আসুন শহীদ মিনারকে একটি মসজিদ অথবা মন্দিরে পরিণত করি! by ফরহাদ মজহার
শহীদ
মিনার গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিক প্রতিবাদের প্রতীক ও হাতিয়ার হিসাবে। প্রতীক,
কারণ রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নিপীড়ন অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের
জনগণের লড়াই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটা বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে
উঠেছিল; শহীদ মিনার সেই মুহূর্তের প্রতীক। সমাজে যখনই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ের
দাবি ওঠে, আমরা বার বার শহীদ মিনারে গিয়ে দাঁড়াই। ফলে লড়াইয়ের সেই বিশেষ
ঐতিহাসিক মুহূর্ত সার্বজনীন তাৎপর্য লাভ করেছে।
অন্যদিকে, একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিগঠন ও রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সঙ্গে যে ভাষার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সেটাও শিখেছি। অতএবএই মুহূর্তটিকে শুধু ভাষা আন্দোলনের দিক থেকে বিচার করলে চলবে না। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মধ্যে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। যেমন, কেন খেটে খাওয়া কৃষক ও শ্রমিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রশ্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতির দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল? ভাষা আন্দোলনে? কী ঐতিহাসিক কারণ ছিল তার?
ইংরেজ ১৭৫৭ সালে এ দেশ দখল করে নেবার পর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ অবধি এই দেশের মানুষ—বিশেষত মুসলমান সমাজ ইংরেজি শেখেনি। ততোদিনে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে। বাংলাভাষী মুসলমান তখন অধিকাংশই কৃষক, জোলা, কারিগর ইত্যাদি। সমাজে নিগৃহীত। যখন তারা শিক্ষার দিকে ঝুঁকল তখন অনেক আশা বুকে বেঁধে পাট বেচে মরিচ বেচে ধান বিক্রি করে তারা তাদের সন্তানদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাতে শুরু করল। তারা পাকিস্তান চেয়েছিল দেশ ভাগ করবার জন্য নয়, জমিদার মহাজনদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাবার জন্য। ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল এমন যে জমিদার ও সুদখোরি মহাজনদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকসহ নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের বিরোধ সাতচল্লিশের দেশভাগের একটি প্রধান কারণ। এই দিকটি মনে না রাখলে আমরা যেমন আমাদের নিজেদের বুঝতে ভুল করব, তেমনি কেন বাংলার কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে শামিল হোল তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা আন্দোলনের পেছনে কেন কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোল তার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ধান বেচে পাট বেচে মরিচ বিক্রি করে যে-ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল তাদের বুকে গুলি চালানো হয়েছে। সেই গুলির রক্তের ছিটা ও ক্ষত কৃষকের বুকে গিয়ে লেগেছে, জোলা, কারিগর মেহনতি মানুষের বুকে গিয়ে লেগেছে। পাঁজর ভেদ করে চলে গিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মত সংখ্যা-গরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে এই আন্দোলন নিছকই ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার আন্দোলন ছিল না। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে জনগণ, কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর তারা বুঝতে পেরেছিল তাদেরকেও ইংরেজি শিখতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে। ভবিষ্যতের আশায় তারা তাদের সন্তানদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করল। সেই ছাত্রদের যখন খুন করা হোল সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে তখন আগুন জ্বলে উঠল।
শুধু প্রতীক নয়, শহীদ মিনার ছিল একই সঙ্গে রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি যখন কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে শহীদ মিনারকে আশ্রয় করে আন্দোলনের দাবিদাওয়া নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে। শহীদ মিনার সরগরম হয়ে ওঠে। ঠিক যে শহীদ মিনার শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দাবিদাওয়ার পাটাতন হিসাবেই প্রধানত ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে শহীদ মিনারের এই ভূমিকা ছিল অনন্য। শহীদ মিনারের এই রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে যখন এর অধঃপতন ঘটেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক মঞ্চে। এই সাংস্কৃতিকতা আবার অধিকাংশ সময় ছিল দলীয়, বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতার নগ্ন প্রদর্শন। পতনের ধারাবাহিকতাই চলছিল এতদিন। ফলে শহীদ মিনারের বিরাজনীতিকরণ ঘটেছে দ্রুত। রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের প্রতীক বা হাতিয়ার হয়ে থাকার অবক্ষয় ঘটেছে মারাত্মকভাবে।
যখন একে তথাকথিত সেক্যুলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী মসজিদ বা মন্দিরের বিকল্প হিসাবে ভাবতে ও গণ্য করতে শুরু করেছে তখনএই পতন পচনের রূপ ধরেছে। শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে 'পাকপবিত্র' স্থান, তার আবার একটি মূলবেদীও আছে। ‘পবিত্র’, ‘বেদী’ ইত্যাদি ধর্মতাত্ত্বিক চিহ্নে শহীদ মিনারকে ভূষিত করা হয়। দারুণ ইন্টারেস্টিং!
এই পচন কতো গভীর রূপ নিয়েছে সেটা মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা জনস্বার্থ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে শহীদ মিনারের ‘মর্যাদা ও পবিত্রতা’ এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় ২৫ আগস্ট ২০১০ তারিখে বুধবার বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দারের বেঞ্চের দেয়া রায়ের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে। রায়ে প্রতিষ্ঠিত হোল শহীদ মিনারের তাৎপর্য রাজনৈতিক তো নয়ই এমনকি সাংস্কৃতিকও নয়; শহীদ মিনারকে এখন আমাদের মন্দির বা মসজিদের মত ‘পবিত্র’ গণ্য করতে হবে। এটাও আমাদের জানিয়ে দেওয়া হোল শহীদ মিনারে মন্দিরের মতো একটি ‘মূল বেদী’ (!) আছে। শহীদ মিনারের মূল বেদীতে কোন সভা সমাবেশ করা যাবে না। তবে ‘বেদীর পাদদেশে’ সভা সমাবেশ করা যাবে।
শহীদ মিনারে ‘বেদী’ আছে এবং বেদীর পাদদেশও আছে। বেশ। অথচ বাংলাদেশের কোন্ স্থান 'পাকপবিত্র' আর কোথায় 'বেদী' স্থাপিত হয়েছে বা আগামিতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত করে নি। শহীদ মিনারে সভা সমাবেশ করা যাবে কি যাবে না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নাই। এই এখতিয়ার জাতীয় সংসদের। ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা করা ও শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র অবস্থায় ‘সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ (দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৩৬ ও ৩৭।)।
রায়ে আদালত নিজের এখতিয়ারের বাইরে আরো নির্দেশ দিয়েছে। যেমন, “বিশ্ববিদ্যালয় ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।” আরো আছে, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মরণোত্তর পদক ও জীবিতদের জাতীয় পদক দেয়ার নির্দেশ; জীবিত ভাষা সৈনিকদের কেউ সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইলে তা দেয়ার নির্দেশ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ; সেখানে পর্যটকদের জন্য ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংক্রান্ত পুস্তিকা রাখার নির্দেশ; ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরির জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ; এমনকি এ বিষয়ে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশও দেয়া হয়। অন্যান্য নির্দেশের মধ্যে আছে ভাষা সৈনিকদের সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাদের জন্য সাধ্যমতো সরকারি সুবিধা নিশ্চিত করা, ইত্যাদি।
এই সকল নির্দেশের মধ্যে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ একাকার হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়গুলো কেন জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই দিকও স্পষ্ট নয়। বিচার বিভাগের সীমা কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ আদালতের রায় দেখে আর বোঝার উপায় নাই। জনগণের লড়াই ও সংগ্রামের প্রতীক ও হাতিয়ার শহীদ মিনারের এই দুর্দশা দেখে সত্যই করুণা হয়।
রায়ে শহীদ মিনার এলাকায় ভবঘুরেরা যেন ঘোরাফেরা করতে না পারে বা ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালাতে না পারে সে জন্য তিন জন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষের কী কার্য সামাজিক আর কোনটাই বা 'অসামাজিক' তার নৈতিক মানদণ্ড ঠিক করে দেবার দায়িত্ব আদালতের নয়। ‘অসামাজিকতা’-র আইনী সংজ্ঞা কী? নৈতিক পরিমণ্ডলের সীমা আইন করে নির্ধারণ করা যায় না। শহীদ মিনারের নির্বাহী ব্যবস্থাপনার সমস্যা রায় দিয়ে সমাধানের চেষ্টাও বিস্ময়কর বটে। শহীদ মিনারের দারোয়ানের সমস্যাকেই আদালত আইন করে নিষ্পত্তি করতে চাইছেন। এতে আদালত কোথায় নেমে আসে সেটা আমরা আদালতকে বিবেচনা করে দেখতে অনুরোধ করব।
ভবঘুরেরা বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু তাদের হাত থেকে শহীদ মিনার রক্ষা করতে হবে, এই যদি আদালতের রায় হয় তাহলে আদালত নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করবে কীভাবে? ঠিক যে শহীদ মিনার এমনভাবে ব্যবহার করা দরকার যাতে তার রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ না হয়। যদি রায়ের বাস্তবোচিত মানে করি, তার মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশের অবহেলিত, নির্যাতিত সাধারণ যেসব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ—যেসব ঘরহারা গরিব মানুষ মাঝেমধ্যে শহীদ মিনারে এসে বিশ্রাম নিত, যাদের মাথার ওপর ছাদ নাই, কিচ্ছু নাই, তাদের জন্য শহীদ মিনার নিষিদ্ধ হোল। এই রায় গণমানুষের পক্ষে গেল না। দুর্ভাগ্য আমাদের।
আসুন রায়ের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমরা শহীদ মিনারকে একটি মসজিদ অথবা মন্দিরে পরিণত করি। বাংলাদেশে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস চুলায় যাক। কী এসে যায় শহীদ মিনার আমাদের বেড়ে ওঠার কোন প্রতীক বা হাতিয়ার কিনা। এই যুগ মসজিদের যুগ, এই যুগ মন্দিরের যুগ। আসুন আমরা আমাদের গোপনে লুকিয়ে রাখা ধর্মান্ধ অনুভূতিগুলোকে শহীদ মিনারে মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজাই। তারপর প্রশংসা করি আমাদের সেক্যুলারিজমের। আসুন পাকপবিত্র স্থানগুলোকে আরো পাকপবিত্র করে তুলি, বেদীগুলোকে আরো পূজার ফুল দিয়ে সাজাই!!!
এই তো চাই!
অন্যদিকে, একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিগঠন ও রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সঙ্গে যে ভাষার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সেটাও শিখেছি। অতএবএই মুহূর্তটিকে শুধু ভাষা আন্দোলনের দিক থেকে বিচার করলে চলবে না। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মধ্যে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। যেমন, কেন খেটে খাওয়া কৃষক ও শ্রমিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রশ্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতির দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল? ভাষা আন্দোলনে? কী ঐতিহাসিক কারণ ছিল তার?
ইংরেজ ১৭৫৭ সালে এ দেশ দখল করে নেবার পর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ অবধি এই দেশের মানুষ—বিশেষত মুসলমান সমাজ ইংরেজি শেখেনি। ততোদিনে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে। বাংলাভাষী মুসলমান তখন অধিকাংশই কৃষক, জোলা, কারিগর ইত্যাদি। সমাজে নিগৃহীত। যখন তারা শিক্ষার দিকে ঝুঁকল তখন অনেক আশা বুকে বেঁধে পাট বেচে মরিচ বেচে ধান বিক্রি করে তারা তাদের সন্তানদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাতে শুরু করল। তারা পাকিস্তান চেয়েছিল দেশ ভাগ করবার জন্য নয়, জমিদার মহাজনদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাবার জন্য। ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল এমন যে জমিদার ও সুদখোরি মহাজনদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকসহ নিপীড়িত জনগণের স্বার্থের বিরোধ সাতচল্লিশের দেশভাগের একটি প্রধান কারণ। এই দিকটি মনে না রাখলে আমরা যেমন আমাদের নিজেদের বুঝতে ভুল করব, তেমনি কেন বাংলার কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে শামিল হোল তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা আন্দোলনের পেছনে কেন কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোল তার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ধান বেচে পাট বেচে মরিচ বিক্রি করে যে-ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল তাদের বুকে গুলি চালানো হয়েছে। সেই গুলির রক্তের ছিটা ও ক্ষত কৃষকের বুকে গিয়ে লেগেছে, জোলা, কারিগর মেহনতি মানুষের বুকে গিয়ে লেগেছে। পাঁজর ভেদ করে চলে গিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মত সংখ্যা-গরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে এই আন্দোলন নিছকই ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার আন্দোলন ছিল না। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে জনগণ, কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর তারা বুঝতে পেরেছিল তাদেরকেও ইংরেজি শিখতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে। ভবিষ্যতের আশায় তারা তাদের সন্তানদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করল। সেই ছাত্রদের যখন খুন করা হোল সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে তখন আগুন জ্বলে উঠল।
শুধু প্রতীক নয়, শহীদ মিনার ছিল একই সঙ্গে রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি যখন কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে শহীদ মিনারকে আশ্রয় করে আন্দোলনের দাবিদাওয়া নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে। শহীদ মিনার সরগরম হয়ে ওঠে। ঠিক যে শহীদ মিনার শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দাবিদাওয়ার পাটাতন হিসাবেই প্রধানত ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে শহীদ মিনারের এই ভূমিকা ছিল অনন্য। শহীদ মিনারের এই রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে যখন এর অধঃপতন ঘটেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক মঞ্চে। এই সাংস্কৃতিকতা আবার অধিকাংশ সময় ছিল দলীয়, বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতার নগ্ন প্রদর্শন। পতনের ধারাবাহিকতাই চলছিল এতদিন। ফলে শহীদ মিনারের বিরাজনীতিকরণ ঘটেছে দ্রুত। রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের প্রতীক বা হাতিয়ার হয়ে থাকার অবক্ষয় ঘটেছে মারাত্মকভাবে।
যখন একে তথাকথিত সেক্যুলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী মসজিদ বা মন্দিরের বিকল্প হিসাবে ভাবতে ও গণ্য করতে শুরু করেছে তখনএই পতন পচনের রূপ ধরেছে। শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে 'পাকপবিত্র' স্থান, তার আবার একটি মূলবেদীও আছে। ‘পবিত্র’, ‘বেদী’ ইত্যাদি ধর্মতাত্ত্বিক চিহ্নে শহীদ মিনারকে ভূষিত করা হয়। দারুণ ইন্টারেস্টিং!
এই পচন কতো গভীর রূপ নিয়েছে সেটা মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা জনস্বার্থ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে শহীদ মিনারের ‘মর্যাদা ও পবিত্রতা’ এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় ২৫ আগস্ট ২০১০ তারিখে বুধবার বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দারের বেঞ্চের দেয়া রায়ের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে। রায়ে প্রতিষ্ঠিত হোল শহীদ মিনারের তাৎপর্য রাজনৈতিক তো নয়ই এমনকি সাংস্কৃতিকও নয়; শহীদ মিনারকে এখন আমাদের মন্দির বা মসজিদের মত ‘পবিত্র’ গণ্য করতে হবে। এটাও আমাদের জানিয়ে দেওয়া হোল শহীদ মিনারে মন্দিরের মতো একটি ‘মূল বেদী’ (!) আছে। শহীদ মিনারের মূল বেদীতে কোন সভা সমাবেশ করা যাবে না। তবে ‘বেদীর পাদদেশে’ সভা সমাবেশ করা যাবে।
শহীদ মিনারে ‘বেদী’ আছে এবং বেদীর পাদদেশও আছে। বেশ। অথচ বাংলাদেশের কোন্ স্থান 'পাকপবিত্র' আর কোথায় 'বেদী' স্থাপিত হয়েছে বা আগামিতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত করে নি। শহীদ মিনারে সভা সমাবেশ করা যাবে কি যাবে না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নাই। এই এখতিয়ার জাতীয় সংসদের। ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা করা ও শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র অবস্থায় ‘সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ (দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৩৬ ও ৩৭।)।
রায়ে আদালত নিজের এখতিয়ারের বাইরে আরো নির্দেশ দিয়েছে। যেমন, “বিশ্ববিদ্যালয় ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।” আরো আছে, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মরণোত্তর পদক ও জীবিতদের জাতীয় পদক দেয়ার নির্দেশ; জীবিত ভাষা সৈনিকদের কেউ সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইলে তা দেয়ার নির্দেশ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ; সেখানে পর্যটকদের জন্য ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংক্রান্ত পুস্তিকা রাখার নির্দেশ; ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরির জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ; এমনকি এ বিষয়ে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশও দেয়া হয়। অন্যান্য নির্দেশের মধ্যে আছে ভাষা সৈনিকদের সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাদের জন্য সাধ্যমতো সরকারি সুবিধা নিশ্চিত করা, ইত্যাদি।
এই সকল নির্দেশের মধ্যে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ একাকার হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়গুলো কেন জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই দিকও স্পষ্ট নয়। বিচার বিভাগের সীমা কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ আদালতের রায় দেখে আর বোঝার উপায় নাই। জনগণের লড়াই ও সংগ্রামের প্রতীক ও হাতিয়ার শহীদ মিনারের এই দুর্দশা দেখে সত্যই করুণা হয়।
রায়ে শহীদ মিনার এলাকায় ভবঘুরেরা যেন ঘোরাফেরা করতে না পারে বা ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালাতে না পারে সে জন্য তিন জন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষের কী কার্য সামাজিক আর কোনটাই বা 'অসামাজিক' তার নৈতিক মানদণ্ড ঠিক করে দেবার দায়িত্ব আদালতের নয়। ‘অসামাজিকতা’-র আইনী সংজ্ঞা কী? নৈতিক পরিমণ্ডলের সীমা আইন করে নির্ধারণ করা যায় না। শহীদ মিনারের নির্বাহী ব্যবস্থাপনার সমস্যা রায় দিয়ে সমাধানের চেষ্টাও বিস্ময়কর বটে। শহীদ মিনারের দারোয়ানের সমস্যাকেই আদালত আইন করে নিষ্পত্তি করতে চাইছেন। এতে আদালত কোথায় নেমে আসে সেটা আমরা আদালতকে বিবেচনা করে দেখতে অনুরোধ করব।
ভবঘুরেরা বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু তাদের হাত থেকে শহীদ মিনার রক্ষা করতে হবে, এই যদি আদালতের রায় হয় তাহলে আদালত নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করবে কীভাবে? ঠিক যে শহীদ মিনার এমনভাবে ব্যবহার করা দরকার যাতে তার রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ না হয়। যদি রায়ের বাস্তবোচিত মানে করি, তার মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশের অবহেলিত, নির্যাতিত সাধারণ যেসব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ—যেসব ঘরহারা গরিব মানুষ মাঝেমধ্যে শহীদ মিনারে এসে বিশ্রাম নিত, যাদের মাথার ওপর ছাদ নাই, কিচ্ছু নাই, তাদের জন্য শহীদ মিনার নিষিদ্ধ হোল। এই রায় গণমানুষের পক্ষে গেল না। দুর্ভাগ্য আমাদের।
আসুন রায়ের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমরা শহীদ মিনারকে একটি মসজিদ অথবা মন্দিরে পরিণত করি। বাংলাদেশে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস চুলায় যাক। কী এসে যায় শহীদ মিনার আমাদের বেড়ে ওঠার কোন প্রতীক বা হাতিয়ার কিনা। এই যুগ মসজিদের যুগ, এই যুগ মন্দিরের যুগ। আসুন আমরা আমাদের গোপনে লুকিয়ে রাখা ধর্মান্ধ অনুভূতিগুলোকে শহীদ মিনারে মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজাই। তারপর প্রশংসা করি আমাদের সেক্যুলারিজমের। আসুন পাকপবিত্র স্থানগুলোকে আরো পাকপবিত্র করে তুলি, বেদীগুলোকে আরো পূজার ফুল দিয়ে সাজাই!!!
এই তো চাই!
No comments