আমি লক্ষ্মী মেয়ে নই by মেহেরুন নেছা রুমা
'স্কুল জীবন থেকেই আমাকে এলাকার সবাই চিনত। সবাই যে খুব ভালো মেয়ে হিসেবে জানত বা লক্ষ্মী মেয়ে ভাবত_ তা নয়। কেননা আমি বুঝতাম আমাদের সমাজে 'লক্ষ্মী মেয়ে' বলতে কাদের বোঝায়_ বলছিলেন তানি। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করেন তিনি। বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। মেয়ে হয়ে সংসারের হালও ধরেছেন। বাবা মারা গেছে বছর পাঁচেক হলো। বড় দুটি ভাই থাকতেও সংসারে তানিই যেন 'কর্তা'। কেননা, সবাই এখন বোঝে, তানির সিদ্ধান্ত কখনও ভুল হতে পারে না। বিয়ে করে সংসারী হওয়াটা তার কাছে তেমনটা লোভনীয় নয়। তানি বলেন, 'মনের সঙ্গে মিলবে তেমন পাত্র খুঁজে পেলে তবেই বিয়ে করব।' মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি_ এমন কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তিনি। স্কুল জীবন থেকেই তানি লেখাপড়ায় যতটা না মনোযোগী ছিল, তার চেয়ে অতিমাত্রায় ছিলেন খেলাধুলা,নাচ, আবৃত্তি এসবে। ক্লাস শেষে কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মন যেদিকে চায় ঘুরে বেড়াতেন। মন চাইলেই সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের বাড়ি চক্কর দিয়ে আসত। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পথটা তার জন্য মসৃণ ছিল না। বাবা-মা এবং বড় ভাইদের অজস্র বকুনি এবং নিষেধাজ্ঞা ছিল তার সকাল-বিকেলের নাস্তার মতোই। তার কথা_ আমি তো অন্যায় কিছু করছি না। মেয়ে হয়েছি তো কী হয়েছে? আমার ভাইয়েরা যদি রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিতে পারে, মাঠে খেলতে যেতে পারে, আমি কেন পারব না? পাছে লোকে কিছু বলে_ তাকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখন এমবিএ পড়ছেন, একই সঙ্গে টেলিভিশনে চাকরি করছেন। এ নিয়েও কম শুনতে হয়নি তাকে। সবাই বলে মিডিয়ার মেয়েরা ভালো না। কেউ বলে, ও তো এমনই, ছোটবেলা থেকেই পুরুষের মতো চলন-বলন। কিন্তু তানির কথা 'আমার কাজ আমি করি । সেটা ভালো কি মন্দ তাও আমিই বুঝব। কোনো অপরাধ তো করি না বা কারও ওপর নির্ভরশীলও নই। কে কী বলল, তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। অন্যের হুকুম মেনে চলা, পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকা, এমন লক্ষ্মী মেয়ে হওয়ার বাসনা আমার নেই।'
তিথির যখন বিয়ে হয় তিনি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বয়সের ব্যবধানটা মানুষের দৃষ্টিতে পড়ার জন্য যতটা যথেষ্ট হওয়া দরকার ততটাই ছিল। তবু তিথি মনে করতেন, একজন ভালো স্বামী তো পেয়েছি। এই ভালো স্বামীটি এতটাই ভালো ছিল, বিয়ের পরপরই তিথিকে সালোয়ার-কামিজ পরা ছাড়তে হলো। এমনকি ভার্সিটিতেও তাকে শাড়ি পরেই যেতে হতো। তিথি বেশ বেকায়দায় পড়তেন। ভালো করে গুছিয়ে শাড়িটা পরতে পারতেন না। শাড়ি পরে ক্লাস করতেন বলে বন্ধুরাও ক্ষেপাত। বাসায় এসে বললে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির গুরুজনরা বলতেন, 'শাড়ি পরে যেতে না পারলে তুমি বাপু লেখাপড়াই ছেড়ে দাও।' বহু কষ্টে পরীক্ষাগুলো দিয়ে দিয়ে সার্টিফিকেট যখন অর্জন করলেন, তখন তাকে সাফ জানানো হলো, 'বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করার জন্য শিক্ষিত মায়ের দরকার আছে, তাই তোমাকে লেখাপড়া শেষ করতে দিলাম। কিন্তু ভুলেও চাকরি করার বাসনা যেন না জাগে মনে। আমাদের পরিবারের বউয়েরা কোনোদিন বাইরে কাজ করতে যায় না।' এভাবে তিথির লালিত স্বপ্নগুলো যখন নিষেধাজ্ঞার কশাঘাতে মার খেতে লাগল, তিনি তখন তা অদৃষ্টের পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমেই তার জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে। একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে তিথি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। চার দেয়ালের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য তার প্রাণ ছটফট করতে থাকে। তিনি প্রথমে ঘরে বসেই আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়েন, কোনো একটা কাজের সন্ধান করেন। একটু একটু করে স্বামীর কাছে নিজের চাওয়াগুলো প্রকাশ করেন। যদিও প্রতিটিতেই তিনি 'না' শোনেন। তবু তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। একটি এনজিওতে কাজ পেয়ে যান এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে বাইরে পা রাখেন।
সংসার তখন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়। তিথি বলেন, আমি যদি ঘর সামলে বাইরে কাজ করতে যাই, তাহলে ঘরের লোকদের সমস্যা কী? তিথি এখন শাড়ি পরতে বাধ্য নন। যে পোশাক পরে তিনি সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে পারেন সেটিই বেছে নেন। সবার মন রক্ষা করে লক্ষ্মী বউ হওয়া -এখন আর ভাবতেই পারেন না তিথি।
তিথির যখন বিয়ে হয় তিনি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বয়সের ব্যবধানটা মানুষের দৃষ্টিতে পড়ার জন্য যতটা যথেষ্ট হওয়া দরকার ততটাই ছিল। তবু তিথি মনে করতেন, একজন ভালো স্বামী তো পেয়েছি। এই ভালো স্বামীটি এতটাই ভালো ছিল, বিয়ের পরপরই তিথিকে সালোয়ার-কামিজ পরা ছাড়তে হলো। এমনকি ভার্সিটিতেও তাকে শাড়ি পরেই যেতে হতো। তিথি বেশ বেকায়দায় পড়তেন। ভালো করে গুছিয়ে শাড়িটা পরতে পারতেন না। শাড়ি পরে ক্লাস করতেন বলে বন্ধুরাও ক্ষেপাত। বাসায় এসে বললে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির গুরুজনরা বলতেন, 'শাড়ি পরে যেতে না পারলে তুমি বাপু লেখাপড়াই ছেড়ে দাও।' বহু কষ্টে পরীক্ষাগুলো দিয়ে দিয়ে সার্টিফিকেট যখন অর্জন করলেন, তখন তাকে সাফ জানানো হলো, 'বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করার জন্য শিক্ষিত মায়ের দরকার আছে, তাই তোমাকে লেখাপড়া শেষ করতে দিলাম। কিন্তু ভুলেও চাকরি করার বাসনা যেন না জাগে মনে। আমাদের পরিবারের বউয়েরা কোনোদিন বাইরে কাজ করতে যায় না।' এভাবে তিথির লালিত স্বপ্নগুলো যখন নিষেধাজ্ঞার কশাঘাতে মার খেতে লাগল, তিনি তখন তা অদৃষ্টের পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমেই তার জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে। একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে তিথি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। চার দেয়ালের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য তার প্রাণ ছটফট করতে থাকে। তিনি প্রথমে ঘরে বসেই আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়েন, কোনো একটা কাজের সন্ধান করেন। একটু একটু করে স্বামীর কাছে নিজের চাওয়াগুলো প্রকাশ করেন। যদিও প্রতিটিতেই তিনি 'না' শোনেন। তবু তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। একটি এনজিওতে কাজ পেয়ে যান এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে বাইরে পা রাখেন।
সংসার তখন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়। তিথি বলেন, আমি যদি ঘর সামলে বাইরে কাজ করতে যাই, তাহলে ঘরের লোকদের সমস্যা কী? তিথি এখন শাড়ি পরতে বাধ্য নন। যে পোশাক পরে তিনি সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে পারেন সেটিই বেছে নেন। সবার মন রক্ষা করে লক্ষ্মী বউ হওয়া -এখন আর ভাবতেই পারেন না তিথি।
No comments