিটও পায়নি বিজেপি। ফলে তাদের ক্ষমতায় যেতে পিডিপি’র জুনিয়র পার্টনার হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে আসে সদ্য অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতে জয় পায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ)। লোকসভার সাত আসনের মধ্যে যেখানে সব ক’টিতে বিজেপি জয় পেয়েছিল, সেখানে বিধানসভায় এভাবে গো-হারা প্রধানমন্ত্রী মোদি আর বিজেপি উভয়ের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনের ফলাফল বিজেপির স্বপ্নযাত্রায় যেন আরো বড় আঘাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত বনগাঁওয়ের লোকসভা উপনির্বাচনে দুই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। একই সাথে কৃষ্ণপুরের বিধানসভা উপনির্বাচনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে বিজেপি তৃণমূলকে তছনছ করার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তার মাঝপথেই এসেছিল এই উপনির্বাচন। নির্বাচনের আগে মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে যেন দলত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। কেউ সারদার আঘাত থেকে বাঁচতে কেউবা তৃণমূলের ‘ডুবন্ত তরী’ থেকে সময়ের আগেই লাফ দিতে চেয়েছিল। এমনকি রাজ্যে মমতার ডান হাত বলে খ্যাত আর ইন্ডিয়া তৃণমূলের সেক্রেটারি মুকুল রায়ের দলত্যাগের গুঞ্জনও দিন দিন বাড়ছিল। এ সময়ে উপনির্বাচনের এই ফলাফল এক দিকে যেমন মমতার জন্য স্বস্তিকর, অন্য দিকে তেমনি শাসক দল ভেঙে ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ দখলের গেরোয়া স্বপ্নে একটি বড় ধরনের আঘাত।
সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে তৃণমূল বধ করার প্রচেষ্টায় মনে হয় উল্টো ফলই এসেছে। বরং মমতা সারদার কর্ণধারদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া এবং অন্যভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, তার প্রতি ভোটারদের আস্থার প্রকাশ পেয়েছে। বিজেপির সামনে এই বার্তা গেছে যে, সারদা দিয়ে তৃণমূলের সামনে খড়ক দাঁড় করানোর ফলাফল বিজেপির জন্য উল্টো ফলতে পারে। বছরখানেক পর পশ্চিম বঙ্গের নতুন বিধানসভা নির্বাচন আসার আগে হয়তো পানি আরো অনেকদূর গড়াবে। তত দিনে মোদি-হাওয়া আরো শীতল হয়ে যাবে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে গেরোয়া পতাকা উড়ানোর স্ব^প্ন অধরা থেকে যাওয়ার বার্তাই এখন মিলছে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্বাচন হবে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য বিহারে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি খেলার নতুন ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার দলের একবারে নি¤œবর্ণের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নেতা জিতেন রাম মানজিকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন। লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডির সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে তিনি এই পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে তিনি বিজেপির সাথে গোপন যোগসূত্র তৈরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত জেডিইউ’র এমপিদের এক সভায় তাকে দল ও মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ না করে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ধরে রেখেছে তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আস্থা ভোটে নিতিশেরই জয় হওয়ার কথা। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার জিতেনের পরামর্শে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি এবং নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। অথবা আস্থা ভোটে জিতেন ও নিতিশের ভাগ্য পরীক্ষা করতে পারে। অন্তরাল থেকে বিহারে বিজেপির জন্য এই খেলাধুলার ফল খুব একটা ভালো বলে মনে হচ্ছে না।
রাজ্যটিতে বিগত লোকসভা নির্বাচনে নিতিশের জেডিইউ এবং লালু প্রসাদের আরজেডি-কংগ্রেস জোটের মধ্যে ভোট বিভাজনের সুযোগে বিজেপি ও রাম বিলাস পাসোয়ানের কোয়ালিশন ভালো ফল করে। এখন নিতিশ লালুর সমঝোতা রাজ্যে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। জিতেন তার সহযোগীদের নিয়ে আলাদা দল তৈরি করার পর তাদের সাথে কোনো সমঝোতা করলেও বিহারে বিজেপি ভালো কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১৬ সালের মে মাসে আসাম কেরালা ও তামিলনাড়–তে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে তামিলনাড়–তে বিজেপির ভালো করার কোনো লক্ষণ নেই। একটি দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে জেলে পাঠানোর বিষয়টি বিজেপির জন্য খুব ভালো ফল আনতে পারেনি। ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতার এআইডিএমকের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।
কেরালায় বিজেপির কোনোকালেই ভালো ফলাফলের রেকর্ড নেই। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মোদি-হাওয়ার সময়ও সেখানে বিজেপি কিছুই করতে পারেনি। ভবিষ্যতে তেমন কিছু করতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই। আসামের রাজ্যক্ষমতা দখল করা বিজেপির অন্যতম লক্ষ্য। সেখানে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেস সরকার কার্যকর কিছু করতে পারছে না। এই স্থানিক বাস্তবতা ২০১৬ সালে বিজেপিকে একটি ইতিবাচক ফলে লাভের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
২০১৭ সালে অনেক রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মোদি বিদায় হওয়ার পর প্রথমবার রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হবে গুজরাটে। এই রাজ্যে বিজেপির শক্ত প্রভাব বলয় থাকায় পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা হয়তো দলটির নেই। তবে অন্য দলগুলো যেকোনো ঐক্য করে সম্মিলিতভাবে নির্বাচন করলে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আম আদমি পার্টি রাজ্য দখলের জন্য টার্গেট করেছে পাঞ্জাবকে। বিগত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে আপ চারটি আসনে জয় পেয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এগোতে পারলে সেখানে ভালো ফল করতে পারে দলটি। এখানে বিজেপির প্রভাব প্রতিপত্তি দল ক্ষমতায় থাকার পরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে।
ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন হবে বিজেপির জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানকার দুই বৃহৎ স্থানিক দল এসপি ও বিএসপির মধ্যে সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর সাথে কংগ্রেস যুক্ত হয়ে বৃহৎ কোনো নির্বাচনী জোট হলে বিজেপির লোকসভার সাফল্যের ঠিক উল্টো ফল হতে পারে সেখানে।
মাত্র এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কেন মোদি-হাওয়া উল্টোমুখী বইতে শুরু করল সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। ভারতের করপোরেট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় মোদি লোকসভা নির্বাচনের সময় যে আগ্রাসী প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন তার মূল ছিল উন্নয়ন সুশাসন কর্মসংস্থান। এর সাথে অন্তরালে সংঘ পরিবার হিন্দু জাতীয়তাবোধকে জাগাতে চেয়েছিল। ক্ষমতায় যাওয়ার পর মোদি এক বছরেও উন্নয়ন সুশাসনে বা কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সেভাবে কোনো কিছু করতে পারেননি। বরং এর মধ্যে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ব এজেন্ডা অনেকটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে, যার ফলে সংখ্যালঘু এবং সেকুলার ভারতীয়রা বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত আরএসএস প্রধান ভগবত সব ভারতীয়ের পরিচয় হিন্দু হতে হবে বলে উল্লেখ করার পর এ ব্যাপরে মোদির কোনো বক্তব্য না থাকাটা তার এজেন্ডা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে। এর সাথে ভারতের মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচির নামে হিন্দু করে ফেলার যে কর্মসূচি, সেটা মোদি শাসনের ব্যাপারে ভুল বার্তা দিয়েছে। দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে। এই আবহ থেকে সরে আসতে হলে হিন্দুত্ব এজেন্ডার রাস টানতে হবে মোদিকে। কিন্তু সংঘ পরিবারের ওপর সে ধরনের প্রভাব মোদি রাখেন কিনা তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে।
বিজেপির পালে এই ঠাণ্ডা হাওয়ার কোনো সুফল কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছে না কংগ্রেস। বিভিন্ন রাজ্য নির্বাচনে তাদের আরো অবক্ষয়ের চিত্র ফুুটে উঠছে। দুই মেয়াদ দিল্লি শাসন করার পরও রাজ্য বিধানসভায় একটি আসনও দখল করতে পারেনি দলটি। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়াসও নজরে আসছে না কারো। এ অবস্থায় তাদের নতুন কিছু করতে হলে রাহুলকে দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প হলো প্রিয়াঙ্কাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা। তার খ্রিষ্টান স্বামী রবার্ট ভদ্রকে নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও তার পক্ষে এক ধরনের পুনরুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া হয়তোবা সম্ভব।
ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা হলো বিকল্প সেকুলার রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। দিল্লিতে আপের ভমিধস জয়, পশ্চিমবঙ্গে মমতার ভিত শক্ত থেকে যাওয়া, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে নতুন মেরুকরণ শক্তিমান তৃতীয় বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে ভারতের জন্য। চার প্রদেশের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে জয়ললিতা ও নবীন পট্টনায়কের অভিন্ন ফোরাম হলে চার বছর পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ভালো একটি সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবে তারা। এটি অবশ্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে।
No comments