স্মরণ : সার্জেন্ট জহুরুল হক
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অন্যতম আসামি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৯ সালের এই দিনে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক সৈনিক। তার জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলা শহরের সোনাপুরে। জহুরুল হক ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ওই বছরই বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে আটক রাখা হয়। একই অভিযোগে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়ার জন্য সরকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বাঙালি অফিসারদের অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ৩৫ জন আসামির মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন ১ নম্বর ও সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন ১৭ নম্বরে। আসামিদের দেশরক্ষা আইন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে পুনরায় গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে যখন এই মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করছে, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে গোলটেবিল বৈঠকে বসতে প্রস্তাব করছেন, ঠিক সে সময় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে। সার্জেন্ট জহুরুল হক তখন পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করলে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন শিশুকে ধরে এনে বন্দিনিবাসের সামনে মারধর শুরু করে। কয়েকজন বন্দী এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে হাবিলদার মনজুর শাহ বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। জহুরুল হক সে আদেশ উপেক্ষা করে তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হন। এতে মনজুর রাইফেলের বেয়োনেট বাগিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসেন। জহুরুল হক পাশ কাটিয়ে তার হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেন এবং কিছুক্ষণ পর বিজয়ী বীরের মতো কামরার দরজায় গিয়ে রাইফেল ফেরত দেন। পরদিন ভোরবেলা জহুরুল হক নিজ কামরা থেকে বের হলে মনজুর শাহ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তার পেটে লাগে। সাথে সাথে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জনগণ প্রচণ্ড আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবসহ সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডকে জনগণ সহজভাবে মেনে না নিয়ে আন্দোলনকে আরো প্রচণ্ড করে তোলে। ২৫ মার্চ গণ-আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে দশ বছর স্থায়ী আইয়ুব সরকারের। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শানিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এ পথ ধরেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।
No comments