বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আর
২৫ থেকে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষা কেমন হবে—এ নিয়ে শিক্ষিতজনের মনে নানা
উদ্বেগ। এই উদ্বেগের পেছনে আছে পড়ার সংস্কৃতির অবক্ষয় এবং ভাষার মানে টান
পড়া। একসময় বই পড়াটা ছিল অনেকের কাছেই অভ্যাসের বিষয়। পরিবারগুলোর সংগ্রহে
থাকত বই, বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের মধ্যে আদান-প্রদান হতো বই। অনেক স্কুলেই
গ্রন্থাগার ছিল, শিক্ষাক্রম ছিল বইবান্ধব। এখন বই পড়াটা চলে গেছে টিভি
দেখা, ইন্টারনেট ঘাঁটা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর
চর্চার পেছনে। যারা বই পড়ছে, তাদের একটা বড় অংশ পড়ছে জনপ্রিয় সাহিত্যের
ফাঁদে। জনপ্রিয় সাহিত্যের চমক আছে, স্থায়িত্ব নেই; মনকে তা আনন্দ দেয়,
চিন্তাকে খোরাক দেয় না। শিক্ষিতজনের উদ্বেগের তালিকায় বড় জায়গা নিয়ে
আছে ভাষার ক্ষেত্রে নানা শৈথিল্য, যা এর মানটাকে কিছুতেই প্রতিষ্ঠা দেয় না।
একসময় শিক্ষিতজনেরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা ভাষার ক্ষেত্রে একমত
হয়েছিলেন, যা তাঁদের চিন্তাভাবনাকে পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করবে। এর কথ্য ও
লিখিত, দুই রূপের ব্যাপারেও মতৈক্য ছিল। এটিকে কেউ বলেছেন প্রমিত, কেউ
মানভাষা। এটি ছিল আমাদের মননশীলতার এবং আনুষ্ঠানিক ভাব ও চিন্তা প্রকাশের
একটি সম্মত রূপ। একসময় এটিকে কর্তৃত্ববাদী, এলিটধর্মী ও প্রাতিষ্ঠানিক বলে
প্রশ্ন করা শুরু হলো। এখন ‘মান’ বা ‘প্রমিত’ শব্দ দুটি সন্দেহজনক একটি
চরিত্র নিয়েছে। এখন কেউ যদি বলে, আমাদের একটি মানভাষার প্রয়োজন আছে, তাকে
নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করবে; অনেকে বলবে, লোকটা সেকেলে অথবা মতলববাজ। ভাষাকে
এখন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পণ্যবিশ্বের হাতে, দৃশ্যমাধ্যমের ঠাকুরদের হাতে;
ভাষার ব্যাপারে আমরা খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছি। ভাষার মান নিয়ে কোনো কথা
তুললে একটা হইচই পড়ে যায়। না, হইচইটা মানটাকে ওপরে তোলার পক্ষে নয়, হইচইটা
ভাষা নিয়ে রক্ষণশীলতা দেখানোর অভিযোগে।
মান যে পড়ছে, তা তো বোঝা যায় বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখে। অনেক শিক্ষিতজনের বাংলা এখন শিথিল—তা ব্যাকরণ মানে না, শুরু ও শেষের যৌক্তিক সম্পর্কটি মানে না। ভাষার অনেক রূপের নিজস্বতা মানে না (এগুলোর সংমিশ্রণ যদিও মানে), ঋণ-শব্দের কার্যকরণ মানে না। কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, বাংলা ভাষায় বিদেশি (ইংরেজি, হিন্দি) শব্দের অকারণ অনুপ্রবেশ ঘটছে, ভাষা সে জন্য দূষিত হচ্ছে, তাকে একেবারে উনিশ শতকের ভাষা-সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দিয়ে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা চলবে, তরুণেরা যদি এ রকম মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে, তাহলে সেটিই বাংলা ভাষার অবধারিত ও নিয়তি নির্দিষ্ট রূপ। এটিই সময় ও সংস্কৃতির পরিক্রমায় হয়ে ওঠা বাংলা ভাষা।
কথ্য বাংলার মান নেমে যাওয়ার প্রশ্নটি না হয় বোঝা গেল— প্রতিদিনের চর্চায় এর কাঠামোগত, উচ্চারণগত এবং নান্দনিক বিচ্যুতিগুলো এখন অনস্বীকার্য (যদিও কারও কারও মতে, এখানে মান থেকেও বেশি বিবেচ্য ভাষার বিবর্তন এবং নতুন রূপে এর উদ্ভবের পেছনে সক্রিয় ঐতিহাসিক অনিবার্যতা)। কিন্তু লিখিত বাংলার? কল্পনার দিগন্তটা ছোঁয়া যায়, প্রকাশের পথগুলো ঘুরে আসা যায় যে বাংলায়, তা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছি আমরা? তা কি আয়ত্তে আসছে তাদের? লিখিত বাংলা কি ক্রমাগত একটা উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে?
ভাষা নিয়ে বিতর্কটা জরুরি। ভালো বিতর্ক একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়কেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরতে পারে, নতুন আলো ফেলতে পারে অবহেলিত কোনো অঞ্চলে। কয়েক বছর ধরে ভাষা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন অনেকেই। পক্ষে-বিপক্ষের এসব ভাবনা-আলোচনা বাংলা ভাষাকে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। এটি একটি শুভলক্ষণ।
ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু করেছিলাম। এক বা দুই প্রজন্ম পর বাংলা ভাষা কি টিকে থাকতে পারবে ইংরেজির সঙ্গে যুদ্ধ করে? এ রকম একটি প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করেন। তাঁরা আমাকে বলেন দেশে ইংরেজি মাধ্যমের/ভার্সনের শিক্ষার্থী বাড়ছে; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেশি শিক্ষার্থী পাচ্ছে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে)। এদের পাঠ্যক্রমের ও পাঠদানের ভাষা ইংরেজি। একটি কাগজে একটি গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বাংলা বই কেনেন খুব কম—৭ থেকে ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু মোটামুটি বাংলা বই কেনেন। ইংরেজি মাধ্যমের স্থলে এটি ১ থেকে ২ শতাংশ। আমি আরও শুনি, ভাষার মান কমে যাওয়ায় ধ্রুপদি সাহিত্যের বই পড়ে এখন অনেকেই আনন্দ পাচ্ছে না। বই এখন উপহারের তালিকায় নেই। পরিবারগুলো বই পড়াকে এখন আর গুরুত্বপূর্ণ ভাবে না।
এক তরুণ আমাকে বললেন, বইমেলায় প্রচুর বই বিক্রি হয়। তা ঠিক। প্রতিবছর বই বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে, এটিও ঠিক। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশে একুশের বইমেলায় প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় এক কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হওয়া মানে মাথাপিছু ছয় পয়সা বৃদ্ধি। এর থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি তো সিগারেট বিক্রিতে হয়, বল সাবান অথবা রিকশার টায়ার বিক্রিতে হয়। তা ছাড়া, বেশি বিক্রি হওয়া বই কোন শ্রেণির, তার একটা হিসাব নিলে খুব আশাবাদী হওয়া কি যায়?
আমি স্বীকার করি, ১৭ কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রির পরিসংখ্যান হতাশাজনক, ভাষার মানে টান পড়াটা কষ্টকর, ভাষার দূষণ ও বিকৃতি দুঃখজনক। কিন্তু এক বা দুই প্রজন্ম অর্থাৎ ২৫ থেকে নিয়ে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষার অবস্থান বা প্রকৃতি নিয়ে আমার খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। আমি বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী, বাংলা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাহীন। আমি বর্তমানের বিচ্যুতি, অসংগতি, শৈথিল্য ইত্যাদি নিয়ে ভাবি বটে, কিন্তু জানি এসব দীর্ঘস্থায়ী নয়। একটা গুণগত পরিবর্তন যে আসবে, ভাষা জেগে উঠবে তার সব মহিমা নিয়ে, এটি ইতিহাসই আমাদের বলে দেয়।
আমার আশাবাদের ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষার অন্তর্গত শক্তি, বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমোন্নতি, বাংলা ভাষার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি ও ‘শিক্ষিত’-এর সংজ্ঞার পরিবর্তন। বাংলা ভাষা বিশ্বের আর দশটা ভাষার মতো নয়, এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণেরা রক্ত দিয়েছে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা—এ রকম একটি দেশই আছে পৃথিবীতে, এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি। এর একটি সমৃদ্ধ এবং পুরোনো সাহিত্য ঐতিহ্য আছে। পৌনে দুই শ বছর ইংরেজ ও ২৪ বছর পাকিস্তানি উপনিবেশে কাটিয়েও এ ভাষা হারিয়ে যায়নি। আর দুই প্রজন্ম পর এই শক্তির জায়গাটি ছোট হওয়া তো দূরে থাক, বড়ই বরং হবে।
পশ্চিম বা চীন-জাপানের দিকে তাকালে বোঝা যায়, একটা ভাষার বিকাশের ও প্রসারের পেছনে অর্থনীতি কত বড় ভূমিকা রাখে। বাংলা ভাষার রাজধানী এখন ঢাকাতেই, দীর্ঘদিন তা কলকাতায় থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে, জীবনমান উন্নত হচ্ছে। আগামী ২৫ বছরে এই উন্নতি হবে চোখে পড়ার মতো। ভারতের তুলনায় আমরা যেখানে এগিয়ে, তা হচ্ছে এই উন্নতি গ্রামকে বদলে দিচ্ছে, যেহেতু উন্নয়নের পেছনের কারিগরেরা বেশির ভাগ এসেছেন গ্রাম থেকে। এখন মানুষ আর রাজনীতির মানুষ নয়, এখন মানুষ অর্থনীতির। অর্থনীতি মজবুত হলে যোগাযোগ বাড়ে। যোগাযোগের মাধ্যম সক্রিয়তা পায়। বাঙালি সচ্ছল হলে ইংরেজির দিকে যাবে। তবে অনেক বেশি যাবে বাংলার দিকে। অর্থনৈতিক উন্নতি পণ্যবিশ্বকে টগবগে করে দেয়। পণ্যের উদ্দেশ্য বিক্রি হওয়া, পণ্যবিশ্ব ভয়ানক গতিশীল এবং পণ্যবিশ্ব নিজের প্রয়োজনে এর প্রবাহ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় করে। ভাষা হচ্ছে পণ্যবিশ্বের এক নিতান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। নিজের প্রয়োজনেই তাই ভাষাকে তা সমর্থন দেবে, গায়ে-গতরে একে বাড়াবে। দেশের ভেতরে পণ্যবিশ্বের দূতিয়ালি করার জন্য বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করাটা তাই নির্বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে।
পণ্যের স্পর্শে যা হয়, নিশ্চয়, বাংলা বিকৃত হবে, শুরুতে, বিজ্ঞাপনের বাংলা এখন যেমন। কিন্তু পণ্যের পেছনে অর্থশক্তি যত বাড়বে, ভাষাও তত শক্তি পাবে। আপন শক্তিতেই তখন ভাষা খুঁজে পাবে নিজেকে সুরক্ষার পথ ও আস্থা।
এখন বাংলা সাহিত্যের দুর্দিন যাচ্ছে বলে যাঁরা দুঃখ করেন, তাঁদের বলি, সব যুগেই বলা হয়েছে সাহিত্যের দুর্দিন যাচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতি যখন উন্নত হবে, বই বিক্রি বাড়বে (পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই তা হয়েছে)। অনেক লেখক যখন শুধু লেখালেখি থেকেই জীবিকা অর্জন করতে পারবেন, তখন সাহিত্যের দৃশ্যপট পাল্টাবেই। দুর্দিন যাচ্ছে কথাটা অনেকেই অবশ্য বলবেন, তবে সেটি অভ্যাসের একটি কথার মতোই শোনাবে। ধরা যাক, বই বিক্রি এখন বছরে ৫০ লাখ, যেদিন তা পাঁচ কোটিতে দাঁড়াবে (অর্থনীতির সূত্র বলে, সেটি হতে পারে এবং এই সংখ্যায় ই-বুক, ভার্চুয়াল বুক—সবই ধরা হলেও) সেদিন পাঠক-লেখকের মিথস্ক্রিয়াটাও পাল্টে যাবে। এবং এর সঙ্গে যোগ করুন নতুন করে অক্ষরজ্ঞান পাওয়া মানুষ। আমাদের দেশে এখনো ৪০ শতাংশ মানুষ লিখতে-পড়তে জানেন না। এই সংখ্যা যেদিন শূন্যে নামবে, সেদিন?
২৫ বছর সামনে তাকালে আমি যে ছবি দেখতে পাই: একটি সমৃদ্ধ, গতিশীল এবং আত্মবিশ্বাসী দেশ। তার শিক্ষাচিত্র ঈর্ষণীয়। মানুষ স্বাবলম্বী, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম, দৃশ্যমাধ্যমের প্রথাগত প্রকাশগুলো বদলে গেছে, মানুষ ফিরে পাচ্ছে বইয়ের স্পর্শ ও আনন্দ। মানুষ শিক্ষিত ও সচ্ছল, ফলে তার ভাষায়ও এসেছে শক্তি। তার ভাষা আর শিথিল নয়। যে ভাষা ব্যবহার করছে মানুষ, তা পরিশীলিত, তাতে ইংরেজির মিশেল থাকলেও তা ভয়াবহ নয় (তার কারণ, প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার মান বাড়তে থাকায়, ভাষাশিক্ষার মান বাড়তে থাকায়)।
২৫ বছর পরের বাঙালি তরুণ হবে আত্মবিশ্বাসী। সে প্রতিযোগিতা করবে বিশ্বের সঙ্গে। সে দেখবে ফরাসিরা, জাপানিরা, ওলন্দাজরা কী যত্নে, কী নিষ্ঠায় ব্যবহার করে, চর্চা করে তাদের মাতৃভাষা। এই তরুণেরাও বাংলাকে সেই নিষ্ঠায় ও ভালোবাসায় ব্যবহার করবে।
তাদের আরও আত্মপ্রত্যয়ী ও নিষ্ঠাবান করার জন্য প্রতিবছর ফিরে আসবে অমর একুশে। ২৫ বছর পর একুশ এবং একাত্তর নিয়ে কোনো বিভ্রম থাকবে না ওই তরুণদের। তখন একুশ এবং একাত্তর হবে জেগে ওঠার নিরন্তর অনুপ্রেরণার নাম।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মান যে পড়ছে, তা তো বোঝা যায় বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখে। অনেক শিক্ষিতজনের বাংলা এখন শিথিল—তা ব্যাকরণ মানে না, শুরু ও শেষের যৌক্তিক সম্পর্কটি মানে না। ভাষার অনেক রূপের নিজস্বতা মানে না (এগুলোর সংমিশ্রণ যদিও মানে), ঋণ-শব্দের কার্যকরণ মানে না। কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, বাংলা ভাষায় বিদেশি (ইংরেজি, হিন্দি) শব্দের অকারণ অনুপ্রবেশ ঘটছে, ভাষা সে জন্য দূষিত হচ্ছে, তাকে একেবারে উনিশ শতকের ভাষা-সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দিয়ে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা চলবে, তরুণেরা যদি এ রকম মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে, তাহলে সেটিই বাংলা ভাষার অবধারিত ও নিয়তি নির্দিষ্ট রূপ। এটিই সময় ও সংস্কৃতির পরিক্রমায় হয়ে ওঠা বাংলা ভাষা।
কথ্য বাংলার মান নেমে যাওয়ার প্রশ্নটি না হয় বোঝা গেল— প্রতিদিনের চর্চায় এর কাঠামোগত, উচ্চারণগত এবং নান্দনিক বিচ্যুতিগুলো এখন অনস্বীকার্য (যদিও কারও কারও মতে, এখানে মান থেকেও বেশি বিবেচ্য ভাষার বিবর্তন এবং নতুন রূপে এর উদ্ভবের পেছনে সক্রিয় ঐতিহাসিক অনিবার্যতা)। কিন্তু লিখিত বাংলার? কল্পনার দিগন্তটা ছোঁয়া যায়, প্রকাশের পথগুলো ঘুরে আসা যায় যে বাংলায়, তা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছি আমরা? তা কি আয়ত্তে আসছে তাদের? লিখিত বাংলা কি ক্রমাগত একটা উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে?
ভাষা নিয়ে বিতর্কটা জরুরি। ভালো বিতর্ক একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়কেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরতে পারে, নতুন আলো ফেলতে পারে অবহেলিত কোনো অঞ্চলে। কয়েক বছর ধরে ভাষা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন অনেকেই। পক্ষে-বিপক্ষের এসব ভাবনা-আলোচনা বাংলা ভাষাকে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। এটি একটি শুভলক্ষণ।
ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু করেছিলাম। এক বা দুই প্রজন্ম পর বাংলা ভাষা কি টিকে থাকতে পারবে ইংরেজির সঙ্গে যুদ্ধ করে? এ রকম একটি প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করেন। তাঁরা আমাকে বলেন দেশে ইংরেজি মাধ্যমের/ভার্সনের শিক্ষার্থী বাড়ছে; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেশি শিক্ষার্থী পাচ্ছে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে)। এদের পাঠ্যক্রমের ও পাঠদানের ভাষা ইংরেজি। একটি কাগজে একটি গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বাংলা বই কেনেন খুব কম—৭ থেকে ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু মোটামুটি বাংলা বই কেনেন। ইংরেজি মাধ্যমের স্থলে এটি ১ থেকে ২ শতাংশ। আমি আরও শুনি, ভাষার মান কমে যাওয়ায় ধ্রুপদি সাহিত্যের বই পড়ে এখন অনেকেই আনন্দ পাচ্ছে না। বই এখন উপহারের তালিকায় নেই। পরিবারগুলো বই পড়াকে এখন আর গুরুত্বপূর্ণ ভাবে না।
এক তরুণ আমাকে বললেন, বইমেলায় প্রচুর বই বিক্রি হয়। তা ঠিক। প্রতিবছর বই বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে, এটিও ঠিক। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশে একুশের বইমেলায় প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় এক কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হওয়া মানে মাথাপিছু ছয় পয়সা বৃদ্ধি। এর থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি তো সিগারেট বিক্রিতে হয়, বল সাবান অথবা রিকশার টায়ার বিক্রিতে হয়। তা ছাড়া, বেশি বিক্রি হওয়া বই কোন শ্রেণির, তার একটা হিসাব নিলে খুব আশাবাদী হওয়া কি যায়?
আমি স্বীকার করি, ১৭ কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রির পরিসংখ্যান হতাশাজনক, ভাষার মানে টান পড়াটা কষ্টকর, ভাষার দূষণ ও বিকৃতি দুঃখজনক। কিন্তু এক বা দুই প্রজন্ম অর্থাৎ ২৫ থেকে নিয়ে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষার অবস্থান বা প্রকৃতি নিয়ে আমার খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। আমি বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী, বাংলা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাহীন। আমি বর্তমানের বিচ্যুতি, অসংগতি, শৈথিল্য ইত্যাদি নিয়ে ভাবি বটে, কিন্তু জানি এসব দীর্ঘস্থায়ী নয়। একটা গুণগত পরিবর্তন যে আসবে, ভাষা জেগে উঠবে তার সব মহিমা নিয়ে, এটি ইতিহাসই আমাদের বলে দেয়।
আমার আশাবাদের ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষার অন্তর্গত শক্তি, বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমোন্নতি, বাংলা ভাষার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর এর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি ও ‘শিক্ষিত’-এর সংজ্ঞার পরিবর্তন। বাংলা ভাষা বিশ্বের আর দশটা ভাষার মতো নয়, এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণেরা রক্ত দিয়েছে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা—এ রকম একটি দেশই আছে পৃথিবীতে, এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি। এর একটি সমৃদ্ধ এবং পুরোনো সাহিত্য ঐতিহ্য আছে। পৌনে দুই শ বছর ইংরেজ ও ২৪ বছর পাকিস্তানি উপনিবেশে কাটিয়েও এ ভাষা হারিয়ে যায়নি। আর দুই প্রজন্ম পর এই শক্তির জায়গাটি ছোট হওয়া তো দূরে থাক, বড়ই বরং হবে।
পশ্চিম বা চীন-জাপানের দিকে তাকালে বোঝা যায়, একটা ভাষার বিকাশের ও প্রসারের পেছনে অর্থনীতি কত বড় ভূমিকা রাখে। বাংলা ভাষার রাজধানী এখন ঢাকাতেই, দীর্ঘদিন তা কলকাতায় থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে, জীবনমান উন্নত হচ্ছে। আগামী ২৫ বছরে এই উন্নতি হবে চোখে পড়ার মতো। ভারতের তুলনায় আমরা যেখানে এগিয়ে, তা হচ্ছে এই উন্নতি গ্রামকে বদলে দিচ্ছে, যেহেতু উন্নয়নের পেছনের কারিগরেরা বেশির ভাগ এসেছেন গ্রাম থেকে। এখন মানুষ আর রাজনীতির মানুষ নয়, এখন মানুষ অর্থনীতির। অর্থনীতি মজবুত হলে যোগাযোগ বাড়ে। যোগাযোগের মাধ্যম সক্রিয়তা পায়। বাঙালি সচ্ছল হলে ইংরেজির দিকে যাবে। তবে অনেক বেশি যাবে বাংলার দিকে। অর্থনৈতিক উন্নতি পণ্যবিশ্বকে টগবগে করে দেয়। পণ্যের উদ্দেশ্য বিক্রি হওয়া, পণ্যবিশ্ব ভয়ানক গতিশীল এবং পণ্যবিশ্ব নিজের প্রয়োজনে এর প্রবাহ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় করে। ভাষা হচ্ছে পণ্যবিশ্বের এক নিতান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। নিজের প্রয়োজনেই তাই ভাষাকে তা সমর্থন দেবে, গায়ে-গতরে একে বাড়াবে। দেশের ভেতরে পণ্যবিশ্বের দূতিয়ালি করার জন্য বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করাটা তাই নির্বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে।
পণ্যের স্পর্শে যা হয়, নিশ্চয়, বাংলা বিকৃত হবে, শুরুতে, বিজ্ঞাপনের বাংলা এখন যেমন। কিন্তু পণ্যের পেছনে অর্থশক্তি যত বাড়বে, ভাষাও তত শক্তি পাবে। আপন শক্তিতেই তখন ভাষা খুঁজে পাবে নিজেকে সুরক্ষার পথ ও আস্থা।
এখন বাংলা সাহিত্যের দুর্দিন যাচ্ছে বলে যাঁরা দুঃখ করেন, তাঁদের বলি, সব যুগেই বলা হয়েছে সাহিত্যের দুর্দিন যাচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতি যখন উন্নত হবে, বই বিক্রি বাড়বে (পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই তা হয়েছে)। অনেক লেখক যখন শুধু লেখালেখি থেকেই জীবিকা অর্জন করতে পারবেন, তখন সাহিত্যের দৃশ্যপট পাল্টাবেই। দুর্দিন যাচ্ছে কথাটা অনেকেই অবশ্য বলবেন, তবে সেটি অভ্যাসের একটি কথার মতোই শোনাবে। ধরা যাক, বই বিক্রি এখন বছরে ৫০ লাখ, যেদিন তা পাঁচ কোটিতে দাঁড়াবে (অর্থনীতির সূত্র বলে, সেটি হতে পারে এবং এই সংখ্যায় ই-বুক, ভার্চুয়াল বুক—সবই ধরা হলেও) সেদিন পাঠক-লেখকের মিথস্ক্রিয়াটাও পাল্টে যাবে। এবং এর সঙ্গে যোগ করুন নতুন করে অক্ষরজ্ঞান পাওয়া মানুষ। আমাদের দেশে এখনো ৪০ শতাংশ মানুষ লিখতে-পড়তে জানেন না। এই সংখ্যা যেদিন শূন্যে নামবে, সেদিন?
২৫ বছর সামনে তাকালে আমি যে ছবি দেখতে পাই: একটি সমৃদ্ধ, গতিশীল এবং আত্মবিশ্বাসী দেশ। তার শিক্ষাচিত্র ঈর্ষণীয়। মানুষ স্বাবলম্বী, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম, দৃশ্যমাধ্যমের প্রথাগত প্রকাশগুলো বদলে গেছে, মানুষ ফিরে পাচ্ছে বইয়ের স্পর্শ ও আনন্দ। মানুষ শিক্ষিত ও সচ্ছল, ফলে তার ভাষায়ও এসেছে শক্তি। তার ভাষা আর শিথিল নয়। যে ভাষা ব্যবহার করছে মানুষ, তা পরিশীলিত, তাতে ইংরেজির মিশেল থাকলেও তা ভয়াবহ নয় (তার কারণ, প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার মান বাড়তে থাকায়, ভাষাশিক্ষার মান বাড়তে থাকায়)।
২৫ বছর পরের বাঙালি তরুণ হবে আত্মবিশ্বাসী। সে প্রতিযোগিতা করবে বিশ্বের সঙ্গে। সে দেখবে ফরাসিরা, জাপানিরা, ওলন্দাজরা কী যত্নে, কী নিষ্ঠায় ব্যবহার করে, চর্চা করে তাদের মাতৃভাষা। এই তরুণেরাও বাংলাকে সেই নিষ্ঠায় ও ভালোবাসায় ব্যবহার করবে।
তাদের আরও আত্মপ্রত্যয়ী ও নিষ্ঠাবান করার জন্য প্রতিবছর ফিরে আসবে অমর একুশে। ২৫ বছর পর একুশ এবং একাত্তর নিয়ে কোনো বিভ্রম থাকবে না ওই তরুণদের। তখন একুশ এবং একাত্তর হবে জেগে ওঠার নিরন্তর অনুপ্রেরণার নাম।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments