দেশটি শুধু রাজনীতিবিদদের নয় by আলী ইমাম মজুমদার
রাজনীতি
একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদ, এটা অস্বীকার করা যায় না। তাই স্বাভাবিক নিয়মে
রাজনীতিবিদেরাই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। তবে দেশের আমজনতার খুব কম
সংখ্যকই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন। কিন্তু সে আমজনতাই
দেশটির সব ক্ষমতার মালিক। আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে এ অবস্থানটি
উচ্চারিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে এ অবস্থানের কার্যকর স্বীকৃতি
রাজনীতিবিদেরা দিতে চান না। গত মাস দেড়েকের অবস্থা দেখেও এটা ধরে নেওয়া
অসংগত হবে না। মনে হচ্ছে রাজনীতিবিদেরা যা চাইবেন, তা-ই করতে হবে এ দেশের
মানুষকে।
এমনটা যদি না হতো, তাহলে এ দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আর প্রায়ই ডাকা হরতাল জনজীবনকে এরূপ স্তব্ধ করে দিত না। আরও ভয়ংকর যে এ হরতাল-অবরোধ কার্যকর করতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাণঘাতী ও মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক পেট্রলবোমা। অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কেউ বা হারাচ্ছে জীবন। আর কারও জন্য রইল যন্ত্রণাদায়ক ভবিষ্যৎ। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি, এমনকি নৌযানও। রেললাইন উপড়ে ফেলে দুর্ঘটনার কারণ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আন্দোলন আহ্বানকারীরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা এসব ঘটনার জন্য দায়ী নন। আর অতীতেও এর চেয়ে বেশি সময় ধরে হয়েছে হরতাল-অবরোধ। সেগুলো কার্যকর করতেও ক্ষেত্রবিশেষে গাড়িতে গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ভাঙা ও পোড়ানো হয়েছিল অনেক গাড়ি। মিথ্যা নয়, তবে এ–জাতীয় অমানবিক কার্যক্রমের উৎস অনুসন্ধান ও যথাযথ তদন্ত করে অপরাধীকে দণ্ড দিতে সক্ষম হয়নি কোনো সরকার।
এটা সত্য, আদালত কর্তৃক অপরাধী বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এসব ঘটনার জন্য কারা দায়ী, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। তবে যে বা যাঁরা এ আন্দোলন আহ্বান করেছেন, তাঁদের এসব ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব তো অস্বীকার করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সন্ত্রাসবাদকে যদি প্রশ্রয় দিতে না চান, তাহলে কথায় ও কাজে প্রমাণ করতে হবে।
যেমন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করতে গিয়ে তা দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচোরায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়। উত্তেজিত জনতা থানা আক্রমণ করে ২৩ জন পুলিশ সদস্যকে জীবন্ত দগ্ধ করে। এর ফলে মহাত্মা গান্ধী সিদ্ধান্তে পৌঁছান জনগণ অহিংস আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়নি। তিনি বন্ধ করেন আন্দোলন। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে অনশনও করেছিলেন। সে সময়েও কিছু লোক ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের আইনের আওতায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেও মহাত্মা গান্ধী তাদের কারও পক্ষে কোনো বিবৃতি দিতে সম্মত হননি।
আমরা সেসব ঐতিহ্য ছেড়ে দিয়ে বসে আছি বহুদিন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা বিবৃতি আর বক্তব্যেই সীমিত রয়ে গেছে। গত ২০ বছর যখন যাঁরা বিরোধী দলে গেছেন, সংসদ বর্জন করেছেন লাগাতার। তাঁরাই কারণে-অকারণে হরতাল-অবরোধ ডেকেছেন। এখনো ডাকা হচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখার আছে যে দেশটি ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। অর্থনীতি এখন অনেক বেশি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। উন্নয়নের পাশাপাশি তা আরও বাড়ার কথা। জনগণের চলাচলের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে।
এ ধরনের সর্বগ্রাসী হরতাল-অবরোধে তো সবই যেতে বসেছে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিপর্যস্ত। ছোট ব্যবসায়ী, দিনমজুর, যানবাহন শ্রমিক, হকারসহ অনেকেই পথে বসতে চলেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীও এ অবস্থার শিকার। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলও খুবই কমে গেছে। এমনকি নিরাপত্তার স্বার্থে রাত নয়টার পর মহাসড়কে যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল সরকার এখনকার মতো বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রশ্ন আসবে এমনটা কেন হয়। দীর্ঘদিনের একটি মন্দ ঐতিহ্য আমরা ধারণ করছি। এবার যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা গত ৫ জানুয়ারি একটি সমাবেশ করতে চেয়েছিলেন। সে সমাবেশটি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিচ্যুতির বিশ্লেষণ ও নতুন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে। সে নির্বাচনটির সাংবিধানিক শুদ্ধতা যতটাই থাক, রাজনৈতিকভাবে অনস্বীকার্যভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আলোচ্য নির্বাচনটিতে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং তারা এ নির্বাচনের সমালোচনা বা নতুন নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশ করতে পারে। এর অনুমতি দিলে নিরাপত্তাসংকট যদি বা হতোই, গত দেড় মাসে ঘটে যাওয়া সংকটের চেয়ে বেশি হতো বলে অনেকে মনে করেন না।
হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশের অনুমতি এবং এর অপব্যবহার করায় সরকার আইন প্রয়োগ করে কৌশলের পরিচয় দিয়েছিল। এবার এর বিপরীতটা কেন ঘটল, তা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। এর পরও সরকার তাদের কোনো সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। চলমান আন্দোলন দমনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী বিভিন্ন কার্যক্রম নিচ্ছে। সহিংসতার বিপক্ষে আপামর জনতা। তা সত্ত্বেও মনে করা হয়, প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতাতেই বিচার হওয়া সংগত। সরকারের আপসহীন হওয়া যেমন যৌক্তিক, তেমনি তা হতে হবে আইনের আওতায়। এ বিষয়ে ভিন্নতর বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, তা প্রকৃত সুফল দেবে না।
এখন প্রশ্ন থাকে, এ জাতীয় অবস্থায় সরকার বা আন্দোলনরত দলগুলোর কী করণীয় থাকে। প্রথমেই আন্দোলনকারীদের কথা আসে। তাদের সব অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আন্দোলনের ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। তারা কেউ আলোচ্য নির্বাচনের বর্ণিত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য দায়ী নয়। অথচ দায়ভার আজ তাদের ঘাড়ে। তাদের জীবন-জীবিকা দুটোই হুমকির মুখে। প্রশ্নটি বিবেচনায় রেখে হরতাল-অবরোধ বাদ দিয়েও তো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া যায়। ঠিক তেমনি আসে সরকারের অবস্থানের বিষয়টি। জনজীবনের নিরাপত্তার
বিধান তাদের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে তারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাহলে আজ দেশে-বিদেশে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, তা বিবদমান পক্ষ দুটোর সংলাপ। এতে দোষ কী? যুদ্ধরত দুটো পক্ষের মধ্যেও শান্তি আলোচনা হয়। কখনো বা তা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে।
এ সংলাপ প্রশ্নে যাঁরাই কথা বলেন, তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। এটা অশোভন। পক্ষদ্বয় সংলাপে কী গ্রহণ বা বর্জন করবে, তা তাদের বিষয়। কিন্তু সংলাপের পরামর্শ কেউ দিলে তাঁদের বিচার-বুদ্ধি এমনকি দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা আছে, এমনটা মনে হয় না। তাঁরা রাজনীতি না করলেও চলমান সংকটে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন। এমনকি কথা বলছে ভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিও। চলমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে সংযম ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই, এমনটাই অনেকে বলে চলছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেছেন, সব পক্ষ যেন কর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবে। দেশে যাঁরা সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাঁদের কেউ কেউ আখ্যায়িত করছেন এক-এগারোর কুশীলব বলে। এক-এগারো নেমে আসার ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখা অসংগত হবে না। একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত অবস্থান, প্রস্তাবিত প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে তখনকার বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি ও আন্দোলন, একপর্যায়ে সে সময়কার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ, তাঁর পক্ষপাতসুলভ আচরণ, মহাজোটের নির্বাচন বর্জন ও উভয় পক্ষের মুখোমুখি প্রাণঘাতী আন্দোলন মূলত এক-এগারোকে ডেকে এনেছিল। এগুলোর কোনো দায় অরাজনৈতিক সুশীল সমাজের ওপর বর্তায় না।
অতীতে যা-ই ঘটুক, আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। আর তা চাই রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বেই। তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যর্থতার পাশাপাশি দৃশ্যমান প্রশংসনীয় সাফল্যের পরিচয়ও দিয়েছেন। তা দিয়েছেন ১৯৭১ আর ১৯৯০-এ। এবার তাঁরা তা করতে সক্ষম হবেন না, এমনটা ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই। তবে তাঁদের কর্মসূচি আর এর মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশের আমজনতাকে ভোগান্তির শিকার হতে দেওয়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এমনটা যদি না হতো, তাহলে এ দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আর প্রায়ই ডাকা হরতাল জনজীবনকে এরূপ স্তব্ধ করে দিত না। আরও ভয়ংকর যে এ হরতাল-অবরোধ কার্যকর করতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাণঘাতী ও মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক পেট্রলবোমা। অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কেউ বা হারাচ্ছে জীবন। আর কারও জন্য রইল যন্ত্রণাদায়ক ভবিষ্যৎ। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি, এমনকি নৌযানও। রেললাইন উপড়ে ফেলে দুর্ঘটনার কারণ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আন্দোলন আহ্বানকারীরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা এসব ঘটনার জন্য দায়ী নন। আর অতীতেও এর চেয়ে বেশি সময় ধরে হয়েছে হরতাল-অবরোধ। সেগুলো কার্যকর করতেও ক্ষেত্রবিশেষে গাড়িতে গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ভাঙা ও পোড়ানো হয়েছিল অনেক গাড়ি। মিথ্যা নয়, তবে এ–জাতীয় অমানবিক কার্যক্রমের উৎস অনুসন্ধান ও যথাযথ তদন্ত করে অপরাধীকে দণ্ড দিতে সক্ষম হয়নি কোনো সরকার।
এটা সত্য, আদালত কর্তৃক অপরাধী বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এসব ঘটনার জন্য কারা দায়ী, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। তবে যে বা যাঁরা এ আন্দোলন আহ্বান করেছেন, তাঁদের এসব ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব তো অস্বীকার করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সন্ত্রাসবাদকে যদি প্রশ্রয় দিতে না চান, তাহলে কথায় ও কাজে প্রমাণ করতে হবে।
যেমন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করতে গিয়ে তা দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচোরায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়। উত্তেজিত জনতা থানা আক্রমণ করে ২৩ জন পুলিশ সদস্যকে জীবন্ত দগ্ধ করে। এর ফলে মহাত্মা গান্ধী সিদ্ধান্তে পৌঁছান জনগণ অহিংস আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়নি। তিনি বন্ধ করেন আন্দোলন। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে অনশনও করেছিলেন। সে সময়েও কিছু লোক ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের আইনের আওতায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেও মহাত্মা গান্ধী তাদের কারও পক্ষে কোনো বিবৃতি দিতে সম্মত হননি।
আমরা সেসব ঐতিহ্য ছেড়ে দিয়ে বসে আছি বহুদিন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা বিবৃতি আর বক্তব্যেই সীমিত রয়ে গেছে। গত ২০ বছর যখন যাঁরা বিরোধী দলে গেছেন, সংসদ বর্জন করেছেন লাগাতার। তাঁরাই কারণে-অকারণে হরতাল-অবরোধ ডেকেছেন। এখনো ডাকা হচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখার আছে যে দেশটি ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। অর্থনীতি এখন অনেক বেশি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। উন্নয়নের পাশাপাশি তা আরও বাড়ার কথা। জনগণের চলাচলের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে।
এ ধরনের সর্বগ্রাসী হরতাল-অবরোধে তো সবই যেতে বসেছে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিপর্যস্ত। ছোট ব্যবসায়ী, দিনমজুর, যানবাহন শ্রমিক, হকারসহ অনেকেই পথে বসতে চলেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীও এ অবস্থার শিকার। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলও খুবই কমে গেছে। এমনকি নিরাপত্তার স্বার্থে রাত নয়টার পর মহাসড়কে যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল সরকার এখনকার মতো বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রশ্ন আসবে এমনটা কেন হয়। দীর্ঘদিনের একটি মন্দ ঐতিহ্য আমরা ধারণ করছি। এবার যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা গত ৫ জানুয়ারি একটি সমাবেশ করতে চেয়েছিলেন। সে সমাবেশটি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিচ্যুতির বিশ্লেষণ ও নতুন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে। সে নির্বাচনটির সাংবিধানিক শুদ্ধতা যতটাই থাক, রাজনৈতিকভাবে অনস্বীকার্যভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আলোচ্য নির্বাচনটিতে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং তারা এ নির্বাচনের সমালোচনা বা নতুন নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশ করতে পারে। এর অনুমতি দিলে নিরাপত্তাসংকট যদি বা হতোই, গত দেড় মাসে ঘটে যাওয়া সংকটের চেয়ে বেশি হতো বলে অনেকে মনে করেন না।
হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশের অনুমতি এবং এর অপব্যবহার করায় সরকার আইন প্রয়োগ করে কৌশলের পরিচয় দিয়েছিল। এবার এর বিপরীতটা কেন ঘটল, তা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। এর পরও সরকার তাদের কোনো সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। চলমান আন্দোলন দমনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী বিভিন্ন কার্যক্রম নিচ্ছে। সহিংসতার বিপক্ষে আপামর জনতা। তা সত্ত্বেও মনে করা হয়, প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতাতেই বিচার হওয়া সংগত। সরকারের আপসহীন হওয়া যেমন যৌক্তিক, তেমনি তা হতে হবে আইনের আওতায়। এ বিষয়ে ভিন্নতর বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, তা প্রকৃত সুফল দেবে না।
এখন প্রশ্ন থাকে, এ জাতীয় অবস্থায় সরকার বা আন্দোলনরত দলগুলোর কী করণীয় থাকে। প্রথমেই আন্দোলনকারীদের কথা আসে। তাদের সব অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আন্দোলনের ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। তারা কেউ আলোচ্য নির্বাচনের বর্ণিত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য দায়ী নয়। অথচ দায়ভার আজ তাদের ঘাড়ে। তাদের জীবন-জীবিকা দুটোই হুমকির মুখে। প্রশ্নটি বিবেচনায় রেখে হরতাল-অবরোধ বাদ দিয়েও তো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া যায়। ঠিক তেমনি আসে সরকারের অবস্থানের বিষয়টি। জনজীবনের নিরাপত্তার
বিধান তাদের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে তারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাহলে আজ দেশে-বিদেশে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, তা বিবদমান পক্ষ দুটোর সংলাপ। এতে দোষ কী? যুদ্ধরত দুটো পক্ষের মধ্যেও শান্তি আলোচনা হয়। কখনো বা তা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে।
এ সংলাপ প্রশ্নে যাঁরাই কথা বলেন, তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। এটা অশোভন। পক্ষদ্বয় সংলাপে কী গ্রহণ বা বর্জন করবে, তা তাদের বিষয়। কিন্তু সংলাপের পরামর্শ কেউ দিলে তাঁদের বিচার-বুদ্ধি এমনকি দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা আছে, এমনটা মনে হয় না। তাঁরা রাজনীতি না করলেও চলমান সংকটে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন। এমনকি কথা বলছে ভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিও। চলমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে সংযম ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই, এমনটাই অনেকে বলে চলছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেছেন, সব পক্ষ যেন কর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবে। দেশে যাঁরা সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাঁদের কেউ কেউ আখ্যায়িত করছেন এক-এগারোর কুশীলব বলে। এক-এগারো নেমে আসার ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখা অসংগত হবে না। একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত অবস্থান, প্রস্তাবিত প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে তখনকার বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি ও আন্দোলন, একপর্যায়ে সে সময়কার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ, তাঁর পক্ষপাতসুলভ আচরণ, মহাজোটের নির্বাচন বর্জন ও উভয় পক্ষের মুখোমুখি প্রাণঘাতী আন্দোলন মূলত এক-এগারোকে ডেকে এনেছিল। এগুলোর কোনো দায় অরাজনৈতিক সুশীল সমাজের ওপর বর্তায় না।
অতীতে যা-ই ঘটুক, আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। আর তা চাই রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বেই। তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যর্থতার পাশাপাশি দৃশ্যমান প্রশংসনীয় সাফল্যের পরিচয়ও দিয়েছেন। তা দিয়েছেন ১৯৭১ আর ১৯৯০-এ। এবার তাঁরা তা করতে সক্ষম হবেন না, এমনটা ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই। তবে তাঁদের কর্মসূচি আর এর মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশের আমজনতাকে ভোগান্তির শিকার হতে দেওয়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments