পারলে থামান না হলে নামেন... by মাহমুদুর রহমান মান্না
সাম্প্রতিক
সময়ে ফেসবুকের একটি জনপ্রিয় পোস্টিং এটি। অবশ্য সম্পূর্ণ পোস্টিং নয়। এর
পরেও কথা আছে। সেটি হলো- আর পারলে নামান, না হলে থামেন। মানুষ যে কতখানি
বিরক্ত হয়েছে তার একটি প্রমাণ এ পোস্টিং। এ লেখা যেদিন ছাপা হবে সেদিন
অবরোধের ৪৪তম দিন চলছে। সোজা কথা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা
এসএসসি ঝুলে গেছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী এ
পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত সহিংসতায় মারা
গেছে প্রায় ৯০ জন লোক। অবশ্য গত কয়েক দিনে পেট্রলবোমা হামলা হলেও মৃত্যুর
ঘটনা ঘটেনি। দেশব্যাপী সহিংসতার বিরুদ্ধে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে
তা এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে বলে মনে হয়। কিন্তু মানুষের ভয় যায়নি। এই
চার-পাঁচ দিন কি বিচ্ছিন্ন আর বাকি দিনগুলো থেকে? নাকি সত্যি সত্যি বোমা
হামলায় মৃত্যুর ঘটনা কমেছে? এ জন্যই এখনো বাসে যেতে মানুষ ভয় পায়। বাসের
জানালা, দরজা খুললে যাত্রীরা হৈহৈ করে ওঠেন। কিন্তু সে আর কতদিন? শীতের সময়
সব বন্ধ করে হয়তো চলা গেছে, কিন্তু গরমে তো তা পারা যাবে না। সবচেয়ে বড়
কথা জীবন হাতে করে মানুষ কি চলতে পারে? যে কোনোভাবে এ অবস্থার অবসান চায়
মানুষ। আর সে জন্যই ফেসবুকের এই পোস্টিং।
প্রশ্ন হচ্ছে পারা অথবা না পারা নিয়ে। সরকার কি পারবে এই হরতাল, অবরোধ এবং সহিংসতা বন্ধ করতে? অথবা বিরোধী দলগুলো কি পারবে এই সরকারকে ফেলে দিতে? যদি না পারে তবে ওই ব্যক্তি বলছেন- হয় নামান না হয় থামেন। আমি মনে করি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মনোভাবও এখন এরকমই।
একটা খুবই খারাপ প্রবণতা সরকারের মধ্যে লক্ষ করছি আমি। সামগ্রিক পরিস্থিতি যে আমাদের রাজনৈতিক সর্বগ্রাসী দুর্বৃত্তায়নের প্রকাশ, বর্তমান পরিস্থিতি যে একটি রাজনৈতিক সংকটের বাস্তব চিত্র এটা তারা যে কোনো প্রকারে অস্বীকার করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকার এবং সরকারি জোটের দায়িত্বশীল কর্তা ও নেতারা বলছেন এটা কেবল সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ। ভুলে যাচ্ছেন যে সন্ত্রাসবাদও রাজনীতির একটি বিকৃত ধারা। তর্ক করে লাভ হচ্ছে না, এ ব্যাপারে এমনকি কোনো কথা শুনতেও রাজি নন তারা। যারা ঠিক কর্তা বা নেতা নন, সরকারের মুখপাত্র বা ভক্ত দেখাতে চাইছেন, তারা এমনকি এ কথা বলছেন যে, বিনা বিচারে হত্যা তত বড় অপরাধ নয়। তার চেয়ে বড় অপরাধ আগুন দিয়ে হত্যা। বাস্তবতা, বিনা বিচারে হত্যার কথা তারা আমলেই নিতে চান না। এই অজুহাতে যে, আগুনে পুড়ে মানুষ মরছে। অতি সম্প্রতি প্যারিসে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করার ব্যাপারে সেখানকার কর্তৃপক্ষ এবং জনগণ যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে হঠাৎ করেই তার প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে। অবাক করা ব্যাপার নয়? দুটোই মৃত্যু। একটি যন্ত্রণার মৃত্যু, আরেকটি যন্ত্রণা পাওয়ার আগেই মৃত্যু এবং এই যে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড তার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। পত্রিকার খবর অনুযায়ী বিনা বিচারে এক রাতে হত্যার সংখ্যা ১৯। আহত প্রচুর। পেট্রলবোমা দিয়ে হত্যা করার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই সমগ্র সমাজের রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু তার মানে কোনোভাবেই এই নয় যে, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নীরবে দেখে যেতে হবে।
যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো উচিত আমাদের। এটা মানবতার দাবি। এ জন্যই এখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির তথা দলবাজির কোনো সুযোগ নেই। 'হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন...।' সরকার বলছে পেট্রলবোমা সব বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের কাজ। বিএনপি বিবৃতি জানিয়ে বলছে, তারা এ ধরনের কাজ করছে না। তারা পাল্টা অভিযোগ করছে এ কাজ সরকারের। মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলেও এ কোন গান!
কোনো তর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। আমাদের দেশে আন্দোলনে সহিংসতা নতুন নয় (পেট্রলবোমার সঙ্গে তুলনা করছি না)। এবং সে সহিংসতায় পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতাও পুরনো। তবুও যেহেতু আন্দোলনের ছায়া ধরে এবারের এই নৃশংস বোমা হামলা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারি দায়িত্বের মধ্যে অবশ্যই পড়ে। সরকার কীভাবে সে ব্যবস্থা নেবে সেটা তারই দায়িত্ব। আমি মনে করি কেবল প্রশাসনিক কঠোরতা দিয়ে সেটা দমন করা যাবে না। অবরোধের ৪৪ দিন পরে এসে যদিও এ কথা বলার কোনো মানে হয় না; কিন্তু তারপরেও সরকার বলছে তারা সেটা পারবে। সরকারকে বিশ্বাস করছি না। বিশ্বাস করার কোনো কারণ তো নেই। কিন্তু তারপরেও বেঘোরে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চাই, তাই ওই ফেসবুকের পোস্টিংয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলছি : পারলে থামান। না পারলে নেমে যেতে বলছি না আমি। রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় এ রকম বিধ্বংসী জেদ অনুমোদনযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতি সব সময় সমঝোতার কথা বলে। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, Democracy is a rule by consensus. একভাবে বলা হয় গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু তার মানে কখনোই এই নয় যে, তা সংখ্যালঘিষ্ঠকে উপেক্ষা করে চলে। আর এই সরকার তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার নয়। This is a government by default. তাদের জেদ করা তো একেবারেই সাজে না। এটা এমন একটা দলের সরকার সম্পর্কে বলছি যাদের অতীত ইতিহাসে অনেক সংগ্রামের পালক। তারা এরকম 'ডু আর ডাই' পরিস্থিতিতে যাবে কেন? সে জন্যই সংলাপের কথা বলি। কারণ সংলাপ সব ধরনের বিকল্প পথ উন্মুক্ত রাখে। অথচ আমাদের সরকার সব বিকল্প পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সংলাপের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন তারা। যারা সংলাপের কথা বলেছেন তাদেরকে যা তা ভাষায় সমালোচনা করেছেন তারা। বিশিষ্ট আইনজীবী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেছেন, এক সময় যেভাবে সংস্কার শব্দটিকে ঘৃণীত বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, এখন সংলাপকে, সংলাপের উদ্যোগকে সেভাবেই আক্রমণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা সংলাপের কথা বলছেন তারা প্রকারান্তরে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংলাপের প্রস্তাবকারী নাগরিক সমাজকে এক-এগারোর কুশীলব বলেছেন আর সংসদে বলেছেন, ড. কামাল এবং মাহমুদুর রহমান মান্না ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সেটা কোনো দিন বাস্তবায়ন হবে না।
হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। যাকে পছন্দ করি না, অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত কেউ এরকম কথা বলতেন তাহলে হাসতাম। কিন্তু বলেছেন শেখ হাসিনা যিনি সরাসরি আমার নেতা ছিলেন। সমালোচনা সত্ত্বেও এখনো তাকে অসম্মান করি না। ড. কামালের অনুভূতি বলতে পারব না, কিন্তু নিজেকে ছোটবোধ করেছি আমি। রাজনীতি করছি, ক্ষমতার আশা থাকবে না তা কি হয়? কিন্তু যে কোনো প্রকারে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়াই যদি কথা হতো তাহলে তা আওয়ামী লীগে থেকে যাওয়াই ভালো ছিল। আমার চেয়ে বড় 'সংস্কারবাদীরা' দলেই রয়ে গেছেন না? ক্ষুদকুঁড়া পাচ্ছেন না?
আমি আন্তরিকভাবেই সংস্কার চাই। সংস্কার ছাড়া সমাজ, রাজনীতি, স্থবির গতিহীন। সে কথা তখনো বলেছি, এখনো বলছি। একইভাবে বর্তমান সময়ে সংলাপ ছাড়া এই জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এ আমার বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস থেকে বলছি।
আন্দোলনকারী বিরোধী দল এখন এরকম জায়গায় পৌঁছেছে যে তারা বলছে, তাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। তার মানে কি দাঁড়াল? পাঠকবৃন্দ, উভয় পক্ষের কথা খেয়াল করে দেখুন। বিএনপিসহ ২০ দল বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এই সরকারের পতনের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এতে ছাড় দেওয়া যাবে না। আর সরকার বলছে এটা কোনো আন্দোলন নয়। এদের ব্যাপারে কোনো রকম কনসেশন নয়। কঠোরতম পন্থায় এদের নির্মূল করা হবে। এই কঠোরতম পন্থা আমরা দেখছি। এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারেই মারা গেছে সরকারি হিসাব মতে অন্তত ১৯ জন। বিরোধী দল বলছে তার দ্বিগুণ।
আমি মনে করি এই প্রক্রিয়ায় সরকার বিরোধীদের নির্মূল করতে পারবে না। একইভাবে আমি এও মনে করি আন্দোলনের নামে যা চলছে তাতে সরকার পড়বে না। ফলে সংঘর্ষ দীর্ঘতর হবে। পেট্রলবোমা হয়তো থাকবে না, কিন্তু দেশ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তখন আরেকটি এক-এগারোর পরিস্থিতি দৃশ্যমান হবে। যা এখনই খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি সমাধানের কথা বলছি আমি। এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই।
দুই. কথা বলুন এবং বলতে দিন; গত ১৪ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংহতি প্রকাশ করতে নেতৃবৃন্দ ও হাজার হাজার মানুষ এসেছিলেন, আমি তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারা শেষ পর্যন্ত সেখানে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে। যদিও সেজন্য আমাকে কোর্টের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল।
সবাই কথা বলুন। সমাজের গভীর গভীর অসুখ এখন। এখন কথা বলা দরকার। সরকার একা কেবল অস্ত্র ও প্রশাসনের ভাষায় কথা বলবেন তাতে কাজ হবে না। বিরোধী দল ঘরে থেকে অডিও-ভিডিও বার্তায় হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকবেন তাতেও কাজ হবে না। মানুষকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
২৩ তারিখ বেলা ৩টায় প্রেসক্লাবের সামনে আসুন। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলি 'শান্তি চাই, সন্ত্রাস চাই না'। 'গণতন্ত্র চাই, স্বেচ্ছাচার চাই না'। আশা করি সরকার এবং পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বাদ সাধবেন না।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : mrmanna.bd@gmail.com
প্রশ্ন হচ্ছে পারা অথবা না পারা নিয়ে। সরকার কি পারবে এই হরতাল, অবরোধ এবং সহিংসতা বন্ধ করতে? অথবা বিরোধী দলগুলো কি পারবে এই সরকারকে ফেলে দিতে? যদি না পারে তবে ওই ব্যক্তি বলছেন- হয় নামান না হয় থামেন। আমি মনে করি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মনোভাবও এখন এরকমই।
একটা খুবই খারাপ প্রবণতা সরকারের মধ্যে লক্ষ করছি আমি। সামগ্রিক পরিস্থিতি যে আমাদের রাজনৈতিক সর্বগ্রাসী দুর্বৃত্তায়নের প্রকাশ, বর্তমান পরিস্থিতি যে একটি রাজনৈতিক সংকটের বাস্তব চিত্র এটা তারা যে কোনো প্রকারে অস্বীকার করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকার এবং সরকারি জোটের দায়িত্বশীল কর্তা ও নেতারা বলছেন এটা কেবল সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ। ভুলে যাচ্ছেন যে সন্ত্রাসবাদও রাজনীতির একটি বিকৃত ধারা। তর্ক করে লাভ হচ্ছে না, এ ব্যাপারে এমনকি কোনো কথা শুনতেও রাজি নন তারা। যারা ঠিক কর্তা বা নেতা নন, সরকারের মুখপাত্র বা ভক্ত দেখাতে চাইছেন, তারা এমনকি এ কথা বলছেন যে, বিনা বিচারে হত্যা তত বড় অপরাধ নয়। তার চেয়ে বড় অপরাধ আগুন দিয়ে হত্যা। বাস্তবতা, বিনা বিচারে হত্যার কথা তারা আমলেই নিতে চান না। এই অজুহাতে যে, আগুনে পুড়ে মানুষ মরছে। অতি সম্প্রতি প্যারিসে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করার ব্যাপারে সেখানকার কর্তৃপক্ষ এবং জনগণ যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে হঠাৎ করেই তার প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে। অবাক করা ব্যাপার নয়? দুটোই মৃত্যু। একটি যন্ত্রণার মৃত্যু, আরেকটি যন্ত্রণা পাওয়ার আগেই মৃত্যু এবং এই যে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড তার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। পত্রিকার খবর অনুযায়ী বিনা বিচারে এক রাতে হত্যার সংখ্যা ১৯। আহত প্রচুর। পেট্রলবোমা দিয়ে হত্যা করার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই সমগ্র সমাজের রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু তার মানে কোনোভাবেই এই নয় যে, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নীরবে দেখে যেতে হবে।
যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো উচিত আমাদের। এটা মানবতার দাবি। এ জন্যই এখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির তথা দলবাজির কোনো সুযোগ নেই। 'হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন...।' সরকার বলছে পেট্রলবোমা সব বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের কাজ। বিএনপি বিবৃতি জানিয়ে বলছে, তারা এ ধরনের কাজ করছে না। তারা পাল্টা অভিযোগ করছে এ কাজ সরকারের। মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলেও এ কোন গান!
কোনো তর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। আমাদের দেশে আন্দোলনে সহিংসতা নতুন নয় (পেট্রলবোমার সঙ্গে তুলনা করছি না)। এবং সে সহিংসতায় পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতাও পুরনো। তবুও যেহেতু আন্দোলনের ছায়া ধরে এবারের এই নৃশংস বোমা হামলা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারি দায়িত্বের মধ্যে অবশ্যই পড়ে। সরকার কীভাবে সে ব্যবস্থা নেবে সেটা তারই দায়িত্ব। আমি মনে করি কেবল প্রশাসনিক কঠোরতা দিয়ে সেটা দমন করা যাবে না। অবরোধের ৪৪ দিন পরে এসে যদিও এ কথা বলার কোনো মানে হয় না; কিন্তু তারপরেও সরকার বলছে তারা সেটা পারবে। সরকারকে বিশ্বাস করছি না। বিশ্বাস করার কোনো কারণ তো নেই। কিন্তু তারপরেও বেঘোরে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চাই, তাই ওই ফেসবুকের পোস্টিংয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলছি : পারলে থামান। না পারলে নেমে যেতে বলছি না আমি। রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় এ রকম বিধ্বংসী জেদ অনুমোদনযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতি সব সময় সমঝোতার কথা বলে। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, Democracy is a rule by consensus. একভাবে বলা হয় গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু তার মানে কখনোই এই নয় যে, তা সংখ্যালঘিষ্ঠকে উপেক্ষা করে চলে। আর এই সরকার তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার নয়। This is a government by default. তাদের জেদ করা তো একেবারেই সাজে না। এটা এমন একটা দলের সরকার সম্পর্কে বলছি যাদের অতীত ইতিহাসে অনেক সংগ্রামের পালক। তারা এরকম 'ডু আর ডাই' পরিস্থিতিতে যাবে কেন? সে জন্যই সংলাপের কথা বলি। কারণ সংলাপ সব ধরনের বিকল্প পথ উন্মুক্ত রাখে। অথচ আমাদের সরকার সব বিকল্প পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সংলাপের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন তারা। যারা সংলাপের কথা বলেছেন তাদেরকে যা তা ভাষায় সমালোচনা করেছেন তারা। বিশিষ্ট আইনজীবী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেছেন, এক সময় যেভাবে সংস্কার শব্দটিকে ঘৃণীত বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, এখন সংলাপকে, সংলাপের উদ্যোগকে সেভাবেই আক্রমণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা সংলাপের কথা বলছেন তারা প্রকারান্তরে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংলাপের প্রস্তাবকারী নাগরিক সমাজকে এক-এগারোর কুশীলব বলেছেন আর সংসদে বলেছেন, ড. কামাল এবং মাহমুদুর রহমান মান্না ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সেটা কোনো দিন বাস্তবায়ন হবে না।
হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। যাকে পছন্দ করি না, অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত কেউ এরকম কথা বলতেন তাহলে হাসতাম। কিন্তু বলেছেন শেখ হাসিনা যিনি সরাসরি আমার নেতা ছিলেন। সমালোচনা সত্ত্বেও এখনো তাকে অসম্মান করি না। ড. কামালের অনুভূতি বলতে পারব না, কিন্তু নিজেকে ছোটবোধ করেছি আমি। রাজনীতি করছি, ক্ষমতার আশা থাকবে না তা কি হয়? কিন্তু যে কোনো প্রকারে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়াই যদি কথা হতো তাহলে তা আওয়ামী লীগে থেকে যাওয়াই ভালো ছিল। আমার চেয়ে বড় 'সংস্কারবাদীরা' দলেই রয়ে গেছেন না? ক্ষুদকুঁড়া পাচ্ছেন না?
আমি আন্তরিকভাবেই সংস্কার চাই। সংস্কার ছাড়া সমাজ, রাজনীতি, স্থবির গতিহীন। সে কথা তখনো বলেছি, এখনো বলছি। একইভাবে বর্তমান সময়ে সংলাপ ছাড়া এই জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এ আমার বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস থেকে বলছি।
আন্দোলনকারী বিরোধী দল এখন এরকম জায়গায় পৌঁছেছে যে তারা বলছে, তাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। তার মানে কি দাঁড়াল? পাঠকবৃন্দ, উভয় পক্ষের কথা খেয়াল করে দেখুন। বিএনপিসহ ২০ দল বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এই সরকারের পতনের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এতে ছাড় দেওয়া যাবে না। আর সরকার বলছে এটা কোনো আন্দোলন নয়। এদের ব্যাপারে কোনো রকম কনসেশন নয়। কঠোরতম পন্থায় এদের নির্মূল করা হবে। এই কঠোরতম পন্থা আমরা দেখছি। এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারেই মারা গেছে সরকারি হিসাব মতে অন্তত ১৯ জন। বিরোধী দল বলছে তার দ্বিগুণ।
আমি মনে করি এই প্রক্রিয়ায় সরকার বিরোধীদের নির্মূল করতে পারবে না। একইভাবে আমি এও মনে করি আন্দোলনের নামে যা চলছে তাতে সরকার পড়বে না। ফলে সংঘর্ষ দীর্ঘতর হবে। পেট্রলবোমা হয়তো থাকবে না, কিন্তু দেশ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তখন আরেকটি এক-এগারোর পরিস্থিতি দৃশ্যমান হবে। যা এখনই খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি সমাধানের কথা বলছি আমি। এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই।
দুই. কথা বলুন এবং বলতে দিন; গত ১৪ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংহতি প্রকাশ করতে নেতৃবৃন্দ ও হাজার হাজার মানুষ এসেছিলেন, আমি তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারা শেষ পর্যন্ত সেখানে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে। যদিও সেজন্য আমাকে কোর্টের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল।
সবাই কথা বলুন। সমাজের গভীর গভীর অসুখ এখন। এখন কথা বলা দরকার। সরকার একা কেবল অস্ত্র ও প্রশাসনের ভাষায় কথা বলবেন তাতে কাজ হবে না। বিরোধী দল ঘরে থেকে অডিও-ভিডিও বার্তায় হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকবেন তাতেও কাজ হবে না। মানুষকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
২৩ তারিখ বেলা ৩টায় প্রেসক্লাবের সামনে আসুন। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলি 'শান্তি চাই, সন্ত্রাস চাই না'। 'গণতন্ত্র চাই, স্বেচ্ছাচার চাই না'। আশা করি সরকার এবং পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বাদ সাধবেন না।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : mrmanna.bd@gmail.com
No comments