কারাগারে দুর্দশায় বন্দিরা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি
কারাগারের বারান্দা, বাথরুমের সামনে বা অন্য কোন ফাঁকা স্থানে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করছেন কারাবন্দিরা। সকাল থেকেই টয়লেটে তাদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্দিদের অধিকাংশকেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। একটি শয্যায় পালাক্রমে চার থেকে পাঁচজন ঘণ্টা হিসেবে ঘুমান। তার ওপর রয়েছে মশা ও মাসলম্যানদের সীমাহীন উপদ্রব। রাজনৈতিক বন্দি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় এভাবেই মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে বন্দিদের। কয়েক গুণ বেশি বন্দি থাকায় কারাগারগুলোর ব্যবস্থাপনায়ও মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। এরই মধ্যে কারাগারের নানা সমস্যার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে কারা অধিদপ্তর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে জামিনে মুক্তি পাওয়া এক বন্দি মানবজমিনকে জানান, কারাগারে মানবেতর অবস্থা বিরাজ করছে। প্রধান সমস্যা হচ্ছে টয়লেট, ঘুমানো বা বিশ্রামের জায়গা নিয়ে। এছাড়া খাবার ও চিকিৎসা সমস্যা তো আছেই। এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাবে। এদিকে জেলখানার বন্দিদের বেশির ভাগ বিএনপি-জামায়াতের। ফলে বন্দি জীবনে তাদের মধ্যে পুরনো বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছে। একসঙ্গে চলছেন, ঘুমাচ্ছেন বা মনের কথা বলছেন। এসব বিষয় বেশ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিভিন্ন কারাগারে দায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। অতিরিক্ত বন্দি থাকায় কারাগারের ভেতরে ও বাইরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। সমস্যা দেখলেই রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়মিত বিভিন্ন কারাগারে বদলি করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বন্দিদের গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে রাখা হচ্ছে। বন্দিরা যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন কারা কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধ শুরুর পর ৩৮ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি মামলা হয়েছে প্রায় এক হাজার। ধরপাকড়ের কারণে দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন বন্দির সংখ্যা ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ। কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে অবরোধ শুরু হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ৪ঠা জানুয়ারি দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ৬১৪। ৮ই ফেব্রুয়ারি এসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ হাজার ৮০২। কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৩৬৬ পুরুষ এবং ১ হাজার ৮০১ জন নারী বন্দির থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে থাকা বন্দিদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বা কয়েদি মাত্র ১৮ হাজার ৭৩০। বাকিদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৬৮২। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি বন্দি ছিল সাড়ে সাত হাজার। ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দির সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট কারা কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে বন্দির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারা অধিদপ্তরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন যে হারে বন্দি কারাগারে আসে, প্রায় একই হারে ছাড়াও পেয়ে যান তারা। ফলে বন্দির সংখ্যা সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু এক মাস ধরে যে হারে বন্দি আসছে, তার তুলনায় জামিনে বের হচ্ছে কম। ফলে হাজতি-বন্দির সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তিনি বলেন, ছুটির দিনে কিছু বন্দিকে কাশিমপুর কারাগারে সরিয়ে চাপ সামলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ঢাকার মতো দেশের অন্য কারাগারগুলোর বন্দি সংখ্যা বাড়েনি। কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্দির চাপ সামলাতে এরই মধ্যে কেরানীগঞ্জে নির্মিতব্য দুটি, নরসিংদী, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, যশোর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রংপুর, বরগুনা, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে ১৪টি কারাগার সমপ্রসারণ ও সংস্কারের কাজ চলছে। এগুলো সম্পন্ন হলে সব কারাগারেই চাপ কমবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের এখন বড় সমস্যা হচ্ছে নতুন বন্দিরা আমদানি সেলে যাওয়া মাত্রই প্রধান কারারক্ষীর মনোনীত রাইটাররা বিভিন্ন দামে তাদের কিনে নিচ্ছেন। এরপর আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে নানা রকম বেকায়দায় ফেলা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অন্যথায় ঘুমাতে না দেয়া, খাবার খেতে সমস্যা সৃষ্টিসহ নানা ঝামেলার সৃষ্টি করছে। ভুক্তভোগীরা জানালেন, এমন সমস্যা এখন অধিকাংশ কারাগারেই ঘটছে।
No comments