বাদশা: দেশ এক আপনজন হারাল by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাদশার
ওবিচুয়ারি আমাকে লিখতে হবে কোনো দিন ভাবিনি। ভেবেছিলাম সে-ই আমার
ওবিচুয়ারি লিখবে। এটা নিয়ে প্রায়ই তার সঙ্গে আমার কথা হতো। যখন ৮০ বছরে পা
দিই, তখন বাদশাকে বলেছিলাম, বয়সের দিক থেকে রবীনদ্রনাথকে ছুঁয়ে ফেলেছি।
ক'দিন আর বাঁচব? তুমি আমার একটা ভালো ওবিচুয়ারি লিখো। বাদশা জিভ কামড়ে বলত,
গাফ্ফার ভাই, এ কথা বলবেন না। আপনি চলে গেলে আমাদের কী হবে?
গত মঙ্গলবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঘুম থেকে জেগে যখন খবর পেলাম বাদশা আর নেই; আগের রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে মারা গেছে, তখন প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, এবার আমাদের, বিশেষ করে আমার কী হবে? বাদশাবিহীন জীবন তো আমি কল্পনা করতেও পারি না। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তার সঙ্গে আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতা। বিলাতে আসার পর বহুকাল সে আমার ছায়াসঙ্গীর মতো ছিল। তাকে নিয়ে ইউরোপের বড় বড় শহর, আমেরিকা, জাপান, কানাডা ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি ১৯৯৪ সালে একই সঙ্গে আমরা মক্কায় গিয়ে হজ সমাধা করেছি। রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব কাজকর্মে সে ছিল আমার সহকর্মী, সহযোগী। শেষ দিকে আমাদের দেখাশোনাও কম হতো। কিন্তু যোগাযোগটা অক্ষুণ্ন ছিল। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো, এটা নিজের কানে নিজের মৃত্যু সংবাদ শোনার মতো।
বাদশা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিল দীর্ঘদিন। জীবনে সে বহু ধাক্কা সামলেছে। হার্ট অপারেশন, ব্রেন অপারেশন, বুকে বসানো ছিল পেসমেকার। সঙ্গে আরও নানা রোগ। ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় সে অক্ষতভাবে বেঁচে গেছে। কিন্তু এবার দীর্ঘকাল হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে থাকার সময় চিকিৎসকরাও তার জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাদশার বয়স হয়েছিল ৭৩-এর মতো। এবার মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সে আর জয়ী হয়নি। একটি কিংবদন্তির মতো মানুষ শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
আমি তার পুরো নামটি বারবার লেখার দরকার মনে করছি না। এই নামটি সকলের জানা, খোন্দকার আমিনুল হক বাদশা। বাদশা তার ডাকনাম। এই বাদশা নামেই সে দেশ-বিদেশে পরিচিত। সে রাজনীতিতে জড়িত ছিল। সেতার বাজাত। নাটক ও ছায়াছবিতে অভিনয় করত। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সব পরিচয়ের ঊধর্ে্ব তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, ছোট-বড় সকলের অকৃত্রিম বন্ধু। বাদশার সঙ্গে একবার যার বন্ধুত্ব হয়েছে, সেই বন্ধুত্বে আর কখনও চিড় ধরেনি। রাজনৈতিক মনান্তর ও মতান্তর সত্ত্বেও ধরেনি।
তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই যে শূন্যতাবোধ দেখা দেবে, তার চেয়ে বড় শূন্যতাবোধ দেখা দেবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার অসংখ্য বন্ধুর বুকে। আমি তার সঙ্গে পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই গেছি, দেখেছি, তার অসংখ্য বন্ধু এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। একবার বাদশাকে নিয়ে লন্ডন থেকে কলকাতায় গেছি, ভোর না হতেই প্লেন নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। আমাকে রিসিভ করার জন্য যে বন্ধুর গাড়ি নিয়ে আসার কথা, তিনি তখনও এসে বিমানবন্দরে পেঁৗছাননি। আমরা বাইরের লাউঞ্জে বসে মশার কামড় খাচ্ছিলাম।
এ সময় দেখি একটা পিকআপ এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। গাড়ির গায়ে লেখা দৈনিক 'আজকাল'। গাড়ি থেকে হৈ রৈ করে তিন-চারজন যুবক নামলেন। তারা সকলেই আজকালের সাংবাদিক। বাদশার বন্ধু। বাদশা কলকাতায় আসছে শুনে তাকে রিসিভ করতে দলবদ্ধ হয়ে ছুটে এসেছে। বাদশার এই অসংখ্য গুণগ্রাহী ও বন্ধুর দেখা আমি আমেরিকার আটলান্টা সিটি এবং কানাডার অটোয়া শহর, এমনকি জাপানের টোকিও শহরেও দেখেছি। বাদশা সঙ্গে থাকলে কোথাও গিয়ে কোনো সমস্যায় কোনোভাবে আটকে পড়েছি, তা মনে পড়ে না।
জীবনে বন্ধু-বিয়োগ ব্যথা বহুবার পেয়েছি। কিন্তু বাদশার বিয়োগ-ব্যথা এত বেশি করে বুকে বাজছে তার কারণ, বিলেতের প্রবাস জীবনে (এখন আর নিজেকে প্রবাসী ভাবি না) একটা সময় প্রাত্যহিক মেলামেশা ও কাজকর্মে আমরা প্রায় অভিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে ছোট ভাই এবং বন্ধুর মতো দেখতাম। সে আমাকে দিয়েছিল বড় ভাইয়ের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মাঝে মধ্যে তার কিছু বেহিসাবি কাজ আমার পছন্দ হতো না। ফলে এমন বকাঝকা করতাম, যা নিজের ভাইয়েরও সহ্য করার কথা নয়। কিন্তু বাদশা অম্লান বদনে আমার সব গালমন্দ সহ্য করত। হাসিমুখে বলত, আপনি আমাকে স্নেহ করেন বলেই বকাঝকাও করেন।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আমি তখন অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। বাদশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, উদীয়মান ছাত্রনেতা (ছাত্রলীগের)। সুদর্শন তরুণ। আজাদের রিপোর্টিং সেকশনে এসে যোগ দিয়েছে। কুষ্টিয়াতে তার বাড়ি। তখনই জানতে পারি, পরিবারটি সংস্কৃতিমনা। লালন গান, বাউল সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। আবার রবীন্দ্রনাথেরও স্নেহধন্য। বাদশার একটা আশ্চর্য গুণ ছিল অল্প সময়ে একজনকে অত্যন্ত আপন করে নেওয়ার। ফলে আমাদের মধ্যেও সম্পর্কটা দ্রুত গভীর হয়ে ওঠে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বাদশা ছিল সামনের সারির ছাত্রনেতা। তখনকার ছাত্রনেতা_ যেমন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ সকলের সঙ্গেই তার ছিল সহযোদ্ধার সম্পর্ক। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কয়েকজন বিপ্লবী যুব নেতা যে গোপন সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, বাদশা তার সঙ্গেও ছিল জড়িত। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি গোষ্ঠীর সঙ্গেও বাদশা জড়িত ছিল ঘনিষ্ঠভাবে। এমনকি সে কারাবরণও করেছিল।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন সাংবাদিককে তার সঙ্গে নেন নির্বাচনী সফরে। বাদশাও তাদের মধ্যে ছিল একজন। অতি অল্পদিনের মধ্যে সে বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে। সে হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন। কিছুকাল বাদশা (সম্ভবত '৬৯ ও '৭০ সাল) বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সে মুজিবনগরে চলে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয়। এ সময় কলকাতায় তার সঙ্গে আমার দেখা। আমি স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে প্রথমে আগরতলায়, তারপর কলকাতায় চলে যাই। কলকাতায় সার্কাস এভিনিউতে তখনকার বাংলাদেশ ভবনে বাদশার সঙ্গে দেখা হতেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় দেশ ছেড়ে এসেছি, সে কথা তাকে জানালাম। বাদশা আমাকে অভয় দিয়েছিল, বলেছিল আমরা থাকতে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না গাফ্ফার ভাই।
বাদশা বন্দুক হাতে নিজে যুদ্ধ করেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমারই মতো সে যুদ্ধের ফ্রন্টে ফ্রন্টে ঘুরেছে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস ও উৎসাহ জোগাতে। আমাদের পরিচয় ছিল মোটিভেটর। বাদশা চমৎকারভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশতে পারত। তাদের উৎসাহ জোগাতে পারত। আমি যখন মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র 'জয়বাংলা' কাগজের নির্বাহী সম্পাদক, তখন যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে 'জয়বাংলা' অফিসে পেঁৗছে দেওয়া ছিল তার অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য কথিকা রচনাতেও সে অংশ নিত। তার ছোট ভাই মান্না হক ছিল এ বেতারের সঙ্গীত বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাদশা বড় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝোঁকেনি। বঙ্গবন্ধুর অনুগত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তার পাশে থাকতে চেয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুই তাকে বিলাতে পাঠান ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। একই সঙ্গে বাদশাকে লন্ডনে বাসসর প্রতিনিধি করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সে সাপ্তাহিক প্রবাসী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের লন্ডন শাখায় সে গণসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করে।
বাদশার কর্মজীবন বিচিত্র। সোস্যাল ওয়ার্কার থেকে মার্কস স্পেনসারের সেলসম্যান, কলকাতা, ঢাকা, লন্ডনের বহু কাগজের খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা, নাটকে ও ছায়াছবিতে অভিনয় ইত্যাদি পেশায় তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গেছে। তার সাহিত্যিক প্রতিভাও ছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার লেখা 'হৃদয়ে বিষাদসিন্ধু' বইয়ে তার এই পরিচয় পাওয়া যায়। আমি যখন ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ওপর 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' ছায়াছবিটি তৈরি করি, তখন বাদশা নিজের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করে। কলকাতায় অরোরা স্টুডিওতে এর চিত্রগ্রহণের সময় বাদশা রাতদিন জেগে ছবিটি শেষ করার জন্য সাহায্য করেছে।
বাদশাকে নিয়ে আমি দু'বার শান্তিনিকেতনে গেছি। একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বাদশা সারারাত আমার বিছানার পাশে জেগে রয়েছে। ওষুধ খাইয়েছে। তাকে নিয়ে ১৯৯৪ সালে গেছি মক্কায় পবিত্র হজ করার জন্য। আমি তখন আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। হাঁটুতে ব্যথা। বাদশা বলেছে, ঘাবড়াবেন না গাফ্ফার ভাই। কাবা শরিফ তাওয়াফের সময় আমার কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটবেন। শুধু তাওয়াফের সময় নয়, শাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণের সময়ও আমি তার কাঁধে ভর করে হেঁটেছি। তাকে ঠাট্টা করে বলেছি, বাদশা তুমি আমার সওয়াবের (পুণ্যের) অর্ধেকটা নিয়ে গেলে।
বাদশাকে নিয়ে কোথায় না গেছি, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সানফ্রান্সিসকো, ডালাস, লাসভেগাস_ সর্বত্র সে ছিল আমার ছায়াসঙ্গী। তাকে হারানোর বেদনা লিখে কাউকে বোঝানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাদশা ইচ্ছা করলেই জিয়াউর রহমান বা এরশাদ চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের একজন কেউকেটা হতে পারত। তা সে হয়নি। লন্ডনে সাধারণ সোস্যাল সার্ভিসের কাজ করে অবসর নিয়েছে। শেষ বয়সে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে তার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যে কখনও চিড় ধরেনি, এটা আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে বাদশার যে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তার সুবাদে সে মন্ত্রী হতে পারত, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা হতে পারত। তার সমসাময়িক অনেক ছাত্রনেতা এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। বাদশাও তা হতে পারত। বাদশা তা হয়নি। সে অনেকটা বোহেমিয়ান টাইপের মানুষ ছিল। কিন্তু ক্ষমতা ও অর্থের লোভ তার ছিল না। এই আপনভোলা মানুষটি অনেক সময় রাজনৈতিক শত্রু এবং বঙ্গবন্ধুর শত্রু হিসেবে গণ্য কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করত। ফলে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এখন এই মানুষটি সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব চলে গেল।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও বাদশা তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করত। আমি যখন শেষবারের মতো তাকে দেখতে যাই, আমাকে হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছে, 'গাফ্ফার ভাই, আমরা কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ রক্ষা করতে পারব না?' নিজের জীবনের চেয়ে দেশের ভবিষ্যৎ তাকে বেশি বিচলিত করেছিল।
বাদশাকে আমি দু'বার অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। একবার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে দাঁড়িয়ে; আরেকবার হজ করার সময় কাবা শরিফের দেয়ালে প্রোথিত কালো পাথর ছুঁয়ে। আজ বাদশার জন্য আমরা কাঁদছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, বিশেষ করে তার ছোট ভাই খোন্দকার রাশেদুল হক নবাকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। নবাও বাদশার মতো সর্বজনপরিচিত এবং বন্ধুবৎসল। বিপদে-আপদে বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাদশা আজ চলে গেল বটে, কিন্তু একজন কিংবদন্তির মানুষের মতো সে বহুকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবে।
লন্ডন, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
গত মঙ্গলবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঘুম থেকে জেগে যখন খবর পেলাম বাদশা আর নেই; আগের রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে মারা গেছে, তখন প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, এবার আমাদের, বিশেষ করে আমার কী হবে? বাদশাবিহীন জীবন তো আমি কল্পনা করতেও পারি না। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তার সঙ্গে আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতা। বিলাতে আসার পর বহুকাল সে আমার ছায়াসঙ্গীর মতো ছিল। তাকে নিয়ে ইউরোপের বড় বড় শহর, আমেরিকা, জাপান, কানাডা ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি ১৯৯৪ সালে একই সঙ্গে আমরা মক্কায় গিয়ে হজ সমাধা করেছি। রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব কাজকর্মে সে ছিল আমার সহকর্মী, সহযোগী। শেষ দিকে আমাদের দেখাশোনাও কম হতো। কিন্তু যোগাযোগটা অক্ষুণ্ন ছিল। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো, এটা নিজের কানে নিজের মৃত্যু সংবাদ শোনার মতো।
বাদশা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিল দীর্ঘদিন। জীবনে সে বহু ধাক্কা সামলেছে। হার্ট অপারেশন, ব্রেন অপারেশন, বুকে বসানো ছিল পেসমেকার। সঙ্গে আরও নানা রোগ। ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় সে অক্ষতভাবে বেঁচে গেছে। কিন্তু এবার দীর্ঘকাল হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে থাকার সময় চিকিৎসকরাও তার জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাদশার বয়স হয়েছিল ৭৩-এর মতো। এবার মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সে আর জয়ী হয়নি। একটি কিংবদন্তির মতো মানুষ শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
আমি তার পুরো নামটি বারবার লেখার দরকার মনে করছি না। এই নামটি সকলের জানা, খোন্দকার আমিনুল হক বাদশা। বাদশা তার ডাকনাম। এই বাদশা নামেই সে দেশ-বিদেশে পরিচিত। সে রাজনীতিতে জড়িত ছিল। সেতার বাজাত। নাটক ও ছায়াছবিতে অভিনয় করত। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সব পরিচয়ের ঊধর্ে্ব তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, ছোট-বড় সকলের অকৃত্রিম বন্ধু। বাদশার সঙ্গে একবার যার বন্ধুত্ব হয়েছে, সেই বন্ধুত্বে আর কখনও চিড় ধরেনি। রাজনৈতিক মনান্তর ও মতান্তর সত্ত্বেও ধরেনি।
তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই যে শূন্যতাবোধ দেখা দেবে, তার চেয়ে বড় শূন্যতাবোধ দেখা দেবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার অসংখ্য বন্ধুর বুকে। আমি তার সঙ্গে পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই গেছি, দেখেছি, তার অসংখ্য বন্ধু এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। একবার বাদশাকে নিয়ে লন্ডন থেকে কলকাতায় গেছি, ভোর না হতেই প্লেন নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। আমাকে রিসিভ করার জন্য যে বন্ধুর গাড়ি নিয়ে আসার কথা, তিনি তখনও এসে বিমানবন্দরে পেঁৗছাননি। আমরা বাইরের লাউঞ্জে বসে মশার কামড় খাচ্ছিলাম।
এ সময় দেখি একটা পিকআপ এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। গাড়ির গায়ে লেখা দৈনিক 'আজকাল'। গাড়ি থেকে হৈ রৈ করে তিন-চারজন যুবক নামলেন। তারা সকলেই আজকালের সাংবাদিক। বাদশার বন্ধু। বাদশা কলকাতায় আসছে শুনে তাকে রিসিভ করতে দলবদ্ধ হয়ে ছুটে এসেছে। বাদশার এই অসংখ্য গুণগ্রাহী ও বন্ধুর দেখা আমি আমেরিকার আটলান্টা সিটি এবং কানাডার অটোয়া শহর, এমনকি জাপানের টোকিও শহরেও দেখেছি। বাদশা সঙ্গে থাকলে কোথাও গিয়ে কোনো সমস্যায় কোনোভাবে আটকে পড়েছি, তা মনে পড়ে না।
জীবনে বন্ধু-বিয়োগ ব্যথা বহুবার পেয়েছি। কিন্তু বাদশার বিয়োগ-ব্যথা এত বেশি করে বুকে বাজছে তার কারণ, বিলেতের প্রবাস জীবনে (এখন আর নিজেকে প্রবাসী ভাবি না) একটা সময় প্রাত্যহিক মেলামেশা ও কাজকর্মে আমরা প্রায় অভিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে ছোট ভাই এবং বন্ধুর মতো দেখতাম। সে আমাকে দিয়েছিল বড় ভাইয়ের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মাঝে মধ্যে তার কিছু বেহিসাবি কাজ আমার পছন্দ হতো না। ফলে এমন বকাঝকা করতাম, যা নিজের ভাইয়েরও সহ্য করার কথা নয়। কিন্তু বাদশা অম্লান বদনে আমার সব গালমন্দ সহ্য করত। হাসিমুখে বলত, আপনি আমাকে স্নেহ করেন বলেই বকাঝকাও করেন।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আমি তখন অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। বাদশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, উদীয়মান ছাত্রনেতা (ছাত্রলীগের)। সুদর্শন তরুণ। আজাদের রিপোর্টিং সেকশনে এসে যোগ দিয়েছে। কুষ্টিয়াতে তার বাড়ি। তখনই জানতে পারি, পরিবারটি সংস্কৃতিমনা। লালন গান, বাউল সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। আবার রবীন্দ্রনাথেরও স্নেহধন্য। বাদশার একটা আশ্চর্য গুণ ছিল অল্প সময়ে একজনকে অত্যন্ত আপন করে নেওয়ার। ফলে আমাদের মধ্যেও সম্পর্কটা দ্রুত গভীর হয়ে ওঠে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বাদশা ছিল সামনের সারির ছাত্রনেতা। তখনকার ছাত্রনেতা_ যেমন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ সকলের সঙ্গেই তার ছিল সহযোদ্ধার সম্পর্ক। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কয়েকজন বিপ্লবী যুব নেতা যে গোপন সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, বাদশা তার সঙ্গেও ছিল জড়িত। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি গোষ্ঠীর সঙ্গেও বাদশা জড়িত ছিল ঘনিষ্ঠভাবে। এমনকি সে কারাবরণও করেছিল।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন সাংবাদিককে তার সঙ্গে নেন নির্বাচনী সফরে। বাদশাও তাদের মধ্যে ছিল একজন। অতি অল্পদিনের মধ্যে সে বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে। সে হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন। কিছুকাল বাদশা (সম্ভবত '৬৯ ও '৭০ সাল) বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সে মুজিবনগরে চলে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয়। এ সময় কলকাতায় তার সঙ্গে আমার দেখা। আমি স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে প্রথমে আগরতলায়, তারপর কলকাতায় চলে যাই। কলকাতায় সার্কাস এভিনিউতে তখনকার বাংলাদেশ ভবনে বাদশার সঙ্গে দেখা হতেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় দেশ ছেড়ে এসেছি, সে কথা তাকে জানালাম। বাদশা আমাকে অভয় দিয়েছিল, বলেছিল আমরা থাকতে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না গাফ্ফার ভাই।
বাদশা বন্দুক হাতে নিজে যুদ্ধ করেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমারই মতো সে যুদ্ধের ফ্রন্টে ফ্রন্টে ঘুরেছে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস ও উৎসাহ জোগাতে। আমাদের পরিচয় ছিল মোটিভেটর। বাদশা চমৎকারভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশতে পারত। তাদের উৎসাহ জোগাতে পারত। আমি যখন মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র 'জয়বাংলা' কাগজের নির্বাহী সম্পাদক, তখন যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে 'জয়বাংলা' অফিসে পেঁৗছে দেওয়া ছিল তার অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য কথিকা রচনাতেও সে অংশ নিত। তার ছোট ভাই মান্না হক ছিল এ বেতারের সঙ্গীত বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাদশা বড় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝোঁকেনি। বঙ্গবন্ধুর অনুগত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তার পাশে থাকতে চেয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুই তাকে বিলাতে পাঠান ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। একই সঙ্গে বাদশাকে লন্ডনে বাসসর প্রতিনিধি করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সে সাপ্তাহিক প্রবাসী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের লন্ডন শাখায় সে গণসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করে।
বাদশার কর্মজীবন বিচিত্র। সোস্যাল ওয়ার্কার থেকে মার্কস স্পেনসারের সেলসম্যান, কলকাতা, ঢাকা, লন্ডনের বহু কাগজের খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা, নাটকে ও ছায়াছবিতে অভিনয় ইত্যাদি পেশায় তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গেছে। তার সাহিত্যিক প্রতিভাও ছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার লেখা 'হৃদয়ে বিষাদসিন্ধু' বইয়ে তার এই পরিচয় পাওয়া যায়। আমি যখন ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ওপর 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' ছায়াছবিটি তৈরি করি, তখন বাদশা নিজের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করে। কলকাতায় অরোরা স্টুডিওতে এর চিত্রগ্রহণের সময় বাদশা রাতদিন জেগে ছবিটি শেষ করার জন্য সাহায্য করেছে।
বাদশাকে নিয়ে আমি দু'বার শান্তিনিকেতনে গেছি। একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বাদশা সারারাত আমার বিছানার পাশে জেগে রয়েছে। ওষুধ খাইয়েছে। তাকে নিয়ে ১৯৯৪ সালে গেছি মক্কায় পবিত্র হজ করার জন্য। আমি তখন আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। হাঁটুতে ব্যথা। বাদশা বলেছে, ঘাবড়াবেন না গাফ্ফার ভাই। কাবা শরিফ তাওয়াফের সময় আমার কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটবেন। শুধু তাওয়াফের সময় নয়, শাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণের সময়ও আমি তার কাঁধে ভর করে হেঁটেছি। তাকে ঠাট্টা করে বলেছি, বাদশা তুমি আমার সওয়াবের (পুণ্যের) অর্ধেকটা নিয়ে গেলে।
বাদশাকে নিয়ে কোথায় না গেছি, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সানফ্রান্সিসকো, ডালাস, লাসভেগাস_ সর্বত্র সে ছিল আমার ছায়াসঙ্গী। তাকে হারানোর বেদনা লিখে কাউকে বোঝানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাদশা ইচ্ছা করলেই জিয়াউর রহমান বা এরশাদ চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের একজন কেউকেটা হতে পারত। তা সে হয়নি। লন্ডনে সাধারণ সোস্যাল সার্ভিসের কাজ করে অবসর নিয়েছে। শেষ বয়সে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে তার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যে কখনও চিড় ধরেনি, এটা আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে বাদশার যে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তার সুবাদে সে মন্ত্রী হতে পারত, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা হতে পারত। তার সমসাময়িক অনেক ছাত্রনেতা এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। বাদশাও তা হতে পারত। বাদশা তা হয়নি। সে অনেকটা বোহেমিয়ান টাইপের মানুষ ছিল। কিন্তু ক্ষমতা ও অর্থের লোভ তার ছিল না। এই আপনভোলা মানুষটি অনেক সময় রাজনৈতিক শত্রু এবং বঙ্গবন্ধুর শত্রু হিসেবে গণ্য কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করত। ফলে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এখন এই মানুষটি সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব চলে গেল।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে সন্ত্রাসের রাজনীতি, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও বাদশা তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করত। আমি যখন শেষবারের মতো তাকে দেখতে যাই, আমাকে হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছে, 'গাফ্ফার ভাই, আমরা কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ রক্ষা করতে পারব না?' নিজের জীবনের চেয়ে দেশের ভবিষ্যৎ তাকে বেশি বিচলিত করেছিল।
বাদশাকে আমি দু'বার অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। একবার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে দাঁড়িয়ে; আরেকবার হজ করার সময় কাবা শরিফের দেয়ালে প্রোথিত কালো পাথর ছুঁয়ে। আজ বাদশার জন্য আমরা কাঁদছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, বিশেষ করে তার ছোট ভাই খোন্দকার রাশেদুল হক নবাকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। নবাও বাদশার মতো সর্বজনপরিচিত এবং বন্ধুবৎসল। বিপদে-আপদে বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাদশা আজ চলে গেল বটে, কিন্তু একজন কিংবদন্তির মানুষের মতো সে বহুকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবে।
লন্ডন, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
No comments