মুক্তিযুদ্ধের অনন্য চেতনা by ড. সুলতান মাহমুদ রানা
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। ওই সময়ে ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। তিনি ১৯৩৪ সালের ৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে রসায়ন বিষয়ে বিএসসি অনার্স, ১৯৫৪ সালে এমএসসি, ১৯৫৭ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। তিনি প্রশাসনিকভাবে ছিলেন যেমন অত্যন্ত দক্ষ, দায়িত্বশীল ও নীতিবান, তেমনি একাডেমিকভাবেও ছিলেন অতীব জ্ঞানী, গুণী ও আদর্শমানের শিক্ষক।
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উত্তাল বছর। এ বছরেই গণআন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং দেশের মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ও মুক্তিকামী রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়। সে সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে জেলের ভেতর গুলি করে হত্যা করে। হত্যার প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে তাতে পুলিশি হামলা হয় এবং বহু ছাত্র আহত হয়। এরই পাল্টা প্রতিবাদে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়। ওই সময় ১৪৪ ধারা অব্যাহত ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার সময় ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহরে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে সেনা মোতায়েন করা ছিল। একটি বিস্টেম্ফারনোন্মুখ অবস্থা তৈরি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ভাষাসংগ্রামী শামসুজ্জোহা স্পষ্টতই দেখতে পান আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থা বিবেচনা করে তিনি একবার সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন আবার ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখারও চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে তিনি ছাত্রদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং সেনা অফিসারদের নিজের পরিচয় দেন। কিন্তু সেনাসদস্যরা তার সব কথা উপেক্ষা করে বুলেট ও বেয়নেটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ও প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে।
ড. জোহার মৃত্যুর খবর ঢাকায় পেঁৗছামাত্র ঢাকার রাজপথ আন্দোলনকারীরা প্রকম্পিত করে তোলে। ছাত্র-জনতা সারারাত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঢাকার রাজপথে রক্তের স্রোত বয়ে যায় এবং ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরে আন্দোলনের মাত্রা এতটাই বেগবান হয় যে, বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের পাকিস্তান সরকার নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ড. জোহার মৃত্যু আইয়ুব সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। এভাবেই বাঙালিদের স্বাধিকারের সংগ্রাম স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়। তার আত্মত্যাগ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একটি মাইলফলক হিসেবে ড. জোহার মৃত্যু বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে ড. জোহাই ছিলেন প্রথম বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তার মৃত্যুর শোক বাঙালিদের শক্তিতে পরিণত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহার আত্মত্যাগের দিনটিকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে এই দিনটিকে জোহা দিবস এবং শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে এই দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করলে স্বাধীনতার চেতনার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলে মনে করি।
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬৯ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উত্তাল বছর। এ বছরেই গণআন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং দেশের মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ও মুক্তিকামী রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়। সে সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে জেলের ভেতর গুলি করে হত্যা করে। হত্যার প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে তাতে পুলিশি হামলা হয় এবং বহু ছাত্র আহত হয়। এরই পাল্টা প্রতিবাদে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়। ওই সময় ১৪৪ ধারা অব্যাহত ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার সময় ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহরে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে সেনা মোতায়েন করা ছিল। একটি বিস্টেম্ফারনোন্মুখ অবস্থা তৈরি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ভাষাসংগ্রামী শামসুজ্জোহা স্পষ্টতই দেখতে পান আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থা বিবেচনা করে তিনি একবার সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন আবার ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখারও চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে তিনি ছাত্রদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং সেনা অফিসারদের নিজের পরিচয় দেন। কিন্তু সেনাসদস্যরা তার সব কথা উপেক্ষা করে বুলেট ও বেয়নেটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ও প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে।
ড. জোহার মৃত্যুর খবর ঢাকায় পেঁৗছামাত্র ঢাকার রাজপথ আন্দোলনকারীরা প্রকম্পিত করে তোলে। ছাত্র-জনতা সারারাত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঢাকার রাজপথে রক্তের স্রোত বয়ে যায় এবং ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরে আন্দোলনের মাত্রা এতটাই বেগবান হয় যে, বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের পাকিস্তান সরকার নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ড. জোহার মৃত্যু আইয়ুব সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। এভাবেই বাঙালিদের স্বাধিকারের সংগ্রাম স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়। তার আত্মত্যাগ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একটি মাইলফলক হিসেবে ড. জোহার মৃত্যু বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে ড. জোহাই ছিলেন প্রথম বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তার মৃত্যুর শোক বাঙালিদের শক্তিতে পরিণত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহার আত্মত্যাগের দিনটিকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে এই দিনটিকে জোহা দিবস এবং শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে এই দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করলে স্বাধীনতার চেতনার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলে মনে করি।
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments