সমাধান সংলাপে বিদেশিরা সরব- আওয়ামী লীগের না, বিএনপি উন্মুখ
রাজনৈতিক
সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে বিদেশিরা সরব হলেও আওয়ামী লীগ তার
অবস্থানে অনড় রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত সহিংসতায়
রূপান্তরিত হওয়ার উদ্বেগের মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট কাল রোববার থেকে
আবারও হরতাল ডেকেছে। সহিংসতার নিন্দা ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা বন্ধের
লক্ষ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিতে গত দুই দিনে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের চাপ বেড়েছে। এ বিষয়ে যাঁরা কূটনৈতিক ভাষায় অনুরোধ বা
আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁদের পুরোভাগে আছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন,
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, নিরীহ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কৌশল অথবা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতপ্রকাশে বাধাদান মেনে নেওয়া যায় না। সহিংস সন্ত্রাসবাদের বিস্তার মোকাবিলায় ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক বৈশ্বিক সম্মেলনের সময়ে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কেরি আরও বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ফেরার জন্য রাজনৈতিক সমাধান খোঁজায় সহায়তা করতে তাঁর দেশ প্রস্তুত আছে।
ওই একই সম্মেলনের সময়ে একই দিনে আরেকটি বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বান কি মুন মাহমুদ আলীকে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার কথা বলেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠির কে কী জবাব দেবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
গত ৩০ জানুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি পাঠিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। যদিও কোনো পক্ষই চিঠির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেনি, তবু সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে সরকার এখনই সংলাপে আগ্রহী নয়। সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে আগে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মন্ত্রী ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের কেউ কেউ দাবি করেছেন যে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক এবং তাঁদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
শুক্রবার ঢাকায় সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে শোভাযাত্রার আয়োজন করে, তাতে দলীয় নেতারা সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। বিদেশিদের সংলাপের প্রস্তাবে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শুক্রবার রাতে বিবিসিকে বলেছেন ’যারা সহিংসতা নাশকতা করছে তাদেরকে আগে তা বন্ধ করতে বলুন। তারপর দেখা যাবে।’ তবে বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, নির্বাচনের আগে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা হবে, তার আগে নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে যে দশম সংসদের মেয়াদ শেষে নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে।
৩০ জানুয়ারির চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৬ ফেব্রুয়ারি পৌঁছেছে বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানানোর পর প্রশ্ন ওঠে, এত উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগে এ ধরনের অবিশ্বাস্য বিলম্বের কারণ কী? প্রশ্নটির জবাব সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট করা না হলেও ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুরাজিচ নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সাধারণভাবে মহাসচিবের চিঠি সংশ্লিষ্ট সদস্যরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তাঁর সরকারের কাছে সেটি পৌঁছানোর দায়িত্বটি তিনিই পালন করে থাকেন।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও সেই উদ্যোগে তেমন কোনো অগ্রগতি এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তেমন কোনো প্রকাশ্য ভূমিকা দেখা না গেলেও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে তারানকোর আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল বলে জাতিসংঘ আগে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছিল। এখন বৃহস্পতিবার জন কেরি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়তে থাকার কারণে দেশটিতে মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সাম্প্রতিক সহিংসতার অবসান ঘটানোর কথা উল্লেখ করে সব দলের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করায় সরকারের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে অবিলম্বে বিরোধী দলের সহিংসতা বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে বেসামরিক নাগরিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করার নিন্দা জানান।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক প্রতিবাদকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় ৪৬ দিনে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে (৯৯)। এঁদের মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে নিহত হয়েছেন ৫৬ জন আর ক্রসফায়ারে ২৩। এ ছাড়া সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আরও ১৫ জন। আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কয়েক শ, যার মধ্যে শুধু ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ১৩০ জন। যানবাহন ধ্বংস হয়েছে হাজারের ওপর। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও চাঁদপুরে ট্রেনে আগুন ও পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন ১৩ জন।
আলোচনার জন্য জাতিসংঘপ্রধানের উদ্যোগকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে এবং তাঁদের অনেকের ধারণা, তাঁদের রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণেই এই বিদেশি চাপ তৈরি হচ্ছে। গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের দাপটে আতঙ্কিত দলীয় নেতা-কর্মীরা দলটির ভাষায় আত্মগোপনে থাকায় রাজপথে তাঁরা পুরোপুরি অনুপস্থিত। মহান একুশে পালনের কথা ঘোষণা করলেও বিএনপি অবরোধ অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপি আহূত উপর্যুপরি হরতাল এবং টানা অবরোধ বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়লেও একধরনের আতঙ্ক এবং অস্বাভাবিক গণ-অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার্থী। এসব ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষা আগামী সপ্তাহে অথবা মার্চের শুরুতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র পঞ্চমটি। অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীদের সমিতি এফবিসিসিআই বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে তাদের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান যেভাবে তুলে ধরেছে, তাতে বিদেশিরাও যে উৎকণ্ঠিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বান কি মুন এবং জন কেরির বৃহস্পতিবারের মন্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে, ওই একই দিনে ঢাকায় প্রায় একই রকম অভিমত দিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটির সদস্যরা। বিএনপিপ্রধান, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন যে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের বিনিময়ে শান্তির ধারণা সঠিক নয়। তাঁরাও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সংলাপের কথা বলেছেন। গুম, খুন, ক্রসফায়ার বন্ধ এবং রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।
সংলাপের জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উদ্দেশে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ জানানো হয়েছিল, সেই উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে অব্যাহত সমালোচনার মুখে তাঁরা কিছুটা থমকে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। নাগরিক সমাজের দায়িত্বশীল একজন সদস্য অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে তাঁর দপ্তরে যোগাযোগ করে তাঁরা শীতল প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন এবং সে কারণে আর অগ্রসর হননি। তবে নাগরিক সমাজের পরিসর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা আরও একটি আলোচনা সভার আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
স্পষ্টতই একটি বিতর্কিত এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটকে জঙ্গিবাদের সমস্যা হিসেবে চিত্রিত করার কৌশল আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানসম্পন্ন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাব যে সরকার বা কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে ক্ষয় ধরায় এবং সরকারের স্থিতিশীলতা নড়বড়ে করে দেয়, সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে হার্ভার্ড এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকটোরাল ইন্টেগ্রিটি প্রজেক্টের সাম্প্রতিকতম প্রকাশনা। ওই প্রকাশনায় বিশ্বের ১০৭টি দেশের ১২৭টি নির্বাচনের ওপর পরিচালিত জরিপের মূল্যায়নে তারা বলেছে, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি ছিল ব্যর্থ নির্বাচন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, নিরীহ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কৌশল অথবা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতপ্রকাশে বাধাদান মেনে নেওয়া যায় না। সহিংস সন্ত্রাসবাদের বিস্তার মোকাবিলায় ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক বৈশ্বিক সম্মেলনের সময়ে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কেরি আরও বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ফেরার জন্য রাজনৈতিক সমাধান খোঁজায় সহায়তা করতে তাঁর দেশ প্রস্তুত আছে।
ওই একই সম্মেলনের সময়ে একই দিনে আরেকটি বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বান কি মুন মাহমুদ আলীকে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার কথা বলেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠির কে কী জবাব দেবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
গত ৩০ জানুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি পাঠিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। যদিও কোনো পক্ষই চিঠির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেনি, তবু সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে সরকার এখনই সংলাপে আগ্রহী নয়। সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে আগে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মন্ত্রী ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের কেউ কেউ দাবি করেছেন যে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক এবং তাঁদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
শুক্রবার ঢাকায় সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে শোভাযাত্রার আয়োজন করে, তাতে দলীয় নেতারা সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। বিদেশিদের সংলাপের প্রস্তাবে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শুক্রবার রাতে বিবিসিকে বলেছেন ’যারা সহিংসতা নাশকতা করছে তাদেরকে আগে তা বন্ধ করতে বলুন। তারপর দেখা যাবে।’ তবে বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, নির্বাচনের আগে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা হবে, তার আগে নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে যে দশম সংসদের মেয়াদ শেষে নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে।
৩০ জানুয়ারির চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৬ ফেব্রুয়ারি পৌঁছেছে বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানানোর পর প্রশ্ন ওঠে, এত উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগে এ ধরনের অবিশ্বাস্য বিলম্বের কারণ কী? প্রশ্নটির জবাব সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট করা না হলেও ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুরাজিচ নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সাধারণভাবে মহাসচিবের চিঠি সংশ্লিষ্ট সদস্যরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তাঁর সরকারের কাছে সেটি পৌঁছানোর দায়িত্বটি তিনিই পালন করে থাকেন।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও সেই উদ্যোগে তেমন কোনো অগ্রগতি এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তেমন কোনো প্রকাশ্য ভূমিকা দেখা না গেলেও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে তারানকোর আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল বলে জাতিসংঘ আগে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছিল। এখন বৃহস্পতিবার জন কেরি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়তে থাকার কারণে দেশটিতে মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সাম্প্রতিক সহিংসতার অবসান ঘটানোর কথা উল্লেখ করে সব দলের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করায় সরকারের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে অবিলম্বে বিরোধী দলের সহিংসতা বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে বেসামরিক নাগরিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করার নিন্দা জানান।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক প্রতিবাদকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় ৪৬ দিনে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে (৯৯)। এঁদের মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে নিহত হয়েছেন ৫৬ জন আর ক্রসফায়ারে ২৩। এ ছাড়া সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আরও ১৫ জন। আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কয়েক শ, যার মধ্যে শুধু ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ১৩০ জন। যানবাহন ধ্বংস হয়েছে হাজারের ওপর। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও চাঁদপুরে ট্রেনে আগুন ও পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন ১৩ জন।
আলোচনার জন্য জাতিসংঘপ্রধানের উদ্যোগকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে এবং তাঁদের অনেকের ধারণা, তাঁদের রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণেই এই বিদেশি চাপ তৈরি হচ্ছে। গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের দাপটে আতঙ্কিত দলীয় নেতা-কর্মীরা দলটির ভাষায় আত্মগোপনে থাকায় রাজপথে তাঁরা পুরোপুরি অনুপস্থিত। মহান একুশে পালনের কথা ঘোষণা করলেও বিএনপি অবরোধ অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপি আহূত উপর্যুপরি হরতাল এবং টানা অবরোধ বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়লেও একধরনের আতঙ্ক এবং অস্বাভাবিক গণ-অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার্থী। এসব ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষা আগামী সপ্তাহে অথবা মার্চের শুরুতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র পঞ্চমটি। অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীদের সমিতি এফবিসিসিআই বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে তাদের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান যেভাবে তুলে ধরেছে, তাতে বিদেশিরাও যে উৎকণ্ঠিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বান কি মুন এবং জন কেরির বৃহস্পতিবারের মন্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে, ওই একই দিনে ঢাকায় প্রায় একই রকম অভিমত দিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটির সদস্যরা। বিএনপিপ্রধান, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন যে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের বিনিময়ে শান্তির ধারণা সঠিক নয়। তাঁরাও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সংলাপের কথা বলেছেন। গুম, খুন, ক্রসফায়ার বন্ধ এবং রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।
সংলাপের জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উদ্দেশে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ জানানো হয়েছিল, সেই উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে অব্যাহত সমালোচনার মুখে তাঁরা কিছুটা থমকে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। নাগরিক সমাজের দায়িত্বশীল একজন সদস্য অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে তাঁর দপ্তরে যোগাযোগ করে তাঁরা শীতল প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন এবং সে কারণে আর অগ্রসর হননি। তবে নাগরিক সমাজের পরিসর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা আরও একটি আলোচনা সভার আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
স্পষ্টতই একটি বিতর্কিত এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটকে জঙ্গিবাদের সমস্যা হিসেবে চিত্রিত করার কৌশল আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানসম্পন্ন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাব যে সরকার বা কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে ক্ষয় ধরায় এবং সরকারের স্থিতিশীলতা নড়বড়ে করে দেয়, সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে হার্ভার্ড এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকটোরাল ইন্টেগ্রিটি প্রজেক্টের সাম্প্রতিকতম প্রকাশনা। ওই প্রকাশনায় বিশ্বের ১০৭টি দেশের ১২৭টি নির্বাচনের ওপর পরিচালিত জরিপের মূল্যায়নে তারা বলেছে, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি ছিল ব্যর্থ নির্বাচন।
No comments