সুশাসনের জন্য একটি প্রতিবেদন by ড. মাহবুব উল্লাহ্
গত ২০ ডিসেম্বর শনিবার ব্র্যাক সেন্টারে
আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর
পক্ষ থেকে The State of Governance Bangladesh 2013: Democracy Party
Politics রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ গভর্নেন্স
অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি ইন্সটিটিউট। এ
ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গভর্নেন্স সমস্যা সম্পর্কে নিয়মিত
বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ ধরনের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের
মূল উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশের গভর্নেন্স সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা। এ
প্রতিবেদন ব্যক্তিবিশেষের কাল্পনিক চিন্তা-ভাবনার ফসল নয়। রিপোর্ট
প্রণয়নকারীরা গবেষণার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিবেদনের
প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সংখ্যাগত ও গুণগত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। এ
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন ড. সুলতান হাফিজ রহমান। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে
ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ, বিআইডিএসের
রিসার্চ ডিরেক্টর ড. বিনায়ক সেন এবং সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর
খান রনো। অবশ্য রনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। অতিথি বক্তাদের মধ্যে
ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগের প্রফেসর মোহাম্মদ আলী আশরাফ এমপি ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার,
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।
প্রধান অতিথি ছিলেন ড. কামাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের পক্ষ থেকেও
কিছুসংখ্যক অতিথিকে মন্তব্য করার সুযোগ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, প্রফেসর
মোহাম্মদ আলী আশরাফ উপস্থিত ছিলেন না। তার অনুপস্থিতির সুযোগে সুরঞ্জিত
সেনগুপ্ত অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। অতিথি বক্তাদের মধ্যে আওয়ামী
লীগ নেতাদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। তবে বিএনপির আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী
এককভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বক্তব্য রাখেন। আলোচনায় রাজনৈতিক বক্তব্য
পরিবেশিত হলেও কোনোরকম তিক্ত, কটাক্ষপূর্ণ শব্দ উচ্চারিত হয়নি। একে অবশ্যই
শুভ লক্ষণ বলা যায়। আলোচকরা প্রায় সবাই একমত হন যে, গণতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে
শর্তহীন সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এদিক থেকে বলা যায়, ব্র্যাক
বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের পরিবেশে একটি রাজনৈতিক
সেতুবন্ধ রচনার উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করেছে। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি,
রাজনীতিকরা যখন নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে বক্তব্য রাখেন তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
শালীনতা ও শিষ্টাচারের সীমা লংঘিত হয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানটি থেকে বোঝা গেল একাডেমিক পরিবেশের মধ্যে পড়লে রাজনীতিকরা ঠিকই বোঝেন কীভাবে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত ভাষায় নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরা যায়। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে রাজনীতিকরা জন্মগতভাবে তেঁতো জিহ্বার অধিকারী নন। তারা যখন তিক্ত কথা উচ্চারণ করেন তখন হয়তো পরিবেশের কারণেই করেন। অথবা কারোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য করেন। এটা তাদের টিকে থাকার কৌশলও হতে পারে।
একটি ইলেকট্রনিক চ্যানেলে দেখলাম ব্র্যাকের এ প্রতিবেদন সম্পর্কে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত একজন আলোচক প্রতিবেদনটিকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারছেন না। তার বক্তব্যের সার কথা হল, বৃহৎ দুটি দলের সমালোচনা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার মাধ্যমে কার্যত বিরাজনীতিকরণকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমনটি করা হয়েছিল ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের শাসনামলে। তার আশংকা এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণতন্ত্রবিরোধী অশুভ শক্তির আত্মপ্রকাশেরই সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেছেন, ২০০৭-এর সেনা হস্তক্ষেপের আগে সৎ প্রার্থী নির্বাচনের প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেনা হস্তক্ষেপের পথকেই সুগম করা হয়েছে। তার আরও অভিমত, এ ধরনের প্রতিবেদনে শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলোকেই তুলে ধরা হয়। সরকারের ইতিবাচক কোনো কাজকে এসব প্রতিবেদনে প্রশংসা করা হয় না। এ কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের মতোই এ প্রতিবেদনটিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনো অসূয়া না থাকলে প্রতিবেদকরা রাজনৈতিক দলের কউন্সিল অধিবেশনের সময় পরামর্শগুলো তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন, যারা এ প্রতিবেদন রচনা করেছেন তারা কেউ রাজনৈতিক দলের লোক নন। তারা যদি কোনো সুনির্দিষ্ট দলের লোক হতেন অথবা কোনো দলের শুভানুধ্যায়ী হতেন তাহলে ওই দলের কাউন্সিল অধিবেশনের সময় তাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ত। একটি মুক্ত সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে এটাই তো স্বাভাবিক। চিন্তাশীল মানুষ দেশ ও দেশের প্রয়োজনে যা কিছু ভালো মনে করবেন, সেসব কথা অকুতোভয়ে যখন ইচ্ছা বলবেন, তাতে আপত্তির কী আছে? আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এর মানে এই নয়, আমাদের দল কানা হয়ে যেতে হবে। নির্দোষ, নির্বিবাদী বিশ্বজিৎকে একটি রাজনৈতিক দলের হরতাল প্রতিহতের নামে কুপিয়ে হত্যা করা হল, তারপরও কি এ ধরনের নৃশংস কাজকে সমর্থন করা যায়? বা এর পক্ষে সাফাই গাওয়া যায়? দলের আইডিয়োলজি যাই হোক, তার জন্য এরকম নির্মম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা যাবে না- এটা কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না।
সুশাসন নিয়ে দেশে বহুদিন ধরেই কথা হচ্ছে। সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্রও সুষ্ঠু রূপ পেতে পারে না। কিন্তু এ প্রশ্নেও বাস্তববাদী হতে হবে। পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সুশাসন এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কথায় বলে- Rome was not built in a day. তেমনি উচ্চমানের সুশাসনের দেশগুলো একদিনে এ পর্যায়ে পৌঁছেনি। সুইডেন, ডেনমার্ক, গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সুশাসন আমরা প্রত্যক্ষ করি তার জন্য একদিকে রাজনৈতিক কালচার উন্নয়নের অব্যাহত প্রয়াস রয়েছে, অন্যদিকে বিশাল পরিমাণের অর্থও বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অতি উন্নতমানের সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে সে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের এক শতাংশ সামর্থ্যও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। দুর্নীতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়ায় এবং আইনশৃংখলা কঠোরভাবে পালন করায় সিঙ্গাপুর সুশাসনের দুটি প্রধান শর্ত পালন করতে পেরেছে। সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ডলার। সুতরাং সুশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সিঙ্গাপুর পূরণ করতে পারছে। কিন্তু আমাদের এ কথাও স্বীকার করতে হবে সিঙ্গাপুর গণতন্ত্রের জন্য কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নয়। সিঙ্গাপুরকে অনেকে পুলিশ স্টেট বলে গণ্য করেন। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পিপল্স অ্যাকশন পার্টি ক্ষমতাসীন রয়েছে। সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী। তাই সিঙ্গাপুর সুশাসনের জন্য কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। বেশ কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীরা যাতে দুর্নীতিপরায়ণ না হয়ে ওঠে, তার জন্য তাদের বিশাল বেতন দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীদের বেতন ৪-৫ লাখ ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সততা এমন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেটি আর্থিক মূল্যে কেনা যায় না। যিনি সৎ হবেন তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সৎ থাকবেন। তার নৈতিকতার মান হবে অনেক উঁচু। আমাদের মতো দেশে উচ্চমানের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সময়ের প্রয়োজন হবে। সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমরা উন্নয়নবান্ধব শাসনের কথা চিন্তা করতে পারি। এর জন্যও প্রয়োজন হবে আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার। এ তিনটি লক্ষ্য অর্জনও খুব সহজ নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটা নিশ্চিত করতে হবে, আইনের চোখে সবাই সমান। শাসক দলের লোক হলে একরকম বিচার এবং বিরোধী দলের লোক হলে অন্যরকম বিচার তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এছাড়া শাসক দলের লোকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া এবং বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে করা মামলা বহাল রাখা আইনের শাসনের কথা নয়। অন্যদিকে লাখ লাখ বিচার ঝুলে থাকার বিষয়টিও আইনের শাসনকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তির জন্য অলটারনেটিভ ডিসপিউট রিজোলিউশনের কথা বলা হয়। কিন্তু ঝুলে থাকা মামলা কমানোর জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলেও যথেষ্ট নয়। বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চ আদালতে বেঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারকদের প্রশিক্ষণ এবং আদালত অঙ্গনে প্রশাসনিক দুর্নীতি দূর করেই ঝুলে থাকা মামলা হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্যও বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। আমাদের এমনিতেই ঘাটতি বাজেট। এরপর একটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি খুবই কঠিন কাজ হবে। অন্যদিকে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের জন্য রাজস্ব প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। এটাও সুশাসনের একটি লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হলেও এর সুফল আসবে বলে এটি বড় রকমের কোনো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না।
উন্নয়নমুখী শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য হল শাসক দলের লোকদের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতমূলক আচরণ। তবে এ পক্ষপাতিত্ব তারাই পেতে পারেন। যারা শাসক দলের মধ্যে সৎ ও দক্ষ বলে পরিচিত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হল সরকারি দলের কোলে ঝোল টানতে গিয়ে প্রায়ই অদক্ষ ও অযোগ্য লোকগুলোকে বেছে নেয়া হয়। এরা নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ না হলেও দুর্নীতিতে খুবই দক্ষ। রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্প হল, জনৈক আমলার সচিব পদে পদোন্নতি সম্পর্কিত। সেই আমলার পদোন্নতি যারা পছন্দ করেননি তারা রাষ্ট্রপতিকে কানপড়া দিলেন, লোকটি আওয়ামীপন্থী। রাষ্ট্রপতি জানতে চাইলেন, লোকটি সৎ কিনা? দ্বিতীয়ত তিনি দক্ষ কিনা? উভয় প্রশ্নের জবাবেই উত্তর এলো লোকটি সৎ ও দক্ষ। রাষ্ট্রপতি জিয়া তার পদোন্নতি নিশ্চিত করলেন। কানপড়ায় কোনো কাজ হল না। জনগণ এ ধরনের রাষ্ট্রনায়কই চায়। পরবর্তীকালে এ ব্যক্তি আওয়ামী লীগের এক সরকারের আমলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। অযোগ্য ও অসৎ লোকদের নিয়ে দেশ চালাতে গেলে সমূহ বিপদ হয়। তাই সুশাসনের প্রেসক্রিপশন বহুমুখী হতে পারে। আপাতত সবকিছু ঠিক করে ফেলার উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য গ্রহণ না করে নির্বাচিত এবং অগ্রাধিকারমূলক লক্ষ্যই গ্রহণ করতে হবে। ব্র্যাকের অনুষ্ঠানে দুজন বুদ্ধিজীবী দুটি চমৎকার কথা বলেছেন। প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেছেন, কুশাসন অব্যাহত থাকতে পারছে কারণ, কুশাসন লাভজনক। আমি তার বক্তব্যটিকে ঈষৎ সংশোধিত করে বলব, কুশাসন তার অংশীদারদের জন্য লাভজনক এবং ক্ষমতার দিক থেকে তারা প্রতাপশালী। ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে, জনসংখ্যার একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। অনেকে অল্প সময়ের মধ্যে বিত্তশালীও হয়েছে। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যারা ওপরের সিঁড়িতে উঠেছেন, সেখান থেকে তারা যে কোনো সময়ে পা পিছলে পড়ে যেতে পারে, তারা এ আশংকায় থাকেন। এজন্য তারা শাসক দলের সঙ্গে মন যুগিয়ে চলে। এ মানসিকতা ব্যাপক হওয়ার ফলে পরিবর্তনের জন্য তেমন কোনো বড় আন্দোলন গড়ে উঠছে না। স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই তাদের কৌশল। এ থেকে আমরা যে উপসংহারে উপনীত হতে পারি তা হল, ষাটের দশকের পুনরাবৃত্তি ঘটা খুব নিকট নয়। তবে দেশে যেভাবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দুর্ভিক্ষ চলছে তা থেকে অনুমান করা যায়, যারা ওপরের সিঁড়িতে উঠেছেন তারাও হয়তো বিনিয়োগহীনতার আঁচ অনুভব করতে শুরু করবেন। উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময়ে কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলন হয় না। কিন্তু অর্থনৈতিক অধোগতির সময়ে উন্নত দেশগুলোর রাজপথ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়ে ওঠে। যেমন, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট কিংবা নাইনটি নাইন এগেইনসট ওয়ান মুভমেন্ট। গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালে এর চেয়েও তীব্র গণবিক্ষোভ হয়েছে। ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।
ব্র্যাকের গভর্নেন্স রিপোর্টে একটি চমৎকার রাজনৈতিক পরিভাষা স্থান পেয়েছে। পরিভাষাটি হল Partyarchy বাংলায়-এর অর্থ হল দলতন্ত্র। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে This attempt by the political parties to capture state and non-state institution has been termed as partyarchy. It is a political phenomenon whereby Ôpolitical parties monopolies the formal political process and politicise society along party lines' (coppedge 1994) কোপেজের এ গ্রন্থটির নাম হল Strong Parties And Lame Ducks: Presidential Partyarchy And Factionalism in Venezuela.পার্টিআরকির কারণেই বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হতে চলেছে। ব্র্যাকের এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংসদে রাজনীতিকদের অবস্থা, অংশীমূলক গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন সম্পর্কে বিশ্লেষণ এবং পরিসংখ্যান, চার্ট এবং বহুবিধ মানচিত্র স্থান পেয়েছে। একাডেমিক বিবেচনায় রিপোর্টটি খুবই সমৃদ্ধ। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে রিপোর্টটি অনেকেরই দৃষ্টি কাড়বে বলে আশা করা যায়। এর সমালোচনাও হতে পারে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এরকম একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত হলেই আমরা আশা করব সেই সরকার বাংলাদেশে সুশাসনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার কাজে ব্রতী হবে। সেই কাজগুলো এ রিপোর্টে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই দিক থেকে রিপোর্টটি মূল্যবান।
জেরেমি বেনথাম একটি সুসমাজ সম্পর্কে বলেছিলেন, Greatest good of the greatest number- আমরা যদি সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই তাহলে আমজনতারও মঙ্গলের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানটি থেকে বোঝা গেল একাডেমিক পরিবেশের মধ্যে পড়লে রাজনীতিকরা ঠিকই বোঝেন কীভাবে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত ভাষায় নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরা যায়। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে রাজনীতিকরা জন্মগতভাবে তেঁতো জিহ্বার অধিকারী নন। তারা যখন তিক্ত কথা উচ্চারণ করেন তখন হয়তো পরিবেশের কারণেই করেন। অথবা কারোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য করেন। এটা তাদের টিকে থাকার কৌশলও হতে পারে।
একটি ইলেকট্রনিক চ্যানেলে দেখলাম ব্র্যাকের এ প্রতিবেদন সম্পর্কে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত একজন আলোচক প্রতিবেদনটিকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারছেন না। তার বক্তব্যের সার কথা হল, বৃহৎ দুটি দলের সমালোচনা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার মাধ্যমে কার্যত বিরাজনীতিকরণকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমনটি করা হয়েছিল ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের শাসনামলে। তার আশংকা এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণতন্ত্রবিরোধী অশুভ শক্তির আত্মপ্রকাশেরই সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেছেন, ২০০৭-এর সেনা হস্তক্ষেপের আগে সৎ প্রার্থী নির্বাচনের প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেনা হস্তক্ষেপের পথকেই সুগম করা হয়েছে। তার আরও অভিমত, এ ধরনের প্রতিবেদনে শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলোকেই তুলে ধরা হয়। সরকারের ইতিবাচক কোনো কাজকে এসব প্রতিবেদনে প্রশংসা করা হয় না। এ কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের মতোই এ প্রতিবেদনটিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনো অসূয়া না থাকলে প্রতিবেদকরা রাজনৈতিক দলের কউন্সিল অধিবেশনের সময় পরামর্শগুলো তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন, যারা এ প্রতিবেদন রচনা করেছেন তারা কেউ রাজনৈতিক দলের লোক নন। তারা যদি কোনো সুনির্দিষ্ট দলের লোক হতেন অথবা কোনো দলের শুভানুধ্যায়ী হতেন তাহলে ওই দলের কাউন্সিল অধিবেশনের সময় তাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ত। একটি মুক্ত সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে এটাই তো স্বাভাবিক। চিন্তাশীল মানুষ দেশ ও দেশের প্রয়োজনে যা কিছু ভালো মনে করবেন, সেসব কথা অকুতোভয়ে যখন ইচ্ছা বলবেন, তাতে আপত্তির কী আছে? আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এর মানে এই নয়, আমাদের দল কানা হয়ে যেতে হবে। নির্দোষ, নির্বিবাদী বিশ্বজিৎকে একটি রাজনৈতিক দলের হরতাল প্রতিহতের নামে কুপিয়ে হত্যা করা হল, তারপরও কি এ ধরনের নৃশংস কাজকে সমর্থন করা যায়? বা এর পক্ষে সাফাই গাওয়া যায়? দলের আইডিয়োলজি যাই হোক, তার জন্য এরকম নির্মম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা যাবে না- এটা কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না।
সুশাসন নিয়ে দেশে বহুদিন ধরেই কথা হচ্ছে। সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্রও সুষ্ঠু রূপ পেতে পারে না। কিন্তু এ প্রশ্নেও বাস্তববাদী হতে হবে। পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সুশাসন এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কথায় বলে- Rome was not built in a day. তেমনি উচ্চমানের সুশাসনের দেশগুলো একদিনে এ পর্যায়ে পৌঁছেনি। সুইডেন, ডেনমার্ক, গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সুশাসন আমরা প্রত্যক্ষ করি তার জন্য একদিকে রাজনৈতিক কালচার উন্নয়নের অব্যাহত প্রয়াস রয়েছে, অন্যদিকে বিশাল পরিমাণের অর্থও বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অতি উন্নতমানের সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে সে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের এক শতাংশ সামর্থ্যও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। দুর্নীতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়ায় এবং আইনশৃংখলা কঠোরভাবে পালন করায় সিঙ্গাপুর সুশাসনের দুটি প্রধান শর্ত পালন করতে পেরেছে। সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ডলার। সুতরাং সুশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সিঙ্গাপুর পূরণ করতে পারছে। কিন্তু আমাদের এ কথাও স্বীকার করতে হবে সিঙ্গাপুর গণতন্ত্রের জন্য কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নয়। সিঙ্গাপুরকে অনেকে পুলিশ স্টেট বলে গণ্য করেন। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পিপল্স অ্যাকশন পার্টি ক্ষমতাসীন রয়েছে। সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী। তাই সিঙ্গাপুর সুশাসনের জন্য কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। বেশ কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীরা যাতে দুর্নীতিপরায়ণ না হয়ে ওঠে, তার জন্য তাদের বিশাল বেতন দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীদের বেতন ৪-৫ লাখ ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সততা এমন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেটি আর্থিক মূল্যে কেনা যায় না। যিনি সৎ হবেন তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সৎ থাকবেন। তার নৈতিকতার মান হবে অনেক উঁচু। আমাদের মতো দেশে উচ্চমানের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সময়ের প্রয়োজন হবে। সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমরা উন্নয়নবান্ধব শাসনের কথা চিন্তা করতে পারি। এর জন্যও প্রয়োজন হবে আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার। এ তিনটি লক্ষ্য অর্জনও খুব সহজ নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটা নিশ্চিত করতে হবে, আইনের চোখে সবাই সমান। শাসক দলের লোক হলে একরকম বিচার এবং বিরোধী দলের লোক হলে অন্যরকম বিচার তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এছাড়া শাসক দলের লোকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া এবং বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে করা মামলা বহাল রাখা আইনের শাসনের কথা নয়। অন্যদিকে লাখ লাখ বিচার ঝুলে থাকার বিষয়টিও আইনের শাসনকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তির জন্য অলটারনেটিভ ডিসপিউট রিজোলিউশনের কথা বলা হয়। কিন্তু ঝুলে থাকা মামলা কমানোর জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলেও যথেষ্ট নয়। বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চ আদালতে বেঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারকদের প্রশিক্ষণ এবং আদালত অঙ্গনে প্রশাসনিক দুর্নীতি দূর করেই ঝুলে থাকা মামলা হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্যও বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। আমাদের এমনিতেই ঘাটতি বাজেট। এরপর একটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি খুবই কঠিন কাজ হবে। অন্যদিকে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের জন্য রাজস্ব প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। এটাও সুশাসনের একটি লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হলেও এর সুফল আসবে বলে এটি বড় রকমের কোনো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না।
উন্নয়নমুখী শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য হল শাসক দলের লোকদের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতমূলক আচরণ। তবে এ পক্ষপাতিত্ব তারাই পেতে পারেন। যারা শাসক দলের মধ্যে সৎ ও দক্ষ বলে পরিচিত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হল সরকারি দলের কোলে ঝোল টানতে গিয়ে প্রায়ই অদক্ষ ও অযোগ্য লোকগুলোকে বেছে নেয়া হয়। এরা নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ না হলেও দুর্নীতিতে খুবই দক্ষ। রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনামল সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্প হল, জনৈক আমলার সচিব পদে পদোন্নতি সম্পর্কিত। সেই আমলার পদোন্নতি যারা পছন্দ করেননি তারা রাষ্ট্রপতিকে কানপড়া দিলেন, লোকটি আওয়ামীপন্থী। রাষ্ট্রপতি জানতে চাইলেন, লোকটি সৎ কিনা? দ্বিতীয়ত তিনি দক্ষ কিনা? উভয় প্রশ্নের জবাবেই উত্তর এলো লোকটি সৎ ও দক্ষ। রাষ্ট্রপতি জিয়া তার পদোন্নতি নিশ্চিত করলেন। কানপড়ায় কোনো কাজ হল না। জনগণ এ ধরনের রাষ্ট্রনায়কই চায়। পরবর্তীকালে এ ব্যক্তি আওয়ামী লীগের এক সরকারের আমলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। অযোগ্য ও অসৎ লোকদের নিয়ে দেশ চালাতে গেলে সমূহ বিপদ হয়। তাই সুশাসনের প্রেসক্রিপশন বহুমুখী হতে পারে। আপাতত সবকিছু ঠিক করে ফেলার উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য গ্রহণ না করে নির্বাচিত এবং অগ্রাধিকারমূলক লক্ষ্যই গ্রহণ করতে হবে। ব্র্যাকের অনুষ্ঠানে দুজন বুদ্ধিজীবী দুটি চমৎকার কথা বলেছেন। প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেছেন, কুশাসন অব্যাহত থাকতে পারছে কারণ, কুশাসন লাভজনক। আমি তার বক্তব্যটিকে ঈষৎ সংশোধিত করে বলব, কুশাসন তার অংশীদারদের জন্য লাভজনক এবং ক্ষমতার দিক থেকে তারা প্রতাপশালী। ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে, জনসংখ্যার একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। অনেকে অল্প সময়ের মধ্যে বিত্তশালীও হয়েছে। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যারা ওপরের সিঁড়িতে উঠেছেন, সেখান থেকে তারা যে কোনো সময়ে পা পিছলে পড়ে যেতে পারে, তারা এ আশংকায় থাকেন। এজন্য তারা শাসক দলের সঙ্গে মন যুগিয়ে চলে। এ মানসিকতা ব্যাপক হওয়ার ফলে পরিবর্তনের জন্য তেমন কোনো বড় আন্দোলন গড়ে উঠছে না। স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই তাদের কৌশল। এ থেকে আমরা যে উপসংহারে উপনীত হতে পারি তা হল, ষাটের দশকের পুনরাবৃত্তি ঘটা খুব নিকট নয়। তবে দেশে যেভাবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দুর্ভিক্ষ চলছে তা থেকে অনুমান করা যায়, যারা ওপরের সিঁড়িতে উঠেছেন তারাও হয়তো বিনিয়োগহীনতার আঁচ অনুভব করতে শুরু করবেন। উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময়ে কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলন হয় না। কিন্তু অর্থনৈতিক অধোগতির সময়ে উন্নত দেশগুলোর রাজপথ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়ে ওঠে। যেমন, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট কিংবা নাইনটি নাইন এগেইনসট ওয়ান মুভমেন্ট। গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালে এর চেয়েও তীব্র গণবিক্ষোভ হয়েছে। ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।
ব্র্যাকের গভর্নেন্স রিপোর্টে একটি চমৎকার রাজনৈতিক পরিভাষা স্থান পেয়েছে। পরিভাষাটি হল Partyarchy বাংলায়-এর অর্থ হল দলতন্ত্র। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে This attempt by the political parties to capture state and non-state institution has been termed as partyarchy. It is a political phenomenon whereby Ôpolitical parties monopolies the formal political process and politicise society along party lines' (coppedge 1994) কোপেজের এ গ্রন্থটির নাম হল Strong Parties And Lame Ducks: Presidential Partyarchy And Factionalism in Venezuela.পার্টিআরকির কারণেই বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হতে চলেছে। ব্র্যাকের এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংসদে রাজনীতিকদের অবস্থা, অংশীমূলক গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন সম্পর্কে বিশ্লেষণ এবং পরিসংখ্যান, চার্ট এবং বহুবিধ মানচিত্র স্থান পেয়েছে। একাডেমিক বিবেচনায় রিপোর্টটি খুবই সমৃদ্ধ। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে রিপোর্টটি অনেকেরই দৃষ্টি কাড়বে বলে আশা করা যায়। এর সমালোচনাও হতে পারে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এরকম একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত হলেই আমরা আশা করব সেই সরকার বাংলাদেশে সুশাসনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার কাজে ব্রতী হবে। সেই কাজগুলো এ রিপোর্টে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই দিক থেকে রিপোর্টটি মূল্যবান।
জেরেমি বেনথাম একটি সুসমাজ সম্পর্কে বলেছিলেন, Greatest good of the greatest number- আমরা যদি সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই তাহলে আমজনতারও মঙ্গলের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments