রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা খরচ নিয়ে নানা প্রশ্ন by দীন ইসলাম ও রোকনুজ্জামান পিয়াস
মালয়েশিয়ার পর এবার সৌদি আরবেও কর্মী পাঠানো নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দিয়েছে। আগে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর চুক্তি হওয়ার পর সাড়ে ১৪ লাখ লোকের রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল। এবার সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতা হওয়ার পর নতুন করে শুরু হয়েছে রেজিস্ট্রেশন। কোন নির্দেশনা ছাড়াই এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সারা দেশে রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রগুলো চলছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। এবার সৌদি গমনেচ্ছুদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসগুলোতে সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের ভিড় ও হট্টগোলের সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরে এক লাখ ২০ হাজার নারী গৃহকর্মী নেয়ার চুক্তি হলেও পুরুষদের নিবন্ধন করা হচ্ছে। কারণ এর আগে মালয়েশিয়া যেতে সাড়ে ১৪ লাখ নারী-পুরুষ নিবন্ধন করেছে। ওই নিবন্ধনকারীরা আবার নতুন করে সৌদি আরব যেতে নিবন্ধন করছেন। এদিকে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার মতো কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে সৌদি সরকার অনেকটা নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নেয়ার দিকে ঝুঁকেছে। যদিও এর আগে ২০১১ সালের এপ্রিলে সৌদি ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট কমিটি (সানারকম) ঢাকায় এসে গৃহকর্মী নিতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল। তবে কর্মী যায়নি। এবার নতুন করে আবার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।
নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশী গৃহকর্মী: সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ এখন সেখানে নারী কর্মী পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে সৌদি আরব। কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগের পর গত ১০ই ফেব্রুয়ারি সৌদি সরকারের সঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে গৃহস্থালির কাজে ১২ ক্যাটাগরিতে লোক নেয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও আপাতত শুধু ৮০০ রিয়াল (প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা) বেতনে গৃহকর্মী (নারী) নেবে সৌদি আরব। শুরুতে ১২০০ রিয়াল (২৫ হাজার ২০০ টাকা) থেকে ১৫০০ রিয়াল (৩১ হাজার ৫০০ টাকা) বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে মালী, ড্রাইভার, দারোয়ানসহ অন্য ১১টি গৃহস্থালির কাজে কর্মী নেবে তারা। গৃহকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সৌদির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে। কাজেই চাইলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। গৃহকর্মী নেয়ার পর অন্যান্য খাতেও কর্মী নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। এ দেশের মেয়েরা যাতে বিপদে না পড়েন ওই বিষয়টি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দেখবে বাংলাদেশ। এদিকে সৌদি আরবের নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা নিয়ে ২০১০ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ওই প্রতিবেদনে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ১৫০ জন গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকার ও অবস্থা তুলে ধরা হয়। সাক্ষাৎকারে তাদের বেশির ভাগ বলেছেন, তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিষয়টি সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক কর্মকর্তা জানালেন, সৌদি আরবে মেয়েদের পাঠানোর আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে। দূতাবাসে সরকারের একটি শেল্টার হোম করা উচিত। যাতে কেউ বিপদে পড়লে আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া দূতাবাসের উচিত নিয়মিত বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া। ঢাকায় সফর করে যাওয়া সৌদি শ্রম উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, গৃহকর্মীদের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার রক্ষা করা হবে। কেউ আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রবাসীকল্যাণ ভবনে আপাতত নিবন্ধন বন্ধ: সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের নিবন্ধনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায়ও জড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। চাপ সামলাতে না পেরে গত বৃহস্পতিবার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে নাম নিবন্ধন কার্যক্রম। এদিকে মালয়েশিয়া গমনের উদ্দেশে নিবন্ধিত কর্মীরাও সৌদি আরব যেতে পারবেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ইতিপূর্বে বিদেশ গমনেচ্ছু ২২ লাখ লোকের নিবন্ধন করা হয়। তবে এর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক কর্মীই বিদেশে যেতে পেরেছেন। সে সময় জনপ্রতি ২০০ টাকা করে নেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাটাবেইজের অন্তর্ভুক্ত বিপুল এ কর্মীকে না পাঠিয়েই সৌদিতে গমনেচ্ছুদের জন্য আবার নতুন করে ডাটাবেইজ তৈরি করছে সরকার। এবার নিবন্ধন করতে নেয়া হচ্ছে ঢাকায় ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১৫০ টাকা। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং দুই তপি ছবি আনলেই যে কেউ নিবন্ধন করতে পারছেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকাতে মূলত নিবন্ধনের এ ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার। এদিকে দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর সৌদি আরবের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ায় সবাই ভিড় জমায় প্রবাসীকল্যাণ ভবনে। এছাড়া ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের নাম নিবন্ধনের জন্য প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়। একইভাবে বিএমইটির অধীনে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসেও নিবন্ধন করা যাবে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএমইটি। তবে মেলার দ্বিতীয় দিনে অব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। মানুষের চাপে ভেঙে যায় প্যাভিলিয়নের সামনের টেবিল। এ সময় কর্মকর্তারা ফরম বিতরণ বন্ধ করে দিলে পুরো প্যাভিলিয়নই গুঁড়িয়ে দেয় ক্ষুব্ধ বিদেশ গমনেচ্ছুরা। মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনেও সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। নিবন্ধন ফরম জমা নিতে হিমশিম খেতে হয় বিএমইটির সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই সৌদি আরব গমনেচ্ছুরা ভিড় জমান প্রবাসীকল্যাণ ভবনের সামনে। গমণেচ্ছুদের চাপ সামলাতে না পেরে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। তবে সারা দেশে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে। এখনও পর্যন্ত কি পরিমাণ নিবন্ধন ফরম জমা পড়েছে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা জানাতে পারেননি।
যাওয়ার খরচ নিয়ে নানা প্রশ্ন: সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো সম্পর্কে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, সৌদি আরবে যেতে কর্মীপ্রতি সর্বোচ্চ খরচ হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। যারা লোক নেবেন তারা ব্যবসায়ীদের পারিশ্রমিক দেবেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে লোক পাঠানোর পুরোটাই বেসরকারিভাবে হবে। তারাই সব প্রক্রিয়া করবে। সবকিছু দেখভাল করবে সরকার। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সৌদি প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল খরচ। একজন কর্মীর সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। কারণ কর্মীর লেভি, যাতায়াত ভাড়া সবই নিয়োগ কর্তা দেবেন। আমরা চাই কর্মীদের কাছ থেকে যেন একটি টাকাও নেয়া না হয়। যারা লোক নেবে তারাই সে খরচ দেবে। তিনি বলেন, ভিসা কেনাবেচার কারণেই সৌদি আরবে খরচ বেড়ে যায়। এবার ভিসা কেনাবেচা করলে ১৫ বছরের জেল হয়ে যাবে।
মালয়েশিয়া যেতে ঢাকঢোল, অতঃপর হতাশা: সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে নাম নিবন্ধন করেছিলেন সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে প্রথম দফায় যাওয়ার জন্য লটারিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৫৩৮ জন। লটারিতে নির্বাচিত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খোকা তালুকদার লটারিতে নির্বাচিত হয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তিনি বলেন, লটারিতে নাম ওঠার পর বলা হয়, যে কোন সময় মালয়েশিয়া চলে যাবো। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু দুই বছরেও যেতে পারিনি। এদিকে চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়া আবার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার বিষয়ে সমঝোতা করে। সরকারিভাবে (জিটুজি) কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ- মালয়েশিয়া। তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত দুই বছরে মাত্র চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। এই ধীরগতিতে নিবন্ধনকারীদের পাশাপাশি সরকারও হতাশ। এদিকে গত কয়েক বছরে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। গত দেড় বছরে হাজার দেড়েক মানুষ অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আটক হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে অনেক দেন দরবার হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়া শুরুতেই বলেছিল ৫০ হাজার লোক নেবে। ১০ হাজারের চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ হাজার লোক নিয়েছে। এতে আমরা হতাশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর দীর্ঘ কূটনৈতিক যোগাযোগের পর এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেশটি। ২০১২ সালের ২৬শে নভেম্বর দুই দেশের সরকারের মধ্যে সরকারিভাবে লোক নিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নিতে সারা দেশে সাড়া পড়ে। ২০১৩ সালের ১৩ই জানুয়ারি থেকে ২১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৬ জন নাম নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে খরচ হয় প্রায় সাত কোটি টাকা। নিবন্ধনকারীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩৬ হাজার ৩৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় পাঠানোর জন্য লটারিতে ১১ হাজার ৭৫৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। ১৭ই জুলাই আরও ১১ হাজার ৭০৪ জনকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এ ২৩ হাজার কর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী গেছেন। এরপর আর কোন কর্মী মালয়েশিয়া যায়নি।
নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশী গৃহকর্মী: সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ এখন সেখানে নারী কর্মী পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে সৌদি আরব। কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগের পর গত ১০ই ফেব্রুয়ারি সৌদি সরকারের সঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে গৃহস্থালির কাজে ১২ ক্যাটাগরিতে লোক নেয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও আপাতত শুধু ৮০০ রিয়াল (প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা) বেতনে গৃহকর্মী (নারী) নেবে সৌদি আরব। শুরুতে ১২০০ রিয়াল (২৫ হাজার ২০০ টাকা) থেকে ১৫০০ রিয়াল (৩১ হাজার ৫০০ টাকা) বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে মালী, ড্রাইভার, দারোয়ানসহ অন্য ১১টি গৃহস্থালির কাজে কর্মী নেবে তারা। গৃহকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সৌদির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে। কাজেই চাইলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। গৃহকর্মী নেয়ার পর অন্যান্য খাতেও কর্মী নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। এ দেশের মেয়েরা যাতে বিপদে না পড়েন ওই বিষয়টি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দেখবে বাংলাদেশ। এদিকে সৌদি আরবের নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা নিয়ে ২০১০ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ওই প্রতিবেদনে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ১৫০ জন গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকার ও অবস্থা তুলে ধরা হয়। সাক্ষাৎকারে তাদের বেশির ভাগ বলেছেন, তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিষয়টি সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক কর্মকর্তা জানালেন, সৌদি আরবে মেয়েদের পাঠানোর আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে। দূতাবাসে সরকারের একটি শেল্টার হোম করা উচিত। যাতে কেউ বিপদে পড়লে আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া দূতাবাসের উচিত নিয়মিত বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া। ঢাকায় সফর করে যাওয়া সৌদি শ্রম উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, গৃহকর্মীদের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার রক্ষা করা হবে। কেউ আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রবাসীকল্যাণ ভবনে আপাতত নিবন্ধন বন্ধ: সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের নিবন্ধনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায়ও জড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। চাপ সামলাতে না পেরে গত বৃহস্পতিবার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে নাম নিবন্ধন কার্যক্রম। এদিকে মালয়েশিয়া গমনের উদ্দেশে নিবন্ধিত কর্মীরাও সৌদি আরব যেতে পারবেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ইতিপূর্বে বিদেশ গমনেচ্ছু ২২ লাখ লোকের নিবন্ধন করা হয়। তবে এর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক কর্মীই বিদেশে যেতে পেরেছেন। সে সময় জনপ্রতি ২০০ টাকা করে নেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাটাবেইজের অন্তর্ভুক্ত বিপুল এ কর্মীকে না পাঠিয়েই সৌদিতে গমনেচ্ছুদের জন্য আবার নতুন করে ডাটাবেইজ তৈরি করছে সরকার। এবার নিবন্ধন করতে নেয়া হচ্ছে ঢাকায় ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১৫০ টাকা। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং দুই তপি ছবি আনলেই যে কেউ নিবন্ধন করতে পারছেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকাতে মূলত নিবন্ধনের এ ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার। এদিকে দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর সৌদি আরবের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ায় সবাই ভিড় জমায় প্রবাসীকল্যাণ ভবনে। এছাড়া ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের নাম নিবন্ধনের জন্য প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়। একইভাবে বিএমইটির অধীনে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসেও নিবন্ধন করা যাবে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএমইটি। তবে মেলার দ্বিতীয় দিনে অব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। মানুষের চাপে ভেঙে যায় প্যাভিলিয়নের সামনের টেবিল। এ সময় কর্মকর্তারা ফরম বিতরণ বন্ধ করে দিলে পুরো প্যাভিলিয়নই গুঁড়িয়ে দেয় ক্ষুব্ধ বিদেশ গমনেচ্ছুরা। মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনেও সৌদি আরব গমনেচ্ছুদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। নিবন্ধন ফরম জমা নিতে হিমশিম খেতে হয় বিএমইটির সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই সৌদি আরব গমনেচ্ছুরা ভিড় জমান প্রবাসীকল্যাণ ভবনের সামনে। গমণেচ্ছুদের চাপ সামলাতে না পেরে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। তবে সারা দেশে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে। এখনও পর্যন্ত কি পরিমাণ নিবন্ধন ফরম জমা পড়েছে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা জানাতে পারেননি।
যাওয়ার খরচ নিয়ে নানা প্রশ্ন: সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো সম্পর্কে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, সৌদি আরবে যেতে কর্মীপ্রতি সর্বোচ্চ খরচ হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। যারা লোক নেবেন তারা ব্যবসায়ীদের পারিশ্রমিক দেবেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে লোক পাঠানোর পুরোটাই বেসরকারিভাবে হবে। তারাই সব প্রক্রিয়া করবে। সবকিছু দেখভাল করবে সরকার। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সৌদি প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল খরচ। একজন কর্মীর সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। কারণ কর্মীর লেভি, যাতায়াত ভাড়া সবই নিয়োগ কর্তা দেবেন। আমরা চাই কর্মীদের কাছ থেকে যেন একটি টাকাও নেয়া না হয়। যারা লোক নেবে তারাই সে খরচ দেবে। তিনি বলেন, ভিসা কেনাবেচার কারণেই সৌদি আরবে খরচ বেড়ে যায়। এবার ভিসা কেনাবেচা করলে ১৫ বছরের জেল হয়ে যাবে।
মালয়েশিয়া যেতে ঢাকঢোল, অতঃপর হতাশা: সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে নাম নিবন্ধন করেছিলেন সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে প্রথম দফায় যাওয়ার জন্য লটারিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৫৩৮ জন। লটারিতে নির্বাচিত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খোকা তালুকদার লটারিতে নির্বাচিত হয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তিনি বলেন, লটারিতে নাম ওঠার পর বলা হয়, যে কোন সময় মালয়েশিয়া চলে যাবো। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু দুই বছরেও যেতে পারিনি। এদিকে চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়া আবার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার বিষয়ে সমঝোতা করে। সরকারিভাবে (জিটুজি) কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ- মালয়েশিয়া। তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত দুই বছরে মাত্র চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। এই ধীরগতিতে নিবন্ধনকারীদের পাশাপাশি সরকারও হতাশ। এদিকে গত কয়েক বছরে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। গত দেড় বছরে হাজার দেড়েক মানুষ অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আটক হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে অনেক দেন দরবার হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়া শুরুতেই বলেছিল ৫০ হাজার লোক নেবে। ১০ হাজারের চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ হাজার লোক নিয়েছে। এতে আমরা হতাশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর দীর্ঘ কূটনৈতিক যোগাযোগের পর এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেশটি। ২০১২ সালের ২৬শে নভেম্বর দুই দেশের সরকারের মধ্যে সরকারিভাবে লোক নিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নিতে সারা দেশে সাড়া পড়ে। ২০১৩ সালের ১৩ই জানুয়ারি থেকে ২১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৬ জন নাম নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে খরচ হয় প্রায় সাত কোটি টাকা। নিবন্ধনকারীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩৬ হাজার ৩৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় পাঠানোর জন্য লটারিতে ১১ হাজার ৭৫৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। ১৭ই জুলাই আরও ১১ হাজার ৭০৪ জনকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এ ২৩ হাজার কর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী গেছেন। এরপর আর কোন কর্মী মালয়েশিয়া যায়নি।
No comments