আমাদের রাজনীতির ভাষা by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
রাজনীতির
ভাষা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশ্চাত্যে রাজনীতির ভাষা
নিয়ে রীতিমতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন কাজ হয়নি।
তবে প্রয়াত প্রফেসর ড. শামসুল হুদা হারুন নির্বাচনী রাজনীতির ভাষা নিয়ে
একটি চমকপ্রদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন (বাংলাদেশ ভোটিং বিহ্যাভিয়ার : এ
সিফোলজিক্যাল স্টাডি ১৯৭৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। রাজনীতির ভাষা নিয়ে ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের চতুরঙ্গে একটি মজার নিবন্ধ দেখেছিলাম। বাংলাদেশে অধুনালুপ্ত
সচিত্র স্বদেশ পত্রিকায় দেয়াললিখন নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী হতে দেখেছি।
এক্ষেত্রে আমার সামান্য কাজ আছে (সমকালীন রাজনীতির ভাষা, আফসার ব্রাদার্স)।
সে সময়ের রাজনীতির ভাষা ছিল সুন্দর, সাবলীল ও গতানুগতিক। বর্তমান যুগে
বিশেষত এ সময়ে রাজনীতির ভাষার নমুনা দেখে রাজনীতিকদের মান নির্ণয় করা যায়।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুধাবন করা যায়।
হঠাৎ করেই রাজনীতির ভাষার এ পরিবর্তন হয়নি। সন্দেহ নেই, একটি অন্ধকার সময় কেটেছে আমাদের। ৯০-এর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পর রাজনীতির গুণগত ও মাত্রাগত উন্নয়ন ঘটবে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং গণতন্ত্রের আদর্শ সর্বত্র প্রতিফলিত হবে- এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। তা হয়নি। হয়েছে বিপরীতটি। গত ২৪ বছরের সংসদীয় রাজনীতির ভাষা আমাদের হতাশ করে। হাটে-মাঠে-ঘাটে এবং জনসভার ময়দানে আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যে ভাষায় কথা বলেন, সাধারণ মানুষ তা প্রত্যাশা করে না। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন আমরা আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের রাজনীতির ভাষার তাৎপর্য ভালোভাবে বোঝার জন্য বিগত এক মাসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি ও সংলাপ হুবহু তুলে ধরা হল (একই ধরনের বক্তব্য প্রকাশে একটু-আধটু শাব্দিক হেরফের হতে পারে। ইংরেজি থেকে অনুবাদেও সে রকম পার্থক্য থাকতে পারে। উদ্ধৃতিগুলো পত্রিকায় প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হল)।
সরকারি দলের ভাষা : সরকারই যেহেতু রাজনীতির মালিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ধারক-বাহক সেজন্য সরকারের রাজনীতির ভাষা বোঝা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিবৃতিগুলো এরূপ :
* আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে লাঠি দিয়ে মোকাবেলা করবে। পরে পায়ে গুলি করবে। পায়ে গুলিতে কাজ না হলে পরিস্থিতি বুঝে বুকে গুলি করবে- মঈন উদ্দীন খান বাদল, জাসদের কার্যকরী সভাপতি, ১৩ জানুয়ারি।
* শ্রমিক ও মালিকরা পোড়া গাড়ি দিয়ে আপনার অফিস ঘেরাও করবে। আপনার নেতাদের সরবরাহকৃত খাবার আপনার রুম পর্যন্ত পৌঁছতে দেয়া হবে না। আপনি সেখানে না খেয়ে মরে পড়ে থাকবেন। ...হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করলে আপনার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়া হবে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ৩১ জানুয়ারি।
* সরকার খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসের লাইন কাটেনি, চলমান অবরোধে বিরক্ত বিদ্যুৎ কর্মচারী ও শ্রমিকরা কাজটি করেছে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ১ ফেব্রুয়ারি।
* যারা এই অরাজকতার মধ্যে সংলাপের জন্য চাপ দিচ্ছে, তারা ক্যান্সারের মতো, তারা বিষফোঁড়া- খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ২ ফেব্রুয়ারি।
* নাশকতা ও মানুষ হত্যার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। চাইলে তাকে অনেক কিছু করা যায়। তবে এ মুহূর্তে কিছুই করতে চাই না- আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২ ফেব্রুয়ারি।
* যারা খালেদা জিয়ার অফিসের ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দিয়েছে, আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই- আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ, ৩ ফেব্রুয়ারি।
* এটা মনে হয় আমাদের থ্রেট করার জন্য করেছে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, গাবতলীতে মন্ত্রীদের অবস্থানকালে বাসে আগুন দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে, ৪ ফেব্রুয়ারি।
* প্রত্যাশা করছি, পরিস্থিতি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হবে- অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* কথা দিলাম আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে- আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউল আলম হানিফ, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* খালেদা জিয়া স্টুপিড লিডার (নির্বোধ নেত্রী)। তার কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ও মানবতাবিরোধী- অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* খালেদা জিয়া এ দেশ চান না, তিনি এ দেশকে পাকিস্তান বানাতে চান। তিনি আল্লাহর ইশারাও বোঝেন না। সে যখন বলল, বোমা বানাইতেছে আওয়ামী লীগের লোক। তখনই ছাত্রদলের এক নেতার হাত বোমায় ঝলসে গেল। উনি পেট্রলবোমা মাইর্যা অনেক মায়ের কোল খালি করছেন। তাই কথা নাই বার্তা নাই বিদেশেই তার ছেলে মইর্যা গেল- কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* আপনি যে রক্ত ঝরিয়েছেন, প্রতি ফোঁটা রক্তের হিসাব নেয়া হবে। নির্বাচন হবে, তবে ২০১৯ সালে। সংলাপও হবে ২০১৯ সালে- স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বলছেন আগুন-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। সব আলোচনা হবে, তবে এখনই তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। আগুনে পোড়াদের মাড়িয়ে আমরা সংলাপ করতে পারি না- তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* সুশীল সমাজের লোকেরা কেবল উপদেশ দেয়। তারা হচ্ছে সমাজে ক্যান্সারের মতো। এরা পরগাছা, এরা বিষফোঁড়া। সুশীল সমাজ নামক বিষফোঁড়াকে অবশ্যই সমাজ থেকে মূলোৎপাটন করতে হবে- খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* সংলাপের উদ্যোক্তারা এক-এগারোর কুশীলব- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১০ ফেব্রুয়ারি।
* গণমাধ্যম যদি একদিন তথাকথিত হরতাল-অবরোধের খবর প্রচার না করত, তখন এমনি তা বন্ধ হয়ে যেত- পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ১১ ফেব্রুয়ারি।
বিরোধী দল : গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারের অংশ। দেশে এ সময় সংসদীয় বিরোধী দল নেই বলা যায়। সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি তুলে ধরা হল :
* কিসের পরীক্ষা কিসের কী? আগে আইনের শাসন দরকার- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ প্রসঙ্গে বিবিসি সংলাপে, ১ ফেব্রুয়ারি।
* নিকৃষ্ট নির্মমতা- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়ার পর, ১ ফেব্রুয়ারি।
* ঢাকা সিটিকে আওয়ামী দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকারের পতন হবে- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* আমরা বারবার বলেছি আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ৬ ফেব্রুয়ারি।
আইনশৃংখলায় নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা : আইনশৃংখলায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। নিচের উদ্ধৃতিগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য বলে সমালোচিত হওয়ায় উল্লেখ করা হল :
* সরকার কেন ক্ষতিপূরণ দেবে? যারা গুলশানে বসে নাশকতা করছে, আদেশ দিচ্ছে, তাদের থেকে ক্ষতিপূরণ কেন আপনারা দাবি করছেন না? কেন তাদের বিরুদ্ধে আপনারা মামলা করছেন না! মামলা করুন শত শত- পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক, বাস মালিকদের প্রতি, ৪ ফেব্রুয়ারি।
* অগ্নিসংযোগে মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি ব্যক্তির বিপরীতে দুটি মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে- চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ, বার্ন ইউনিট পরিদর্শন করতে গিয়ে, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* যদি দেখা যায় গাড়িতে কেউ এ রকম বোমা মারছে, সাথে সাথে গুলি- অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ৭ ফেব্রুয়ারি।
* অপরাধ দমন করতেই সরকার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, হাডুডু খেলার জন্য নয়- র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ৭ ফেব্রুয়ারি।
* কেউ যদি নাশকতার ঘটনা ঘটায়, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে গুলি করবে। একই কাজ বিজিবি ও র্যাবও করবে- চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার, ৭ ফেব্রুয়ারি।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায় উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে (এ স্বল্প পরিসরে সব উদ্ধৃতি প্রকাশ সম্ভব নয়। শুধু প্রতীকী অর্থে বিবৃতিগুলো গ্রহণ করতে হবে)। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এসব বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে কথা বলাও যে বিপজ্জনক তা উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যাবে। গতানুগতিকভাবে প্রথমত সরকারি দল, দ্বিতীয়ত বিরোধী দল এবং তৃতীয়ত প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য উল্লেখ করলাম। নিজে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। রাজনীতির ভাষা দেখে, কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ দেখে হিসাব মেলানো কঠিন। তবে যাদের বোঝার তারা যদি বোঝেন তাহলেই ভালো। সুতরাং আমাদের মতো আম আদমিদের আবেদন হতে পারে : বুঝহ হে সুজন।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
হঠাৎ করেই রাজনীতির ভাষার এ পরিবর্তন হয়নি। সন্দেহ নেই, একটি অন্ধকার সময় কেটেছে আমাদের। ৯০-এর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পর রাজনীতির গুণগত ও মাত্রাগত উন্নয়ন ঘটবে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং গণতন্ত্রের আদর্শ সর্বত্র প্রতিফলিত হবে- এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। তা হয়নি। হয়েছে বিপরীতটি। গত ২৪ বছরের সংসদীয় রাজনীতির ভাষা আমাদের হতাশ করে। হাটে-মাঠে-ঘাটে এবং জনসভার ময়দানে আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যে ভাষায় কথা বলেন, সাধারণ মানুষ তা প্রত্যাশা করে না। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন আমরা আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের রাজনীতির ভাষার তাৎপর্য ভালোভাবে বোঝার জন্য বিগত এক মাসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি ও সংলাপ হুবহু তুলে ধরা হল (একই ধরনের বক্তব্য প্রকাশে একটু-আধটু শাব্দিক হেরফের হতে পারে। ইংরেজি থেকে অনুবাদেও সে রকম পার্থক্য থাকতে পারে। উদ্ধৃতিগুলো পত্রিকায় প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হল)।
সরকারি দলের ভাষা : সরকারই যেহেতু রাজনীতির মালিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ধারক-বাহক সেজন্য সরকারের রাজনীতির ভাষা বোঝা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিবৃতিগুলো এরূপ :
* আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে লাঠি দিয়ে মোকাবেলা করবে। পরে পায়ে গুলি করবে। পায়ে গুলিতে কাজ না হলে পরিস্থিতি বুঝে বুকে গুলি করবে- মঈন উদ্দীন খান বাদল, জাসদের কার্যকরী সভাপতি, ১৩ জানুয়ারি।
* শ্রমিক ও মালিকরা পোড়া গাড়ি দিয়ে আপনার অফিস ঘেরাও করবে। আপনার নেতাদের সরবরাহকৃত খাবার আপনার রুম পর্যন্ত পৌঁছতে দেয়া হবে না। আপনি সেখানে না খেয়ে মরে পড়ে থাকবেন। ...হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করলে আপনার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়া হবে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ৩১ জানুয়ারি।
* সরকার খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসের লাইন কাটেনি, চলমান অবরোধে বিরক্ত বিদ্যুৎ কর্মচারী ও শ্রমিকরা কাজটি করেছে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ১ ফেব্রুয়ারি।
* যারা এই অরাজকতার মধ্যে সংলাপের জন্য চাপ দিচ্ছে, তারা ক্যান্সারের মতো, তারা বিষফোঁড়া- খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ২ ফেব্রুয়ারি।
* নাশকতা ও মানুষ হত্যার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। চাইলে তাকে অনেক কিছু করা যায়। তবে এ মুহূর্তে কিছুই করতে চাই না- আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২ ফেব্রুয়ারি।
* যারা খালেদা জিয়ার অফিসের ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দিয়েছে, আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই- আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ, ৩ ফেব্রুয়ারি।
* এটা মনে হয় আমাদের থ্রেট করার জন্য করেছে- নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, গাবতলীতে মন্ত্রীদের অবস্থানকালে বাসে আগুন দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে, ৪ ফেব্রুয়ারি।
* প্রত্যাশা করছি, পরিস্থিতি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হবে- অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* কথা দিলাম আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে- আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউল আলম হানিফ, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* খালেদা জিয়া স্টুপিড লিডার (নির্বোধ নেত্রী)। তার কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ও মানবতাবিরোধী- অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* খালেদা জিয়া এ দেশ চান না, তিনি এ দেশকে পাকিস্তান বানাতে চান। তিনি আল্লাহর ইশারাও বোঝেন না। সে যখন বলল, বোমা বানাইতেছে আওয়ামী লীগের লোক। তখনই ছাত্রদলের এক নেতার হাত বোমায় ঝলসে গেল। উনি পেট্রলবোমা মাইর্যা অনেক মায়ের কোল খালি করছেন। তাই কথা নাই বার্তা নাই বিদেশেই তার ছেলে মইর্যা গেল- কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* আপনি যে রক্ত ঝরিয়েছেন, প্রতি ফোঁটা রক্তের হিসাব নেয়া হবে। নির্বাচন হবে, তবে ২০১৯ সালে। সংলাপও হবে ২০১৯ সালে- স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বলছেন আগুন-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। সব আলোচনা হবে, তবে এখনই তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। আগুনে পোড়াদের মাড়িয়ে আমরা সংলাপ করতে পারি না- তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* সুশীল সমাজের লোকেরা কেবল উপদেশ দেয়। তারা হচ্ছে সমাজে ক্যান্সারের মতো। এরা পরগাছা, এরা বিষফোঁড়া। সুশীল সমাজ নামক বিষফোঁড়াকে অবশ্যই সমাজ থেকে মূলোৎপাটন করতে হবে- খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ৯ ফেব্রুয়ারি।
* সংলাপের উদ্যোক্তারা এক-এগারোর কুশীলব- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১০ ফেব্রুয়ারি।
* গণমাধ্যম যদি একদিন তথাকথিত হরতাল-অবরোধের খবর প্রচার না করত, তখন এমনি তা বন্ধ হয়ে যেত- পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ১১ ফেব্রুয়ারি।
বিরোধী দল : গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারের অংশ। দেশে এ সময় সংসদীয় বিরোধী দল নেই বলা যায়। সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি তুলে ধরা হল :
* কিসের পরীক্ষা কিসের কী? আগে আইনের শাসন দরকার- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ প্রসঙ্গে বিবিসি সংলাপে, ১ ফেব্রুয়ারি।
* নিকৃষ্ট নির্মমতা- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়ার পর, ১ ফেব্রুয়ারি।
* ঢাকা সিটিকে আওয়ামী দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকারের পতন হবে- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* আমরা বারবার বলেছি আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ৬ ফেব্রুয়ারি।
আইনশৃংখলায় নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা : আইনশৃংখলায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। নিচের উদ্ধৃতিগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য বলে সমালোচিত হওয়ায় উল্লেখ করা হল :
* সরকার কেন ক্ষতিপূরণ দেবে? যারা গুলশানে বসে নাশকতা করছে, আদেশ দিচ্ছে, তাদের থেকে ক্ষতিপূরণ কেন আপনারা দাবি করছেন না? কেন তাদের বিরুদ্ধে আপনারা মামলা করছেন না! মামলা করুন শত শত- পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক, বাস মালিকদের প্রতি, ৪ ফেব্রুয়ারি।
* অগ্নিসংযোগে মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি ব্যক্তির বিপরীতে দুটি মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে- চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ, বার্ন ইউনিট পরিদর্শন করতে গিয়ে, ৫ ফেব্রুয়ারি।
* যদি দেখা যায় গাড়িতে কেউ এ রকম বোমা মারছে, সাথে সাথে গুলি- অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ৭ ফেব্রুয়ারি।
* অপরাধ দমন করতেই সরকার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, হাডুডু খেলার জন্য নয়- র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ৭ ফেব্রুয়ারি।
* কেউ যদি নাশকতার ঘটনা ঘটায়, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে গুলি করবে। একই কাজ বিজিবি ও র্যাবও করবে- চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার, ৭ ফেব্রুয়ারি।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায় উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে (এ স্বল্প পরিসরে সব উদ্ধৃতি প্রকাশ সম্ভব নয়। শুধু প্রতীকী অর্থে বিবৃতিগুলো গ্রহণ করতে হবে)। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এসব বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে কথা বলাও যে বিপজ্জনক তা উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যাবে। গতানুগতিকভাবে প্রথমত সরকারি দল, দ্বিতীয়ত বিরোধী দল এবং তৃতীয়ত প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য উল্লেখ করলাম। নিজে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। রাজনীতির ভাষা দেখে, কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ দেখে হিসাব মেলানো কঠিন। তবে যাদের বোঝার তারা যদি বোঝেন তাহলেই ভালো। সুতরাং আমাদের মতো আম আদমিদের আবেদন হতে পারে : বুঝহ হে সুজন।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments