অমর একুশের ডাক by আনিসুজ্জামান
(একুশ উদ্যাপনের প্রস্তুতি হিসেবে দেয়াললিখন। গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো) বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লিখিত দিনগুলির মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি প্রধান দিন।
যা ছিল মূলত ছাত্রদের এবং রাজনীতিবিদদের আন্দোলন, ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে গেল সর্বসাধারণের আন্দোলন। রেলের চাকা বন্ধ হয়ে গেল, বেতার-ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন কর্মীরা; কর্মচারীরা ছেড়ে গেলেন সরকারি দপ্তর, দোকানিরা ঝাঁপ ফেলে দিলেন। মর্মাহত নারীর বুক চিরে ধ্বনিত হলো হাহাকার, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে কিশোর আওয়াজ তুললো, আমরা বরকতের ভাই, আমরা রফিকের ভাই।
এদেশে আন্দোলন আগেও হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার যোগ এমন করে হয়েছে বলে মনে হয় না। বাইশ তারিখেও তাই আত্মাহুতি দিতে মানুষ দ্বিধা করেনি। সে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ধ্বনি তুলেছে, তখন বাংলা ভাষার প্রতি তার যে-ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে, তা কিন্তু একদিনে সঞ্চিত হয়নি, বহুদিনে, একাধিক প্রজন্ম ধরে, একটু একটু করে তা সঞ্চিত হয়েছে তার মর্মমূলে। তার প্রকাশ হয়েছে প্রথমে কুণ্ঠিত, তারপর অনর্গল, শেষে প্রবল। সমাজচৈতন্যে বাসা-বাঁধা এই ভাষাপ্রেম সম্পর্কে দেশের শাসকগোষ্ঠীর কোনো ধারণা ছিল না। যেসব বাঙালির সঙ্গে তাঁদের লেনদেন ছিল, তাঁরা সকলেই উর্দু অথবা ইংরেজিতে পারঙ্গম ছিলেন। সুতরাং এঁদের ভাষা যে বাংলা, তার প্রতি এদের যে বিশেষ দরদ আছে, তা তাঁরা বোঝেননি। তাই ১৯৪৭ বা ১৯৪৮ সালে যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠল, তখন তাঁরা এটাকে একটা ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখলেন। তাতে আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল।
বাংলা ভাষার প্রতি ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাবে আহত বাঙালি বুঝে গেল, যে-নতুন রাষ্ট্রে সে নিজের সর্বাধিক বিকাশের স্বপ্ন দেখেছিল, যে-রাষ্ট্রে তার ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত অধিকার সহজে মিলবে না। এ থেকেই উপ্ত হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ। পরবর্তী দুই দশকের ঘটনায় এই বীজ মহীরুহতে পরিণত হলো। ১৯৭১-এ তা চূড়ান্ত রূপ নিলো। ২৬শে মার্চের বর্বরোচিত আক্রমণ বাঙালিকে নতুন রাষ্ট্রগঠনে বদ্ধপরিকর করে তুলল। তার পরের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ন মাসের ইতিহাস। যে-বাঙালি ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলে ফেলেছিল, সে এখন তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে লিখল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’
কিন্তু বাধা যখন অপসারিত হয়ে গেল, তখন যেন আমরা ভাষাবিষয়ে উদাসীন হয়ে গেলাম। আমরা আগের মতোই বললাম বটে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই, কিন্তু সেই প্রচলনের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কাজ করতে এগিয়ে এলাম না। পাকিস্তান-আমলে বরঞ্চ বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার নানা শাখায় বই লেখা শুরু হয়েছিল, পরিভাষা-নির্মাণের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরে প্রারম্ভিক উৎসাহের পরে আমাদের চেষ্টায় ভাটা পড়ে গেল। একটা সময়ে রাষ্ট্রীয় কর্তারাও ঔদাসীন্যের পরিচয় দিলেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের মনে নানারকম দ্বিধা ও সন্দেহ দেখা দিলো। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে চেয়ে আমরা ঠিক করছি তো? এতে বহির্বিশ্ব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব না তো? জ্ঞানবিজ্ঞানে আমরা পিছিয়ে পড়ব না তো? এটা ঠিক হবে তো? ওটা সংগত হবে তো?
সব প্রশ্নের সহজ উত্তর আমরা পেয়ে যাব যদি ঠিকমতো চিন্তা করি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, অন্যে কাজটা করবে বলে তাঁরা বসে থাকেননি। আমাদেরও বসে থাকলে চলবে না। দেশটা যেমন সবার, দায়িত্ব তেমনি সবার। একুশের উত্তরাধিকার যেমন সবার, কর্তব্যটাও তেমনি সবার। আমরা না বরকতের ভাই? আমরা না রফিকের ভাই?
একুশ ডাকছে আমাদের। সেই ডাক কি সকলে শুনতে পাচ্ছি?
যা ছিল মূলত ছাত্রদের এবং রাজনীতিবিদদের আন্দোলন, ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে গেল সর্বসাধারণের আন্দোলন। রেলের চাকা বন্ধ হয়ে গেল, বেতার-ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন কর্মীরা; কর্মচারীরা ছেড়ে গেলেন সরকারি দপ্তর, দোকানিরা ঝাঁপ ফেলে দিলেন। মর্মাহত নারীর বুক চিরে ধ্বনিত হলো হাহাকার, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে কিশোর আওয়াজ তুললো, আমরা বরকতের ভাই, আমরা রফিকের ভাই।
এদেশে আন্দোলন আগেও হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার যোগ এমন করে হয়েছে বলে মনে হয় না। বাইশ তারিখেও তাই আত্মাহুতি দিতে মানুষ দ্বিধা করেনি। সে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ধ্বনি তুলেছে, তখন বাংলা ভাষার প্রতি তার যে-ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে, তা কিন্তু একদিনে সঞ্চিত হয়নি, বহুদিনে, একাধিক প্রজন্ম ধরে, একটু একটু করে তা সঞ্চিত হয়েছে তার মর্মমূলে। তার প্রকাশ হয়েছে প্রথমে কুণ্ঠিত, তারপর অনর্গল, শেষে প্রবল। সমাজচৈতন্যে বাসা-বাঁধা এই ভাষাপ্রেম সম্পর্কে দেশের শাসকগোষ্ঠীর কোনো ধারণা ছিল না। যেসব বাঙালির সঙ্গে তাঁদের লেনদেন ছিল, তাঁরা সকলেই উর্দু অথবা ইংরেজিতে পারঙ্গম ছিলেন। সুতরাং এঁদের ভাষা যে বাংলা, তার প্রতি এদের যে বিশেষ দরদ আছে, তা তাঁরা বোঝেননি। তাই ১৯৪৭ বা ১৯৪৮ সালে যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠল, তখন তাঁরা এটাকে একটা ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখলেন। তাতে আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল।
বাংলা ভাষার প্রতি ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাবে আহত বাঙালি বুঝে গেল, যে-নতুন রাষ্ট্রে সে নিজের সর্বাধিক বিকাশের স্বপ্ন দেখেছিল, যে-রাষ্ট্রে তার ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত অধিকার সহজে মিলবে না। এ থেকেই উপ্ত হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ। পরবর্তী দুই দশকের ঘটনায় এই বীজ মহীরুহতে পরিণত হলো। ১৯৭১-এ তা চূড়ান্ত রূপ নিলো। ২৬শে মার্চের বর্বরোচিত আক্রমণ বাঙালিকে নতুন রাষ্ট্রগঠনে বদ্ধপরিকর করে তুলল। তার পরের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ন মাসের ইতিহাস। যে-বাঙালি ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলে ফেলেছিল, সে এখন তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে লিখল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’
কিন্তু বাধা যখন অপসারিত হয়ে গেল, তখন যেন আমরা ভাষাবিষয়ে উদাসীন হয়ে গেলাম। আমরা আগের মতোই বললাম বটে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই, কিন্তু সেই প্রচলনের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কাজ করতে এগিয়ে এলাম না। পাকিস্তান-আমলে বরঞ্চ বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার নানা শাখায় বই লেখা শুরু হয়েছিল, পরিভাষা-নির্মাণের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরে প্রারম্ভিক উৎসাহের পরে আমাদের চেষ্টায় ভাটা পড়ে গেল। একটা সময়ে রাষ্ট্রীয় কর্তারাও ঔদাসীন্যের পরিচয় দিলেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের মনে নানারকম দ্বিধা ও সন্দেহ দেখা দিলো। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে চেয়ে আমরা ঠিক করছি তো? এতে বহির্বিশ্ব থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব না তো? জ্ঞানবিজ্ঞানে আমরা পিছিয়ে পড়ব না তো? এটা ঠিক হবে তো? ওটা সংগত হবে তো?
সব প্রশ্নের সহজ উত্তর আমরা পেয়ে যাব যদি ঠিকমতো চিন্তা করি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, অন্যে কাজটা করবে বলে তাঁরা বসে থাকেননি। আমাদেরও বসে থাকলে চলবে না। দেশটা যেমন সবার, দায়িত্ব তেমনি সবার। একুশের উত্তরাধিকার যেমন সবার, কর্তব্যটাও তেমনি সবার। আমরা না বরকতের ভাই? আমরা না রফিকের ভাই?
একুশ ডাকছে আমাদের। সেই ডাক কি সকলে শুনতে পাচ্ছি?
No comments