শুভেচ্ছা সফরটি আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী? by সোহরাব হাসান
গত
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় নেমেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘মনে হয় নিজের দেশে এসেছি। দুই বাংলার সম্পর্ক অনেক
গভীর করতেই এই সফরে এসেছি।’ এর আগে কলকাতায় তিনি বলেছিলেন, প্রাণের টানেই
ঢাকায় যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের মানুষও পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরায় গেলে একই অনভূতি প্রকাশ করেন। তাঁরা সেখানে যান মনের টানে, প্রাণের তাগিদে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁরাও আনন্দ ও বেদনা সমানভাবে ভাগ করে নিতে চান। অনেকে পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। একই ভাষাভাষী মানুষ বলেই টানটা বেশি। তবে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে অনেক সময় রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক বাধা আমাদের সম্পর্ককে এগোতে দেয় না। পিছু টানে।
সম্ভবত আমরা এ রকম একটি বাধার মুখোমুখি হই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি হলো না ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে। অনেক কাটাছেঁড়া করে যে সীমান্ত প্রটোকল সই হলো, তাতে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অজুহাতে মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হলেন না যে তাঁকে না জানিয়েই দিল্লি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করেছে।
এর আগে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে অতীতের সন্দেহ-অবিশ্বাস পেছনে ফেলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এসেছিল। এরপর শেখ হাসিনার সরকার ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি কেবল কমাননি, উলফা আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে, নেতাদের বিতাড়িত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নয়। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও তাঁর সরকার ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে পেরেছিল বলে মনে করেন না ভারতীয়রা।
সে ক্ষেত্রে ২০১১ সাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাইলফলক রচিত হতে পারত। হয়নি। এ ব্যাপারে দিল্লির কতটা ভুল ছিল, কতটা আমাদের কূটনৈতিক ঘাটতি ছিল আর কতটা মমতার অনাপসী মনোভাব কাজ করেছিল, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের শিকার হলো। আগে এসব নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিই দ্বিধাবিভক্ত ছিল।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি—এই সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যে নেমে এলেও ঢাকা, কলকাতা ও নয়াদিল্লির রাজনীতির অঙ্গনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঢাকায় শেখ হাসিনা তৃতীয়বার প্রধামন্ত্রী হয়েছেন ৫ জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনে। দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। কংগ্রেসের অবস্থান দুর্বল থাকায় লোকসভায় সীমান্ত বিল তুলতে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়ে। বর্তমানে বিজেপির সেই সমস্যা নেই। তারা চাইলেই বিলটি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবে। পশ্চিবঙ্গে বামফ্রন্টকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু যেভাবে তিনি বামফ্রন্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপিকে সেটি পারছেন না। বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কেবল দুটি আসনই ছিনিয়ে নেয়নি, পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখছে। তারা তৃণমূলে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়সহ অনেকেই দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর পাশাপাশি সারদা কেলেঙ্কারি ও বর্ধমান–কাণ্ড আপসহীন মমতাকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেত্রী। এটাই তাঁর ঢাকায় শুভেচ্ছা সফরের পটভূমি। একুশের রাতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উপলক্ষ মাত্র।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে বলেছেন, তিনি শিগগিরই সুখবর নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চান। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই আশাবাদী। তবে তাদের আশা ভঙ্গের বেদনাও কম নয়। এর পরও তারা পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। সামনে এগোতে চায়। আর সে ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দূতিয়ালির ভূমিকা নিতে পারতেন, বাংলাদেশের সমস্যাটি দিল্লিকে বোঝাতে পারতেন। যেমনটি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু। তিনি ছাড়া গঙ্গা চুক্তি হতো না। আর মমতার জন্য তিস্তা ও সীমান্ত প্রটোকল আটকে আছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে মমতা যেমন আবেগময় অনুভূতি প্রকাশ করলেন, তাঁর প্রতিও বাংলাদেশের মানুষের আবেগের ভাগটি মোটেই কম নয়। যেদিন তিনি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন, পশ্চিবঙ্গের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও খুশি হয়েছিল, আরেকজন নারী রাজনীতিককে একটি দেশের না হলেও রাজ্যের প্রধান পদে পেয়ে। তারা ভেবেছিল, জ্যোতি বসুর মতো তিনিও বাংলাদেশের সমস্যাটি বুঝবেন। যেদিন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য ফুল দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এটি রাষ্ট্রীয় আচারের চেয়ে বেশি কিছু।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, যন্ত্র দিয়ে পানির পরিমাণ মাপা যায়, কিন্তু হৃদয়ের উষ্ণতা মাপা যায় না। এ জন্য আরেকটি উষ্ণ হৃদয় থাকা দরকার। মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তৃণমূল নেত্রী মমতার কথা বলছি না, লেখক-কবি-চিত্রকর মমতার সেই হৃদয় আছে বলেই আমরা মনে করি। বহু বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যখন হিলি সীমান্তের কাছ দিয়ে যাই, বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি, একই রকম শস্যখেত, একই রকম সবুজ বনানী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেদিন বলতে না পারলেও আজ বলছি, এই শস্যক্ষেত ও সবুজ বনানীকে বাঁচিয়ে রাখবে যে জলধারা, সেটি শুকিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আরেকবার মমতা বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হলেও একই ভাষায় কথা বলি। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী এক থাকলে তার শক্তির কথাটি ভাবুন।’ এবার ঢাকায় নেমেও তিনি গানের ভাষায় বললেন, ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ।’
এই রূপময় বাংলাকে, বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতে যে নদীর জলধারা সচল রাখা প্রয়োজন, সে কথাটিও নিশ্চয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করবেন। সীমান্তের দুই দিকেই যে তিস্তা প্রবহমান, তার তীরে লাখ লাখ মানুষের বাস, তাদের জীবন–জীবিকার কথাটিও একবার তিনি ভেবে দেখবেন। সীমান্তের ওপারের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন জল প্রয়োজন, তেমনি এপারের মানুষের জন্যও। তিনি যদি রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ ও জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, তাহলে তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তিতে কেন সম্মতি দেবেন না?
আমরা এ–ও জানি যে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। উজানে পানি সরানো হচ্ছে। পানির ঘাটতি থাকলে দুই পক্ষকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। প্রয়োজনে পানির প্রবাহ বাড়াতে যৌথ ও সমন্বিত প্রয়াস চালাতে হবে। উজানে মজুতাগার তৈরি করতে হবে। কিন্তু ভাটির দেশ বলে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যাবে না।
আমরা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি তিনি খোলাখুলি বলেছেন। ছিটমহল বিনিময়ের পর শরণার্থীদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছেন। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তিস্তার ব্যাপারেও তিনি অনেকখানি নমনীয়। ঢাকায় যাত্রা করার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয়ই মোদি সরকারের বার্তাটি পেয়েছেন। মমতা বলেছেন, ‘এটি ঐতিহাসিক সফর।’ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে পশ্ছিমবঙ্গ সেতুবন্ধ হতেও প্রস্তুত আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া সেটি কী করে সম্ভব? গতকাল সুধি সমাবেশে মমতা বলেছেন তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। আমরা আস্থা হারাতে চাই না বলেই তাঁর কাছ থেকে স্পষ্ট কথা চাই।
১৭ বছর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার ঢাকায় এসেছেন। প্রথমবার যখন তিনি এসেছিলেন, তখন তিনি লোকসভার একজন সাংসদমাত্র। এবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে তাঁর কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তঁারা মনে করেন, দিল্লিকে কাছে টানতে কলকাতা ভূমিকা রাখতে পারে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দিল্লি এগিয়ে এলেও কলকাতা মনস্থির করতে পারছে না। কেন এমনটি হবে? দিদি, আর কত দিন আমরা বকেয়া সমস্যা নিয়ে ঝগড়াবিবাদ করব? আসুন, বকেয়া সমস্যা দুটি যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রচনা করি। আপনার সঙ্গে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা কেবল পশ্চিমবঙ্গের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র নন, বাংলাদেশের মানুষেরও অত্যন্ত প্রিয়জন। তাঁদের সাক্ষী রেখে বলছি, অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। তবে আপনাদের কাছ থেকেও তার প্রতত্তর আশা করি।
মমতার শুভেচ্ছা সফরটি কেবলই শুভেচ্ছার ডালিতে সীমিত না রেখে আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
বাংলাদেশের মানুষও পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরায় গেলে একই অনভূতি প্রকাশ করেন। তাঁরা সেখানে যান মনের টানে, প্রাণের তাগিদে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁরাও আনন্দ ও বেদনা সমানভাবে ভাগ করে নিতে চান। অনেকে পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। একই ভাষাভাষী মানুষ বলেই টানটা বেশি। তবে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে অনেক সময় রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক বাধা আমাদের সম্পর্ককে এগোতে দেয় না। পিছু টানে।
সম্ভবত আমরা এ রকম একটি বাধার মুখোমুখি হই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি হলো না ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে। অনেক কাটাছেঁড়া করে যে সীমান্ত প্রটোকল সই হলো, তাতে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অজুহাতে মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হলেন না যে তাঁকে না জানিয়েই দিল্লি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করেছে।
এর আগে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে অতীতের সন্দেহ-অবিশ্বাস পেছনে ফেলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এসেছিল। এরপর শেখ হাসিনার সরকার ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি কেবল কমাননি, উলফা আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে, নেতাদের বিতাড়িত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নয়। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও তাঁর সরকার ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে পেরেছিল বলে মনে করেন না ভারতীয়রা।
সে ক্ষেত্রে ২০১১ সাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাইলফলক রচিত হতে পারত। হয়নি। এ ব্যাপারে দিল্লির কতটা ভুল ছিল, কতটা আমাদের কূটনৈতিক ঘাটতি ছিল আর কতটা মমতার অনাপসী মনোভাব কাজ করেছিল, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের শিকার হলো। আগে এসব নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিই দ্বিধাবিভক্ত ছিল।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি—এই সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যে নেমে এলেও ঢাকা, কলকাতা ও নয়াদিল্লির রাজনীতির অঙ্গনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঢাকায় শেখ হাসিনা তৃতীয়বার প্রধামন্ত্রী হয়েছেন ৫ জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনে। দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। কংগ্রেসের অবস্থান দুর্বল থাকায় লোকসভায় সীমান্ত বিল তুলতে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়ে। বর্তমানে বিজেপির সেই সমস্যা নেই। তারা চাইলেই বিলটি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবে। পশ্চিবঙ্গে বামফ্রন্টকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু যেভাবে তিনি বামফ্রন্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপিকে সেটি পারছেন না। বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কেবল দুটি আসনই ছিনিয়ে নেয়নি, পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখছে। তারা তৃণমূলে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়সহ অনেকেই দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর পাশাপাশি সারদা কেলেঙ্কারি ও বর্ধমান–কাণ্ড আপসহীন মমতাকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেত্রী। এটাই তাঁর ঢাকায় শুভেচ্ছা সফরের পটভূমি। একুশের রাতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উপলক্ষ মাত্র।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে বলেছেন, তিনি শিগগিরই সুখবর নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চান। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই আশাবাদী। তবে তাদের আশা ভঙ্গের বেদনাও কম নয়। এর পরও তারা পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। সামনে এগোতে চায়। আর সে ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দূতিয়ালির ভূমিকা নিতে পারতেন, বাংলাদেশের সমস্যাটি দিল্লিকে বোঝাতে পারতেন। যেমনটি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু। তিনি ছাড়া গঙ্গা চুক্তি হতো না। আর মমতার জন্য তিস্তা ও সীমান্ত প্রটোকল আটকে আছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে মমতা যেমন আবেগময় অনুভূতি প্রকাশ করলেন, তাঁর প্রতিও বাংলাদেশের মানুষের আবেগের ভাগটি মোটেই কম নয়। যেদিন তিনি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন, পশ্চিবঙ্গের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও খুশি হয়েছিল, আরেকজন নারী রাজনীতিককে একটি দেশের না হলেও রাজ্যের প্রধান পদে পেয়ে। তারা ভেবেছিল, জ্যোতি বসুর মতো তিনিও বাংলাদেশের সমস্যাটি বুঝবেন। যেদিন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য ফুল দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এটি রাষ্ট্রীয় আচারের চেয়ে বেশি কিছু।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, যন্ত্র দিয়ে পানির পরিমাণ মাপা যায়, কিন্তু হৃদয়ের উষ্ণতা মাপা যায় না। এ জন্য আরেকটি উষ্ণ হৃদয় থাকা দরকার। মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তৃণমূল নেত্রী মমতার কথা বলছি না, লেখক-কবি-চিত্রকর মমতার সেই হৃদয় আছে বলেই আমরা মনে করি। বহু বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যখন হিলি সীমান্তের কাছ দিয়ে যাই, বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি, একই রকম শস্যখেত, একই রকম সবুজ বনানী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেদিন বলতে না পারলেও আজ বলছি, এই শস্যক্ষেত ও সবুজ বনানীকে বাঁচিয়ে রাখবে যে জলধারা, সেটি শুকিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আরেকবার মমতা বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হলেও একই ভাষায় কথা বলি। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী এক থাকলে তার শক্তির কথাটি ভাবুন।’ এবার ঢাকায় নেমেও তিনি গানের ভাষায় বললেন, ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ।’
এই রূপময় বাংলাকে, বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতে যে নদীর জলধারা সচল রাখা প্রয়োজন, সে কথাটিও নিশ্চয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করবেন। সীমান্তের দুই দিকেই যে তিস্তা প্রবহমান, তার তীরে লাখ লাখ মানুষের বাস, তাদের জীবন–জীবিকার কথাটিও একবার তিনি ভেবে দেখবেন। সীমান্তের ওপারের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন জল প্রয়োজন, তেমনি এপারের মানুষের জন্যও। তিনি যদি রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ ও জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, তাহলে তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তিতে কেন সম্মতি দেবেন না?
আমরা এ–ও জানি যে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। উজানে পানি সরানো হচ্ছে। পানির ঘাটতি থাকলে দুই পক্ষকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। প্রয়োজনে পানির প্রবাহ বাড়াতে যৌথ ও সমন্বিত প্রয়াস চালাতে হবে। উজানে মজুতাগার তৈরি করতে হবে। কিন্তু ভাটির দেশ বলে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যাবে না।
আমরা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি তিনি খোলাখুলি বলেছেন। ছিটমহল বিনিময়ের পর শরণার্থীদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছেন। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তিস্তার ব্যাপারেও তিনি অনেকখানি নমনীয়। ঢাকায় যাত্রা করার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয়ই মোদি সরকারের বার্তাটি পেয়েছেন। মমতা বলেছেন, ‘এটি ঐতিহাসিক সফর।’ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে পশ্ছিমবঙ্গ সেতুবন্ধ হতেও প্রস্তুত আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া সেটি কী করে সম্ভব? গতকাল সুধি সমাবেশে মমতা বলেছেন তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। আমরা আস্থা হারাতে চাই না বলেই তাঁর কাছ থেকে স্পষ্ট কথা চাই।
১৭ বছর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার ঢাকায় এসেছেন। প্রথমবার যখন তিনি এসেছিলেন, তখন তিনি লোকসভার একজন সাংসদমাত্র। এবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে তাঁর কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তঁারা মনে করেন, দিল্লিকে কাছে টানতে কলকাতা ভূমিকা রাখতে পারে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দিল্লি এগিয়ে এলেও কলকাতা মনস্থির করতে পারছে না। কেন এমনটি হবে? দিদি, আর কত দিন আমরা বকেয়া সমস্যা নিয়ে ঝগড়াবিবাদ করব? আসুন, বকেয়া সমস্যা দুটি যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রচনা করি। আপনার সঙ্গে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা কেবল পশ্চিমবঙ্গের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র নন, বাংলাদেশের মানুষেরও অত্যন্ত প্রিয়জন। তাঁদের সাক্ষী রেখে বলছি, অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। তবে আপনাদের কাছ থেকেও তার প্রতত্তর আশা করি।
মমতার শুভেচ্ছা সফরটি কেবলই শুভেচ্ছার ডালিতে সীমিত না রেখে আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি কী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments