সংলাপের উদ্যোগ অঙ্কুরেই বাধা পাচ্ছে by ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া
চলমান
রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সুশীল সমাজের জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ অঙ্কুরেই
বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সাধারণ জনগণ এ জাতীয় উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও সংশ্লিষ্ট
পক্ষগুলো বর্তমান অচলাবস্থাকে জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয়
স্বার্থে তা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টা না চালালে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে
না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে সামরিক শাসক এরশাদের
স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন সাতদলীয়
ঐক্যজোট নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া
এবং ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেত্রী আওয়ামী লীগ-প্রধান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার মধ্যে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার বৈঠকটির কথা। এরশাদবিরোধী আন্দোলন
চলাকালে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল হক চৌধুরীর
নেতৃত্বে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ এ বৈঠক অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন
করে। আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় সম্মেলনে বর্তমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক
মন্ত্রী সোহরাব হোসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার লিখিত
বক্তব্য পাঠ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। দুই নেত্রীর লিখিত বক্তব্য
এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করেছিল। ওই সময় থেকে
ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট শামসুল হক,
ছড়াকার ফয়েজ আহম্মদসহ অনেকেই বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে একটি
মুখোমুখি বৈঠকের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর
স্বামী ড. ওয়াজেদ বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার
জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। যদিও ড. ওয়াজেদ তার বইতে ওই সাক্ষাতের জন্য আমি
তাকে অনুরোধ করেছি বলে উল্লেখ করেছেন। ড. ওয়াজেদের এ ইচ্ছার কথা আমি বেগম
খালেদা জিয়াকে জানালে তিনি বললেন, ড. ওয়াজেদ একজন উচ্চপদস্থ সরকারি
কর্মকর্তা, তা ছাড়া তার স্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, তার সঙ্গে আলাপ করা
ঠিক হবে কি? আমি বললাম, এ সাক্ষাৎটি হবে একান্তই সৌজন্যমূলক। কিছু দিনের
মধ্যেই আমার সঙ্গে ড. ওয়াজেদ মিয়া বেগম জিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন। বেগম খালেদা
জিয়ার সঙ্গে ড. ওয়াজেদের এই সাক্ষাতে ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর দুই নেত্রীর
ঐতিহাসিক বৈঠকটির পথ উন্মোচিত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের অক্টোবরের শেষদিকে
সার্জেন্ট জহুরুল হকের বড় ভাই সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক আমাকে তার
সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য
বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, সেখানে গেলেই বুঝতে পারবেন যাওয়াটা কত
গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাডভোকেট আবদুল আওয়ালের গাড়িতে আমি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তখন তার লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলেন। তিনি আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আপনার বন্ধু ওয়াজেদ সাহেবকে আপনার নেত্রীর বাসায় চা খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার আপনার নেত্রীকে ড. ওয়াজেদ সাহেবের বাসায় চা খাওয়ার জন্য নিয়ে আসতে হবে। উনার সেদিনের কথায় আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। আমি অনেক ভেবেচিন্তে অনেক সঙ্কোচের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দিই। ইতিমধ্যে দুই নেত্রীর মধ্যে একটি বৈঠকের চেষ্টা অনেকেই করেছেন। যাই হোক মহাখালীর আণবিক শক্তি কমিশনের অতিথিশালায় বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে ওই অতিথিশালায় উপস্থিত ছিলাম। এ অতিথিশালার পাশেই ছিল ড. ওয়াজেদের সরকারি কোয়ার্র্টার। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে বেগম জিয়া সেখানে পৌঁছান। আমি যথারীতি তাকে অভ্যর্থনা জানাই। কয়েক মিনিটের মধ্যে ড. ওয়াজেদ সেখানে এসে বেগম জিয়াকে তার কোয়ার্টারে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ করেন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে আছেন বলেও জানান। বেগম খালেদা জিয়া আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চাইলেন।
তখন ড. ওয়াজেদ বললেন, আপনার বাসায় চা খেতে রফিক সাহেবের সঙ্গে গিয়েছিলাম, এবার আমার বাসায় অন্তত এক কাপ চা খাবেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে আমরা ড. ওয়াজেদের বাসায় গেলাম। শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ সবাইকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন। চা-নাশতার বৈঠকের জন্য অতিথিশালায় যাওয়ার প্রস্তাবের পর ড. ওয়াজেদ বললেন, এ ছোট কক্ষে দুই নেত্রী ইচ্ছা করলে অন্তরঙ্গ বৈঠকে বসতে পারেন। দুই জননেত্রীর ওই ঐতিহাসিক বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছিল। ওই বৈঠকের পর বেগম খালেদা জিয়ার বড় বোন সাবেক মন্ত্রী খুরশিদ জাহান হকের বাসায় দুই নেত্রীর আরও একটি বৈঠক হয়েছিল। বিভিন্নভাবে দুই নেত্রীর মতামত বিনিময় হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তা ছাড়া আমার যতটুকু মনে পড়ে তারেক রহমানের বিয়েতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি জাতীয় ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে, দেশ রক্ষার স্বার্থে আইনের শাসন কায়েমের স্বার্থে সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দুঃশাসনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সংকট থেকে জাতি অবশ্যই মুক্তি পেতে পারে। চাই সৎ সাহস, দেশপ্রেম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
কত আদম সন্তান পেট্রলবোমার নৃশংস আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে গুম, খুন, ক্রসফায়ারে। এসবের বিরুদ্ধে জাতির বিবেক জেগে উঠুক এ কামনায় বুকে আশা সঞ্চার করে বলছি, দেশজুড়ে সংঘটিত সহিংসতা বন্ধ হোক।
পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করা, একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানব জাতির জীবন রক্ষা করা। স্বাভাবিক জীবনই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। কেউ চিরকাল ক্ষমতায় থাকে না। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হত্যা নয়, জীবন রক্ষাই হোক আমাদের ব্রত। দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার মুখে বিনা বিচারে হত্যার অবাধ লাইসেন্স দেওয়ার কথা শুনে আমি হতভম্ব, বিচলিত, ভীতসন্ত্রস্ত। একজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হলেই তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা গেলে বিচার বিভাগ রেখে লাভ কি? কেউ আপনাকে হত্যা করতে চাইলে আত্দরক্ষায় আইন আপনাকে প্রয়োজনে হত্যার অধিকার দিয়েছে।
আমি দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে জিজ্ঞাসা করতে চাই- আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধে দায়ের করা সব মামলা কি সত্য। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নির্যাতনের কথা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের লিখিত পুস্তকে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ১/১১ ঘটনার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ, বিএনপির অনেক নেতারই রয়েছে। বহু আলোচিত রিমান্ডসংক্রান্ত মামলা সুপ্রিমকোর্টের দিকনির্দেশনা মেনে কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়? সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের কোনো মূল্যই কি নেই। নির্যাতন চালিয়ে অপমানকর আচরণ করে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য আদায় আইনের চোখে অচল হলেও বিভীষিকাময় নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা নাগরিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন তারাই রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা পান। তা হলে কী করে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাবেন।
রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রদান করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হতেই পারে। ১৯৬২-৬৩ সালে বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষার ১৫ দিন আগে রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগে আমি বহিষ্কৃত হয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানও বহিষ্কৃত হয়েছিল আইয়ুববিরোধী সেই শিক্ষা আন্দোলনে।
আমি সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের দিন বেলা ১টার সময় আমাকে একটি ভোটকেন্দ্রে মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে মগবাজার মোড়ে ১০০ পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এমপি ইকবালের উপস্থিতিতে আমাকে মিছিল চলাকালে গজারি লাঠি দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে কুমিল্লার হায়দরাবাদে আমার একটি জনসভায় বোমা ফেলে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ২০০৮ সালে পল্লবী নির্বাচনী এলাকায় মিছিল করার সময় আমার চোখে ইট মারা হয়। এভাবে আমার জীবননাশের চেষ্টা করা করেছিল, সেটা আমি এখানে উলি্লখ করতে চাই না। কারণ তাতে তিক্ততা বাড়বে, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নও নেমে আসতে পারে।
আমি কোনো দিন সন্ত্রাসের রাজনীতি করিনি, সন্ত্রাস প্রশ্রয় দেইনি, ভোটকেন্দ্র দখল করিনি। আমার নির্বাচনী এলাকার এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, কায়কোবাদ ও জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানেন আমার রাজনৈতিক জীবন। অথচ আমার চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্য বোমা হামলার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। যারা আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন তারা কি উপলব্ধি করবেন এ মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা বহন করা কত কঠিন।
আমি সব হত্যার বিচার চাই। আদালতে দোষীসাব্যস্ত হওয়ার আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রতিহিংসার রাজনৈতিক ভয়ঙ্কর দাবানলে পুড়ে ছারখার করবেন না নির্দোষ নিরপরাধ মানুষকে। গুম, খুন, হত্যা, ক্রসফায়ার, পেট্রলবোমা হামলাসহ সব অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের বিচার ব্যতীত মানবাধিকার, আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। সুবিচার প্রতিষ্ঠাই হোক সব রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। দুর্নীতি অপশাসন থেকে জাতি রক্ষা পাক এ কামনা করি মনেপ্রাণে। এ লেখায় আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা বলে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি করে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইনসাফ পাওয়ার আশায় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির কথোপকথনকে ক্ষমার চোখে দেখলে বাধিত হব।
লেখক : জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি।
অ্যাডভোকেট আবদুল আওয়ালের গাড়িতে আমি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তখন তার লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলেন। তিনি আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আপনার বন্ধু ওয়াজেদ সাহেবকে আপনার নেত্রীর বাসায় চা খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার আপনার নেত্রীকে ড. ওয়াজেদ সাহেবের বাসায় চা খাওয়ার জন্য নিয়ে আসতে হবে। উনার সেদিনের কথায় আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। আমি অনেক ভেবেচিন্তে অনেক সঙ্কোচের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দিই। ইতিমধ্যে দুই নেত্রীর মধ্যে একটি বৈঠকের চেষ্টা অনেকেই করেছেন। যাই হোক মহাখালীর আণবিক শক্তি কমিশনের অতিথিশালায় বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে ওই অতিথিশালায় উপস্থিত ছিলাম। এ অতিথিশালার পাশেই ছিল ড. ওয়াজেদের সরকারি কোয়ার্র্টার। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে বেগম জিয়া সেখানে পৌঁছান। আমি যথারীতি তাকে অভ্যর্থনা জানাই। কয়েক মিনিটের মধ্যে ড. ওয়াজেদ সেখানে এসে বেগম জিয়াকে তার কোয়ার্টারে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ করেন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে আছেন বলেও জানান। বেগম খালেদা জিয়া আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চাইলেন।
তখন ড. ওয়াজেদ বললেন, আপনার বাসায় চা খেতে রফিক সাহেবের সঙ্গে গিয়েছিলাম, এবার আমার বাসায় অন্তত এক কাপ চা খাবেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে আমরা ড. ওয়াজেদের বাসায় গেলাম। শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ সবাইকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন। চা-নাশতার বৈঠকের জন্য অতিথিশালায় যাওয়ার প্রস্তাবের পর ড. ওয়াজেদ বললেন, এ ছোট কক্ষে দুই নেত্রী ইচ্ছা করলে অন্তরঙ্গ বৈঠকে বসতে পারেন। দুই জননেত্রীর ওই ঐতিহাসিক বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছিল। ওই বৈঠকের পর বেগম খালেদা জিয়ার বড় বোন সাবেক মন্ত্রী খুরশিদ জাহান হকের বাসায় দুই নেত্রীর আরও একটি বৈঠক হয়েছিল। বিভিন্নভাবে দুই নেত্রীর মতামত বিনিময় হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তা ছাড়া আমার যতটুকু মনে পড়ে তারেক রহমানের বিয়েতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি জাতীয় ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে, দেশ রক্ষার স্বার্থে আইনের শাসন কায়েমের স্বার্থে সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দুঃশাসনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সংকট থেকে জাতি অবশ্যই মুক্তি পেতে পারে। চাই সৎ সাহস, দেশপ্রেম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।
কত আদম সন্তান পেট্রলবোমার নৃশংস আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে গুম, খুন, ক্রসফায়ারে। এসবের বিরুদ্ধে জাতির বিবেক জেগে উঠুক এ কামনায় বুকে আশা সঞ্চার করে বলছি, দেশজুড়ে সংঘটিত সহিংসতা বন্ধ হোক।
পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করা, একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানব জাতির জীবন রক্ষা করা। স্বাভাবিক জীবনই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। কেউ চিরকাল ক্ষমতায় থাকে না। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হত্যা নয়, জীবন রক্ষাই হোক আমাদের ব্রত। দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার মুখে বিনা বিচারে হত্যার অবাধ লাইসেন্স দেওয়ার কথা শুনে আমি হতভম্ব, বিচলিত, ভীতসন্ত্রস্ত। একজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হলেই তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা গেলে বিচার বিভাগ রেখে লাভ কি? কেউ আপনাকে হত্যা করতে চাইলে আত্দরক্ষায় আইন আপনাকে প্রয়োজনে হত্যার অধিকার দিয়েছে।
আমি দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে জিজ্ঞাসা করতে চাই- আমাদের দেশে ফৌজদারি অপরাধে দায়ের করা সব মামলা কি সত্য। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নির্যাতনের কথা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের লিখিত পুস্তকে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ১/১১ ঘটনার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ, বিএনপির অনেক নেতারই রয়েছে। বহু আলোচিত রিমান্ডসংক্রান্ত মামলা সুপ্রিমকোর্টের দিকনির্দেশনা মেনে কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়? সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের কোনো মূল্যই কি নেই। নির্যাতন চালিয়ে অপমানকর আচরণ করে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য আদায় আইনের চোখে অচল হলেও বিভীষিকাময় নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা নাগরিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন তারাই রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা পান। তা হলে কী করে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাবেন।
রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রদান করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হতেই পারে। ১৯৬২-৬৩ সালে বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষার ১৫ দিন আগে রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগে আমি বহিষ্কৃত হয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানও বহিষ্কৃত হয়েছিল আইয়ুববিরোধী সেই শিক্ষা আন্দোলনে।
আমি সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের দিন বেলা ১টার সময় আমাকে একটি ভোটকেন্দ্রে মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে মগবাজার মোড়ে ১০০ পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এমপি ইকবালের উপস্থিতিতে আমাকে মিছিল চলাকালে গজারি লাঠি দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে কুমিল্লার হায়দরাবাদে আমার একটি জনসভায় বোমা ফেলে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ২০০৮ সালে পল্লবী নির্বাচনী এলাকায় মিছিল করার সময় আমার চোখে ইট মারা হয়। এভাবে আমার জীবননাশের চেষ্টা করা করেছিল, সেটা আমি এখানে উলি্লখ করতে চাই না। কারণ তাতে তিক্ততা বাড়বে, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নও নেমে আসতে পারে।
আমি কোনো দিন সন্ত্রাসের রাজনীতি করিনি, সন্ত্রাস প্রশ্রয় দেইনি, ভোটকেন্দ্র দখল করিনি। আমার নির্বাচনী এলাকার এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, কায়কোবাদ ও জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানেন আমার রাজনৈতিক জীবন। অথচ আমার চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্য বোমা হামলার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। যারা আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন তারা কি উপলব্ধি করবেন এ মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা বহন করা কত কঠিন।
আমি সব হত্যার বিচার চাই। আদালতে দোষীসাব্যস্ত হওয়ার আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রতিহিংসার রাজনৈতিক ভয়ঙ্কর দাবানলে পুড়ে ছারখার করবেন না নির্দোষ নিরপরাধ মানুষকে। গুম, খুন, হত্যা, ক্রসফায়ার, পেট্রলবোমা হামলাসহ সব অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের বিচার ব্যতীত মানবাধিকার, আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। সুবিচার প্রতিষ্ঠাই হোক সব রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। দুর্নীতি অপশাসন থেকে জাতি রক্ষা পাক এ কামনা করি মনেপ্রাণে। এ লেখায় আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা বলে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি করে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইনসাফ পাওয়ার আশায় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির কথোপকথনকে ক্ষমার চোখে দেখলে বাধিত হব।
লেখক : জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি।
No comments