ভাষা-সংকট ও ভাবনা-দৈন্যের কথা by আবুল মোমেন
ভাষার
মাসে একটু বড় পরিসরের একটি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে বলতে চাই। এটা বিশ্বায়নের
কাল, তাই বিশ্বের সংযোগ-ভাষা হয়ে ওঠা ইংরেজির দাপট বাড়ছে। মাতৃভাষা বাংলা
যেন আজ উৎসব-অনুষ্ঠানের ভাষা। যেমন মেয়েদের মধ্যে নৈমিত্তিক ব্যবহারিক
পোশাক হয়ে উঠেছে কামিজ-কুর্তা আর বাঙালির শাড়ি এখন আনুষ্ঠানিক পোশাক;
ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলার সেই দশা। কিন্তু ভাষা তো আর পোশাকের মতো কেবল
ব্যবহারিক উপাদান নয়, এ হলো চিন্তাচর্চার বাহন, সংস্কৃতির প্রাণভোমরা।
তাই এদিক থেকে বিষয়টা দেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ পূর্বসূরি রামমোহন রায়কে
বলেছিলেন ‘ভারতপথিক’। আর পরে বাংলার সারস্বতসমাজ রবীন্দ্রনাথকে ডেকেছে
‘বিশ্বকবি’। তাঁর ইচ্ছা ছিল নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের
বিশ্ববিদ্যার আসর বসবে। জীবৎকালে সেই পরিবেশ কবি তৈরি করেছিলেন।
আসলে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পর থেকেই মানবমনের পরিসর কেবল প্রসারিত হয়েছে—বিশ্বমন ও বিশ্বমানবতার চেতনায় আলোকিত মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। তারই ছোঁয়া এসে লেগেছিল কলকাতায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আমরা পেলাম রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ হয়ে নজরুল পর্যন্ত বহুমুখী সৃষ্টিশীলতায় সম্পন্ন মহান চিন্তাবিদ ও কর্মীমানবদের। তাঁদের সেই বিশ্বমুখীনতার বীজ ছিল জ্ঞান আর মন্ত্র ছিল পরমার্থের সাধনা।
আজকের নতুন বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি শোনা শব্দ বিশ্বায়ন। যোগাযোগব্যবস্থার অত্যুন্নতির ফলে পৃথিবী যেমন ছোট হয়ে এসেছে, তেমনি এককালের ঘরকুনো বাঙালি সারা বিশ্বে বসতি গড়ছে। এই বিশ্বায়নের বীজকথা বৈষয়িক উন্নতি, আর মন্ত্র ব্যক্তিস্বার্থ। পরমার্থের চিন্তা বিসর্জিত হয়েছে।
মানুষের আদি ও আদিম কাজ হলো জীবনধারণ। তবে এটা প্রবৃত্তিগত এবং ভোগ ও একান্ত স্বার্থ পূরণের সঙ্গে যুক্ত বিষয়। তাই যতই এর পেছনে সময়, শক্তি ও বুদ্ধি খাটানো হবে, ততই মানুষ জীবনভোগের বিলাসিতায় আচ্ছন্ন হবে। এ কাজ মূলত প্রবৃত্তিচালিত ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির সঙ্গে যুক্ত বলে এর জন্য ভাব প্রকাশে ন্যূনতম কিছু শব্দের বেশি প্রয়োজন পড়ে না। সমাজের প্রধান এবং ক্রমে একমাত্র লক্ষ্য এমনটা হয়ে পড়ায় তার প্রভাব পড়ছে ভাষার ওপর।
এই বিবর্তনের প্রক্রিয়া ও পরিণতির দীর্ঘ ব্যাখ্যার সুযোগ এখানে নেই। শুধু বলব, এই বাস্তবতায় সমাজ ভাব প্রকাশে অল্প শব্দ ব্যবহার করে। কর্ম, উপার্জন, ভোগ—এই ত্রিবৃত্তে আবদ্ধ মানুষের কাছে ভাষার বাহুল্য অসুবিধাজনক, বেদরকারি। কান পাতলে এবং কিছুদিন অনুসরণ করলে লক্ষ করবেন একালের ছেলেমেয়েদের কথাবার্তা ভঙ্গিময়, মোদ্দা ভাবগুলোতে (হর্ষ, বিষাদ, ক্রোধ, কাম ইত্যাদি) সীমাবদ্ধ এবং তাদের ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা বেশ কম। যেসব শব্দ এবং বাক্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক, তার ব্যবহার খুবই কম। তদুপরি এই বাস্তবতায় কর্মীমানুষ ব্যতিব্যস্ত জীবন কাটায়। তাদের জীবনে ভোগ নিতান্ত অপরিহার্য, কিন্তু ভাবনা যেন বিলাস। চিন্তাচর্চা ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভাষার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক হয় না এবং সমষ্টিগত চর্চার অভাবে ভাষার বিকাশও রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
বর্তমানকালে অন্তত আমার চেনা জগতে, যা প্রধানত বাংলা ভাষানির্ভর—ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মানবসংস্কৃতির মূল অবলম্বন প্রত্যেকের মাতৃভাষা, আর তা যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তবে সে সংস্কৃতির বিকাশও রুদ্ধ হতে বাধ্য। আর্থিক উন্নতি বা সামাজিক সূচকে উন্নতির মাধ্যমে জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, যা পাওয়া সবার অধিকার এবং কাম্য। তবে এটাই যে মানবজীবনের মোক্ষ নয়, তা বোঝাবে কে? এ উন্নতির মাত্রা যে পর্যায়ে গেলে স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা পেরিয়ে ভোগ-বিলাসের রাজ্যের শুরু, তার আগে থামাতে না পারলে সাংস্কৃতিক সংকট বাড়তে থাকবে।
ভুল না বোঝার জন্য বলি, অতিদারিদ্র্যের মধ্যে ন্যূনতম মানবজীবনই অস্বীকৃত থাকে, তাই তা মোটেও কাম্য নয়। সে অবস্থায় উন্নত ভাষাসহ উন্নত সংস্কৃতির চিন্তাও বৃথা। দারিদ্র্যবিমোচন জাতীয় উন্নয়নের তালিকায় শীর্ষেই থাকুক। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নও চাই। কিন্তু তাকে ভারসাম্য দিতে হবে সমাজে নিরন্তর জ্ঞানচর্চা, ভাষাচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার তাগিদ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অনেকের অতৃপ্তি ও ক্ষুধা, সৃষ্টিশীল তাগিদ ও প্রকাশের ইচ্ছা, বিপুল সমঝদারের উপভোগ ও চরিতার্থতার আনন্দে যেন সংস্কৃতি সজীব ও প্রাণবন্ত থাকে, সেই দিকটা খেয়াল করতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক চাহিদা পূরণে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। দেশের সব শিশুকে স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে, সবাইকে বই দেওয়া যাচ্ছে, স্কুল ভবনের উন্নতি হচ্ছে, ভৌত চাহিদার জোগান দেওয়া হচ্ছে, গরিব ছাত্রদের পোশাক ও বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ও সরকার শিক্ষার প্রাথমিক চাহিদা পূরণে চমকপ্রদ কাজ করেছেন। কিন্তু শিক্ষার ভিত্তি পাকা করে তারপর কেবল পরীক্ষার ফলাফলে সাফল্যকে বেঁধে ফেললে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। ছাত্ররা, অবশ্যই অভিভাবক ও শিক্ষকদের যোগসাজশে, অনেক অর্থ ব্যয় করে ‘সাফল্যের’ সস্তা পথে চলবে। কারণ, শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য সেটাই। এখন কে অকারণে বাহুল্যের ফাঁদে পা দেবে? পড়াশোনা কোচিং সেন্টার, টিউটর, প্রশ্ন-উত্তর, মডেল টেস্টেই বোতলবন্দী হয়ে পড়বে। তাতে দৈত্য তৈরি হতে পারে, মানুষ তৈরি হওয়া মুশকিল।
আলোচনা অন্যদিকে না বাড়িয়ে শুধু বলব, অন্যের ভাষায় পড়ে, অন্যের ভাষায় লিখে, অন্যের ভাবনায় চলে কেউ ঠিক শিক্ষিত মানুষ হতে পারে না। কোনো ভাষায়ই—একমাত্র কথাবার্তা চালানোর ভাষা ছাড়া—তাদের ব্যুৎপত্তি অর্জিত হবে না।
বর্তমানে আমাদের ভাষাচর্চা সংবাদপত্র পাঠ এবং টেলিভিশনে কথা বলা ও তা শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার হার বাড়লেও আমরা সদলবলে এক ওরাল নেশন বা কথ্যভাষানির্ভর জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের গবেষণাপত্র, সাময়িকপত্র, সংবাদপত্রের লেখার ভাষা লক্ষ করলে ভাষা-সংকট ও ভাবনা-দৈন্যের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর টিভির টক শো শুনলে তার পরাকাষ্ঠা দেখা ও শোনা যাবে।
বর্তমানকালের ‘বিশ্বপথিকদের’ আতিশয্যে দেশে ইংরেজিয়ানার জোয়ার চলছে। এ নিয়ে কারও দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না, কারণ, সংস্কৃতির অগ্রজনেরাও গড্ডলিকায় গা ভাসিয়েছেন। কেউ ভাবছেন না যথাযথ বয়সে মাতৃভাষায় যথাযথ সাহিত্যপাঠ না করলে বড় হয়ে কেউই আর আপন সংস্কৃতির অন্দরের মানুষ হতে পারেন না। অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে দু-চারজন একাগ্র নিষ্ঠায় আবু সায়ীদ আইয়ুব বা ফাদার দ্যতিয়েন হতে পারেন, কিন্তু সে তো ব্যতিক্রম। এ কথাটাও বলা দরকার, শৈশব থেকে ঠিকভাবে শেখানো হলে শিশুর পক্ষে দুটি, এমনকি তিনটি ভাষা শেখাও কঠিন নয়। তারা তো গণিত শিখছে, যা উচ্চতর জ্ঞানচর্চার ভাষা বা বাহন বৈ আর কি! ফলে বাংলায় জোর দিলে ইংরেজি শেখা হবে না, এমন ধারণা ভুল। কিন্তু মাতৃভাষার সাহিত্য শৈশব থেকে পাঠ করে বড় না হলে শিশুর জীবনে সাংস্কৃতিক বৃক্ষটির ডানা কাটা পড়বে কিংবা মূল শিকড় বাদ যাবে—হয় সে ফুলে-ফলে বিকশিত হবে না, নয়তো বামন হয়ে অকেজো হয়ে থাকবে। তার পক্ষে মানবজীবনের চরিতার্থতা খোঁজার পথ খোলা থাকবে না।
সাহিত্যপাঠ দিয়েই একজন শিক্ষিত মানুষ উচ্চতর ভাবের বিষয়ে পঠনপাঠনের জন্য তৈরি হয়। এ অংশ বাদ গেলে একজন মানুষ বেশি হলে সরল ও স্বাভাবিক মানুষ হতে পারে (ম্যাথু আর্নল্ডের ভাষায় simple and natural), কিন্তু মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ (noble and grand) হতে পারে না। অথচ এ পথেই চিন্তার গভীরতায় পৌঁছাতে পারে মানুষ। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা যদি এ পথ খুলে দিতে না পারে, তবে মানুষ হয়ে জন্মানোর আনন্দ ও সার্থকতার বোধ হারিয়ে যাবে। খেয়ে-পরে চলে সঙ্গসুখে বা কামে-ক্রোধে-হর্ষে, পুলকে-ক্রন্দনে বাঁধা যে জীবন, তার উত্তেজনা ও চরিতার্থতার বোধ ক্ষণিকের এবং তা অপ্রাপ্তির আফসোস ও পরবর্তী প্রাপ্তির কামনায় নিরন্তর অস্থিরতায় ভোগাতে থাকে। সেটাকেই মানবজীবনের নিয়তি ভেবে নেওয়া চরম ভুল হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আসলে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পর থেকেই মানবমনের পরিসর কেবল প্রসারিত হয়েছে—বিশ্বমন ও বিশ্বমানবতার চেতনায় আলোকিত মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। তারই ছোঁয়া এসে লেগেছিল কলকাতায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আমরা পেলাম রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ হয়ে নজরুল পর্যন্ত বহুমুখী সৃষ্টিশীলতায় সম্পন্ন মহান চিন্তাবিদ ও কর্মীমানবদের। তাঁদের সেই বিশ্বমুখীনতার বীজ ছিল জ্ঞান আর মন্ত্র ছিল পরমার্থের সাধনা।
আজকের নতুন বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি শোনা শব্দ বিশ্বায়ন। যোগাযোগব্যবস্থার অত্যুন্নতির ফলে পৃথিবী যেমন ছোট হয়ে এসেছে, তেমনি এককালের ঘরকুনো বাঙালি সারা বিশ্বে বসতি গড়ছে। এই বিশ্বায়নের বীজকথা বৈষয়িক উন্নতি, আর মন্ত্র ব্যক্তিস্বার্থ। পরমার্থের চিন্তা বিসর্জিত হয়েছে।
মানুষের আদি ও আদিম কাজ হলো জীবনধারণ। তবে এটা প্রবৃত্তিগত এবং ভোগ ও একান্ত স্বার্থ পূরণের সঙ্গে যুক্ত বিষয়। তাই যতই এর পেছনে সময়, শক্তি ও বুদ্ধি খাটানো হবে, ততই মানুষ জীবনভোগের বিলাসিতায় আচ্ছন্ন হবে। এ কাজ মূলত প্রবৃত্তিচালিত ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির সঙ্গে যুক্ত বলে এর জন্য ভাব প্রকাশে ন্যূনতম কিছু শব্দের বেশি প্রয়োজন পড়ে না। সমাজের প্রধান এবং ক্রমে একমাত্র লক্ষ্য এমনটা হয়ে পড়ায় তার প্রভাব পড়ছে ভাষার ওপর।
এই বিবর্তনের প্রক্রিয়া ও পরিণতির দীর্ঘ ব্যাখ্যার সুযোগ এখানে নেই। শুধু বলব, এই বাস্তবতায় সমাজ ভাব প্রকাশে অল্প শব্দ ব্যবহার করে। কর্ম, উপার্জন, ভোগ—এই ত্রিবৃত্তে আবদ্ধ মানুষের কাছে ভাষার বাহুল্য অসুবিধাজনক, বেদরকারি। কান পাতলে এবং কিছুদিন অনুসরণ করলে লক্ষ করবেন একালের ছেলেমেয়েদের কথাবার্তা ভঙ্গিময়, মোদ্দা ভাবগুলোতে (হর্ষ, বিষাদ, ক্রোধ, কাম ইত্যাদি) সীমাবদ্ধ এবং তাদের ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা বেশ কম। যেসব শব্দ এবং বাক্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক, তার ব্যবহার খুবই কম। তদুপরি এই বাস্তবতায় কর্মীমানুষ ব্যতিব্যস্ত জীবন কাটায়। তাদের জীবনে ভোগ নিতান্ত অপরিহার্য, কিন্তু ভাবনা যেন বিলাস। চিন্তাচর্চা ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভাষার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক হয় না এবং সমষ্টিগত চর্চার অভাবে ভাষার বিকাশও রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
বর্তমানকালে অন্তত আমার চেনা জগতে, যা প্রধানত বাংলা ভাষানির্ভর—ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মানবসংস্কৃতির মূল অবলম্বন প্রত্যেকের মাতৃভাষা, আর তা যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তবে সে সংস্কৃতির বিকাশও রুদ্ধ হতে বাধ্য। আর্থিক উন্নতি বা সামাজিক সূচকে উন্নতির মাধ্যমে জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, যা পাওয়া সবার অধিকার এবং কাম্য। তবে এটাই যে মানবজীবনের মোক্ষ নয়, তা বোঝাবে কে? এ উন্নতির মাত্রা যে পর্যায়ে গেলে স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা পেরিয়ে ভোগ-বিলাসের রাজ্যের শুরু, তার আগে থামাতে না পারলে সাংস্কৃতিক সংকট বাড়তে থাকবে।
ভুল না বোঝার জন্য বলি, অতিদারিদ্র্যের মধ্যে ন্যূনতম মানবজীবনই অস্বীকৃত থাকে, তাই তা মোটেও কাম্য নয়। সে অবস্থায় উন্নত ভাষাসহ উন্নত সংস্কৃতির চিন্তাও বৃথা। দারিদ্র্যবিমোচন জাতীয় উন্নয়নের তালিকায় শীর্ষেই থাকুক। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নও চাই। কিন্তু তাকে ভারসাম্য দিতে হবে সমাজে নিরন্তর জ্ঞানচর্চা, ভাষাচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার তাগিদ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অনেকের অতৃপ্তি ও ক্ষুধা, সৃষ্টিশীল তাগিদ ও প্রকাশের ইচ্ছা, বিপুল সমঝদারের উপভোগ ও চরিতার্থতার আনন্দে যেন সংস্কৃতি সজীব ও প্রাণবন্ত থাকে, সেই দিকটা খেয়াল করতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক চাহিদা পূরণে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। দেশের সব শিশুকে স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে, সবাইকে বই দেওয়া যাচ্ছে, স্কুল ভবনের উন্নতি হচ্ছে, ভৌত চাহিদার জোগান দেওয়া হচ্ছে, গরিব ছাত্রদের পোশাক ও বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ও সরকার শিক্ষার প্রাথমিক চাহিদা পূরণে চমকপ্রদ কাজ করেছেন। কিন্তু শিক্ষার ভিত্তি পাকা করে তারপর কেবল পরীক্ষার ফলাফলে সাফল্যকে বেঁধে ফেললে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। ছাত্ররা, অবশ্যই অভিভাবক ও শিক্ষকদের যোগসাজশে, অনেক অর্থ ব্যয় করে ‘সাফল্যের’ সস্তা পথে চলবে। কারণ, শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য সেটাই। এখন কে অকারণে বাহুল্যের ফাঁদে পা দেবে? পড়াশোনা কোচিং সেন্টার, টিউটর, প্রশ্ন-উত্তর, মডেল টেস্টেই বোতলবন্দী হয়ে পড়বে। তাতে দৈত্য তৈরি হতে পারে, মানুষ তৈরি হওয়া মুশকিল।
আলোচনা অন্যদিকে না বাড়িয়ে শুধু বলব, অন্যের ভাষায় পড়ে, অন্যের ভাষায় লিখে, অন্যের ভাবনায় চলে কেউ ঠিক শিক্ষিত মানুষ হতে পারে না। কোনো ভাষায়ই—একমাত্র কথাবার্তা চালানোর ভাষা ছাড়া—তাদের ব্যুৎপত্তি অর্জিত হবে না।
বর্তমানে আমাদের ভাষাচর্চা সংবাদপত্র পাঠ এবং টেলিভিশনে কথা বলা ও তা শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার হার বাড়লেও আমরা সদলবলে এক ওরাল নেশন বা কথ্যভাষানির্ভর জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের গবেষণাপত্র, সাময়িকপত্র, সংবাদপত্রের লেখার ভাষা লক্ষ করলে ভাষা-সংকট ও ভাবনা-দৈন্যের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর টিভির টক শো শুনলে তার পরাকাষ্ঠা দেখা ও শোনা যাবে।
বর্তমানকালের ‘বিশ্বপথিকদের’ আতিশয্যে দেশে ইংরেজিয়ানার জোয়ার চলছে। এ নিয়ে কারও দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না, কারণ, সংস্কৃতির অগ্রজনেরাও গড্ডলিকায় গা ভাসিয়েছেন। কেউ ভাবছেন না যথাযথ বয়সে মাতৃভাষায় যথাযথ সাহিত্যপাঠ না করলে বড় হয়ে কেউই আর আপন সংস্কৃতির অন্দরের মানুষ হতে পারেন না। অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে দু-চারজন একাগ্র নিষ্ঠায় আবু সায়ীদ আইয়ুব বা ফাদার দ্যতিয়েন হতে পারেন, কিন্তু সে তো ব্যতিক্রম। এ কথাটাও বলা দরকার, শৈশব থেকে ঠিকভাবে শেখানো হলে শিশুর পক্ষে দুটি, এমনকি তিনটি ভাষা শেখাও কঠিন নয়। তারা তো গণিত শিখছে, যা উচ্চতর জ্ঞানচর্চার ভাষা বা বাহন বৈ আর কি! ফলে বাংলায় জোর দিলে ইংরেজি শেখা হবে না, এমন ধারণা ভুল। কিন্তু মাতৃভাষার সাহিত্য শৈশব থেকে পাঠ করে বড় না হলে শিশুর জীবনে সাংস্কৃতিক বৃক্ষটির ডানা কাটা পড়বে কিংবা মূল শিকড় বাদ যাবে—হয় সে ফুলে-ফলে বিকশিত হবে না, নয়তো বামন হয়ে অকেজো হয়ে থাকবে। তার পক্ষে মানবজীবনের চরিতার্থতা খোঁজার পথ খোলা থাকবে না।
সাহিত্যপাঠ দিয়েই একজন শিক্ষিত মানুষ উচ্চতর ভাবের বিষয়ে পঠনপাঠনের জন্য তৈরি হয়। এ অংশ বাদ গেলে একজন মানুষ বেশি হলে সরল ও স্বাভাবিক মানুষ হতে পারে (ম্যাথু আর্নল্ডের ভাষায় simple and natural), কিন্তু মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ (noble and grand) হতে পারে না। অথচ এ পথেই চিন্তার গভীরতায় পৌঁছাতে পারে মানুষ। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা যদি এ পথ খুলে দিতে না পারে, তবে মানুষ হয়ে জন্মানোর আনন্দ ও সার্থকতার বোধ হারিয়ে যাবে। খেয়ে-পরে চলে সঙ্গসুখে বা কামে-ক্রোধে-হর্ষে, পুলকে-ক্রন্দনে বাঁধা যে জীবন, তার উত্তেজনা ও চরিতার্থতার বোধ ক্ষণিকের এবং তা অপ্রাপ্তির আফসোস ও পরবর্তী প্রাপ্তির কামনায় নিরন্তর অস্থিরতায় ভোগাতে থাকে। সেটাকেই মানবজীবনের নিয়তি ভেবে নেওয়া চরম ভুল হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments