ওঁরাওরা ভুলতে বসেছে নিজের ভাষা কুঁড়ূখ by রাজীব নূর
বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও অনেক ভাষা আছে। সেসব ভাষায় শিক্ষা এবং ভাষার চর্চা ও ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন...
মিঠুন কুমার ওঁরাও। জাতিতে ওঁরাও। কিন্তু তার জানা নেই ওঁরাওদের নিজের ভাষা 'কুঁড়ূখ'।
আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিঠুনের ছাত্রজীবন শেষের পথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনও ফল প্রকাশিত হয়নি। নিজের ভাষা 'কুঁড়ূখ' কখনও শেখা হয়নি মিঠুনের। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মথুরাপুর নামে যে গ্রামটিতে তার বাড়ি, সেখানে ছোটবেলায় বাংলা ভাষায় পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। যে স্কুলে মিঠুনের হাতেখড়ি, সেই মথুরাপুর ফিডার বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা
খ্রিস্টান মিশনারিরা। স্কুলে তিনজন আদিবাসী এবং একজন বাঙালি শিক্ষক ছিলেন। প্রথমে স্কুলের পুরো খরচ তো বটেই, ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, কলমের খরচও দিত মিশনারিরা।
মিঠুনের ধারণা, মিশনারিরা খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে একসময় নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করে। পরে গ্রামের ওঁরাওরা ধান তুলে স্কুলটি চালু রাখে। আরও পরে স্কুলটির সঙ্গে ব্র্যাকসহ বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যুক্ত হয়। তবে এখনও সেখানে ওঁরাওদের নিজের ভাষায় শিক্ষাদানের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
মিঠুন নিজের ভাষা বলতে 'সাদরি'কে বোঝেন। অথচ ওঁরাওদের আদি ভাষা হলো 'কুঁড়ূখ'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র ওঁরাওরাই দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। 'কুঁড়ূখ' ভাষার নিজস্ব কোনো লিখিত বর্ণমালা নেই। নৃতাত্তি্বক দিক থেকেও এরা দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত। অবশ্য যেহেতু ওঁরাওদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য কালো গাত্র-বর্ণ, চুল কোঁকড়ানো, মাথা গোলাকৃতির এবং উচ্চতা মাঝারি_ সেহেতু এরা মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যের নয়। আজকাল ওঁরাওদের সাঁওতালদের সঙ্গে মিলিয়ে আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীভুক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। ওঁরাওরা ঠিক কোন নৃগোষ্ঠীভুক্ত, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভাষাবিচারে এরা নিঃসন্দেহে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সদস্য। তবে ওঁরাওদের বেশির ভাগ এখন আর 'কুঁড়ূখ' নয়, 'সাদরি' ভাষা ব্যবহার করে। প্রকৃতপক্ষে সাদরি একটি মিশ্র ভাষা বা লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা। সাদরি ভাষায় উর্দু, হিন্দি, মৈথিলী ও বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কার সমার্থক শব্দ হলো বাহক ভাষা বা সংযোগকারী ভাষা, যা বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে যোগাযোগের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ওঁরাওদের সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৯৯৬। তবে এ সংখ্যা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানালেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন। তিনি জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার প্রায় ৫০ হাজারের মতো ওঁরাও তাদের নিজের ভাষা কুঁড়ুখ জানে না। এই তিনটি জেলার ওঁরাও-অধ্যুষিত গ্রামগুলো অনুসন্ধান করে তারা এটি নিশ্চিত হয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র দুই প্রজন্ম আগে অনেকেরই দাদা-দাদি বা নানা-নানি কুঁড়ূখ জানতেন; কিন্তু ওই প্রজন্মের অনেকেই আর জীবিত নেই। এ তিন জেলার নতুন প্রজন্মের ওঁরাওদেরও জানা নেই যে তাদের মাতৃভাষা কুঁড়ুখ, সাদরি নয়! তবে দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার ওঁরাওরা এখনও কুঁড়ুখ ভাষা জানে।
আদিবাসী বিষয়ক গবেষক সালেক খোকন বলেন, দিনাজপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা কুড়ূখ ভাষা ব্যবহার করলেও সাদরি তাদের জানা আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সাদরিতে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে জানান, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগে দিনাজপুরে বহু সংখ্যক ওঁরাওদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে। নানা কারণে এখন দেশ থেকে ওঁরাও আদিবাসীরা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অতি নিঃশব্দে। একসময় ওঁরাও গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকত গ্রাম পরিষদের হাতে। ওঁরাওদের ভাষায় একে বলা হয় 'পাঞ্চেস'। একসময় বয়োবৃদ্ধ সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো গ্রাম পরিষদ। আবার পাঞ্চেসের ওপরের সংগঠনের নাম ছিল 'পাঁড়হা'। পাঁড়হা সাধারণত ৭ থেকে ১২টি আদিবাসী-অধ্যুষিত গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ওঁরাওদের আদি গ্রাম পরিষদের কাঠামো আর টিকে নেই। তার মতে, সামাজিক এসব সংগঠনের মতো তাদের ভাষাও আজ বিপন্ন। তিনি দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম টিনপাড়ায় সরেজমিন অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, টিনপাড়ার ওঁরাওরা দুটি ভাষায় কথা বলে_ একটি কুঁঁড়ূখ, অন্যটি সাদরি ভাষা। কারও নাম জানতে ওঁরাওরা কুঁঁড়ূখ ভাষায় বলে, 'নিহাই নাম এন্দা'; আর এ বাক্যটিই সাদরিতে বলা হয়, 'তোর নাম কা।' কেমন আছেন_ বাক্যটিকে কুঁড়ূখ ভাষায় বলে, 'একাশে রাদি।' আমি খাই_ বাক্যটিকে বলে, 'এঙ অনদান।' তুমি খেয়েছ_ বাক্যটিকে বলে, 'নিন ওন্ডকায়।' মাকে এরা 'মায়া', বোনকে 'বাহিন', সূর্যকে 'বেলা', ঝড়কে 'সাতোয়া', মাছকে 'মাছড়ি', নদীকে 'নাদি', মোরগকে 'কোকড়ো', কুড়ালকে 'টাঙিয়া', নাপিতকে 'নাউয়া' বলে। তার মতে, এমন দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের ওঁরাওরা কুঁড়ূখ ভুলে সাদরিকেই মূল ভাষা করে নেবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও ওঁরাওদের ভাষা সাদরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে 'ভাষা পরিবার :ইন্দো-ইউরোপীয়, ভাষিক এলাকা :বাংলাদেশ ও ভারত, ভাষা অঞ্চল :দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশে ভাষাভাষীর সংখ্যা :৮৫,০০০, লিপি :বাংলা ব্যবহৃত' বলে লেখা রয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক পুলক বরণ চাকমা বলেন, এটি হয়ে থাকলে ভুলবশত হয়েছে। সাদরি আসলে একটি মিশ্র ভাষা; ওঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, রাজোয়া, মাহাতো, মাহালি, কর্মকার, রবিদাস, কুলকামার, পাহান, রাই, তুরি, ভূমিজসহ উত্তরবঙ্গের অনেক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এ ভাষা ব্যবহার করে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গে আদিবাসীদের অনেকে সাদরিকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা সাদরির উপভাষাগত পার্থক্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভোজপুরি ভাষার সঙ্গে মিল থাকায় অনেকে একে ভোজপুরির উপভাগ বলেও মনে করেন। ড. জি এ গ্রিয়ারসন তার 'লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া'য় সাদরিকে কোনো পৃথক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত না করে আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীদের ভাববিনিময়ের একটি মিশ্র নতুন ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তবে বর্তমানে এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে এবং বাংলাদেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য প্রথম ধাপে যে কয়টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হচ্ছে, সাদরি তার একটি।
মিঠুন কুমার ওঁরাও। জাতিতে ওঁরাও। কিন্তু তার জানা নেই ওঁরাওদের নিজের ভাষা 'কুঁড়ূখ'।
আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিঠুনের ছাত্রজীবন শেষের পথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনও ফল প্রকাশিত হয়নি। নিজের ভাষা 'কুঁড়ূখ' কখনও শেখা হয়নি মিঠুনের। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মথুরাপুর নামে যে গ্রামটিতে তার বাড়ি, সেখানে ছোটবেলায় বাংলা ভাষায় পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। যে স্কুলে মিঠুনের হাতেখড়ি, সেই মথুরাপুর ফিডার বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা
খ্রিস্টান মিশনারিরা। স্কুলে তিনজন আদিবাসী এবং একজন বাঙালি শিক্ষক ছিলেন। প্রথমে স্কুলের পুরো খরচ তো বটেই, ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, কলমের খরচও দিত মিশনারিরা।
মিঠুনের ধারণা, মিশনারিরা খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে একসময় নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করে। পরে গ্রামের ওঁরাওরা ধান তুলে স্কুলটি চালু রাখে। আরও পরে স্কুলটির সঙ্গে ব্র্যাকসহ বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যুক্ত হয়। তবে এখনও সেখানে ওঁরাওদের নিজের ভাষায় শিক্ষাদানের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
মিঠুন নিজের ভাষা বলতে 'সাদরি'কে বোঝেন। অথচ ওঁরাওদের আদি ভাষা হলো 'কুঁড়ূখ'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র ওঁরাওরাই দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। 'কুঁড়ূখ' ভাষার নিজস্ব কোনো লিখিত বর্ণমালা নেই। নৃতাত্তি্বক দিক থেকেও এরা দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত। অবশ্য যেহেতু ওঁরাওদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য কালো গাত্র-বর্ণ, চুল কোঁকড়ানো, মাথা গোলাকৃতির এবং উচ্চতা মাঝারি_ সেহেতু এরা মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যের নয়। আজকাল ওঁরাওদের সাঁওতালদের সঙ্গে মিলিয়ে আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীভুক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। ওঁরাওরা ঠিক কোন নৃগোষ্ঠীভুক্ত, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভাষাবিচারে এরা নিঃসন্দেহে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সদস্য। তবে ওঁরাওদের বেশির ভাগ এখন আর 'কুঁড়ূখ' নয়, 'সাদরি' ভাষা ব্যবহার করে। প্রকৃতপক্ষে সাদরি একটি মিশ্র ভাষা বা লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা। সাদরি ভাষায় উর্দু, হিন্দি, মৈথিলী ও বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কার সমার্থক শব্দ হলো বাহক ভাষা বা সংযোগকারী ভাষা, যা বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে যোগাযোগের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ওঁরাওদের সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৯৯৬। তবে এ সংখ্যা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানালেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন। তিনি জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার প্রায় ৫০ হাজারের মতো ওঁরাও তাদের নিজের ভাষা কুঁড়ুখ জানে না। এই তিনটি জেলার ওঁরাও-অধ্যুষিত গ্রামগুলো অনুসন্ধান করে তারা এটি নিশ্চিত হয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র দুই প্রজন্ম আগে অনেকেরই দাদা-দাদি বা নানা-নানি কুঁড়ূখ জানতেন; কিন্তু ওই প্রজন্মের অনেকেই আর জীবিত নেই। এ তিন জেলার নতুন প্রজন্মের ওঁরাওদেরও জানা নেই যে তাদের মাতৃভাষা কুঁড়ুখ, সাদরি নয়! তবে দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার ওঁরাওরা এখনও কুঁড়ুখ ভাষা জানে।
আদিবাসী বিষয়ক গবেষক সালেক খোকন বলেন, দিনাজপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা কুড়ূখ ভাষা ব্যবহার করলেও সাদরি তাদের জানা আছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সাদরিতে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে জানান, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগে দিনাজপুরে বহু সংখ্যক ওঁরাওদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে। নানা কারণে এখন দেশ থেকে ওঁরাও আদিবাসীরা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অতি নিঃশব্দে। একসময় ওঁরাও গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকত গ্রাম পরিষদের হাতে। ওঁরাওদের ভাষায় একে বলা হয় 'পাঞ্চেস'। একসময় বয়োবৃদ্ধ সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো গ্রাম পরিষদ। আবার পাঞ্চেসের ওপরের সংগঠনের নাম ছিল 'পাঁড়হা'। পাঁড়হা সাধারণত ৭ থেকে ১২টি আদিবাসী-অধ্যুষিত গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ওঁরাওদের আদি গ্রাম পরিষদের কাঠামো আর টিকে নেই। তার মতে, সামাজিক এসব সংগঠনের মতো তাদের ভাষাও আজ বিপন্ন। তিনি দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম টিনপাড়ায় সরেজমিন অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, টিনপাড়ার ওঁরাওরা দুটি ভাষায় কথা বলে_ একটি কুঁঁড়ূখ, অন্যটি সাদরি ভাষা। কারও নাম জানতে ওঁরাওরা কুঁঁড়ূখ ভাষায় বলে, 'নিহাই নাম এন্দা'; আর এ বাক্যটিই সাদরিতে বলা হয়, 'তোর নাম কা।' কেমন আছেন_ বাক্যটিকে কুঁড়ূখ ভাষায় বলে, 'একাশে রাদি।' আমি খাই_ বাক্যটিকে বলে, 'এঙ অনদান।' তুমি খেয়েছ_ বাক্যটিকে বলে, 'নিন ওন্ডকায়।' মাকে এরা 'মায়া', বোনকে 'বাহিন', সূর্যকে 'বেলা', ঝড়কে 'সাতোয়া', মাছকে 'মাছড়ি', নদীকে 'নাদি', মোরগকে 'কোকড়ো', কুড়ালকে 'টাঙিয়া', নাপিতকে 'নাউয়া' বলে। তার মতে, এমন দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের ওঁরাওরা কুঁড়ূখ ভুলে সাদরিকেই মূল ভাষা করে নেবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও ওঁরাওদের ভাষা সাদরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে 'ভাষা পরিবার :ইন্দো-ইউরোপীয়, ভাষিক এলাকা :বাংলাদেশ ও ভারত, ভাষা অঞ্চল :দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশে ভাষাভাষীর সংখ্যা :৮৫,০০০, লিপি :বাংলা ব্যবহৃত' বলে লেখা রয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক পুলক বরণ চাকমা বলেন, এটি হয়ে থাকলে ভুলবশত হয়েছে। সাদরি আসলে একটি মিশ্র ভাষা; ওঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, রাজোয়া, মাহাতো, মাহালি, কর্মকার, রবিদাস, কুলকামার, পাহান, রাই, তুরি, ভূমিজসহ উত্তরবঙ্গের অনেক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এ ভাষা ব্যবহার করে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গে আদিবাসীদের অনেকে সাদরিকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা সাদরির উপভাষাগত পার্থক্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভোজপুরি ভাষার সঙ্গে মিল থাকায় অনেকে একে ভোজপুরির উপভাগ বলেও মনে করেন। ড. জি এ গ্রিয়ারসন তার 'লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া'য় সাদরিকে কোনো পৃথক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত না করে আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীদের ভাববিনিময়ের একটি মিশ্র নতুন ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তবে বর্তমানে এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে এবং বাংলাদেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য প্রথম ধাপে যে কয়টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হচ্ছে, সাদরি তার একটি।
No comments