আফগানিস্তানে ইরানি প্রভাববলয় by মাসুম বিল্লাহ
নাইন-ইলেভেন
এবং এর জের ধরে আফগানিস্তান ইরাকে আমেরিকার সামরিক অভিযানের ফলে
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের ‘শক্তিশূন্যতা’ তৈরি হয়। এই সুযোগে ইরাক, সিরিয়া ও
লেবাননের শিয়া গ্রুপগুলোর সহায়তায় ওই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে ইরান, যা এক
সময় ন্যাটোর জন্য প্রধান উদ্বেগ ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানকে যখন একটি
সম্ভাব্য আঞ্চলিক শক্তি এবং এ অঞ্চলে আমেরিকা ও তার সবচেয়ে বড় মিত্র
ইসরাইলের স্বার্থ হাসিলের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল
তখনই তেহরানের জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয় আইএসআইএস। আমেরিকা এখন
ওই কট্টর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত। ফলে সিরিয়া-ইরান জোট
এবং সেই সাথে হিজবুল্লাহর মতো ‘রাষ্ট্রহীন সত্তা’র উত্থান মধ্যপ্রাচ্যে
ন্যাটোর জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করতে পেরেছে। পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর সেখানেও প্রভাববলয়
বিস্তারের কাজে নেমে পড়েছে ইরান। ১৯৮৯ সালে ইরানের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়
হিজবে ওয়াদাদ ইসলামি মারদুমই আফগাস্তিান। আফগানিস্তানের রাজনীতি ও সামরিক
ক্ষেত্রে এই দলটির রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। এই দলটি মূলত হাজারা
জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক। তারা দেশটির জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। হিজবে ওয়াদাদের
নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবদুল আলি মাজারি। তাদের মূল লক্ষ্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম
এবং নিপীড়িত হাজারা জনগণের জন্য ন্যায্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব
নিশ্চিতকরণ। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সুন্নি তালিবান গোষ্ঠীর পতনের পর
তেহরানের জন্য প্রতিবেশী দেশটিতে প্রভাববলয় বিস্তার বেশ সহজ হয়। বর্তমানে
দেশটির ওপর ইরানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রভাব
ব্যাপক।
২০০১ সালে বন-চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে শত বছরের পশতু আধিপত্যের অবসান ঘটে। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও সমান প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। নতুন প্রশাসনে তাজিক হাজারা ও উজবেকদের ব্যাপক প্রাধান্য দেখা যায়, যা আফগানিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারের জন্য ইরানের সামনে বড় ধরনের সুযোগ এনে দেয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে তা দেশটির ওপর তেহরানের প্রভাবকে আরো সুসংহত করবে বলে ধরে নেয়া যায়। বর্তমানে আফগানিস্তানের অবকাঠামো, শিল্প ও খনি উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে ইরান। ২০০২ সাল থেকে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবেশী দেশটিতে ইরানের রফতানি দুই বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। শিগগিরই এই অঙ্ক ছয় বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে একটি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে ইরান। পাশাপাশি সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিয়া ধর্মীয় ভাবধারা বিস্তার করে চলেছে তেহরান।
আফগানিস্তানে ইরানের মূল্য লক্ষ্য পাঁচটি। প্রথমত ইরানি স্বার্থের অনুকুল একটি স্থিতিশীল সরকার কাবুলের ক্ষমতায় বসানো। যার মানে হলো আফগান রাজনীতিতে পশতুদের আধিপত্য কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত তাজিক ও হাজারা গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা। তৃতীয়ত দেশটি থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর পুরোপুরি প্রত্যাহার। চতুর্থত আফগান রাজনীতিতে পাকিস্তান ও সৌদি প্রভাব প্রতিরোধ এবং পঞ্চমত আফগানিস্তানে আলকায়দা ও তালেবান শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন আরেকটি সুন্নি-সালাফি আন্দোলনের পুনরুত্থান প্রতিরোধ।
ইরান আসলে আফগানিস্তানে একটি ‘ডুয়েল কনটেইনমেন্ট পলিসি’ বা ‘দ্বৈত সংবরণ নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে। একদিকে যেমন ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবান বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে তেমনি ‘দারি’ ভাষাভাষী তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। ২০১১ সালে ন্যাটো বাহিনীর হাতে আটক হেলমন্দ প্রদেশের এক তালেবান কমান্ডার স্বীকার করেছেন যে একটি বাঁধ ধ্বংস করার জন্য ইরান তার বাহিনীকে ৫০ হাজার ডলার দিতে চেয়েছে। এ ছাড়া ইরানের তালেবানদের সহায়তা করার অনেক নজির রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ন্যাটো বাহিনীর ওপর হামলার জন্য তালেবানদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইরান সহায়তা করে। ২০১০ সালে ইরান সরকার আফগানিস্তানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কাবুলে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চার ডজন ১২২ মিলিমিটার রকেটের একটি চালান ইরান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশের সময় ন্যাটো সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে। এ ছাড়া ‘কুদস বাহিনী’ ইরানের অভ্যন্তরে একটি সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করছে বলে আফগান গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ডাইরেক্টরেট অব সিকিউরিটি’ (এনডিএস) অভিযোগ করে।
আফগানিস্তানকে ঘিরে তেহরানের পররাষ্ট্রনীতি ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য আমাদের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনার দিকেও নজর দিতে হবে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে ইরান তার পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা থেকে সরে আসতে চায়। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা কেবল তখনই আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীকে সহায়তায় রাজি হবে যদি তাদের নিজেদের মতো করে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়। ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার আফগান নীতিকে নিজের অনুকূলে আনতে ইরানের সামনে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই ইরান পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে সুবিধা পেতে ন্যাটো-উত্তর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার গ্যারান্টিকে কাজে লাগাতে চাইবে।
আইএসআইএসের উত্থান ইরানের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। আইএসআইএস এবং অন্যান্য জিহাদি গ্রুপের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান মিত্র সিরিয়া বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে যেকোনো প্রকারে তেহরান আসাদ সরকার-কে সহায়তা দান এবং আইএসআইএসকে ধ্বংসে বদ্ধপরিকর। আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনী সরে গেলে সেখানেও এই জিহাদি গ্রুপটির বিস্তার ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে গ্রুপটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জনবল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে বলে গত মাসে মার্কিন জেনারেল জন ক্যাম্পবেল জানান। আফগানিস্তানে আইএসআইএস-এর উপস্থিতি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। কারণ এতে সুন্নি-সালাফি চরমপন্থীদের দ্বারা দুই দিক দিয়েই ঘেরাও হয়ে পড়বে দেশটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ইরানের বিচক্ষণ নেতা হাসান রুহানি আফগানিস্তান থেকে তালেবান বিদ্রোহীদের নির্মূলে ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীর সাথে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন যেন দেশটি আইএসআইএস-এর খপ্পরে না পড়ে। পাশাপাশি ইরান আফগানিস্তানের দারি ভাষাভাষী তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠীর সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে। তারা দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক। আফগানিস্তানের বাইরে থাকা আফগানি শিয়াগোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যে ইরানের সাথে সংহতি প্রকাশ শুরু করেছে। বিশেষ করে এমন কয়েকটি গ্রুপ সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষে লড়ছে।
কেউ কেউ বলছেন ইরানের সবচেয়ে গোপন বাহিনী কুদস বাহিনী আফগানিস্তানে হিজবে ওয়াদাদের মতো একটি শিয়া যোদ্ধাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন বাহিনী বিদায়ের পর আফগানিস্তানে আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আফগান গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান আমরুল্লাহ সালেহের মতে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের কাজে ইরান তার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করেছে। এগুলো হলো কোমকেন্দ্রিক ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী। তাদের কাজ হলো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে (মিসর থেকে পাকিস্তান) সংখ্যালঘু শিয়া গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সরাসরি সমর্থন জানিয়ে ইরানের ‘নমনীয় শক্তি’ ও ‘শিয়া রাজনৈতিক প্রভাব’ বিস্তারে সহায়তা করা। এরপর আছে গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়। ইরানি বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের কাজ হলো আফগানিস্তানের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, পানি ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধান লক্ষ্য। তাদের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ। আর রয়েছে ইরানের বিপ্লবী রক্ষী সেনা। সালেহের মতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানোর জন্য কুদস বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পারস্পরিক ভিসামুক্তির সুযোগে ইরানের অনেক বিপ্লবী গার্ড সদস্য ও গোয়েন্দা আফগানিস্তানে ঢুকে পড়েছে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য।
গত ১৫ জানুয়ারি কাবুল ও তেহরানের মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর নতুন আফগান প্রেসিডেন্ট ইরানের সাথেও একটি নিরাপত্তা চুক্তি করতে চান। এর লক্ষ্য হচ্ছে সন্ত্রাস ও আন্তঃসীমান্ত মাদক পাচার বন্ধে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার। প্রেসিডেন্ট ঘানি পাকিস্তান সফর থেকে আসার পর এই খবর প্রকাশ পায়। ঘানি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান সরকারের সহায়তা কামনা করেন। ইরান কয়েক দশক ধরে হিজবে ওয়াদাদকে প্রশিক্ষণ, অর্থ ও সামরিক সাহায্য দিয়ে গেলেও কাবুলে ক্ষমতার কেন্দ্রে যেসব হাজারা রয়েছে তাদের নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়ে গেছে দেশটি। এটা আসলে ১৯৯০-এর দশকে আফগান গৃহযুদ্ধ থেকে লাভ করা অভিজ্ঞতা। তখনো ইরান আফগানিস্তানে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করেছে। আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে তাজিক কোয়ালিশন ফোর্সের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিজবে ওয়াদাদকে সহায়তা দিয়েছে ইরান। আবার তারা যখন কাবুলে পরস্পরের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয় তখন উভয় পক্ষকে সামরিক সহায়তা দেয় তারা। অনেক সচেতন হাজারা ইরানকে বিশ্বাস করে না বরং তারা ১০৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্তি উসকে দেয়ার জন্য তেহরানকে দায়ী করে। ২০১১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে ভোট দিতে লয়া জিরগার (আফগান পার্লামেন্ট) বহু প্রবীণ সদস্যকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছে। যদিও চুক্তির পক্ষেই ভোট দেন ওই সব প্রবীণ। আশরাফ ঘানির নতুন সরকার চুক্তিটি অনুমোদন এবং অনুস্বাক্ষরের কাজ সম্পন্ন করে। এ থেকে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আফগানবাসী ইরান ও পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে নিতে আগ্রহী।
২০০১ সালে বন-চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে শত বছরের পশতু আধিপত্যের অবসান ঘটে। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও সমান প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। নতুন প্রশাসনে তাজিক হাজারা ও উজবেকদের ব্যাপক প্রাধান্য দেখা যায়, যা আফগানিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারের জন্য ইরানের সামনে বড় ধরনের সুযোগ এনে দেয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে তা দেশটির ওপর তেহরানের প্রভাবকে আরো সুসংহত করবে বলে ধরে নেয়া যায়। বর্তমানে আফগানিস্তানের অবকাঠামো, শিল্প ও খনি উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে ইরান। ২০০২ সাল থেকে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবেশী দেশটিতে ইরানের রফতানি দুই বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। শিগগিরই এই অঙ্ক ছয় বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে একটি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে ইরান। পাশাপাশি সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিয়া ধর্মীয় ভাবধারা বিস্তার করে চলেছে তেহরান।
আফগানিস্তানে ইরানের মূল্য লক্ষ্য পাঁচটি। প্রথমত ইরানি স্বার্থের অনুকুল একটি স্থিতিশীল সরকার কাবুলের ক্ষমতায় বসানো। যার মানে হলো আফগান রাজনীতিতে পশতুদের আধিপত্য কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত তাজিক ও হাজারা গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা। তৃতীয়ত দেশটি থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর পুরোপুরি প্রত্যাহার। চতুর্থত আফগান রাজনীতিতে পাকিস্তান ও সৌদি প্রভাব প্রতিরোধ এবং পঞ্চমত আফগানিস্তানে আলকায়দা ও তালেবান শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন আরেকটি সুন্নি-সালাফি আন্দোলনের পুনরুত্থান প্রতিরোধ।
ইরান আসলে আফগানিস্তানে একটি ‘ডুয়েল কনটেইনমেন্ট পলিসি’ বা ‘দ্বৈত সংবরণ নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে। একদিকে যেমন ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবান বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে তেমনি ‘দারি’ ভাষাভাষী তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। ২০১১ সালে ন্যাটো বাহিনীর হাতে আটক হেলমন্দ প্রদেশের এক তালেবান কমান্ডার স্বীকার করেছেন যে একটি বাঁধ ধ্বংস করার জন্য ইরান তার বাহিনীকে ৫০ হাজার ডলার দিতে চেয়েছে। এ ছাড়া ইরানের তালেবানদের সহায়তা করার অনেক নজির রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ন্যাটো বাহিনীর ওপর হামলার জন্য তালেবানদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইরান সহায়তা করে। ২০১০ সালে ইরান সরকার আফগানিস্তানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কাবুলে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চার ডজন ১২২ মিলিমিটার রকেটের একটি চালান ইরান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশের সময় ন্যাটো সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে। এ ছাড়া ‘কুদস বাহিনী’ ইরানের অভ্যন্তরে একটি সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করছে বলে আফগান গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ডাইরেক্টরেট অব সিকিউরিটি’ (এনডিএস) অভিযোগ করে।
আফগানিস্তানকে ঘিরে তেহরানের পররাষ্ট্রনীতি ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য আমাদের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনার দিকেও নজর দিতে হবে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে ইরান তার পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা থেকে সরে আসতে চায়। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা কেবল তখনই আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীকে সহায়তায় রাজি হবে যদি তাদের নিজেদের মতো করে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়। ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার আফগান নীতিকে নিজের অনুকূলে আনতে ইরানের সামনে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই ইরান পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে সুবিধা পেতে ন্যাটো-উত্তর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার গ্যারান্টিকে কাজে লাগাতে চাইবে।
আইএসআইএসের উত্থান ইরানের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। আইএসআইএস এবং অন্যান্য জিহাদি গ্রুপের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান মিত্র সিরিয়া বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে যেকোনো প্রকারে তেহরান আসাদ সরকার-কে সহায়তা দান এবং আইএসআইএসকে ধ্বংসে বদ্ধপরিকর। আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনী সরে গেলে সেখানেও এই জিহাদি গ্রুপটির বিস্তার ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে গ্রুপটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জনবল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে বলে গত মাসে মার্কিন জেনারেল জন ক্যাম্পবেল জানান। আফগানিস্তানে আইএসআইএস-এর উপস্থিতি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। কারণ এতে সুন্নি-সালাফি চরমপন্থীদের দ্বারা দুই দিক দিয়েই ঘেরাও হয়ে পড়বে দেশটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ইরানের বিচক্ষণ নেতা হাসান রুহানি আফগানিস্তান থেকে তালেবান বিদ্রোহীদের নির্মূলে ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীর সাথে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন যেন দেশটি আইএসআইএস-এর খপ্পরে না পড়ে। পাশাপাশি ইরান আফগানিস্তানের দারি ভাষাভাষী তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠীর সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে। তারা দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক। আফগানিস্তানের বাইরে থাকা আফগানি শিয়াগোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যে ইরানের সাথে সংহতি প্রকাশ শুরু করেছে। বিশেষ করে এমন কয়েকটি গ্রুপ সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষে লড়ছে।
কেউ কেউ বলছেন ইরানের সবচেয়ে গোপন বাহিনী কুদস বাহিনী আফগানিস্তানে হিজবে ওয়াদাদের মতো একটি শিয়া যোদ্ধাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন বাহিনী বিদায়ের পর আফগানিস্তানে আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আফগান গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান আমরুল্লাহ সালেহের মতে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের কাজে ইরান তার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করেছে। এগুলো হলো কোমকেন্দ্রিক ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী। তাদের কাজ হলো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে (মিসর থেকে পাকিস্তান) সংখ্যালঘু শিয়া গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সরাসরি সমর্থন জানিয়ে ইরানের ‘নমনীয় শক্তি’ ও ‘শিয়া রাজনৈতিক প্রভাব’ বিস্তারে সহায়তা করা। এরপর আছে গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়। ইরানি বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের কাজ হলো আফগানিস্তানের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, পানি ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধান লক্ষ্য। তাদের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ। আর রয়েছে ইরানের বিপ্লবী রক্ষী সেনা। সালেহের মতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানোর জন্য কুদস বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পারস্পরিক ভিসামুক্তির সুযোগে ইরানের অনেক বিপ্লবী গার্ড সদস্য ও গোয়েন্দা আফগানিস্তানে ঢুকে পড়েছে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য।
গত ১৫ জানুয়ারি কাবুল ও তেহরানের মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর নতুন আফগান প্রেসিডেন্ট ইরানের সাথেও একটি নিরাপত্তা চুক্তি করতে চান। এর লক্ষ্য হচ্ছে সন্ত্রাস ও আন্তঃসীমান্ত মাদক পাচার বন্ধে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার। প্রেসিডেন্ট ঘানি পাকিস্তান সফর থেকে আসার পর এই খবর প্রকাশ পায়। ঘানি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান সরকারের সহায়তা কামনা করেন। ইরান কয়েক দশক ধরে হিজবে ওয়াদাদকে প্রশিক্ষণ, অর্থ ও সামরিক সাহায্য দিয়ে গেলেও কাবুলে ক্ষমতার কেন্দ্রে যেসব হাজারা রয়েছে তাদের নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়ে গেছে দেশটি। এটা আসলে ১৯৯০-এর দশকে আফগান গৃহযুদ্ধ থেকে লাভ করা অভিজ্ঞতা। তখনো ইরান আফগানিস্তানে দ্বৈতনীতি অবলম্বন করেছে। আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে তাজিক কোয়ালিশন ফোর্সের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিজবে ওয়াদাদকে সহায়তা দিয়েছে ইরান। আবার তারা যখন কাবুলে পরস্পরের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয় তখন উভয় পক্ষকে সামরিক সহায়তা দেয় তারা। অনেক সচেতন হাজারা ইরানকে বিশ্বাস করে না বরং তারা ১০৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্তি উসকে দেয়ার জন্য তেহরানকে দায়ী করে। ২০১১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিরুদ্ধে ভোট দিতে লয়া জিরগার (আফগান পার্লামেন্ট) বহু প্রবীণ সদস্যকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছে। যদিও চুক্তির পক্ষেই ভোট দেন ওই সব প্রবীণ। আশরাফ ঘানির নতুন সরকার চুক্তিটি অনুমোদন এবং অনুস্বাক্ষরের কাজ সম্পন্ন করে। এ থেকে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আফগানবাসী ইরান ও পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে নিতে আগ্রহী।
No comments